চিকিৎসা শাস্ত্রে চট্টগ্রামের অবদান ন্যূন নয়। আলোপ্যাথির আগে আয়ুর্বেদ যুগেও চট্টগ্রামে এমন দু’একজন দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিভাবান চিকিৎসক আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাদেরকে শুধু কবিরাজ, বৈদ্য বা হেকিম পরিচয়ে বিজ্ঞাপিত করলে তাঁদের প্রতিভা ও কৃতিত্বের প্রতি অবিচারই করা হবে; তাঁরা হতেন নিজ নিজ ক্ষেত্রের এক একজন বিশিষ্ট সাধক। তাঁদের ডাক্তারি জ্ঞানের সূক্ষ্মদর্শিতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁরা রোগীকে ভালো করে তুলতেন। এমন ডাক্তারও ছিলেন, যাঁরা শুধু রোগীর নাড়ি টিপে বলে দিতে পারতেন তাঁর কি রোগ হয়েছে। এমন চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে মানুষ বলত অমুক ডাক্তারের হাতযশ আছে। এঁরা রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ে প্রায় শতভাগ সফল হতেন। অন্যান্য ডাক্তার যখন হাল ছেড়ে দিতেন, তখনই তাদের ডাক পড়তো রোগীর বাড়িতে। আর তারা যেন কোন মন্ত্রবলে অবলীলায় রোগীকে সারিয়ে তুলতে পারতেন। এ ধরনের ডাক্তারকে নাকি দেখলেও রোগী ভালো হয়ে যায়। এমনই আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতেন তাঁরা।
এই ডাক্তারদের দেখেই তখন ‘ধন্বন্তরী’ কথাটা চালু হয়েছিলো। একটা দেশ বা কোনো বিশেষ অঞ্চলে একশো বছরে এমন ‘ধন্বন্তবী’ ডাক্তার দু’চারজনের দেখা পাওয়া গেলে সৌভাগ্যইে বলতে হবে। কিন্তু উনিশ শতকে চট্টগ্রামে প্রায় একই সঙ্গে এমন তিন তিনজন ধন্বন্তরী ডাক্তারের আবির্ভাব কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো সেটাই পরমাশ্চর্যের বিষয়। দু’জনের জন্ম তো একই গ্রামে। সে গ্রামের নাম সুচক্রদ-ী, যেখানে ডাক্তার অন্নদাচরণ খাস্তগির ও ষষ্টীচরণ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ডাক্তার খাস্তগির মূলত ছিলেন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক, তবে বিদ্যাসাগরের অনুরোধে হোমিওপ্যাথিও চর্চা করেছেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি প্রবাদতুল্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ষষ্ঠীচরণ মজুমদার আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ভারতজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি কাশ্মীরের মহারাজের চিকিৎসক ছিলেন।
উনিশ শতকে আরেকজন কিংবদন্তী চিকিৎসক ছিলেন, তাঁর নাম নীলকমল কবিরাজ। তাঁর সময়ে তাঁকেই চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক মানা হতো।
প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়লো কলকাতার দু’জন ধন্বন্তরী চিকিৎসকের নামÑতাঁদের একজন হলেন স্যার নীলরতন সরকার, অপরজন ডা. বিধান চন্দ্র রায়। বিধান রায় দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। শুনেছি বিধান রায় মানুষের হাঁটাচলা, কথাবার্তা শুনে রোগ ধরে ফেলতেন। একবার তাঁর বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে তিনি নিচে রাস্তার ফুটপাতে চলাচলকারী পথচারীদের দেখছিলেন। তাঁর সঙ্গে আরো দু’একজন ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ একজন লোককে হেঁটে যেতে বিধান রায় নাকি বলেছিলেনÑআহা, এই লোকটা বাঁচবে না। একদিন বা দু’দিন পর ঠিকই লোকটির মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়।
বিশ শতকে আমাদের বাংলাদেশে আর একজন ধন্বন্তরী চিকিৎসকের দেখা মেলে। তিনি হলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম। তিনি নাকি খুব কম ওষুধ দিতেন এবং তাতেই মানুষ ভালো হয়ে যেত। শুনেছি একবার একজন রোগী তাঁর কাছে গেলে তিনি নাকি তাঁকে শুধু পান্তা ভাত খেতে বলেছিলেন এবং তা’ খেয়ে লোকটির রোগের উপমশ হয়। এমনি আরো দু’তিনজন রোগীর মধ্যে কাউকে তিনি বলেছেন একটি এসপিরিন, কাউকে শুধু প্যারাসিটামল খেতে বলেছেন। বলা বাহুল্য, তারা তা’ খেয়ে ভালো হয়ে যান।
এই ধারারই অধুনাতন একজন ধন্বন্তরী চিকিৎসক ডা. রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত; এটা তাঁর পারিবারিক নাম। কিন্তু বিদেশিদের কাছে রামপ্রসাদ হয়ে গেলেন রবীন সেনগুপ্ত। সে নামেই তাঁকে চেনেন য়োরোপ, আমেরিকায় তাঁর চেনাজানা মানুষেরা। রবীন সেনগুপ্ত এমনই একজন আধুনিক ধন্বন্তরী চিকিৎসক, নিউরোসার্জারির জগতে যাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিউরোসায়েন্টিস্ট হিসেবে মানা হয়। ভুবনজোড়া তাঁর আসন। তিনি থাকেন ব্রিটেনেই, ব্রিটিশ নাগরিক তিনি। কিন্তু নিউরো সার্জারিতে তাঁর অসাধারণ অধিকার ও অপারেশনে কৃতিত্বপূর্ণ ব্যাপক সাফল্যের খবর চাউর হয়ে যাবার পর য়োরোপ ছাড়াও এখন এশিয়া ও আমেরিকা থেকেও তাঁর ডাক পড়ছে এবং তিন মহাদেশে দৌড়ঝাপ করেই তাঁর বছর কেটে যায়। কারণ, নিউরো সার্জারিতে তিনি অথরিটির পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার বা ও বি ই উপাধিতে ভূষিত করেছে।
বিশ্ববিখ্যাত নিউরোসায়েন্টিস্ট, চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ড. রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও বি ই দীর্ঘ ৬৪ বছর পর আজ মাতৃভূমি চট্টগ্রাম পরিদর্শনে আসছেন। হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েন্ট পাস করার পর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য তিনি কলকাতা যান। সেখান থেকে অধিকতর উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৬১ সালে বিলেতে যান।
ইন্টার্নশিপ শেষ করেননি, হাতে খুব অল্পই টাকাপয়সা। লন্ডনে যাওয়ার পর মাসখানেক এখানে ওখানে ঘুরলেন। খুব একটা সুবিধে করতে পারলেন না। শেষে ম্যানচেস্টারের বেরি জেনারেল হাসপাতালে একটা চাকরি পেলেন। একবছর পরে পেলেন ডাক্তার হিসেবে নিবন্ধন। এরপর বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে শেষে নিউরোসার্জাারি বিভাগেই থিতু হলেন ড. রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত।
চিকিৎসা শাস্ত্রের এই বিভাগটা দারুণভাবে আকর্ষণ করল তাকে। নিউরোসার্জনদের কাজ, রোগীদের জীবন-মরণ লড়াই, তাদের সুস্থ করে তোলার জন্যে চিকিৎসকদের আকুলতা–সবকিছুতেই একটা চ্যালেঞ্জিং অনুপ্রেরণা খুঁজে পেলেন। মানব শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ অংশটার চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেলেন।
কিন্তু যত সহজে চাওয়া যায়, পাওয়াটা তত সহজে হয় না। এ জন্যে লাগে সুষ্ঠু পরিকল্পনা, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ঐকান্তিকতা। ড. সেনগুপ্ত এই তিনটি জিনিসকে কাজে লাগালেন। চরম কঠিন সে দিনগুলোতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন তিনি। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কাজে লেগে থাকতেন। কারণ ততদিনে সংসারে বাড়তি মুখ এসেছে। ছেলে এবং মেয়ে। তাদের ভরণপোষণও তো বাবাকেই করতে হবে। প্রতিটি পাই-পয়সা পর্যন্ত হিসেব করে খরচ করতেন। স্ত্রী-সন্তানকে ততদিনে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন।
১৯৭১ সালে এডিনবরা থেকে এফআরসিএস পাস করলেন ড. সেনগুপ্ত। এসময় তার স্ত্রী ভারতে ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। ড. সেনগুপ্ত নিজেও চাইছিলেন পেশাগত ক্যারিয়ারটা ভারতেই গড়ে তুলবেন। কিন্তু ভারতের কোথাও সুযোগ পাচ্ছিলেন না। যাহোক দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ১৯৭৩ সালে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে চাকরি পেলেন। তবে সেখানে কেবল মাথার ইনজুরি ছাড়া আর কোনো ধরনের চিকিৎসার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ড. সেনগুপ্ত চাইছিলেন আরো সূক্ষ্ম ও বড় ধরনের কাজ করতে। কারণ এর আগে এর চেয়ে বড় কাজও তিনি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলেন, ভারতে এর চেয়ে বড় কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি ফের ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। জানেন, কঠিন পরিশ্রম করে তাকে ওখানেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
কিন্তু সময়টা গত শতকের সত্তরের দশক। একজন ভারতীয় ডাক্তারের পক্ষে ইংল্যান্ডের স্থানীয় চিকিৎসকদের ভীড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাটা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। কিন্তু নিজের যোগ্যতা ও ঐকান্তিক ইচ্ছার ফল পেলেন ড. সেনগুপ্ত। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত নিউরোসার্জন ড. উইলিয়াম সুইটের কাছ থেকে ডাক পেলেন। মেস জেনারেল হাসপাতালে তার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলেন। কিন্তু কাজটাকে উপভোগ করতে পারছিলেন না ড. সেনগুপ্ত। শেষে নিউ ক্যাসলের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে যোগ দিলেন।
২০০২ সালে ৬৫ বছর বয়সে নিউক্যাসল হাসপাতাল থেকে অবসর নেন ড. সেনগুপ্ত। নিউক্যাসল হাসপাতাল তাদের অপারেশন থিয়েটারের নাম রাখে তার নামানুসারে ‘রবিন সেনগুপ্ত থিয়েটার’। এর মানে হলো সরকারী চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এরপরও তাকে চেয়েছিল। তাই শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে তিনি চূড়ান্তভাবে অবসর নেন।
শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে পেযেছেন অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার। ১৯৫৩ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে পাস করলেন। মেডিক্যাল ফর প্রফিসিয়েন্সি ইন বায়োকেমিস্ট্রি সম্মাননা পেলেন ১৯৫৭ সালে, ১৯৫৮ সালে সার্টিফিকেট অভ অনার্স ইন সার্জারি পেলেন। পেশাগত জীবনে ১৯৭৩ সালে পান ডেভিড ডিকসন গবেষণা পুরস্কার। এসবিএনএস ১৯৭৪ সালে তাকে কেইমস মেমোরিয়াল ট্রাভেলিং স্কলারশিপে ভূষিত করে। ডিসটিংশন অ্যাওয়ার্ড পেলেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯২ সালে পান এ মেরিট। ১৯৯৯ সালে ডাচ নিউরোসার্জিক্যাল সোসাইটি থেকে পান বেক পদক। ২০০০ সালে নিউরোসার্জিক্যাল সোসাইটি অভ ইন্ডিয়া তাঁকে নিউরোসার্জন অভ দ্য মিলেনিয়াম পদকে ভূষিত করে।
পেশাগত ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে যেমন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে ড. সেনগুপ্তের, তেমনি তার দাতব্য কর্মকা-ের ভা-ারও বিশাল। জন্ম বাংলাদেশে হলেও বর্তমানে তিনি ভারতেরও নাগরিক। ভারতে নিউরোসার্জারি চিকিৎসাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। নিজের টাকায় কলকাতায় গড়ে তুলেছেন নিউরোসায়েন্স সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি পূর্ব ভারতের ৩০ কোটি মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে। স্ত্রী এবং নিজের সঞ্চয় থেকে আড়াই লাখ পাউন্ড খরচ করেছেন। এই দাতব্য প্রতিষ্ঠানটির বড় পৃষ্ঠপোষক হলেন ডাচেস এলিজাবেথ অভ নর্দাম্বারল্যান্ড। মূল প্রতিষ্ঠানটি হলো নিউরোসায়েন্স ফাউন্ডেশন।