রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৬ আশ্বিন, ১৪৩২, ২৮ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭

ত্রিশের যুববিদ্রোহে শ্বেতাঙ্গদের জাহাজে চড়ে সমুদ্রে পলায়নের অজানা কাহিনি

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ, যা সিপাহী বিদ্রোহ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত, সেই বিদ্রোহে চট্টগ্রামের শ্বেতাঙ্গ নাগরিকেরা ভয়ে প্রাণ রক্ষার জন্য সমুদ্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিহাসে এটুকু তথ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু তারা কিভাবে পালিয়েছিলেন, কার জাহাজে করে পালিয়েছিলেন এবং জাহাজ কোথায় ছিল ু এটা কারো জানা ছিল না। আমি দীর্ঘদিন অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পেরেছিলাম ু চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার একজন জাহাজ ব্যবসায়ী আবদুল মালুমের জাহাজে করে শ্বেতাঙ্গরা পলায়ন করেছিলেন। আবদুল মালুমের জাহাজ ছিল কর্ণফুলীতে, তাঁর জাহাজে চড়িয়ে তিনি শ্বেতাঙ্গদের সমুদ্রে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তখনও কর্ণফুলিতে জেটি নির্মিত হয়নি, পোর্ট কমিশনার্সও গঠিত হয়নি। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন জেটি ছিল; যেমন-বাংলা বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা আমির হোসেন দোভাষের ‘চানবালি ঘাট’ নামে একটি জেটি ছিল।
ব্রিটিশদের চরম বিপদের সময় তাদের জীবন রক্ষার জন্য সাহায্য করায় তারা আবদুল মালুমকে ‘ইনাম’ দিয়েছিলেন। সেই ইনাম কি ছিল, তা আমি ‘দৈনিক আজাদী’তে লিখিত আমার নিবন্ধে প্রকাশ করেছিলাম, যারা এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান, তারা দৈনিক আজাদীর কপি সংগ্রহ করে পড়লেই সব তাঁদের জানা হয়ে যাবে।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মত ঘটনা ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দেও ঘটেছিল। সেবার মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, চট্টগ্রাম চারদিন (১৮-২২ এপ্রিল, ১৯৩০) স্বাধীন ছিল। সেই বিদ্রোহ কালেও চট্টগ্রামের ব্রিটিশ নাগরিকেরা জাহাজে করে সমুদ্রে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। এবারও চট্টগ্রামের একজন জাহাজ ব্যবসায়ী তাঁর জাহাজ দিয়ে ব্রিটিশদের সমুদ্রে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
এই জাহাজ ব্যবসায়ী হলেন চট্টগ্রাম মহানগরের মনসুরাবাদ এলাকার কিংবদন্তী ব্যবসায়ী খান সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া। তিনি একজন প্রবাদপ্রতীম জাহাজ ব্যবসায়ী ও স্টিভিডোর ছিলেন। তিনি দানবীর হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। সারা চট্টগ্রামে তাঁর বদান্যতার অনেক প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
খান সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া ঊনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে চট্টগ্রামের একজন নেতৃস্থানীয় ধনী ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী সম্ভ্রান্ত পুরুষ ছিলেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের মনসুরাবাদে তাঁর জন্ম। পিতা উজির আলী। তাঁর পুর্বপুরুষ ছিলেন ইয়েমেনের বাসিন্দা। পিতামহ মানউল্লাহ ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।
১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে মো. মানউল্লাহ ইয়েমেনের রাজধানী এডেন নগরীতে এক ইয়েমেনী সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে মানউল্লাহ ২৪ বছর বয়সে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থাকাকালে মানউল্লাহ ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে এক ইয়েমেনী মহিলাকে বিয়ে করেন।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে মানউল্লাহ সেনাবাহিনী হতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাধারণ জীবন যাপন শুরু করেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন মানউল্লাহর পরিবারে প্রথম সন্তানের আগমন ঘটে। পুত্র সন্তানের নামকরণ করেন মো. নাদের আলী। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন মানউল্লাহ দ্বিতীয় পুত্র সন্তানের পিতা হন। তার নাম রাখেন মো. উজির আলী।
দু’ভাই ইয়েমেনে বড় হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারের অধীনে নাগরিক হিসেবে মালবাহী জাহাজে চাকরিতে যোগদান করেন।
১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ইয়েমেনের রাজধানী এডেন বন্দর থেকে জাহাজে করে মালামাল নিয়ে মো. নাদের আলী ও উজির আলী রেঙ্গুনে আসেন। কিছুদিন পর সেখান থেকে ভ্রাতৃদ্বয় চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রাম বন্দরে আগমনের পর তারা তীরে ওঠে নতুন স্থান দেখতে থাকেন। চট্টগ্রাম তখন ছোট শহর, তবুও ঘুরে ফিরে দেখতে গিয়ে চট্টগ্রামের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য তাদের ভাল লেগে যায়। তারা এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। নাদের আলী ও উজির আলী মনসুরাবাদে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করলেন। এটা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।
কিছুদিন পর দু’ভাই দু’দিকে ছড়িয়ে পড়েন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে উজির আলী আস্তে আস্তে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চট্টগ্রামে জাহাজের মালামাল উঠানো নামানোর কাজ শুরু করেন তিনি।
১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে নাদের আলী ও উজির আলীর খবর পেয়ে তাদের পিতা মানউল্লাহ সস্ত্রীক চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেন। মানউল্লাহ ও তার স্ত্রী দ্বিতীয় পুত্র উজির আলীর গৃহে থাকা শুরু করেন। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ৯৫ বৎসর বছর মো. মানউল্লাহ পরলোকগমন করেন। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রীও ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর উজির আলী চট্টগ্রামের (বৌ বাজার) এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করেন। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে উজির আলী ব্রিটিশ সরকারের অধীনে পুরোদমে জাহাজের কাজ শুরু করে দেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে তার ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটে। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট উজির আলীর সংসারে প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সন্তানের নাম রাখা হয় মো. আবদুল হাকিম। উজির আলী মেসার্স ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কো. লি. এবং মেসার্স বার্মা অয়েল কোং লি. নামে দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেন—তাঁর হাতে প্রচুর টাকা-পয়সা আসতে লাগলো। তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি খরিদ করেন।
উজির আলীর পুত্র আবদুল হাকিম মিঞা চট্টগ্রাম জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও বুড়া মাদ্রাসা বা মোহছেনিয়া মাদ্রাসা থেকে উলা পাস করেন। তাঁর বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হলে, ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে উজির আলী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পিতার ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করেন। তিনি পিতার সমস্ত কাজ কারবার নিজের হাতে নেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলির নাম পরিবর্তন করে ‘আবদুল হাকিম সন্স এন্ড কোং’ করেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ব্রিটিশ স্টিম নেভিগেশন ও বার্মা অয়েল কোম্পানি লি.-এর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতার নীতি অবলম্বন করেন এবং বহু ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য আয়ত্ত করেন।
ব্রিটিশ সরকারের সাথে আবদুল হাকিম মিয়ার খুবই ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাঁর দুটি গাড়ি ছিলো-একটি গভর্নর চট্টগ্রাম আসলে তাঁর ব্যবহারের জন্য, আর একটি তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য। আবদুল হাকিম মিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে রাণী ভিক্টোরিয়ার পুত্র পঞ্চম জর্জ ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘খান সাহেব’ উপাধি প্রদান করেন। আবদুল হাকিম মিয়ায় সাথে সাক্ষাতের জন্য বাংলার গভর্নর ‘লর্ড বেবরু-কে হুকুম প্রদান করেন পঞ্চম জর্জ।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেবরু নিজে এসে জুবিলী রোডস্থ মিয়া হাউজে (বর্তমানে স্টেডিয়ামের দক্ষিণ-পূর্বকোণের দক্ষিণ দিকে অনুচ্চ টিলার ওপর ন্যাভাল কমান্ডারের বাসভবন এসে আবদুল হাকিম মিয়ার হাতে ‘খান সাহেব’ খেতাব তুলে দেন।
আবদুল হাকিম মিয়া বিআই এবং পিএনও’র স্টিভিডোর এবং বার্মা ইস্টার্নের হ্যান্ডলিং কন্ট্রাক্টর ছিলেন। তাঁর ফার্মের নাম ‘খান সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া স্টিভিডোরিং ফার্ম’ ও ‘খান সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া হ্যান্ডলিং কন্ট্রাক্টর’। এভাবে নানামুখি ব্যবসা-বাণিজ্য করে তিনি প্রচুর টাকা-পয়সা উপার্জন করেন। সেকালের চট্টগ্রামের তিনি অন্যতম শীর্ষ ধনী ছিলেন। তাঁর ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ব্রিটিশের দুটি অস্ত্রাগার দখল করে, টেলিগ্রাফের তার কেটে এবং রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে চট্টগ্রামকে যখন চারদিনের জন্য স্বাধীন করে ফেলেছিলেন, তখন দু’চারজন ছাড়া চট্টগ্রামের সকল শ্বেতাঙ্গ নারী পুরুষ বন্দরে সমবেত হয়ে যে জাহাজে চড়ে বর্হিনোঙ্গরে পালিয়ে গিয়েছিলো, সে জাহাজ তাদের পিতার। তারা ঠিক স্পষ্ট করে এমন কথা বলেননি, কিন্তু তারা আভাসে ইঙ্গিতে যা বলতে চেয়েছেন তার অর্থ এটাই দাঁড়ায়।
তাঁর বাসভবনের সম্মুখে ওয়াক্ফ এস্টেটের যে অফিসটি আছে তাতে বেশ কয়েকবারই আমি গিয়েছি। সেই অফিসে আমি এমন কথাও শুনেছি যে, মিয়া ব্রিটিশের দালালি করায় তাঁর এক পুত্র, যিনি সেন্ট প্লাসিড স্কুলে অধ্যয়ন করতেন, স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে কোন একদিন বিপ্লবীরা তাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছিলো। এই পুত্র আবদুল হাকিম মিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র, নাম আবু বকর। যুব বিদ্রোহের ওপর অনেক বই বের হয়েছে। কিন্তু কোথাও এঘটনার উল্লেখ নেই। কোন নিরপেক্ষ উৎস থেকেও এ ঘটনার সত্যতা আমি যাচাই করতে পারিনি। এমনও হতে পারে আমি যা বললাম তা হয়তো আদৌ সত্য নয়। বেসামরিক শ্বেতাঙ্গ নরনারীরা যে জাহাজে করে সমুদ্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন, দু’টি বই থেকে আমি তার তথ্য সংগ্রহ করেছি। একটি বই হচ্ছে – Do & Die – The Chittagong Uprising 1930-34 (First Published by Penguin Books India in 1999)- লেখক মানিনী চ্যাটার্জি। তিনি বিপ্লবী কল্পনা দত্তের (যোশী) পুত্র চাঁদ যোশীর স্ত্রী এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন লেখক ও সাংবাদিক। বইয়ে (পৃষ্ঠা ১১৯, ১২০) তিনি লিখেছেন ু All through the night of 18/19 April, women and children were being taken to the ‘S.S Chakdara’, a ship at the jetties some two miles from town. They would remain there for several nights in a row while the men were ‘herded into the Club’ lest the raiders return to attack the town. A.R Leishman, chairman of the Port Trust, Chittagong and president of the Chittagong Chamber of Commerce, complained to his bosses in Calcutta and Simla on 24 April of the terribly ‘unpleasant time’ faced by the residents. There were ‘no services on Easter Day’ and no relief from the continuing panic.
অন্য বইটির লেখক মানসী ভট্টাচার্য, তিনি ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন ভূতপূর্ব চিকিৎসক। তাঁর বইয়ের নাম ‘Chittagong – Summer of 1930 (First published in India 2012 by Harper Collins Publishers India, a joint venture with The India Today Group). তাঁর বইতে (পৃষ্ঠা ২০২, ২০৩) উক্ত ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় নিম্নরূপ:
That they had got away was nothing short of a miracle. Abandoning their cars and wounded colleagues they ran like never before. The white man’s life was at risk… their beautiful Chittagong had turned against them. The families would have to be moved and reinforcements brought in.
A train had rushed them to the port. The steamship ‘Halizones’ had docked for the night. Wilkinson hurried on board to send off the telegrams.
এ হচ্ছে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট এইচ আর উইলকিনসনের কথা, যা’ তাঁর জবানিতে বসিয়েছেন মানসী তাঁর বইতে।
দেখা যাচ্ছে, দু’টি বইয়ে উল্লেখিত জাহাজের নাম দু’রকম; মানিনীর বইতে জাহাজের নাম ‘S S Chakdara’, আর মানসীর বইতে জাহাজের নাম ‘Halizones’. অপরদিকে আবদুল হাকিম মিয়ার যে দু’টি জাহাজ ছিল, তার কোনটির সঙ্গে এই নামগুলির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মিয়ার জাহাজের নাম ‘দারা’ ও ‘সুজা’।
যাই হোক, তবে এটা মানতেই হবে, আবদুল হাকিম মিয়া দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বৈধ উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেই ধনী হয়েছিলেন। ইংরেজ প্রভুদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি যদি তিনি অবলম্বন করেই থাকেন, তাতে হয়তো লাভ এটাই হয়েছিলো যে, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে উটকো ঝামেলা তাকে পোহাতে হয়নি। হয়তো শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্য পেয়ে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক সুবিধা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। পিতার আমল থেকেই তাদের পরিবার আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল। তাঁর পিতাও ভাল ব্যবসায়ী ছিলেন। মিয়া এই ব্যবসাকে বহুগুণ বর্ধিত করেছিলেন। আবদুল হাকিম মিয়া লাখ টাকার মালিক হলে সেকালের প্রথা অনুযায়ী তাঁর বাড়ির সামনে একটি বাতি ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ তাঁর বাড়ির সামনে এ ধরনের বাতি ঝুলিয়ে দিলে সবাই ধরে নিত তিনি লাখপতি হয়েছেন। ঐ বাতিটাকে বলা হত ‘লাখের বাতি’।
ব্রিটিশের দালালি করেই যদি আবদুল হাকিম মিয়া ভাগ্য গড়ে থাকেন, তাহলে এটাও দেখতে হবে যে, তিনি যুববিদ্রোহের পর মাত্র ৪ বছর বেঁচেছিলেন। ব্রিটিশ শাসকদের সহযোগিতা করার পুরস্কার হিসেবে তিনি যদি তাদের আনুকূল্য পেয়েই থাকেন, তার ফল পেতে সময়ের দরকার ছিলো। মিয়া সেই সময় পাননি। তাহলে এটাই সত্য যে মিয়া আগে থেকেই বড়লোক ছিলেন, ব্রিটিশের সহযোগিতা নিয়ে তিনি বড়লোক হননি।
বিপ্লবীদের বিদ্রোহের কথা তিনি জানতে না; সংশ্লিষ্ট বিপ্লবীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাড়া কেউই জানতো না যে, ১৮ এপ্রিল আর্মারি রেইড হবে। সাদা চামড়ার সাহেবরা জাহাজে চড়ে শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন, এটা মিয়ার জানার কথা নয়। তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে এবং সম্ভবত মানবিক কারণে তিনি নর-নারী ও শিশুদের বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন।
আবদুল হাকিম মিয়া শিক্ষানুরাগী ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন। তাঁর ছেলেরা তাঁর নামে একটি হাইস্কুল তৈরি করেছেন, যার উদ্যোক্তা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে উপযুক্ত পুত্র ইসলাম মিয়া। তিনি রেফারি ইসলাম মিয়া নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন ডবলমুরিং, সন্দ্বীপ থেকে।
খান সাহেব আবদুল হাকিম মিয়া ৯ পুত্র ও ৩ কন্যা রেখে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। চট্টগ্রাম শহরের ডবলমুরিং থানা, পাহাড়তলী থানা, কোতোয়ালী থানা, পাঁচলাইশ ও বন্দর থানা এলাকায় আবদুল হাকিম মিয়ার বহু স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। মনসুরাবাদে তাঁর বাসভবন ও বিশাল ভূ-সম্পত্তি তিনি ওয়ালেদী ওয়াকফ্ করে যান।
খান সাহেব আবদুল হাকিম মিয়ার ৯ পুত্রের নাম : আবু বকর, সেকান্দর মিয়া, ছালেহ আহমদ, ইসহাক, মিয়া, ইসলাম মিয়া, শফি মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, ইউনুস মিয়া ও ইউসুফ মিয়া।
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

সাংবাদিকদের সমস্যা নিয়ে সংবাদপত্র মালিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকে যে সংগঠনটি জন্ম লাভ করেছিলো ষাটের দশকে, তার নাম সিইউজে বা চিটাগাং

বিস্তারিত »

আহমদ শরীফ মনীর : রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

স্বাধীনতা-উত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে; সেই দলের নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এটা বোধ হয় কারো অজানা

বিস্তারিত »

জান আলীকে নিয়ে মকবুলের কবিতা : তক দে মিয়া বকশিস দিবা আসলত্তুন হানি

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পথিকৃৎ শিল্পপতি এ কে খানের পিতামহ জান আলী খান চৌধুরী ১৮ ও ১৯ একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার ও সমাজপতি ছিলেন। আঠার শতকে

বিস্তারিত »

ভালো মানুষের জন্য খারাপ সময়ে একজন ভালো মানুষের প্রস্থান

জীবন থেকে ছুটি নিলেন মোবারক ভাই। মোবারক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে আমার মধ্য নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন এটা সত্য

বিস্তারিত »

বাঁশখালীর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক সুভাষ আচার্য্য

ভারতে না গিয়ে যাঁরা গ্রামে অবস্থান করে বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুভাষ আচার্য্য অন্যতম। তিনি সুলতান উল কবির চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করতেন এবং

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা চলে গেছেন, হারিছই আছেন একা

চট্টগ্রাম শহরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা চলে যাচ্ছেন। সাতজন ছিলেন তাঁরা, পাঁচজন ইতিমধ্যে তাঁদের প্রভুর ডাক পেয়ে এ গ্রহ ছেড়ে চলে গেছেন প্রভুর সন্নিধানে।

বিস্তারিত »

আওয়ামী লীগ, বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণ ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাথা

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৩ বছরের অবিরাম সংগ্রাম এবং অবশেষে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকেই

বিস্তারিত »

সুলতান কুসুমপুরী ও তাঁর কোম্পানি কমান্ডার হাবিলদার আবু’র মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৩জন এমপি সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধে তাদের গ্রæপকে কমান্ড করেন। এই ১৩ জন এমপি

বিস্তারিত »