ষাটের দশক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অগ্নিগর্ভ সময়। সংগ্রামী ছাত্র সমাজই ওই দশকের নায়ক। বায়ান্নে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতের রক্তস্রোতে সিক্ত বাংলার পালল মৃত্তিকায় যদি বাঙালি চেতনার বীজ বপন হয়, তাহলে ষাটের দশকে মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল, মনু মিয়া, মতিউর, আসাদ, ড. জোহা, সার্জেন্ট জহুরুল হক-দের তাজা খুনে ভেজা মাটির উর্বরতায় সেই বীজ থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চারা গজিয়ে ওঠে এবং একই দশকে বাঙালি জাতিসত্তা বিকশিত হয়ে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় পরিব্যাপ্ত হয়। উনসত্তর থেকে তো ইতিহাস দ্রæত স্বাধীনতার অভিমুখে ধাবিত হয় এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পূর্ণাহূতি দেয়। অতঃপর, বাঙালি জাতির স্বাধীন আবাসভ‚মি ‘বাংলাদেশ’-এর সগৌরবে সমুত্থান। বাষট্টি সালে এদেশের ছাত্রসমাজ জেনারেল আইয়ুবের শিক্ষক মি. শরীফের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে নেমে আসে, ৬২-তেই চট্টগ্রামে একুশে ফেব্রæয়ারি পালন উপলক্ষে মুসলিম হলের সমাবেশ থেকে ¯েøাগান দিয়ে মিছিল সহবগরে রাজপথে বহির্গত হয়ে ছাত্ররা সামরিক আইন ভেঙে ফেলে। সেই যে ছাত্র আন্দোলনের আগুনে বাংলাদেশ জ্বলে উঠেছিলো, সে আগুন আর নেভেনি। ’৬৪’র হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮’র বন্দীমুক্তি ও আগরতলা মামলা বাতিলের আন্দোলনে সে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে; ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে দাবানল হয়ে প্রলয়ংকরী রূপ পরিগ্রহ করে ৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে সে আগুন ছড়িয়ে যায় সারা বাংলায়।
ষাটের দশকে যাঁরা ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ জেনে রাজপথে রক্তের হোলি খেলে আগুন উৎপন্ন করেছিলো, সোনার ফ্রেমে বাঁধানো চট্টগ্রামের সেই অগ্নিঋষিদের নাম কীভাবে যেন বিস্মৃতির পলেস্তরা পড়ে বিবর্ণ হয়ে ধূসর হতে হতে অবশেষে মুছে যাচ্ছে বিস্মৃতিপ্রবণতার জন্য বিখ্যাত বাঙালির স্মৃতি থেকে।
কোথায় হারিয়ে গেল সেসব নামÑকাজী জাফরুল ইসলাম, নূরউল্লাহ, কফিলউদ্দিন, এম এ মান্নান, ফেরদৌস কোরেশী, শহীদ মুরিদুল আলম, আবদুর রউফ খালেদ, পিরজাদা খায়েরউল বশর (ড. রশীদ আল ফারুকী), অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী, হারুনুর রশিদ খান, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, আবু ছালেহ, এএমএম শহীদুল্লাহ, মাহবুবুর আলম তারা, বখতেয়ার কামাল, শায়েস্তা খান (অধ্যক্ষ), সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হারুনুর রশিদ (অধ্যক্ষ), বদরুল কামাল, লোকমানুল মাহমুদ, শামসুল আলম চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ (অ্যাডভোকেট), আনোয়ারুল আজিম (ভোলা), মোখতার আহমদ, মির্জা আবু মনসুর, আশরাফ খানসহ… নুরুন্নবী চৌধুরী, সালাহউদ্দিন জঙ্গী, আবদুল্লাহ আল নোমান, নুরুল আলম চৌধুরী, অধ্যাপক নাজিমুদ্দিন, এসএম ইউসুফ, ইদরিস আলম, আবু তাহের মাসুদ, কাজী আবু জাফর, গোলাম রব্বান, আবু মোহাম্মদ হাশেম (অ্যাডভোকেট), মোহাম্মদ মুসা, শফিকুল মওলা, কাজী সিরাজ, গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সুলতান উল কবির চৌধুরী, মোহাম্মদ ইদ্রিস, হাজি কামাল, মোহাম্মদ ইব্রাহিম (চাকসু’র প্রথম ভিপি), আবদুর রব (শহীদ, চাকসু’র প্রথম জিএস), সাবের আহমদ আসগরী, ড. মাহবুবুল হক, নজরুল ইসলাম চৌধুরী (কক্সবাজার), সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী (শহীদ), একেএম আবু বকর চৌধুরী, আবদুল্লাহ হারুন, সালাহউদ্দিন মাহমুদ, কলিমুল্লাহ চৌধুরী, শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহিম, ডা. মাহফুজুর রহমান, খোরশেদুল ইসলাম, তপন দত্ত, তোফায়েল আহমদ (অধ্যাপক), দানেশ আহমদ চৌধুরী, শাহ্-ই-জাহান চৌধুরী, কাজী ইনামুল হক দানু, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, এম.এ. হাশেম, ইমামুল ইসলাম লতিফি, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ শফিকউদ্দিন, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, ফজলুল হক (অধ্যক্ষ), চৌধুরী আলী রেজা, কমরেড শাহ আলম, মাহবুব মিন্টু, নঈমুদ্দিন চৌধুরী, এবিএম নিজামুল হক, জালালউদ্দিন আহমদ, কাজী মনিরুজ্জামান মন্টু, আনোয়ারুল আজিম আরিফ (অধ্যাপক), বালাগত উল্লাহ, ডা. শামসুদ্দিন, বখতিয়ারুল আলম, জাফর আহমদ, আবু ইউসুফ চৌধুরী (ডা.), নুরুল আলম মন্টু, রবিউল হোসেন কচি, বোরহান উদ্দিন আহমদ, শাহজাহান খান, গোফরানুল হক (ডা.), মোজাম্মেল হক, নুরুল হুদা, আবদুল্লাহ আল হারুন, ফাহিম উদ্দিন, আবদুল আহাদ, ওসমান গণি খান, নাজিমুদ্দিন খান (শহীদ), মাহব্বুুর রহমান (ডিকেন্স), মোছলেম উদ্দিন আহমদ, খালেকুজ্জামান, আবুল কাশেম, আবদুল্লাহ আল রায়হান, ফজলুল করিম, তাজুল ইসলাম, আবদুস শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান, ফাতেমা খায়রুন্নেসা লুসি, রাশেদা খানম, খালেদা খানম, সেলিম খান, শহীদুর রহমান, কামরুল ইসলাম, জাহিদুল করিম কচি, ফালান সাহা, ফখরুল ইসলাম মনি, আবু কামাল বশর, সাথী দাশ, খালেদ নোমান নমি, খোরশেদ আলম, ইফতেখার সেলিম, ফরহাদ হোসেন অলক, গোলাম সামদানী, সুশীল বড়–য়া, মমতাজ বেগম, ওসমান গণি চৌধুরী, আলো মোস্তফা, মৃদুল গুহ, আবুল হাশেম, শফর আলী, সন্তোষ ধর, শফিউল বশর, অমল মিত্র, কাজী সিরাজ (ছাত্রলীগ), তোহা গাজী, শফিউল্লাহ, রাখাল চন্দ্র বণিক, তোফায়েল আহমদ, ইন্দু নন্দন দত্ত, আনোয়ারুল আজিম, কৃষ্ণ প্রসাদ বড়–য়া, চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ, শামসুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আহমদ বি.কম, আহমদ নূর। ষাটের দশকের এই সংগ্রামী ছাত্রনেতারা আমাদের স্মৃতিতে স্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো স্মৃতি থেকেও তাঁরা ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছেন। ষাটের দশকের ছাত্রনেতা বখতিয়ারুল আলমও এ বিস্মৃতির শিকারে পরিণত হয়েছেন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন; কিন্তু তাঁর নাম কোথাও উচ্চারিত হয় না, তাঁর কথা কেউ বলেন না। বখখিতয়াল আলম সিটি কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি শহরেই রাজনীতি করতেন। বয়সে জ্যেষ্ঠ নেতা আশরাফ খান, মৌলভী সৈয়দ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, ইদরিস আলম, আইয়ুব বাঙালি, সুলতান, হাজি কামালদের সমসাময়িক হওয়ায় তাঁর প্রজন্মের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তো রাজনীতি করতেনই, তদুপরি তিনি বয়োকনিষ্ঠ সন্তোষ, শফিউল বশর, অমলদের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে আন্দোলন মুখর সেই সময়টায় রাজনৈতিক কর্মকাÐ পরিচালনা করেছেন। তিনি এমন এক সময়ে শহরের আন্দোলনের দুর্গ হিসেবে খ্যাত সিটি কলেজের ছাত্র সংসদ ও ছাত্রলীগের মুখ্য কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছিলেন, যখন প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলনে দেশ হয়ে উঠেছিলো টালমাটাল। রাজপথে আগুনের ফুলকি ছুটছিলো, মিছিলের দৃপ্ত পদভারে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো শহরের অলি-গলি-রাজপথ। মাঠে ময়দানে অগ্নিবর্ষী বক্তৃতার খৈ ফুটছিলো। বখতিয়ারুল আলম এই ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ আগুনে সময়ের সাহসী ছাত্রনেতা, যিনি বঙ্গবন্ধু’র ৬ দফা, আগরতলা মামলায় গ্রেফতারকৃত বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতৃবন্দের মুক্তির দাবিতে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার ন্যায় ফুটতে থাকা ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সময়ের সাহসী সৈনিক বখতিয়ার অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ যুদ্ধে নির্ভয়ে লড়াই করে অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের শহরের আন্দোলনের দুর্গ হিসেবে খ্যাত লীন হয়ে যান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম ১৯৪২ সালের ৩ মার্চ চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশ থানাধীন বর্তমান ৮নং শুলকবহর ওয়ার্ডের আবদুল মান্নান সওদাগর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল মান্নান সওদাগর তাঁর পিতা, মাতা নছুমা খাতুন। বখতিয়ার আলমের পিতামহ আবদুল গণি সওদাগর; পিতামহী রহিমন বিবি, প্রপিতামহের নাম আমির হোসেন সওদাগর; মাতামহী মাহমুদা খাতুন। বখতিয়ারুল আলমের দুই ভাই, দুই বোন; তিনি ছিলেন সবার ছোট।
বখতিয়ারুল আলম শৈশবে বেশিরভাগ সময় নানা হামদু মিয়া চৌধুরীর সঙ্গেই কাটাতেন। মিয়া তাঁর প্রিয় নাতিকে স্বদেশ ও স্বজাতিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তিনি তাঁকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে স্বাধীনতার লাল গোলাপ ছিনিয়ে আনার বজ্রকঠিন শপথে বলীয়ান হয়ে কঠিন কঠোর সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হবার প্রেরণা জুগিয়েছেন। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার বেদীমূলে নিঃশেষে নিজেকে নিবেদনের জন্য সেই কৈশোরেই বখতিয়ারকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলেন হামদু মিয়া। ফলে পরবর্তীকালে বখতিয়ারুল আলম যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন তাতে তাঁর নানা হামদু মিয়া চৌধুরীর প্রভাব ও অনুপ্রেরণা অনেকখানি কার্যকর ছিল। প্রাইমারি শিক্ষা অর্জনের পর বখতিয়ার কাজেম আলী হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তৎকালীন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে (বর্তমানে সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। উক্ত কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে মানবিক বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৬৮ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম আইন কলেজে ভর্তি হন এবং এল এল বি পাস করেন।
সিটি কলেজে পড়ার সময় থেকেই বখতিয়ার ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি সিটি কলেজে পড়ার সময়ে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন। জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। তিনি যখনই ডাকতেন, যত রাতই হউক মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম তাঁর ডাকে ছুটে যেতেন। কারণ তিনি ছিলেন তাঁর পরম বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন কর্মী। ১৯৬৬ সালে লালদীঘির জনসভা হতে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করেন; বখতিয়ার এই জনসভা আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। বখতিয়ার বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ১৯৬৮ সালে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই সময়ে ছাত্রলীগের নির্বাচনী জোট ‘অভিযাত্রিক’এরও সভাপতি ছিলেন তিনি। সিটি কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী আশরাফ খান, মৌলভী সৈয়দ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর, ইদরিস আলম, নুরুল আফসার বাঁশি, কাজী ইনামুল হক দানু, শেখ মোহাম্মদ আইয়ুব বাঙালি, এসএম কামাল উদ্দিন, বখতিয়ারুল আলম, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ, খালেকুজ্জামান, জাফর আহমদ, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, জাহেদ হোসেন, হারুনুর রশিদ, মোছলেম উদ্দিন আহমদ, সন্তোষ ধর, শফর আলী, অমল মিত্র প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ১৯৭১ সালে ১০ মার্চ বখতিয়ারুল আলমের সভাপতিত্বে সিটি কলেজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন মৌলভী সৈয়দ, ইদ্রিস আলম, সাইফুুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, শফিউল বশর, সমীর সেন, মনির আহমদ। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য কলেজ ছাত্রলীগের শেষ প্রস্তুতি সভা। একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। বখতিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। যেহেতু তিনি চট্টগ্রাম শহরের মানুষ এবং শহরেই এতদিন ছাত্র রাজনীতিক করে এসেছেন, তাই তিনি চট্টগ্রাম শহরকেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য বেছে নেন। ছাত্র রাজনীতি করার সময় তিনি শহর ছাত্রলীগ সভাপতি মৌলভী সৈয়দের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মৌলভী সৈয়দ শহরেই আত্মগোপন করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরকে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনিও বখতিয়ারকে শহরে থেকে যুদ্ধ করতে পরামর্শ দেন। তিনি বখতিয়ারকে পাঁচলাইশ, শুলকবহর, বাকলিয়া এলাকায় কাজ করার দায়িত্ব দেন। তাঁর শুলকবহরস্থ বাড়িকে মুক্তিযোদ্ধাদের সেল্টার হিসেবে তৈরি করার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী বখতিয়ার ঝুঁকি নিয়ে নিজের বাসভবনটিকে মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলেন এবং নিজেই এই সেল্টারের তত্ত¡াবধান করতেন। চাকসু’র প্রথম ভি,পি ইব্রাহিম এই সেল্টারের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখতেন। বখতিয়ারুল আলমও ভি,পি ইব্রাহিম এর বেইজকে সব সময় টাকা পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করতেন। উল্লেখ্য, মৌলভী সৈয়দ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কয়েকমাস চট্টগ্রাম শহরের কমান্ডার এবং পরবর্তী কয়েকমাস ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন।
খাতুনগঞ্জের পোড়াভিটা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে যুদ্ধের একটি চিঠি পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায় ক্যাম্পটি ছিল মৌলভী সৈয়দের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। বখতিয়ারুল আলম চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। শহরের ষোলশহর এবং কদমতলীতে অপারেশনে অংশগ্রহণের কথা তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন গেরিলা কমান্ডার কাজী ইনামুল হক দানু, চাকসু ভি.পি. ইব্রাহিম, কুতুব উদ্দীন চৌধুরী, আবুল বশর, কামাল উদ্দীন, জামাল উদ্দীন, আবু তাহের চৌধুরী প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম আটক হন। স্থানীয় কিছু চিহ্নিত রাজাকার, আল বদরের সহযোগিতায় তাকে আটক করা হয়। তাঁকে আটক করার জন্য কয়েকটি গাড়ি নিয়ে ৫০জন পাঞ্জাবি সৈন্য তাঁর বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন। পাঞ্জাবিদের কিছু স্থানীয় রাজাকার, আলবদরও ছিলে। পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে চোখে কালো কাপড় এবং তাঁর দুই হাতকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায়। প্রথমে তাঁকে তৎকালীন বালতি কোম্পানির মুখে বর্তমানে বাদুরতলা আরাকান হাউজিং সোসাইটির সম্মুখে নিয়ে যাওয়া হয়।
তারপর তাঁকে কদমতলীতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাঁর কাছ থেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে চাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে সার্কিট হাউজের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাঁর উপর শুরু করা হয় অকথ্য নির্যাতন। তাঁকে ৪৮ ঘণ্টা দড়ি দিয়ে উপরে ছাদের বিমের সঙ্গে পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে অত্যাচার করা হয়। রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে তাঁর মুখের উপরের পাটির ছয়টি দাঁত ফেলে দেয়া হয়। হাতের বাহুতে দেয়া দড়ির বাঁধন হাড়ে গিয়ে ঠেকে। এভাবে তাঁর উপর পাঁচদিন পর্যন্ত অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হয়।
এদিকে পাক বাহিনীর হাতে তাঁর আটক হবার খবর শুনে ঘরে তাঁর বাবা-মা বেহুঁশ হয়ে যান। তাঁর ভগ্নিপতি ছিলেন তৎকালীন সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম। তিনি খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে ছুটে আসেন। পাঁচদিন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া না যাওয়ায় তিনিও চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য।
বখতিয়ার মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত ছিলো এটা সবাই জানতেন, তাই বখতিয়ারের কোন বিপদ হলে তিনি যাতে তাঁর শান্তি কমিটির পরিচয় ব্যবহার করে বখতিয়ারকে সাহায্য করতে পারেন, সেজন্য তাঁর আত্মীয়-স্বজনরাই বুদ্ধি করে তাঁর ভগ্নিপতি প্রফেসর আবুল কালামকে আগেই শান্তি কমিটির মেম্বার করে রেখেছিলেন। প্রফেসর কালাম বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে খবর পান যে, বখতিয়ারুল আলমকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের ভিতরে টর্চার সেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং তার উপর চরম অত্যাচার নির্যাতন চলছে। ঐ টর্চার সেল বেলুচি ক্যাপ্টেন মালেক-এর অধীনে ছিল। প্রফেসর আবুল কালাম নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেয়ে সার্কিট হাউজে যান এবং ক্যাপ্টেন মালেক-এর সাথে দেখা করার অনুমতি চান। প্রফেসর আবুল কালাম উর্দু এবং ইংরেজি ভাষাতে সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। তিনি সার্কিট হাউজে ঢুকে দেখলেন ক্যাপ্টেন মালেক চেয়ারে বসা, দুই পাশে সারি সারি মিলিটারি প্রফেসর আবুল কালামের দিকে রাইফেল তাক করে ধরে আছে। মনে হচ্ছিল তখনি বুঝি ওরা গুলি করে দেবে। তিনি ক্যাপ্টেন মালেকের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার পর টিপ সই দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলমকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম নন। বখতিয়ারুল আলমকে যখন তাঁর বাসায় শুলকবহরের আব্দুল মান্নান সওদাগর বাড়িতে তাঁর বাসায় নিয়ে আসা হয় তখন তাঁর জ্ঞান ছিল না। খবর পেয়ে শুলকবহরের অসংখ্য মানুষ তাঁকে দেখতে যান।
মুক্তিযুদ্ধে বখতিয়ারুল আলমের মা নছুবা খাতুনের অবদান উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করতেন। বিশেষ করে মক্তিযোদ্ধারা যখন অপারেশন শেষ করে গভীর রাতে কোনো এক সময়ে আব্দুল মান্নান সওদাগর বাড়িতে আসতেন তখন তিনি নিজ হাতে তাদের রান্নাবান্না করে খাওয়াতেন। এমনকি তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা আসলে ঘুম থেকে জেগেও তাদের রান্নাবান্না করে খাওয়াতেন এবং যতটুকু তার পক্ষে সম্ভব তিনি তা দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতেন। আশেপাশে কোথাও পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যদের আগমন কিংবা রাজাকার আল বদর সদস্যদের উপস্থিতি টের পেলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে লুকিয়ে রাখতেন এবং অন্যত্র পালিয়ে যেতে সাহায্য করতেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম ১৯৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর বিয়ে করেন। কনে রুবি আক্তার, তাঁর বাড়ি ফটিকছড়ি থানাধীন দক্ষিণ ধুমপুরস্থ কানু তালুকদার বাড়ি। পাকহানাদার বাহিনীর চরম নির্যাতনে বখতিয়ারুল আলমের মুখের উপরের পাটির ৬টি দাঁত পড়ে যাওয়ায় বিয়ের সময় আলগা পাটি লাগানো হয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম দীর্ঘদিন যাবৎ দুরারোগ্য রোগে অসুস্থ থাকার পর ২০০০ সালের ৩ এপ্রিল তাঁর হার্টের স্ট্রোক হয়। তাঁকে দ্রæত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে একদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ৫ এপ্রিল ২০০০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলমের পরিবার বর্তমানে ৮নং শুলকবহর ওয়ার্ডের বাদুরতলাস্থ আরাকান হাউজিং সোসাইটি বি বøকে বসবাস করছেন। তাঁর পরিবারে তাঁর স্ত্রী রুবি আক্তার এবং তার চার ছেলে আছেন। তাঁর তিন ছেলে বিবাহিত, বড় ছেলে আরাফাতুল মান্নান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে এখন ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। মেজ ছেলে এরফানুল মান্নান সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা করে তিনিও এখন ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। সেজ ছেলে নুরুল মান্নান প্রবাসী, বর্তমানে তিনিও ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। তাঁর ছোট ছেলে মোহাম্মদ আরিফুল মান্নান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত আছেন।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা