শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫, ৮ ভাদ্র, ১৪৩২, ২৮ সফর, ১৪৪৭

আহমদ শরীফ মনীর : রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

স্বাধীনতা-উত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে; সেই দলের নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এটা বোধ হয় কারো অজানা নয়। এই দুটি ঘটনা ছাড়াও চট্টগ্রামের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে একজন নতুন রাজনৈতিক নেতার অভিষেক ঘটে, তিনি আহমদ শরীফ মনীর। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি ছাত্রনেতা ছিলেন। তবে চট্টগ্রামে নয়, ঢাকায়। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং ছাত্রলীগ করতেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমদ, আ.স.ম. আবদুর রব প্রমুখের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ফলে তিনি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার জন্য গঠিত গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াসের সদস্য হওয়ার সুযোগ লাভ করেন এবং একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বের সঙ্গেও কাজ করতে থাকেন। আ.ফ.ম মাহবুবুল হক তাঁর কলেজ জীবনের বন্ধু এবং সহপাঠী, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়াও তাঁর সমসাময়িক এবং তাঁদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আহমদ শরীফ মনীর থাকতেন জিন্নাহ হলে (পরবর্তীকালে সূর্য সেন হল)। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় যোগদানের জন্য জিন্নাহ হল থেকে একটি মিছিল যায়, তিনি সেই মিছিলের সাথে রেসকোর্সে যান। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে প্রকারান্তরে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের করণীয় সম্পর্কে যে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন, সে অনুযায়ী কাজ করার জন্য আহমদ শরীফ মনীর নিজের থানা পটিয়ায় চলে আসেন। তার পূর্বে অবশ্য ৭০-এর নির্বাচনের আগেও একবার তিনি চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সে নির্বাচনে পটিয়ায় প্রাদেশিক পরিষদে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী নামে একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিলো। তাঁর মনোনয়ন লাভে যারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি, সেসব আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা ৬ দফা প্রচার কমিটি নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করে কুসুমপরা নিবাসী সিটি কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফকে পাল্টা মনোনয়ন প্রদান করলে তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে তখন পটিয়ায় এক অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো। এই পরিস্থিতিতে সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর সমর্থনে এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আহমদ শরীফ মনীর এবং পশ্চিম পটিয়াব্যাপী সফর করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কুসুমপুরীর সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ করেন। এ ব্যাপারে তাঁকে অনেকে সহযোগিতা করেন।
তিনি কুসুমপুরী সাহেবের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজের পাশাপাশি নির্বাচনী প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রার্থীর সঙ্গে সমগ্র নির্বাচনী এলাকা ঘুরে ঘুরে মিছিল, পথসভা এবং জনসভা করে জনমত গড়ে তোলেন। কুসুমপুরী সাহেবের প্রতিপক্ষ ছিলেন খুবই শক্তিশালী প্রার্থী। তিনি একজন অগ্নিযুগের বিপ্লবী এবং চট্টগ্রামে ন্যাপের প্রধান নেতা পূর্ণেন্দু দস্তিদার। এছাড়া তিনি আইনজীবী এবং সাহিত্যিক ছিলেন। সবমিলে তাঁর একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ছিলো এবং তাঁকে মানুষ শ্রদ্ধা করতো। এমন একজন জনপ্রিয় প্রার্থীকে হারানো খুব সহজ কাজ ছিলো না। তবুও আওয়ামী লীগের জনজোয়ারে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যান। নির্বাচনের পরে আহমদ শরীফ মনীর আবার ঢাকা চলে যান এবং ৭১-এর ৭ মার্চের পরে আবার চট্টগ্রামে তাঁর এলাকায় ফিরে আসেন। তাঁর এলাকা পশ্চিম পটিয়া নামে পরিচিত, তিনি পশ্চিম পটিয়ায় অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর নির্বাচনী কাজে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, প্রধানত তাঁদেরকে নিয়েই তিনি কাজ করেন। এসময় জিরি ফকির মসজিদে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটি গঠনের পিছনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। এভাবে পশ্চিম পটিয়ার ঘরে ঘরে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর গ্রাম সাঁইদাইর, বুধপুরা, দ্বারক পেরপেরা ও মহিরা পেরপেরা, পিঙ্গলা প্রভৃতি গ্রামকে নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি। যুদ্ধের জন্য মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা, তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, অস্ত্র সংগ্রহ এবং শেল্টার তৈরির কাজও একই সঙ্গে আরম্ভ করেন। বুধপুরা বাজার পশ্চিম পটিয়ার মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়। বুধপুরা বাজারকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পটিয়াকে মুক্ত এলাকা হিসেবে গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ চট্টগ্রামে দুটি বৃহৎ মুক্তাঞ্চল ছিলো-একটি বরকল, শাহজাহান ইসলামাবাদীর ঘাঁটি; অপরটি বুধপুরা, আহমদ শরীফ মনীরের ঘাঁটি—যেখানে বাজার এবং সন্নিহিত গ্রামগুচ্ছ নিয়ে একটি ট্রেনিং সেন্টার ও একাধিক শেল্টার সৃষ্টি হয়েছিলো। প্রধান শেল্টার বা মূল ঘাঁটি ছিলো দ্বারক পেরপেরা গ্রামে ব্রজেন্দ্র বর্ধনের বাড়ি।
আহমদ শরীফ মনীর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থানার জিরি ইউনিয়নের সাঁইদাইর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী আনু মিয়া ছিলেন সেকালের ডিলার, তিনি গ্রামের একজন মান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর মাতার নাম গোলবাহার খাতুন।
চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আহমদ শরীফ মনীর দ্বিতীয়। তাঁর বড় ভাই ইমাম শরীফ চট্টগ্রাম শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। তবে ব্যবসায়িক ব্যস্ততার কারণে তাঁর পক্ষে রাজনীতিতে সার্বক্ষণিক সময় দেয়া সম্ভব ছিলো না। কিন্তু রাজনীতির খবরাখবর রাখতেন। তিনি মওলানা ভাসানীর অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর প্রভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। মওলানা সাহেব তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তিনি এমএ আজিজের সমর্থক বা সহযোগী ছিলেন। এ কারণে এমএ আজিজের পুত্র অধ্যাপক নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু যখন স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে জাসদে যোগ দেন এবং চট্টগ্রামে জাসদকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্রিয় রাজনীতি আরম্ভ করেন, তখন ইমাম শরীফ সাহেব তাঁর সর্বস্ব দিয়ে অধ্যাপক মঞ্জুকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর ছোট ভাই আহমদ শরীফ মনীর ছিলেন জাসদের অন্যতম প্রধান সংগঠক এবং মঞ্জুর বন্ধু।
আহমদ শরীফ মনীর সাঁইদাইর প্রাথমিক বিদ্যালয়, কর্তালা বেলখাইন উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে কর্তালা হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা পাস করেন এবং সে বছরই চট্টগ্রাম কলেজে এইচএসসি মানবিকে ভর্তি হন।
জনাব আহমদ শরীফ মনীর স্কুল জীবন থেকে রাজনীতি আরম্ভ করেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে পূর্ব পাকিস্তানে যখন শরীফ শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন চলছিল, তখন কানুনগোপাড়া কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস আনোয়ারার আওয়ামী লীগ নেতা হাফেজ মোহাম্মদ শরীফের ভাই মোহাম্মদ নাছির (তিনি হুলাইনে থাকতেন, স্বাধীনতার পর আহমদ শরীফ মনীর যখন জাসদ সংগঠিত করছেন, তখন তাঁর অনুরোধে নাছির সাহেব পটিয়া থানা জাসদের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ) কর্তালা হাইস্কুলে গিয়ে ছাত্রদের ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে আন্দোলনের মিছিলে যোগদানের আহ্বান জানালে জনাব মনীর ও তাঁর সহপাঠী বেশ কয়েকজন ছাত্র সেই আন্দোলনে যোগদান করেন; তারা মিছিল করে আনোয়ারা থানার পরৈকোড়া নয়নতারা হাইস্কুল পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
জনাব আহমদ শরীফ মনীর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে ছাত্রলীগের নির্বাচনী সংগঠক ‘যাত্রিকে’ যোগদান করেন। সে বছরই প্রথম ‘ইউএসপিপি’ থেকে বেরিয়ে ছাত্রলীগ আলাদা নির্বাচনী সংগঠন ‘দিশারী’ গঠন করে সেই সংগঠনের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সন্দ্বীপের আকবর সাহেব, কাট্টলীর আবদুর রাজ্জাক মাহমুদ চৌধুরীকে (নবী চৌধুরীর পুত্র ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী’র বড় ভাই, পরে তিনি লন্ডনে চলে যান) ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল ‘যাত্রিকে’র। পুরনো হোস্টেলের দোতলার পূর্ব পাশের রুমে আ ফ ম মাহবুল হকও (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা এবং জাসদ ও বাসদের শীর্ষস্থানীয় নেতা) থাকতেন। তাঁর সাথে জনাব মনিরের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। মাহবুবও চট্টগ্রাম কলেজে যাত্রিক করতেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে আশরাফ খান (পাঠানটুলীর খান বাড়ির সন্তান। তিনি সংসদে ‘যাত্রিকে’র পক্ষে জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনলবর্ষী বক্তা ছিলেন। তিনি পরে সিটি কলেজে গিয়ে নির্বাচন করে ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন)। আশরাফ খানের ক্যাবিনেটে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন মীর্জা আবু মনসুর (ফটিকছড়ির নানুপুরের মুসলিম লীগ নেতা শিল্পপতি মীর্জা আবু আহমদের পুত্র, তিনি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমএপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন)। সেই প্রথম ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাবিনেট দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। তার আগে ইউএসপিপিভুক্ত ছাত্র ইউনিয়নের প্রভাব ছিল নিরঙ্কুশ।
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র বোন মাদারে মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দান করে। তাঁকে চট্টগ্রামের জনগণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য লালদিঘি ময়দানে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি ঢাকা থেকে ট্রেনে করে চট্টগ্রামে আসছিলেন। তাঁকে একনজর দেখার জন্য পথে পথে বিভিন্ন রেলস্টেশনে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছিল। তাদের উদ্দেশ্যে দু’চার কথা বলতে বলতে তিনি চট্টগ্রাম এসে পৌঁছান নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। স্টেশন থেকে তাঁকে নিয়ে ছাত্র জনতা মিছিল সহকারে লালদিঘিতে গিয়েছিল। সেই মিছিলে জনাব আহমদ শরীফ মনীরও ছিলেন। তৎকালীন ছাত্রনেতা আশরাফ খান, আবু তাহের মাসুদ, এবং ইদরিস আলম অগ্রভাগে থেকে মিছিল পরিচালনা করেন।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করেন। লালদিঘিতে ৬ দফার সভা আহবান করা হয়েছিল। সেখানে এমএ আজিজ, আবদুল্লাহ আল হারুন, এমএ মান্নান, আশরাফ খান বক্তৃতা দিয়েছিলেন। জহুর আহমদ চৌধুরী সভাপতিত্ব করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণার পরে আওয়ামী লীগের নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ দফা ঘোষণার পরে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অনেক নেতা যখন জেলে, তখন জিরি ফকিরা মসজিদের পাশে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা আমেনা বেগমকে এনে জনসভা করেছিলেন।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দেই জনাব মনীর ও আ.ফ.ম মাহবুবুল হকসহ আরো কয়েকজন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঢাকা গিয়েছিলেন। তাঁরা জগন্নাথ হলের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী কার্যালয়ে ভর্তিসহ যাবতীয় ফি জমা দিয়ে, জিন্নাহ হলের দোতলায় একটা রুমে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। জনাব মনীরের এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ থাকলেও যেহেতু এসএসসিতে ছিল না, সেহেতু তিনি ভালো সিট পাননি প্রথম দফায়, পরে অবশ্য ৫২০ নং রুম বরাদ্দ পেয়েছিলেন।
১৯৬৯, মহান গণঅভ্যুত্থানের বছর। তখন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসু নির্বাচন হত পরোক্ষ পদ্ধতিতে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের হল সংসদ নির্বাচনে ইকবাল হলে ডাকসু সদস্য ও ভিপি হয়েছিলেন ছাত্রলীগের তোফায়েল আহমদ। জিন্নাহ হল থেকে এনএসএফ-এর নাজিম কামরান চৌধুরী হয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক। এর ফলে এনএসএফ এর প্রভাব আরো শক্তিশালী হয়েছিল। আরো অনেকেই এনএসএফ-এ যোগদান করেছিলেন। বাকি ছিলেন তারা কয়েকজন।
এরপর বাঙালির মহাজাগরণ; ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি গণআন্দোলনের সূচনা। ১৮ তারিখে কলেবর একটু বৃদ্ধি পায়। নতুন নতুন ছেলেরা এসে তাদের সাথে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনে রাস্তায় পুলিশ বাহিনী, ভিতরে ছাত্ররা। ছাত্ররা চাইছে রাস্তায় বেরোতে, পুলিশ বাধা দিচ্ছে। এভাবে আরো একদিন ১৯ জানুয়ারি কেটে গেল। ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ছাত্রদের মিছিল পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল। মিছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল পার হয়ে জগন্নাথ হল শহীদ মিনারের দিকে যেতেই মিছিলের উপর গুলি হয়। গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান শহীদ হন। আন্দোলন নতুন গতি ও মাত্রা পায়।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষে প্রথম দিকে গোপনে এক সংগঠন গড়ে উঠেছিল, যার নাম স্বাধীন বাংলার নিউক্লিয়াস। ছাত্রলীগের বাছাই করা কর্মীদের সেখানে সদস্য করা হত, অতীব গোপনীয়তার সাথে, যার সাংগঠনিক কাঠামোর নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদ।
আহমদ শরীফ মনীর স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস এর সদস্য নির্বাচিত হন। নিউক্লিয়াস এর বিশেষ বৈঠকগুলো হত ডাকসু ভিপির অফিস, আনোয়ারা হোটেল, ইকবাল হলের কেন্টিন অথবা চত্বরে; জনতা পত্রিকার সম্পাদক জনাব আনিসুজ্জামান বলাকা ভবনের ছাত্রলীগ অফিসে নিয়মিত ক্লাশ নিতেন। সেখানে রাজনীতি এবং অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় ও সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হত। সেখানে যোগদান ছিল তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সিনিয়র সদস্য কাজী আরেফ আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নিউক্লিয়াস এর কার্যক্রম সমন্বয় করতেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কি বলতে পারেন সে ব্যাপারে তাঁদের ধারণা ছিল। তাঁরা তাঁদের অবস্থান থেকে “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর” স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আসলেন, মঞ্চে আরোহণ করলেন। বজ্রকণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করলেন। তাঁর বক্তৃতা পাকিস্তান রেডিওতে সম্প্রচার করার কথা ছিল। সম্প্রচার শুরুর পরে অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি তাঁর বক্তৃতায় তাদের মনের কথাই বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,” জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। সেটা ছিল এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই আহবানে আহমদ শরীফ মনির হয়েছিলেন এবং হয়েছিলেন বলেই ৭ মার্চের ভাষণের পর তাঁর কর্তব্য পালনে, সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ১১ মার্চ তাঁর এলাকা পশ্চিম পটিয়ায় চলে আসেন। পশ্চিম পটিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলেন। বুধপুরা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর লোকদের দিয়ে এলাকার যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করেন। এ কাজে তাদেরকে সহায়তা করেন বুধপুরা গ্রামের সামরিক বাহিনীর (অবসরপ্রাপ্ত) লোক সুলতান আহমদ, সাঁইদাইর গ্রামের ইপিআর হাবিলদার আবদুল লতিফ, লে. নায়েক মোতালেব, গোরনখাইন এর আনসার কমান্ডার মুনসী মিয়া। সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর আহবানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠতে থাকে। এর মধ্যে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। ৭ মার্চের পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি শাসন লুপ্ত হয়ে যায়। দেশ কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। দেখতে দেখতে ২৫ মার্চ চলে আসে। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট এর নামে বাঙালি নিধনে মেতে উঠে পাকিস্তানি সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ২৫ মার্চ পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাঙালি সেনা, ইপিআর, পুলিশের উপর আক্রমণ চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ও ক্যাম্পাসে আক্রমণ চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এককথায় গণহত্যা চালানো হয়। ২৫ মার্চ রাত্রে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ইপিআর অয়ারলেসে স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে এম.এ হান্নান প্রথমে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। পরে ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
২৫ মার্চের পর থেকে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। যার যার অবস্থান থেকে সবাই প্রতিরোধ করেন। শক্তিশালী ও সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এপ্রিল এর মাঝামাঝি প্রতিরোধ সংগ্রাম স্তিমিত হয়ে আসে। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ও হাজার হাজার যুবক ভারতে আশ্রয় নেয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করা হয়। নিয়মিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি গোটা দেশকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে মুক্তি সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার জন্য মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে ইয়ুথ ক্যাম্প করে এফএফ ট্রেনিং এর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় তাদের বৃহত্তর পটিয়া এলাকায় প্রথমে সার্জেন্ট আলম, ক্যাপ্টেন করিম ও প্রফেসর শামসুর নেতৃত্বে বিভিন্ন এফএফ গ্রুপ আসে। এদের সবাই মেজর রফিকের তত্ত্বাবধানে ত্রিপুরার হরিণা ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশে আসেন। সার্জেন্ট আলমের গ্রুপ বরকল এলাকায় শাহজাহান ইসলামাবাদী-ও মুরিদুল আলমের তত্ত্বাবধানে ছিল। তাদের সাথে আহমদ শরীফ মনীরেরও যোগাযোগ হয়েছিল। তারা জিরি মাদ্রাসার মুজাহিদ ক্যাম্পে অভিযান চালাবার জন্য তাঁর সাথে যোগাযোগ রেখে এসেছিলেন। আহমদ শরীফ মনীর তাদেরকে বুধপুরা হাসপাতালের পাশে আলী নবী দানা মিয়াদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। প্রথম দিন তারা জিরি মাদ্রাসা এলাকা ঘুরে আসেন। পরদিন তাদেরকে কর্ত্তালা গ্রামের অমিয় চৌধুরী, উবাগুপ্ত বড়ুয়াদের বাড়িতে আশ্রয় দেন। সেই দলে হুলাইন গ্রামের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আহমদ নবীও ছিলেন। তারা অজ্ঞাত কারণে অভিযান পরিচালনা না করে চলে যান। এ ব্যাপারে তিনি ও সংশ্লিষ্ট লোক ছাড়া কেউ কিছু জানত না, টেরও পায়নি। এরপরও বরকলে শাহজাহান ইসলামাবাদীর সাথে যোগাযোগ ছিল। সার্জেন্ট আলম বাঁশখালীতে শহীদ হন।
এর আগে স্থানীয়ভাবে সুলতান এর নেতৃত্বে একটি গ্রুপকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছিল। তাছাড়া পটিয়া, আনোয়ারা, ভাটিখাইনের শিবু, পিঙ্গলা গ্রামের দুলাল বড়ুয়া, তেমিয় ও রাজমোহন মিলন বড়ুয়াকে নিয়ে পিঙ্গলা কেন্দ্রীক আরো একটি গ্রুপ ছিল। সুলতান এর নেতৃত্বে স্থানীয় বদি মেম্বার, আবুল কালাম, এখলাছ, মোহাম্মদ, মুন্সী মিয়া, নুর মোহাম্মদ, আলী আকবর, আবদুল, রফিকসহ আরো অনেকে সংগঠিত হয়েছিলেন। তারা স্থানীয় দালাল ও রাজাকারদের ব্যাপারে সজাগ ও সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের এই তৎপরতার সাথে সাঁইদাইর গ্রামের আবুল হোসেন মাস্টার, মোহাম্মদ আলী মাস্টার, মোহাম্মদ ইসহাক, হাবিলদার লতিফ, লে. নায়েক মোতালেব, দুই নুরুল আমিন, নুরুল আলম, রুস্তম আলী, আবদুর রহমান, আলী আকবর, জহির আহমদ জড়িত ছিলেন। এদের অনেকেই পরে ভারতের ডিমাগিরি ক্যাম্পে গিয়েছিলেন।
প্রফেসর শামসুর গ্রুপ ও তার আগমন : নাজিরহাট কলেজের প্রফেসর ও পটিয়া ধলঘাট ইউনিয়নের করণখাইন গ্রামের বাসিন্দা প্রফেসর শামসুল ইসলামও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ভারতের হরিণা ক্যাম্প থেকে ১নং সেক্টরের অধীনে এফএফ গ্রুপ নিয়ে পটিয়া এলাকায় আসেন। ছাত্রলীগ নেতা সমশুদ্দিন আহমদও একই সময়ে পটিয়া এলাকায় আসেন। তাঁরা আসার পর পটিয়া এলাকায় সরকারী অফিস তথা খাস মহালগুলোতে আক্রমণ হয়। গৈড়লার পোস্ট মাস্টার আহমদ হোসেনের নির্দেশে বামপন্থী যুবনেতা অনিল লালাও খাসমহাল অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ক্যাপ্টেন করিমের আগমন : এরপরে তারা খবর পান যে ক্যাপ্টেন করিম নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বিনিনিহারা গ্রামে ডা. শামসুর বাড়িতে তাঁর চিকিৎসাধীন আছেন। ডা. শামসু তাদের ঘনিষ্ঠজন, সেই সুবাদে করিম সাহেবের সাথে আহমদ শরীফ মনীরের আলাপ পরিচয় হয়। পরে ক্যাপ্টেন করিমকে কেন্দ্র করে তারা বড় ধরনের গেরিলা গ্রুপ গঠন করে ফেলেন। তাদের সাথে প্রথম ধাপে যোগ দেন আনোয়ারার চাতরী থেকে আনসার কমান্ডার বজল আহমদ, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আহমদুল্লাহ, গোলাফুর রহমান, দৌলতপুর থেকে সেনাবাহিনীর আজিজ, শাহমীরপুরের নূর হোসেন, আনসার কমান্ডার রশীদ ও গোলাম শরীফ, ইপিআর এর মোতালেব, তাদের সাথে গৈড়লা গ্রামের হাবিলদার নুরুল আলম ও অন্যরা। করিম সাহেব সুস্থ হওয়ার পর বুধপুরা হাসপাতালের ডা. রায় বাবুর বাসায় ও পেরপেরা গ্রামের ব্রজেন্দ্র লাল বর্দ্ধনের বাসায় আশ্রয় নেন। তাদের সংগঠিত যোদ্ধারা দ্বারক পেরপেরা ও মহিরা পেরপেরার মহাজন বাড়ি, দাশপাড়া ঠাকুরবাড়িসহ বিভিন্ন বাড়িতে থাকতেন। তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে হত। সময় হলে করিম সাহেবের নেতৃত্বে গেরিলা যোদ্ধারা অভিযানে বের হতেন। করিম সাহেবের অভিযানের এলাকা উত্তরমুখী বোয়ালখালী, দ. রাউজান, রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উক্ত এলাকায় যতগুলো অপারেশন হয়েছে প্রায় সবগুলোই করিম সাহেবের নেতৃত্বে হয়েছে। মিলিটারি পুলে পাক সেনাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ, সেনের পুলে বোয়ালখালী থানায় আক্রমণ, ধলঘাট স্টেশনে সৈন্যবাহী ট্রেনে আক্রমণ, কালারপুল পুলিশ ফাঁড়ি, বাণীগ্রাম অয়ারলেস অফিস আক্রমণ-সবগুলোই করিম সাহেব এর নেতৃত্বে হয়। তাছাড়া জিরি মাদ্রাসায় মুজাহিদ বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা, গোমদণ্ডী রাজাকার ক্যাম্পেও করিম সাহেব সফল অভিযান পরিচালনা করেন।
২য় ধাপে আহমদ শরীফ মনীর ব্রজেন্দ্র লাল বর্দ্ধনের বাড়ির পুকুর পাড়ে প্রতিষ্ঠিত পেরপেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প খোলেন। সেখানে ইপিআরের ল্যান্স নায়েক মোতালেব, হাবিলদার লতিফ ও কমান্ডার সুলতান, হাবিলদার নুরুল আলম নবাগত যুবক ও ছাত্রনেতাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতেন। এ পর্যায়ে তাদের কলেবর অনেক বড় হয়ে যায়। জিরি গ্রামের ছাত্রনেতা ফজল, ইসহাক, আবুল বশর চৌধুরী, নুরুল আনোয়ার, জুলধার এম.এন ইসলাম, দৌলতপুরের তাহের, বাদশা, শাহমীরপুরের কামাল উদ্দিনসহ আরো অনেকে এসে ট্রেনিং নেন ও যোগদান করেন।
ইতিমধ্যে তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন মনসা গ্রামের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম, আবুল কাশেম ও নিজামুল হক; চরকানাই গ্রামের হাবিলদার নুরুল আলম, হুলাইন গ্রামের সুবেদার মেজর সোলায়মান, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুুর রহমান খান। ক্যাপ্টেন করিমের সহকর্মী হিসেবে এ পর্যায়ে আরো যারা যোগদান করেন তারা হলেন প্রফেসর শামসু, বড়লিয়ার জামাল, গৈড়লার ইব্রাহিম, মঠপাড়ার প্রদে্যুৎ পাল বা দুলাল এরা সবাই তাঁর নিয়মিত অপারেশনসঙ্গী ছিলেন। তাছাড়া বোয়ালখালীর ছাত্রনেতা আ.হ.ম. নাসির, মনসুর, পীষুষ, ওবায়দুল হক শিকদারসহ কয়েকজন তাদের আশ্রয়ে থেকে করিম সাহেবের গ্রুপে বিভিন্ন অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন। বড়উঠান গ্রামের ডা. ছত্তার সাহেব ও পটিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের আরো কয়েকজন অভিযানে নিয়মিত অংশ নিতেন। বুধপুরা গ্রামের মোহাম্মদ মিয়া, এখলাছ, নুর মোহাম্মদ, কামাল, আকবর, সাইদাইরের মোতালেব, পিঙ্গলা গ্রামের দুলাল ও মিলনসহ আরো কয়েকজন নিয়মিত অভিযানে যেতেন। আশিয়া গ্রামের নুরুন্নবী, পিঙ্গলা গ্রামের তেমিয় বড়ুয়া, রাজমোহন, অনিল বড়ুয়া ও জামাল উদ্দিন খানসহ এই বিশাল কর্মকাণ্ডে এলাকার অনেকেই তাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। সবচাইতে বেশি চাপ সহ্য করেছেন ব্রজেন্দ্র লাল বর্দ্ধনের পরিবার, দ্বারক, পেরপেরা ও মহিরা পেরপেরা ও পিঙ্গলা গ্রামের মানুষ, বুধপুরা বাজারের বসন্ত বাবু ও হাসপাতালের রায়বাবু। এক পর্যায়ে বুধপুরা বাজার এলাকা হয়ে যায় মুক্তাঞ্চল ও বাজারের বসন্ত বাবুর চায়ের দোকান হয়ে যায় তাদের আড্ডার কেন্দ্র।
৩য় ধাপে তাদের কলেবর আরো বৃদ্ধি পায়, শত শত যুবক এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে ভারতে ট্রেনিং—এ যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে যায়। আহমদ শরীফ মনীর করিম সাহেবের মাধ্যমে তাদেরকে ভারতে প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ভারত গমনেচ্ছুদের প্রথম গ্রুপে ডা. শামসুসহ অনেকেই ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হন। কিন্তু ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি রাজ্যগুলো সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তারা সবাই কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষে রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া হয়ে ভারতের ডিমাগিরিতে চলে যান। সেখানে শরণার্থী শিবির খোলা হয়েছিল বটে, কিন্তু যোদ্ধাদের জন্য কোন ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল না। সেখান থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ক্যাম্পে আসার কোন সুযোগ ছিল না। তাই সবাই সেখানে আটকা পড়ে যায়। তাদের সঙ্গে সুলতান আহমদ কুসুমপুরীসহ সবাই সেখানে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য যাঁরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন জনাব মনীর তাদেরকে বুধপুরা বাজারের নিকটবর্তী কর্ত্তালা হাইস্কুলে রাত্রিবেলা জমায়েত করে দুইদফায় পশ্চিম পটিয়া অঞ্চলের অনেক যুবক ছেলেকে ভারতের ডিমাগিরিতে পাঠান। ২য় দলে বড়লিয়া গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা মজহারুল হক চৌধুরীও ছিলেন। দফায় দফায় এত লোক ভারতে যাওয়ার পরেও কেউ যখন ট্রেনিং নিয়ে ফেরত আসছিল না, তখন আহমদ শরীফ মনীর চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং এবার নিজেই ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে রাউজান হাটহাজারী ফটিকছড়ি পথে যাওয়ার চেষ্টা করেন, নিরাপদ যোগাযোগ না পাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে ফেনী মুন্সীর হাট পথে রওনা হন, সে ব্যাপারে আনোয়ারা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম.এ হক সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের সাথে ছিলেন গোরনখাইন গ্রামের রায়হান ফিরদাউস মধু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা, ছাত্রলীগের লিটারেচার ড্রাফ্ট করতেন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশার সহকারী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণের জন্য হাঙ্গেরী পাঠিয়েছিলেন) , জিরি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন। তারা বিলোনিয়া দিয়ে না গিয়ে মুন্সির হাটকে পাশ কাটিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে আগরতলা গিয়ে শ্রীধর ভিলায় আ. স. ম. আবদুর রব-এর সঙ্গে দেখা করেন। আ. স. ম. আবদুর রব তাঁদের কাছে মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন।
আহমদ শরীফ মনীর যখন সেখানে পৌঁছান তখন মিত্র বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখ সমর শুরু হয়ে গেছে। সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যজুড়ে সামরিক বাহিনীর তৎপরতা। সমস্ত ট্রেনিং শেষ। মুক্তিবাহিনীর শেষ দল ও মুজিব বাহিনীর লোকজন দেশের ভেতরে আসার অপেক্ষায়, এটা নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়। আর মাত্র একমাস পরেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। শোভনদণ্ডীর নুরুল আনোয়ারের নেতৃত্বে আমরা ৬জন বিএলএফ যোদ্ধা দক্ষিণ চট্টগ্রামে কাজ করার দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলাম, সেটা তিনি তখনই জানতে পারেন। নুরুল আনোয়ার পরে আরেকদল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে রাজাকারদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হন।
আ.স.ম. আবদুর রবের সঙ্গে আলোচনার পর জনাব মনীরকে উদয়পুরে পাঠানো হয়। সেখানে বিএলএফ বিভিন্ন থানা কমান্ডের লোকজন, বিভাগীয় ও জেলা আঞ্চলিক অধিনায়কগণ অবস্থান করছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সদস্য হিসাবে তাঁর একটা পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আঞ্চলিক ও থানা কমান্ডগুলো তখন গঠিত হয়ে গেছে, তাঁদের মধ্যে দায়িত্বও বন্টন করা হয়েছে। তাই বিভাগীয় ও জেলা কমান্ড তাঁকে উক্ত বাহিনীর সিনিয়র সদস্য হিসাবে গ্রহণ করে অস্ত্রসহ দেশের ভিতরে পাঠিয়ে দেন। তারা উদয়পুর থেকে মুজিব বাহিনীর বিভাগীয় কমান্ড সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম, জেলা কমান্ডার এস.এম ইউসুফ, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান থানা মুজিব বাহিনীর সদস্যবৃন্দ ও স্বপন চৌধুরীর কমান্ডের অধীনে বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, বাঁশখালী মুজিববাহিনীর সদস্যদের নিয়ে উদয়পুর থেকে প্রথমে হরিণা ক্যাম্পে আসেন; সেখানে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আবু মোহাম্মদ হাশেমের সাথে দেখা হয়।
হরিণা ক্যাম্প থেকে আসার সময় দক্ষিণ চট্টগ্রাম এর বিভিন্ন থানার এফএফ যোদ্ধারা স্বপন চৌধুরীর সাথে যোগ দেন। তার মধ্যে ছিলো পটিয়ার ধলঘাটের অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্রের কমান্ডে হুলাইনের আহমদ নবী ও আশিয়ার সিরু বাঙালির গ্রুপ, দোহাজারী’র আবু তাহের খান খসরুর কমান্ডে থাকা জাফর আলী হিরু ও চন্দনাইশের নজরুল ইসলামের (প্রাক্তন এমপি) এফএফ গ্রুপ; সাতকানিয়ার বাজালিয়া গ্রামের জলিল বক্্সুর কমান্ডে থাকা আবুল হোসেন, এফএফ গ্রুপ আর চকরিয়ার মাহবুব এর কমান্ডে থাকা এফএফ গ্রুপ। তারা হরিণা থেকে বৈষ্ণবপুর দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ১৬ মাইল পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে খুব ভোরে কুমারী নামক স্থানে এসে পৌঁছান। সেখানে তেমন কোন লোকালয় ছিল না। পেটের ক্ষিধায় তাঁরা উপজাতীয়দের বাড়িতে কাঁচা কলা আর তেঁতুল খেয়েছিলেন। সেখান পর্যন্ত এসে পরিশ্রান্ত হয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। তারা তাকে রেখেই যুগ্যাছোলা বাজার হয়ে ফটিকছড়ির ধুরুং খালে চলে আসেন। সেদিন ছিল রমজানের ঈদের দিন। তারা দোকানে গিয়ে চার আনা দিয়ে এক গ্লাস সেমাই কিনে খেয়েছিলেন। ময়ুর খান বকিয়তুল্লাহ’র খামার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট ক্যাম্প ছিল। সেখানে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম, এসএম ইউসুফসহ হাটহাজারী, ফটিকছড়ির গ্রুপ সেখানে থেকে যায়, সেখানে আগে থেকেই অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিল। সেখান থেকে তারা কাউখালীর উদ্দ্যেশে চলে আসেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সকল বিএলএফ ও এফএফ সদস্য যারা স্বপন চৌধুরীর সাথে এসেছিলেন, সবাই কাউখালী চলে যান। কাউখালীর ওখানে ইছাখালী নদীর পাশে থানা এলাকার বিপরীতে এক চাকমা পাড়ায় তারা রাত্রিযাপন করেন। তারা তাদেরকে ভালভাবে আপ্যায়ন করে। সেখানে স্বপন চৌধুরী দক্ষিণ চট্টগ্রামের সকল বিএলএফ ও এফএফ কমান্ডারকে ডেকে বৈঠক করেন। সবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেন এবং আহমদ শরীফ মনীরের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন যে, তিনি তাঁর সিনিয়র ও বড় ভাই। তারা দুইজন যেহেতু ছাত্রলীগের রাজনীতিতে একই মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন।
স্বপন চৌধুরী দুর্ভাগ্যজনকভাবে শহীদ হওয়ার একদিন আগে আহমদ শরীফ মনীর দক্ষিণ চট্টগ্রামের এফএফ সদস্যদের নিয়ে কাউখালী থেকে মাইজপাড়া হয়ে রাউজানের কচু ক্ষেতে চলে আসেন। সেখান থেকে একরাতেই রাঙামাটি সড়ক ও দক্ষিণ রাউজান অতিক্রম করে কাপ্তাই সড়কে গচ্ছি নয়াহাট দিয়ে লাম্বুরহাট এসে নৌকায় কর্ণফুলী পার হয়ে জৈষ্ঠপুরা সেনদের বাড়িতে তাদের আশ্রয়ে চলে আসেন। সেখানে অবস্থান করে তিনি পুনরায় কর্ণফুলী পার হয়ে বেতাগী ন্যাপ নেতার বাড়িতে ক্যাপ্টেন করিমের খোঁজে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি রাঙ্গুনিয়ার পারুয়াতে কমান্ডার আলমের ওখানে আছেন। তিনি মনসা গ্রামের আবুল কাশেমকে তাঁর আগমনের খবরটা জানানোর কথা বলে রাত্রেই এফএফ গ্রুপসহ বুধপুরা বাজারে চলে আসেন। তাঁর সাথে তখন ধলঘাটের প্রফেসর মিত্র, দোহাজারীর আবু তাহের খান খসরু, সাতকানিয়ার জলিল বকসু, চকরিয়ার মাহবুবের গ্রুপ ছিল। তিনি সবাইকে একদিন পিঙ্গলা, মহিরা পেরপেরা ও দ্বারক পেরপেরার শেল্টারে রেখে নিরাপদে গন্তব্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
এরা চলে যাওয়ার পরে তাঁর কাছে খবর আসে জিরি গৌর মহাজনের বাড়িতে কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে এসেছেন। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন বাঁশখালী ও সাতকানিয়া থানার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার যথাক্রমে ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী ও মনির আহমদসহ অন্যরা সেখানে অবস্থান করছেন, তারা কিছুটা আতংকিতও বটে। তাদের মুখে শুনলেন, তারা কাউখালী থেকে চলে আসার পর অয়্যারলেস সেট ব্যবহার করতে গিয়ে দেওয়ানজীসহ স্বপন চৌধুরী পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হন। তখন বাঁশখালী গ্রুপ, সাতকানিয়া গ্রুপ ও বোয়ালখালীর রাজেন্দ্রের গ্রুপ সেখান থেকে রাঙ্গুনিয়া পারুয়া এলাকায় নুরুল আলমের ঠিকানায় চলে আসেন। আলম সাহেব তাদেরকে পেয়ে অজ্ঞাত নির্দেশে সেখানে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন করিমকে তার সঙ্গী ইব্রাহিমকেসহ গুলি করে হত্যা করেন। তারপর তারা সেখানে থেকে জিরি গ্রামের নাথপাড়ায় আসেন। আহমদ শরীফ মনীরকে পেয়ে তারা সেখানে থাকতে চাচ্ছিলেন না। তিনিও তাদেরকে নিয়ে আসেন।
স্বপন চৌধুরী বন্দি হয়ে যাওয়ার পর পটিয়ার নুরুল ইসলাম, শাহ আলমের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ, রাউজানের গ্রুপ রাউজানের কচুক্ষেত এলাকায় চলে আসে। সেখানে আর একটি দুর্ঘটনা ঘটে, সে কচুক্ষেতেই সুনিলের আত্মঘাতী ফায়ারে রাউজানের কমান্ডার নাজিম নিহত হন। তারপরেই পটিয়ার গ্রুপ এলাকায় আসে। ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
বাঁশখালীতে ডা. ইউসুফ এর নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনীর গ্রুপ পৌঁছানোর পর তারা গুনাগরি রাজাকার ক্যাম্প দখল করে বাণীগ্রামে অবস্থান নেন। জলদীতে থানা হেডকোয়ার্টার তখনো পাকিস্তানি শাসনাধীনে। ডা. ইউসুফের গ্রুপ এর সাথে সেখানে স্থানীয়ভাবে সুলতান উল কবির চৌধুরীর (সিটি কলেজের সাবেক ভিপি ও স্বাধীনতার পর বাঁশখালীর এমপি) গ্রুপের ভুল বুঝাবুঝি হয়। লোকমুখে খবর পেয়ে আনোয়ারা বাঁশখালী কুতুবদিয়া থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সার কুতুবদিয়ার সফিউল আলমকে একটি ইঞ্জিনবোটসহ আহমদ শরীফ মনীরকে নেওয়ার জন্য পাঠান। জনাব মনীর তাঁর সাথে চকরিয়া রাজাখালী ঘোনাতে অবস্থিত আতাউর রহমান কায়সারের খামার বাড়িতে যান। সেখানে ডবলমুরিং থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ইসহাক মিয়াও ছিলেন। তাদের দুইজনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়, মুজিববাহিনী গঠন নিয়ে তিনি যতটুকু জানেন ততটুকু আলাপ হয়। তারপর দিন আতাউর রহমান কায়সার তাঁকে নিয়ে বাণীগ্রাম এলাকায় ডা. ইউসুফদের ক্যাম্পে আসেন। ডা. ইউসুফ, জাকারিয়া, আলম সবার সাথে দেখা হয়। সেখান থেকে তিনি সাতকানিয়ার কাঞ্চনায় অবস্থানরত সাতকানিয়ার গ্রুপ কমান্ডার মনির ও নিতাইদের সাথে দেখা করে তাঁর নিজ এলাকা বুধপুরা বাজারে চলে আসেন।
এর দুই একদিনের মাথায় সেই সপ্তাহেই দেশ হানাদারমুক্ত হয়ে যায়। করিম সাহেবের গ্রুপে থাকা তাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বোয়ালখালী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়ায় চলে আসে। ভারতের ডিমাগিরি থেকে সুলতান আহমদ কুসুমপুরীসহ অন্যরা দেশে আসেন। ডিমাগিরি থেকে বিশেষভাবে বাছাইকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দেশে চলে আসেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরপরই মুজিব বাহিনীর পটিয়া কমান্ড পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেন জেলা ও বিভাগীয় কমান্ড। সে অনুযায়ী আহমদ শরীফ মনীরকে অবিভক্ত পটিয়ার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ও সামশুদ্দিনকে ডেপুটি কমান্ডার মনোনীত করা হয়। বিএলএফ এর থানা কমান্ডার নুরুল ইসলামকে মুজিব বাহিনীর পটিয়া অঞ্চলের কমান্ডার ও জুলধার এম.এন ইসলামকে ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সমগ্র পটিয়াকে তিনভাগ করা হয়। পশ্চিম, মধ্যম ও দক্ষিণ।
১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএলএফ ও এফএফ ছিল। মুজিববাহিনী কাগজে-কলমে ছিল না। স্বাধীনতার পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুক্তিবাহিনী সনদ বিতরণ করা হয়। আর মুজিববাহিনীর সনদ বিতরণ হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শেখ ফজলুল হক মনির প্রতি স্বাক্ষরে।
স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজকর্ম শুরু করেন আহমদ শরীফ মনীর। ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক বিভক্তির পূর্বেই দেশব্যাপী মেরুকরণ শুরু হয়ে যায়। ছাত্রলীগ যখন সত্যি সত্যি ভেঙে গেল, তখন রাজনীতিতে একটি নতুন বক্তব্য আসলো। নতুন নয়, পুরাতনই, সেটা হলো মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই রাজনীতি জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগই যে প্রথম আরম্ভ করেছিল তা নয়, তখন কমিউনিস্ট পার্টির নামে অন্তত আধা ডজন গোপন ও প্রকাশ্য দল রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলো। তাদের সঙ্গে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের মূলগত তফাৎ হলো তারা বাংলাদেশের সমাজ বিশ্লেষণ করে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হন; কেউ বললেন বাংলাদেশ একটি আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, কেউ বললেন সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র। তারা বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করলেন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, নয়া জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ইত্যাদি। পক্ষান্তরে জাসদ বা ছাত্রলীগ বললো বাংলাদেশের সামজ বিকাশের স্তর পুঁজিবাদের পর্যায়ে পৌঁছেছে, সুতরাং বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবী বুকনি এবং ধোঁয়াশার মধ্যে জাসদের আবির্ভাব এবং চট্টগ্রামে তার মুখপাত্র হয়ে উঠলেন আহমদ শরীফ মনীর। সিনিয়র নেতা বিধান কৃষ্ণ সেন, আবুল কালাম আজাদ, মোখতার আহমদ, আবু মোহাম্মদ হাশেম, ছাবের আহমদ আসগরী, মঈনউদ্দিন খান বাদল, শওকত হাফিজ খান রুশ্নিরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ থেকে ভালো ভালো নেতাকর্মীদের বের করে এনে জাসদের প্রাথমিক ভিত্তি প্রদানে তৎপর ছিলেন। বৃহত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছাবের আহমদ আসগরীর গোটা জেলায় ছাত্রলীগের নেটওয়ার্ক ছিলো। তিনি সমগ্র জেলায় সফরে বের হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সমাজতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন রাজনীতি ও সংগঠনে যোগদান করার প্রেরণা জোগান। পরে তাঁর পরামর্শে আহমদ শরীফ মনীর সফরে বের হয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে অবিভক্ত ছাত্রলীগে ছাবের আহমদ আসগরীর সমর্থক যারা ছিলেন তাদেরকে ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের ছাত্রলীগ ভাঙ্গছে এই তথ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের পক্ষে কাতারবন্দী হবার আহবান জানান। জাসদ তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে, সেই জাসদের সাংগঠনিক ভিত্তিও তিনি স্থাপন করে আসেন। অতঃপর ছাত্রলীগ যখন ভাগ হয় এবং জাসদ যখন গঠিত হয়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ আজিজের অনুসারীদের সঙ্গেও তিনি দেখা সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যে মতামর্শগত দ্বন্দ্ব চলছে, তার সংবাদ দিয়ে তাদেরকে ভবিষ্যতে নতুন দল গড়ার জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানিয়ে আসেন। আহমদ শরীফ মনীর চট্টগ্রাম জাসদের প্রধান তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন; মার্কসবাদ, লেলিনবাদের ওপর তাঁর ব্যাপক পড়াশোনা ছিলো; তাছাড়া তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্ব এসব বিষয়ে পড়াশোনা করে নিজেকে ‘থিয়োরেটক্যালি ইকুইপ্ড করে রেখেছিলেন। এনায়েতবাজার বাটালী রোডে ‘সাগর হোটেল’ নামে তাঁর বড় ভাইয়ের একটি হোটেল ছিলো, সেই হোটেলে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত নেতাকর্মীদের সাথে তিনি রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। বিভিন্ন স্থানে গিয়েও তিনি আলোচনা করতেন। তাত্ত্বিক আলোচনায় তাঁকে সহায়তা করতেন এম এ আজিজের পুত্র অধ্যাপক নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু, তারিক মনজুর, ডা. গোফরানুল হক প্রমুখ। তিনি এছাড়াও কাজির দেউড়ির রুবী মুদ্রণালয়, বাংলা হোটেল এবং আরো কোনো কোনো স্থানে পাঠচক্র স্থাপন করে তাত্ত্বিক আলোচনা করতেন মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, মঈনুদ্দিন খান বাদল।
পটিয়ায় জাসদ গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় আহমদ শরীফ মনীর একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার প্রতিবাদে ব্যাপক মিটিং-মিছিল হয় এবং পটিয়ার সর্বস্তরের নাগরিকদের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করা হলে প্রশাসন তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
জাসদের জন্মে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ঝড় উৎপন্ন হয়েছিলো এবং সেই ঝড়ের কবলে পড়ে গণতন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়ার পূর্বেই গণতন্ত্র হোঁচট খায়। জাসদ আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যায়, পরে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তারপরে অনেক ঘটনা-অঘটনের জন্ম দিয়ে জাসদ ভাঙ্গতে থাকে। প্রথমে জাসদ থেকে বাসদ, তারপর জাসদ রব গ্রুপ ও ইনু গ্রুপ এবং শেষে বাসদও ভেঙ্গে মাহবুব ও খালেকুজ্জামানে বিভক্ত হয়। ইতিমধ্যে জাসদের অসংখ্য নেতা-কর্মী পুলিশ, রক্ষীবাহিনী ও সেনাবাহিনীর হাতে মারা যায় (যেমন চট্টগ্রামে আবু তাহের খান খসরু মারা যায়), কারাপ্রকোষ্ঠে ধুঁকে ধুঁকে অনেকের জীবন ক্ষয়ে যায়। কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন দেন। কাজী আরিফ আহমদ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে তাদের গ্রুপ বলে যে জাসদটা চিহ্নিত ছিলো, আহমদ শরীফ মনীর সে পর্যন্ত জাসদ কাজী আরেফ আহমদকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন, সে কারণে হয়তো জাসদ (ইনু) করেছেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেন। তাঁর ইউনিয়ন জিরিতে খলিল-মীর কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে কলেজটিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। জীবনের শেষদিকে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
অসুস্থ হয়ে আহমদ শরীফ মনীর দীর্ঘদিন থেকে ঘরবন্দী হয়ে আছেন। তিনি হাটহাজারীর একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিদূষী কন্যা এবং হাটহাজারীর কলেজের প্রথিতযশা অধ্যক্ষ আ. ম. ম. ওবায়দুল্লাহ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চিফ মেডিক্যাল অফিসার ডা. শফি উল্লাহর ভাগ্নী অধ্যাপক দিলদার বেগমকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করেন। অধ্যাপক দিলদার বেগম হাটহাজারী কলেজে বাঙলা বিভাগে অধ্যাপনা করতেন, সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন। সুখী দাম্পত্য জীবনে তাঁরা দুটি কন্যা সন্তান লাভ করেছেন। দু’কন্যাই চিকিৎসক। জ্যেষ্ঠ কন্যা ডা. সানজিদা আফরিন (হৃদি), কনিষ্ঠ কন্যা ডা. সামিয়া আফরিন (সেঁজুতি)।

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

জান আলীকে নিয়ে মকবুলের কবিতা : তক দে মিয়া বকশিস দিবা আসলত্তুন হানি

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পথিকৃৎ শিল্পপতি এ কে খানের পিতামহ জান আলী খান চৌধুরী ১৮ ও ১৯ একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার ও সমাজপতি ছিলেন। আঠার শতকে

বিস্তারিত »

ভালো মানুষের জন্য খারাপ সময়ে একজন ভালো মানুষের প্রস্থান

জীবন থেকে ছুটি নিলেন মোবারক ভাই। মোবারক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে আমার মধ্য নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন এটা সত্য

বিস্তারিত »

বাঁশখালীর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক সুভাষ আচার্য্য

ভারতে না গিয়ে যাঁরা গ্রামে অবস্থান করে বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুভাষ আচার্য্য অন্যতম। তিনি সুলতান উল কবির চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করতেন এবং

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা চলে গেছেন, হারিছই আছেন একা

চট্টগ্রাম শহরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা চলে যাচ্ছেন। সাতজন ছিলেন তাঁরা, পাঁচজন ইতিমধ্যে তাঁদের প্রভুর ডাক পেয়ে এ গ্রহ ছেড়ে চলে গেছেন প্রভুর সন্নিধানে।

বিস্তারিত »

আওয়ামী লীগ, বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণ ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাথা

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৩ বছরের অবিরাম সংগ্রাম এবং অবশেষে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকেই

বিস্তারিত »

সুলতান কুসুমপুরী ও তাঁর কোম্পানি কমান্ডার হাবিলদার আবু’র মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৩জন এমপি সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধে তাদের গ্রæপকে কমান্ড করেন। এই ১৩ জন এমপি

বিস্তারিত »
প্রদ্যোৎ কুমার পাল

৭১-এর দুরন্ত গেরিলা প্রদ্যোৎ কুমার পাল

প্রদ্যোৎ কুমার একজন অসম সাহসী বীরের নাম। মুক্তিযুদ্ধে এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা দক্ষিণ চট্টগ্রামের রণাঙ্গণ মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর অসীম সাহস ও পরাক্রম দিয়ে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চারটি

বিস্তারিত »

দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ক্যান্টনমেন্ট বরকল, শাহজাহান ইসলামাবাদী জিওসি

মুক্তিযুদ্ধের এক কিংবদন্তী শাহজাহান ইসলামাবাদী। দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের তিনিই ছিলেন প্রধান নায়ক। কিংবা এভাবেও বলা যায়, তাঁকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে উঠেছিল। তাঁর

বিস্তারিত »