শিক্ষা বিষয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কাকে বলবো, কোথায় বলবো বুঝতে পারছিলাম না। প্রথমে ভেবেছিলাম প্রেস কনফারেন্স করবো। সেজন্য ইঞ্জিনিয়ার হারুন ভাই, ডা. মাহফুজ ভাই’র সঙ্গে কথা বলাই সমীচীন। কিন্তু তাঁরা আমার মুরুব্বি-স্থানীয় এবং ইদানিং তাঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে আসায় মনে দ্বিধা এসে গেল। তাই আর তাদেরকে বিরক্ত করলাম না। অগত্যা বহদ্দারহাটের বহদ্দারবাড়ির গৌরবময় ঐতিহ্য বর্তমান সময়ে যিনি বহন করে চলেছেন, সেই বন্ধুস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরীর স্মরণাপন্ন হলাম। আমি অসুস্থ এবং কর্মহীনতা থেকে উদ্ভূত আর্থিক অনটনে পতিত না হলে একাই কাজটা করে ফেলতে পারতাম। কারো প্রয়োজন ছিলো না। প্রেস কনফারেন্স তো তুচ্ছ, চট্টগ্রামে গত তিন দশকের মধ্যে বড় বড় যত কাজ হয়েছে, তার সবকিছুর পেছনে তো আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কই সক্রিয় ছিলো।
যাই হোক, রেজাউল ভাই সক্রিয় রাজনীতি করেন। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক। ফলে মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির ভাই অসুস্থ হয়ে কিংবা বিদেশ সফরের কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার সঁপে দেন রেজাউল ভাই’র কাঁধে। হয়তো পোর্টফোলিওর কারণে প্রতিদিন রাজনীতি তাঁর অনেকটা সময় নিংড়ে নেয়, যে কারণে অপরাপর কর্তব্য তিনি ইচ্ছে থাকলেও করে উঠতে পারেন না। কিন্তু সেজন্য তাঁর সহৃদয়তা ও আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে।
তাহলে কথাটা বলি। যাঁর উদ্দেশ্যে বলা তিনি শুনবেন কিনা জানিনা। তিনি পূর্বদেশ পড়েন কিনা তাও জানিনা। তিনি আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আমি জানি তিনি পূর্ণমন্ত্রী নন। কিন্তু মন্ত্রী যিনি, সাংবাদিক-কন্যা ডা. দীপুমনিকে আমার কথা শোনাবার সুযোগ কোথায়। নওফেল সাহেব আমাদের ঘরের মানুষ, চাটগাঁর সুসন্তান, তাঁর ওপর কিছু আবদার তো আমাদের রয়েছেই। তাছাড়া তিনি আমাদের মহিউদ্দিন ভাই’র কৃতীপুত্র। মহিউদ্দিন ভাই আমাদের কথা শুনতেন, সম্ভব হলে রাখতেনও। মহিউদ্দিন ভাই ব্যক্তিগতভাবে আমার নেতা, পাক আমলে যখন ছাত্র রাজনীতি করতাম তখনকার নেতা। স্বাধীনতার পরে দু’তিন বছর ‘জুদা’ হয়ে জাসদ-বাসদ করলেও তাঁকে সব সময় মান্য করেই চলেছি। আশির দশকে যখন আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম, তখন আবার সেই তিনিই তো নেতা। সাংবাদিকতা করতে গেলাম, সেখানেও তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করলেন পূর্বকোণকে দাঁড় করাতে। ৯৪-তে যখন তিনি মেয়র পদে নির্বাচন করতে প্রার্থী হলেন, তখন ইউসুফ ভাই (ড. আবু ইউসুফ), মান্নান ভাই (অধ্যাপক আবদুল মান্নান), রঘু বাবুদের সঙ্গে মহিউদ্দিন ভাইকে বিজয়ী করতে কত কাজই না করলাম। জিতেও ছিলেন তিনি। তারপর মেযর হয়ে তিনি শহরের তদারকি, উন্নযন ও পরিচালনায় নতুন যুগের সূচনা করলেন। আমার কথায় চেরাগীর পাহাড়ে দ্বি-সহ¯্রাব্দে মিলেনিয়াম উৎসব উদযাপন করলেন। গান গাইলেন ‘চট্টগ্রামের কোকিল’ শেফালী ঘোষ।
আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারিকে যেবার ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করলো, সেই সংবাদ চট্টগ্রামে এসে পৌঁছার পর আমি মহিউদ্দিন ভাইকে বলেছিলাম বাঙালির এই অর্জনকে চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে উদযাপনের জন্য আপনি সিটি কর্পোরেশন থেকে উদ্যোগ নিন। তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তিনি নিজে চেয়ারম্যান হয়ে আমাকে মহাসচিব করে ‘চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন কমিটি’ গঠন করলেন। অনেক ঘটা করে মাতৃভাষা দিবসের গৌরব আমরা শিরে ধারণ করলাম।
আমরা মুসলিম হলের সামনে বইমেলা করতাম ‘একুশ মেলা’ নাম দিয়ে। তিনি সেই মেলাকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। কবি শামসুর রাহমান মেলায় এসে শাল হারিয়ে ফেললে মহিউদ্দিন ভাই কবিকে আরেকটা শাল কিনে দিয়েছিলেন। কবি ত্রিদিব দস্তিদারও তখন ছিলেন।
তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সংবাদপত্রÑপ্রেমিক ছিলেন। আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে তিনি একুশ মেলার দায়িত্বই নিয়ে ফেলেছিলেন। কমিটি করলেন-তিনি চেয়ারম্যান আমি মহাসচিব। আমরা মেলা করতাম এক জায়গায়-মুসলিম হলের সম্মুখে-তিনি করলেন তিন জায়গায়-লালদিঘি, মুসলিম হল প্রাঙ্গণ এবং মিউনিসিপিাল হাইস্কুলের মাঠে।
স্বাধীনতার পর অনেকে যখন গুদাম ভাঙা আর অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া অফিস-দোকান, মিল-কারখানা দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিলেন, মহিউদ্দিন ভাই তখন প্রকাশ করলেন ‘আন্দোলন’ নামে একটি পত্রিকা। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সহযোগী হলেন, গল্পকার হেনা ইসলাম, কবি স্বপন দত্ত, লেখক প্রদীপ খাস্তগীর সহ আরো অনেকেই।
পুত্রের লেখায় পিতার এত কথার অবতারণার একটাই উদ্দেশ্য যে, তাঁকে বুঝানো যে তাঁর পিতা কত বড় নেতা ছিলেন। পাকিস্তানের একুশ বছরকে (১৯৫০-১৯৭১) যদি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের আজিজ-জহুর যুগ ধরি আর বাংলাদেশের প্রথম সাড়ে তিন বছর জহুর-হান্নান-মান্নান যুগ ধরি, তাহলে বাংলাদেশের নব্বই থেকে আড়াই দশককে (১৯৯০-২০১৫) মহিউদ্দিন যুগ ধরতে হয়। ব্যাপকার্থে স্বাধীনতা পূর্বকালে আজিজ-জহুরের পরে স্বাধীনতা-উত্তরকালে মহিউদ্দিনই একমাত্র রাজনীতিক, সিংহপুরুষের মতো যার আবির্ভাব ঘটেছিলো চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। এখন সিংহ নাই, সিংহের গর্জনও আর শোনা যায় না। কিন্তু চট্টগ্রামের সমস্যার তো অন্ত নেই।
কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলের মানুষের অনেক দিনের সাধনার পর একজন নেতার আবির্ভাব ঘটে; যেমন চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনে সৃষ্ট ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্ব যা’ পাকিস্তান-উত্তর কালে চট্টগ্রামের জন্য একটি ‘গজব’ হিসেবে ‘নাজিল’ হয়েছিলো; তার সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ট নেতৃত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চট্টগ্রামবাসীকে গোটা পঞ্চাশের দশকে সাধনা করতে হয়েছে। যার ফল স্বরূপ চট্টগ্রামের মানুষ পেয়েছিলো তীক্ষ্ম ধার দুটি জোড়া ফলার মতো এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর যুগ্ম নেতৃত্ব। আজিজ-জহুর ছিলেন এক বৃন্তে দুটি ফুল-বৃন্ত আওয়ামী লীগ, ফুল বা ফল আজিজ-জহুর। আর স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যখন জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ হান্নান পরলোকগমন করলেন, তারপর থেকে চট্টগ্রামবাসীর প্রতীক্ষার প্রহর গোণা শোনা শুরু হলো, কখন আর একজন নেতা এসে শূন্যতা পূরণ করবেন। আশির দশক থেকে সেই নেতার আবির্ভাবের লক্ষণ পরিস্ফুট হতে থাকে এবং একদিন রাত্রির তপস্যার অবসান হয় ভোরের সূর্যোদয়েÑ সেই সূর্য ছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
মহিউদ্দিনÑতনয় ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে একদিন সেনা কল্যাণ ট্রাস্টের চিটাগাং কনভেনশন সেন্টারে চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী আবুল কালাম আজাদের মেয়ের বিয়েতে পেয়ে আমি একটি অনুরোধ করেছিলাম। সেটি হলো মহিউদ্দিন ভাই’র ওপর একটি স্মারণগ্রন্থ প্রকাশের জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, আপনার পিতার মৃত্যু চট্টগ্রামের জন্য একটি হৃদয় বিদারক দুঃসংবাদ। চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ে তা’ এত মর্মান্তিক আঘাত হেনেছে যে, তারা শোকে, দুঃখে, কান্নায় ভেঙে পড়েছে। আরো দুঃখের ঘটনা হলো আপনার পিতার ওপর কোন স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হলো না। ভবিষ্যতেও প্রকাশিত হবে কিনা আমি সন্দিহান। কারণ কোন উদ্যোগ আমি দেখছিনা। আপনি অন্তত একটা উদ্যোগ নিন। আমার অনেক লেখা আছে, সেগুলি দেব এবং লেখা সংগ্রহে আপনাকে সাহায্যও করবো। আমি বলেছিলাম, অনেক ছোটখাট নেতার নামেও স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু মহিউদ্দিন চৌধুরী, যাঁর মতো এত বড় নেতা গত চল্লিশ বছরে চট্টগ্রাম পায়নি, তাঁর নামে কোন স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হবে না, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে শহরে এখনো কোন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণ হয়নি।
আবুল কালাম আজাদ, মহিউদ্দিন ভাইয়ের জামাতা এবং বিয়েটা ছিলো তাঁর কন্যার। অর্থাৎ নওফেল সাহেবের ভগ্নির।
এরপর অনেক দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু নওফেল সাহেব কোন উদ্যোগ নেন নি। তিনি আমার মোবাইল নম্বর তাঁর মুঠোফোনে সেভ করেছিলেন। কিন্তু তিনিও আমাকে কোন ফোন করেন নি, আমিও করিনি।
এখন যে কথাটা বলতে চাচ্ছি, সেটি নওফেল সাহেবের মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারাধীন বিষয়। বিষয়টি হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বস্তরে জাতির জনকের জীবনী পাঠ্য তালিকাভুক্তি। নাহিদ সাহেব এতদিন ছিলেন। তিনি কি করেছেন বলতে পারছিনা। পাঠ্য তালিকাভুক্ত যদি করা হয়ে থাকে তাহলে তো ভালো, না করলে আর বিলম্ব না করে এখনই তালিকাভুক্ত করতে হবে। সবাইকে এটা জানাতেই হবে যে, বঙ্গবন্ধু না হলে বাংলাদেশ হতো না। পাকিস্তানের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু একক নেতা ছিলেন না। অনেক নেতাই ছিলেন তখন-যেমন শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, অলি আহাদ ইত্যাদি। কিন্তু পাকিস্তানের বয়স যত বেড়েছে, রাজনীতি যত বিকশিত হয়েছে, দেখা গেল উল্লেখিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে শুধু একজন নেতার নেতৃত্বেরই উত্থান ঘটছে এবং জনমানসে প্রভাব বিস্তার করছে। তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৬২-তে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে যখন এন.ডি.এফ গঠিত হচ্ছে, তখনো সিনিয়র নেতারা বেঁচে; কিন্তু সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক সাহেবের মৃত্যুর পর পূর্ববঙ্গের (পূর্ব পাকিস্তান) রাজনীতি ক্রমান্বয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। পাকিস্তানের শেখ তিন বছরে-৬৮-৬৯-৭০ এবং ৭১-এর তিন মাসে অন্য সব নেতাকে ছাপিয়ে-ছাড়িয়ে শেখ মুজিব এত উচুতে উপনীত হতে থাকেন যে, তাঁর ধারে কাছেও ছিলেন না পূর্ববঙ্গের কোনো নেতা। তাঁর নেতৃত্ব তখন এভারেস্টের চূড়ায়Ñ তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে গেলেন। অন্য নেতারা ছিলেন, কিন্তু নেতৃত্ব-হারা। যেমন মওলানা ভাসানী, কমরেড মনি সিং, আতাউর রহমান খান, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, কিন্তু বঙ্গবন্ধু’র নেতৃত্বে ভাগ বসানোর অবস্থায় এঁরা কেউ ছিলেন না। কারণ স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁর মত অনমনীয় আর কেউ ছিলেন না। একমাত্র তিনিই বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাঙালির আত্মবিকাশের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশের দশক থেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন এবং সেজন্য নানা উপায় অবলম্বন করেছিলেন। তিনি কখনো আপস করেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন বিকিয়ে বা বিসর্জন দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা বা আত্মস্বার্থ সিদ্ধির কথা কখনো ভাবেননি। তিনি নিজের প্রাণের উপর ঝুঁকি নিয়েছিলেনÑ একবার আগরতলা মামলায়, আরেকবার একাত্তরে। কিন্তু স্বাধীনতার পথ থেকে বিচ্যুত হন নি। পাকিস্তানি জমানায় তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের আগাগোড়া তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে যেখানে অনুসরণ করে একাত্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন, পূর্ববঙ্গের অন্যকোন বাঙালি নেতা স্বাধীনতার উপর স্থির থেকে রাজনীতি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্সে ভাষণ দিচ্ছেন, তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় নি, সেটা হবে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১; কিন্তু সাতই মার্চেই বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশে’ পরিণত করে ফেলেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সরকার তখন আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু অঘোষিত সরকার প্রধান এবং প্রশাসন তাঁর কব্জায়। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের এই ইতিহাস কী পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত আছে? যিনি জনগণমন জয় করে তাদেরকে স্বাধীনতার মন্ত্রগুপ্তি দিয়েছেন, যিনি বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণ করেছেন, স্বাধীনতার জন্য জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা কায়েম করেছে, তাঁর কথা তো জাতির নবপ্রজন্মকে জানাতেই হবে। আর সেজন্য দরকার পাঠ্য বইয়ে তাঁর অসাধারণ গৌরবময় জীবনেতিহাস।
স্কুল, কলেজের পাঠ্য বইয়ে যদি বঙ্গবন্ধু একটি চ্যাপ্টার হিসেবে থাকেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাসে বিভাগে বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ পাঠ্য তালিকাভুক্ত করতে হবে।
‘বঙ্গবন্ধু’র পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকেও পাঠ্য তালিকাভুক্ত করতে হবে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলা হয় না, তাই ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যদি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ চ্যাপ্টার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে ¯œাতক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ’কে আলাদা একটি বিষয় হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি আলাদা বিভাগ খুলতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে পৃথক বিভাগ চালু করতে হবে।
এবার যে বিষয়টির দিকে নওফেল সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, সেটি তাঁর মন্ত্রণায়ের এখতিয়ারাধীন নয়। তবুও তাঁকে জানাচ্ছি, কারণ তিনি আমাদের চট্টগ্রামের মন্ত্রী; তিনি সরকারের কানÑ তাঁর মাধ্যমে সরকারের গোচরীভূত করতে চাই। শুনতে পাই নওফেল সাহেবের মস্তকোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা মাতৃ¯েœহের ছত্রছায়া ধরে আছেন। সুতরাং তাঁকে বললে হয়তো তিনি সুযোগ পেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি পেশ করার চেষ্টা করবেন, এই ভরসা তো করাই যায়।
আমি শুনেছি, আজো য়োরোপ, আমেরিকায় কেউ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধের কোন অভিযোগ আছে কিনা তা’ তদন্ত করে দেখা হয়। হিটলারের নাৎসী বাহিনীর সঙ্গে কোন রকম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ তিনি বা তাঁর পরিবারের কারো ছিলো কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হয়। তেমন যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে পাসপোর্টের আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশে এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি শহীদের রক্তে সিক্ত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে পাসপোর্টর আবেদন নিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে আবেদনকারীর ভূমিকা খতিয়ে দেখা হয় না। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাতে চাই, পাসপোর্টের আবেদনের পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় আবেদনকারী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন কিনা এবং স্বাধীনতা বিরোধিদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সং¯্রব ছিলো কিনা তা’ যাচাই করার বিধান করা হোক। তেমন প্রমাণ পাওয়া গেলে তার আবেদন খারিজ করে দেয়া হোক। স্বাধীনতা বিরোধীদের যদি পাসপোর্ট দেয়া না হতো, তাহলে মওলানা আবুল কালাম আজাদের মতো যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে পারতো না। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বিদেশে পালিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারতো না। শুধু পাসপোর্টের অধিকার বাতিল করা নয়। স্বাধীনতা বিরোধীদের ভোটাধিকারও বাতিল করে দিতে হবে। যারা দেশের স্বাধীনতা চায় নি, স্বাধীনতার অভ্যুদয় ঠেকানোর জন্য পাকিস্তানিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের ভোটাধিকার দিতে পারে না।