৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধে পটিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি বড় ধরণের অপারেশন করেন জিরি মাদ্রাসায়। উক্ত মাদ্রাসা ছিলো মুজাহিদ বাহিনীর ঘাঁটি এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজাকার ও মুজাহিদদের পটিয়ার বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হতো। তারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ও তৎপরতা সম্পর্কে গোপনে সংবাদ সংগ্রহ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে সরবরাহ করতো এবং বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চৌকিতে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর যেখানে সংষর্ষ হয়েছে, সেখানে মুজাহিদরাও তাদের পশ্চাৎবর্তী বাহিনী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে।
৭১ -এর ১৭ আগস্ট মুক্তিবাহিনী জিরি মাদ্রাসায় অপারেশন পরিচালনা করেন। এই অপারেশনে তারা মুজাহিদ বাহিনীর কাছ থেকে ২২টি রাইফেল ও ৬ বাক্স গুলি হস্তগত করেন। যেসময় এই অস্ত্রগুলি পাওয়া যায়, সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তেমন অস্ত্রশস্ত্র ছিলো না। অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একমাত্র ক্ষয়ক্ষতি হলো মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরতর আহত হন। অপারেশনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সেটি ছিলো ৬টি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের একটি সম্মিলিত অপারেশন। যে সমস্ত গ্রুপ জিরি মাদ্রাসা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলো, সেগুলি হলো-ক্যাপ্টেন করিম গ্রুপ, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম গ্রুপ, শামসুদ্দিন গ্রুপ, মহসিন খান গ্রুপ, শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ, আহমদ নবী গ্রুপ।
পূর্বকথা : জিরি মাদ্রাসা অপারেশনে আহত ইউসুফ চৌধুরীর বাড়ি পটিয়া থানার মনসা গ্রামে। তিনি ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে আসার পর তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁর মাকে দেখতে। সেসময় একদিন জিরি মাদ্রাসায় পড়ুয়া বেশ কিছু ছাত্র রাজাকারের ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র নিয়ে পটিয়া থেকে জিরি যাচ্ছিলো ইউসুফের বাড়ির সামনে দিয়ে। ইউসুফ তখন পুকুর পাড়ে বসা। তাদেরকে অস্ত্র নিয়ে যেতে দেখে এই অস্ত্রগুলি কিভাবে কেড়ে নেয়া যায় তাঁকে সেই চিন্তা পেয়ে বসলো। কারণ তাদের তখন অস্ত্রের প্রয়োজন ছিলো। ওরা চলে যাওযার সঙ্গে সঙ্গে ইউসুফ স্বগ্রামনিবাসী মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং এই অস্ত্রগুলি দখল করা যায় কিনা তাকে চিন্তা করতে বলেন। সালাম ইউসুফকে বললেন, মাথা গরম করবি না। মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করতে হবে অপারেশনের কথা। সালাম খুব ধীর স্থির, শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। যোগাযোগের জন্য তিনি এক নম্বর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বিনিনেহারা গ্রামে গিয়ে ডা. শামসুর সেল্টারে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন করিমের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁকে উক্ত অস্ত্রের কথা বলেন। ক্যাপ্টেন করিম বললেন আমরা অবশ্যই এই অস্ত্রগুলি তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবো। সেজন্য আমরা জিরি মাদ্রাসা অপারেশনে করবো।
বেশ কয়েকদিন রেকি করার পর ১৭ আগস্ট জিরি মাদ্রাসা আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ক্যাপ্টেন করিম যে পরিকল্পনা করলেন তা’ ছিলো এরকম মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ছদ্মবেশে মাদ্রাসার পাশে কাজীর হাটে যাবেন। যেদিন বাজার বসে সেদিনই অপারেশন হবে। মুক্তিযোদ্ধারা হাটুরে হিসেবে থলে, লাই ইত্যাদি নিয়ে যাবে এবং তার ভিতরে করে অস্ত্র নিয়ে যাবে। মাগরিবের আজানের সময় আক্রমণ করা হবে।
অপারেশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী অপারেশনে অংশগ্রহণের জন্য ডাক পাওয়া ১৫/২০জন মুক্তিযোদ্ধারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হবেন— এক গ্রুপ কাজীর হাটের বাইরে ধান ক্ষেতে অ্যামবুশ নেবে; আরেক গ্রুপ আক্রমণে থাকবে। তিনটি গ্রুপে ভাগে করে তিন দিকে অবস্থান গ্রহণ করতে বলা হয়। জিরি মাদ্রাসা পুকুরের উত্তর পাশে বড়বাজার, সেখানে অবস্থান নেন ক্যাপ্টেন করিম, আ.হ.ম নাসিরউদ্দিন, প্রদ্যোৎপাল দুলাল, হাবিলদার গোলাপুর রহমান, ওবায়েদ, সোলায়মান, রুহুল আমিন, নায়েক আজিজ, ইউসুফ (মনসা)। এই গ্রুপটি ছিলো অ্যাসল্ট গ্রুপ। কাজির হাটের গ্রুপে ছিলেন, সামশুদ্দিন আহমদ, কামাল, এম এন ইসলাম, বদিউজ্জমাল, আহমদ নবী, হাবিবুর রহমান (বরকল), আবু তৈয়ব (সাবেক চেয়ারম্যান, টি কে গ্রুপ, বর্তমানে প্রয়াত), আবু তাহের।
তারা কিছু অস্ত্র মুরগির খাঁচায় ভরে ওপরে মুরগি, নীচে অস্ত্র রেখে আগেই মাদ্রাসার পূর্বদিকে মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিনের বাড়িতে রেখেছিলেন। এভাবেই অস্ত্র নিয়ে আরেক গ্রুপে কাজীর হাটের বাইরে অবস্থান নেয়। অ্যাসল্ট গ্রুপ আসরের নামাজের কিছুক্ষণ পূর্বে বাঁশঝাড়ের পূর্বদিকে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন করিম ও আ হ ম নাসিরের কাছে ছিলো ২টি রিভলভার, দুলালের কাছে ১টি এসএমজি।
আজানের সঙ্গে সঙ্গে অধ্যক্ষ বদনা নিয়ে ওজু করার জন্য পুকুরঘাটে আসেন। পূর্বদিকে ২ জন রাইফেলধারী সেন্ট্রি ছিলো। অধ্যক্ষ ওজু করার প্রস্তুতি গ্রহণকালে বাঁশঝাড়ের লুকানো স্থান থেকে ক্যাপ্টেন করিম, আ.হ.ম নাসিরুদ্দিন, দুলাল দৌড়ে যেয়ে অধ্যক্ষকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় সেন্ট্রি গুলি করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলে অধ্যক্ষ হাত তুলে নিষেধ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্টেন থেকে এক ম্যাগাজিন গুলিবর্ষণ করেন। ফায়ারের পর চারিদিক থেকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা বিস্ফোরক এবং বরকলের শাহজাহান ইসলামাবাদীর কাছ থেকে আনা দুটি জি-৩ রাইফেলের ফাঁকা গুলির আওয়াজ করে তাদের ভীতি প্রদর্শন করেন। অ্যাসল্ট গ্রুপ কড়া পাহারায় পুকুরঘাট থেকে পূর্বদিকের গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকেন। ক্যাপ্টেন করিম অধ্যক্ষকে বলেন, আপনাকে মেরে ফেলা হবে। এখানে রাজাকার ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। এরা ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে বাইরে নারী ধর্ষণ, লুটপাটসহ বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। আপনি মৃত্যু থেকে রেহাই পেতে পারেন, সেজন্য আগামীকাল থেকে রাজাকার ট্রেনিং বন্ধ করতে হবে। যদি বন্ধ না করেন তাহলে আবার আক্রমণ করা হবে। আপনার কাছে যত রাইফেল, গুলি আছে, এখনি আমাদের কাছে সারেন্ডার করতে হবে। অধ্যক্ষ কথা মত অস্ত্র, গুলি জড়ো করে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেন। ২২টি রাইফেল ও ছয় পেটি গুলি উদ্ধার করা হয়। রাইফেলগুলি পরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। তাঁকে হুলাইন গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আহমদ নবী কাঁধে করে বুধপুরা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেই হাসপাতালে ডা. শামসু এবং ডা. নৃপেন্দ্র লাল রায় অপারেশন করে তাঁর হাত ও পা থেকে গুলি বের করেন। অপারেশনের পর নিরাপত্তার জন্য তাঁকে কর্ত্তালা গ্রামের মাস্টার দীপক বড়ুয়ার বাড়িতে রাখা হয়। এই সেল্টারটির ব্যবস্থা করেছিলেন আহমদ শরীফ মনীর। তাঁকে সার্বক্ষণিক প্রহরা দেয়ার জন্য গোরণখাইন আনসার কমান্ডার মুন্সি মিয়াকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ৮দিন পর কিছুটা চলাফেরার উপর্যুক্ত হলে তাঁকে কর্ত্তালা থেকে শহরে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহজাহান ইসলামাবাদীর ছোট ভাই বদরুল আজাদ ইসলামাবাদীর মোমিন রোডের বাসায় ছিলেন। ইউসুফ চৌধুরী পরে বিদেশে চলে যান। তিনি জার্মানি ও আমেরিকায় পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকার বস্টন অঙ্গরাজ্যে সপরিবারে বসবাস করছেন।