রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনি একজন Knowledgeable মানুষ ছিলেন। রাজনীতিকের বুদ্ধিজীবী হতে বাধা নেই। রাজনীতিওত এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা। যদিও বহুদিন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তির পরিবর্তে পেশীশক্তিই রাজত্ব করছে। কায়সার ভাই এই রাজনীতিতে মিসফিট ছিলেন।
তিনি ইন্টেলেকচুয়াল রাজনীতিক ছিলেন। আমার মাঝে মাঝে এমন ধারণা হয়, তিনি ভুলে রাজনীতির অঙ্গনে ঢুকে পড়েছিলেন। চিন্তায়, মননে তিনি ছিলেন ভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দা। তাঁর ছিলো কবিস্বভাব (কবি তো ছিলেনই), আত্মনিমগ্ন, স্বপ্নচারি মানুষ ছিলেন। চিন্তাচর্চাই ছিলো তাঁর স্বক্ষেত্র।
আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম দল, বর্তমানে শাসক দল। নেতার অভাব নেই এ দলে, ভবিষ্যতেও হবে না। কিন্তু আতাউর রহমান কায়সারের মতো একজন পরিশীলিত, প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব বোধকরি আর সহসা হবে না। এটা আওয়ামী লীগের ক্ষতি। চট্টগ্রামের ক্ষতি একজন ভালো মানুষ চলে গেলেন।
আরো বড় ক্ষতি হয়ে গেলো দেশের। জাতীয় জীবনে ক্রমশ বিরল হয়ে আসা সৎ মানুষেরই এক প্রজাতি ছিলেন কায়সার ভাই। তাঁকেই বলা যায় সাদা মনের মানুষ। আমাদের সাবেক সাহেব প্রভুদের ‘খান বাহাদুর’, ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব বিতরণের ন্যায় নিকট অতীতে ফৌজি সমর্থনপুষ্ট এক তদারকি সরকারের জমানায় উপর্যুক্ত বিশেষণের ছড়াছড়ি প্রয়োগ কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ না হলে আতাউর রহমান কায়সারকে আমি ‘সাদা মনের মানুষ’ই বলতাম।
আতাউর রহমান কায়সারের কাছে রাজনীতি আত্মোন্নতির মাধ্যম ছিলো না। রাজনীতিকে তিনি জনসেবার আদর্শ ও জাতীয় উন্নয়নের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রাজনীতিক দু’জাতের হয়ে থাকেন। একদল রাজনীতি করেন মস্তিষ্ক দিয়ে, এটি রাজনীতির বুদ্ধিবাদী ধারা। বুদ্ধি ও মেধার চর্চা করেন বলে এই জাতের রাজনীতিকরা খুব একটা জনপ্রিয় হন না। আবেগপূর্ণ, উত্তেজক বক্তৃতায় যারা মাঠ মাতিয়ে শ্রোতা-দর্শককে মোহাবিষ্ট করে রেখে পিনপতন নীরবতার মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্গল অগ্নি উদগীরণ করতে পারেন, তাঁদের জাত ভিন্ন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সংগঠনী-শক্তি ও বাগ্মিতা এই ত্রিবিধ গুণের সমাহারে উদ্ভাসিত বিরল নেতৃত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চট্টগ্রামের শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত, ফজলুল কাদের চৌধুরী, এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী সব্যসাচী নেতা ছিলেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী পরে জনমতের তোয়াক্কা না করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বিতর্কিত হয়ে যান। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমদ, চট্টগ্রামের যাত্রামোহন সেন, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শাহ বদিউল আলম, মহিম চন্দ্র দাশ, নূর আহমদ চেয়ারম্যান, ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী, ব্যারিস্টার ড. ছানাউল্লাহ, বহরদারহাটের বহরদার পরিবারের গৌরব অধ্যাপক সুলতানুল আলম চৌধুরী, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, এ কে খান, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, গান্ধী-খ্যাত মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, আবুল কাশেম সাবজজ, এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সুধাংশু বিমল দত্ত, অধ্যাপক ননী দত্ত, চৌধুরী হারুনুর রশিদ-রা রাজনীতির বুদ্ধিবাদী ধারার উজ্জ্বল প্রতিনিধি। আতাউর রহমান কায়সার সম্ভবত এই জাতের শেষতম রাজনীতিক ছিলেন।
রাজনীতিক, সমাজসেবী, কবি, শিল্প-সংস্কৃতির সমঝদার আতাউর রহমান খান কায়সার চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আনোয়ারার জমিদার এয়ার আলী খান বঙ্গীয় আইন পরিষদ ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর মাতা- গুলশান আরা বেগম। মাতামহ- খান বাহাদুর আবদুস সাত্তার-চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান, এমএলএ, ব্রিটিশ রাজত্বের চট্টগ্রামের সরকারি উকিল।
আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৫৫ সালে সেন্ট প্ল্যাসিড্স স্কুল থেকে জুনিয়র ক্যাম্ব্রিজ পাস করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন সর্বাধিক ভোটে। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি মেধাবৃত্তি পান। এ সময় তিনি ছাত্রশক্তিতে যোগ দেন এবং কার্যকরী পরিষদের কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হন এবং এতে নেতৃত্ব দেন। এ বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৩ সালে এমএ ডিগ্র্রি লাভ করেন। ছাত্র রাজনীতি ছাড়াও তিনি ছাত্রাবস্থায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।
পড়াশোনা শেষ করে আতাউর রহমান খান কায়সার পারিবারিক ব্যবসায় জড়িত হন। পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। তিনি সাবেক চকবাজার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম মহানগর থেকে সম্মিলিত বিরোধী দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলির সদস্য নির্বাচিত হন।
আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রবাহে যুক্ত হন ১৯৬৮ সালে। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে যান। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আনোয়ারা, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। নির্বাচন পরবর্তীকালে বাঙালিদের অধিকার আদায়ে চট্টগ্রামে গণআন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত মেজর জিয়ার (পরবর্তীকালে জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) ভাষণে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে জিয়া একই দিন দ্বিতীয়বার সংশোধিত ঘোষণা পাঠ করেন। এ সংশোধিত ঘোষণাটি এ. কে. খানকে দিয়ে লেখানো এবং মেজর জিয়াকে দিয়ে পড়াতে যারা উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আতাউর রহমান কায়সার। তিনি ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুজিব নগর সরকার কর্তৃক এক নম্বর সেক্টরে রাজনৈতিক সমন্বয়কারী হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৭২ সলে থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫-এর আগস্ট থেকে ১৯৮৭-এর আগস্টের মধ্যে সামরিক সরকারের হাতে দু’বার গ্রেফতার হন এবং এগার মাস কারাভোগ করেন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক নির্বাচিত হন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ওপর পুলিশের নির্বিচার ও জঘন্য হামলায় অনেকের সঙ্গে তিনিও আহত হন। চট্টগ্রাম গণহত্যা নামে চিহ্নিত এ ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। ১৯৯১-১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে এনডিআই ওয়াশিংটনের উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনার/কর্মশালায় যোগদান করেন। তিনি ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক পদে পুনঃনির্বচিত হন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থানরত পার্বত্য চট্টগ্রামের শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের নিমিত্তে চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও ১৯৯২ সালে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং ঐ সময়ের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া মূল্যায়ন ও চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত সহায়তাকারী অর্থনীতিবিদের প্যানেলের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার পর বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিকল্প বাজেট উপস্থাপনের রেওয়াজ চালু করেছিলো, আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক জনাব আতাউর রহমান কায়সার উক্ত বিকল্প বাজেট সাংবাদিকদের সামনে পেশ করতেন।
আতাউর রহমান খান কায়সার বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে ঙওঝঈঅ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকল্পে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে জাপান সফর করেন; গণচিনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে চিনের সঙ্গে হংকং-এর পুনরেকত্রীকরণ উৎসবে যোগদান উপলক্ষে ১৯৯৭ সালের জুন-জুলাইতে চিন সফর করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে সরকারি ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে গমন করেন।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সুশীল সমাজ বহুলআলোচিত একটি প্রপঞ্চ। রাজনীতি কালো টাকা ও পেশীশক্তি কবলিত হওয়ায় সুশাসন এবং প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে ওয়াচডগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম। রাজনীতির বিপথগামিতায় সুশীল সমাজের চমৎকার উত্থানের পটভূমিতে সম্মানজনক ব্যতিক্রম হিসেবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেন আতাউর রহমান কায়সার। দেশ শাসনের জন্য যারা রাজনীতি করেন, তাদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বশেষ অগ্রগতি ও গবেষণা, প্রকৌশল-প্রযুক্তির উৎকর্ষের খোঁজখবর রাখতে হয়।
আতাউর রহমান কায়সার সে খোঁজ রাখতেন। যদিও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের বাস্তবতা বিপরীত চিত্রই উপস্থাপন করে। স্বার্থান্ধ ভোগবাদী রাজনীতির ঊষর মরুতে জ্ঞানবৃক্ষ শুকিয়ে কাষ্টখণ্ডে পরিণত হয়।
এই নিষ্প্রাণ, নির্জ্ঞান রাজনীতির মাঝে বিচরণ করেও আতাউর রহমান কায়সার নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন জ্ঞানস্পৃহা। বই ছিলো তাঁর নিত্যসঙ্গী। কবিতা লিখতেন আর ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, কীটসের ইংরেজি কবিতার পঙক্তি আউড়ে যেতেন অনর্গল। মুসলিম হল প্রাঙ্গণে, ডিসি হিলে আমাদের বইমেলাকে প্রাণবন্ত করে রাখতেন তাঁর প্রাত্যহিক সহৃদয় উপস্থিতি দিয়ে। সঙ্গে বখতেয়ার ভাই। সন্ধ্যা উতরে রাত যতই গভীর হতো, কোনো এক বইয়ের স্টলে কিংবা একুশ মেলার অফিসে কায়সার ভাইকে ঘিরে জমে উঠতো নগরের লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের জম্পেশ আড্ডা। তাঁর বন্ধু সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, সাবেক এমপি ভাষা সৈনিক প্রয়াত আবদুল্লাহ আল হারুন, প্রয়াত ভাষাসৈনিক সাইফুদ্দিন খান, ও এডভোকেট এ কে এম এমদাদুল ইসলাম প্রয়াত, আবৃত্তিকার ও নাট্যাভিনেতা মাহবুব হাসান প্রয়াত, শিক্ষাবিদ ড.আবু ইউসুফ (উপাচার্য,চবি), অধ্যাপক আবদুল মান্নান (সাবেক উপাচার্য,চবি), অধ্যক্ষ রীতা দত্ত, অধ্যাপক বাদল বরণ বড়ুয়া, অধ্যাপক শিশির বড়ুয়া, ড. গাজী সালেহউদ্দিন, ড. ইফতেখারউদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক হেলাল নিজামী, ড. ওবায়দুল করিম ও অধ্যাপক ঢালী আল মামুন, শিক্ষাবিদ সাহিত্যিক ড. মনিরুজ্জামান, প্রয়াত শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান, ড. শামসুল আলম সাঈদ, প্রয়াত চৌধুরী জহুরুল হক, ড. মাহবুবুল হক, প্রয়াত হেনা ইসলাম, ড. মোহীত উল আলম ও ড. মহীবুল আজিজ, নারী নেত্রী শহীদ জায়া মুশতারী শফি, রাজনীতিক শরদিন্দু দস্তিদার, মৌলানা আহমেদুর রহমান আজমী, পংকজ ভট্টাচার্য, প্রয়াত এস এম জামালউদ্দিন, সাবেক এমপি কফিল উদ্দিন, সাবেক এমএনএ আবু ছালেহ, সাবেক এমপি প্রয়াত মোখতার আহমদ, প্রয়াত আবদুল হাই, এ এম এম শহীদুল্লাহ ও কাজী শাহজাহান, এডভোকেট আনোয়ারুল কবির, আহসানউল্লাহ চৌধুরী, এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, সাবেক এমপি নুরুল আলম চৌধুরী, ডা. আফসারুল আমীন এমপি (সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী), আশরাফ খান, ইদ্রিস আলম, নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু, বদন দীদারি, শাহ বদিউল আলম, কাজী ইনামুল হক দানু, প্রফুল্ল রঞ্জন সিনহা, নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, আবু তাহের মাসুদ, এডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম, এডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত, মোসলেম উদ্দিন আহমদ, কমরেড শাহ আলম, ডা. মাহফুজুর রহমান, এম এ সালাম, নুরুল আলম মন্টু, তপন দত্ত, মাহবুব মিন্টু, আবুল হাশেম, ইব্রাহিম হোসেন বাবুল ও কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন, পেশাজীবী নেতা ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, নারীনেত্রী নুরজাহান খান, সাংবাদিক ওবায়দুল হক, অরুণ দাশগুপ্ত, কাজী জাফরুল ইসলাম, প্রয়াত আখতার উন নবী ও মুহাম্মদ ইদ্রিস, সিদ্দিক আহমদ, সুভাষ দে ও আবু সুফিয়ান, প্রয়াত কবি শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, কবি আবুল মোমেন, খুরশিদ আনোয়ার, প্রয়াত সুনীল নাথ, স্বপন দত্ত, সাথী দাশ, মৃদুল গুহ, আহমেদ খালেদ কায়সার, আশীষ সেন, কমলেশ দাশগুপ্ত, ফাউজুল কবির, আনন্দমোহন রক্ষিত, অভীক ওসমান, কবি-শিল্পী খালিদ আহসান, এজাজ ইউসুফী, হাাফিজ রশিদ খান, ওমর কায়সার, বিশ্বজিত চৌধুরী, ছড়াশিল্পী নুর মোহাম্মদ রফিক, রাশেদ রউফ, এমরান চৌধুরী, রহীম শাহ, সুজন বড়ুয়া, সংগীত শিল্পী প্রয়াত ওস্তাদ জগদানন্দ বড়ুয়া, নীরদ বরণ বড়ুয়া ও অমিতাভ বড়ুয়া, ওস্তাদ মনোরঞ্জন বড়ুয়া, মিহির লালা, মিহির নন্দী, নির্মলেন্দু চৌধুরী ও পরেশ চন্দ্র কুরী, প্রয়াত সংগীতশিল্পী শেফালী ঘোষ ও প্রবাল চৌধুরী, শিল্পী মৃণাল ভট্টাচার্য, দিলীপ দাশ, অশোক সেনগুপ্ত, শীলা মোমেন, শাক্যমিত্র বড়ুয়া, মানসপাল চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম আজাদ, দীপেন চৌধুরী, আইরিন সাহা, চন্দ্রশেখর দত্ত, প্রমোদ দত্ত, আবদুর রহিম, এমদাদুল ইসলাম, মালবিকা দাশ, অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত ও শিমুল শীল, গীতিকার ও সুরকার আবদুল গফুর হালি ও সৈয়দ মহিউদ্দিন, আবৃত্তিশিল্পী রণজিৎ রক্ষিত, অঞ্চল চৌধুরী, পঞ্চানন চৌধুরী,- এমনি আরো জানা-অজানা কত শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর সায়াহ্নিক মিলনমেলা হয়ে উঠতো একুশে মেলা, যার মধ্যমণি হিসেবে শোভিত হতেন আতাউর রহমান কায়সার।
আতাউর রহমান কায়সারের মৃত্যুতে একজন জ্ঞানী ও ভদ্রলোক রাজনীতিবিদ, সজ্জন, অভিজাত রুচির বিদগ্ধ ও পরিশীলিত মানুষ, একজন কবি ও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক-সমঝদার চলে গেলেন— এই অপরিমেয় ক্ষতির শোক ও বেদনা অনেকদিন বহন করতে হবে জাতিকে।
তিনি ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ পদে আসীন ছিলেন।
আতাউর রহমান খান কায়সার বরাবরই খেলাধুলায় উৎসাহী ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৫৬ ও ১৯৫৮ সালে কলেজ ক্রিকেট দলের সদস্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আন্তঃকলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৯-৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সিটি রোভারস ক্লাব, ইয়ং স্টার্স ক্লাব-এর পক্ষে চিটাগাং ক্রিকেট লীগে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সমিতির (বর্তমান চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা) পরিচালনা পর্ষদ-এর সদস্য ছিলেন; তিনি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে চিটাগাং রাইফেল ক্লাবের আজীবন সদস্য এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম আবাহনী ক্রীড়াচক্রের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
শিক্ষানুরাগী আতাউর রহমান খান কায়সার শিক্ষা বিস্তারেও ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি আনোয়ারা ডিগ্র্রি কলেজ ও মাহতা পাটনিকোটা হাই স্কুল (আনোয়ারা), রাজাখালী এয়ার আলী খান হাই স্কুল (চকরিয়া)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, টি.বি. এরশাদ আলী হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও চেয়ারম্যান, খাসখামা উচ্চ বিদ্যালয় ও চন্দনপুরাস্থ গুল-এজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে যুক্ত হন।
তিনি ১৯৭৯-৮০ সালে চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান; ১৯৯০-৯১ খ্রিস্টাব্দে রোটারি ক্লাব, চট্টগ্রাম-এর প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দে রোটারি জেলা গভর্নর-এর গ্রুপ প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি চিটাগাং ইনস্টিটিউট লিমিটেড (সিনিয়রস ক্লাব)-এর আজীবন সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আঞ্চলিক ত্রাণ কমিটি, চট্টগ্রাম-এর সমন্বয়কারি ছিলেন।
তিনি ভাটিয়ারি গল্ফ ও কান্ট্রি ক্লাব-এর সদস্য, চট্টগ্রাম ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের আজীবন সদস্য ও সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম শাখার আজীবন সদস্য ও উপদেষ্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী সমিতি-চট্টগ্রাম সম্মেলন শাখার সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৮৪-১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্টিমার এজেন্টস এসোসিয়েশন-এর নির্বাহি কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৮-৯২ সালে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনে বাংলাদেশ স্টিমার এজেন্টস এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ছিলেন।
আতাউর রহমান খান কায়সার একজন সাহিত্যসেবী ছিলেন। তিনি অবসরে কবিতা লিখতেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ‘চক্রবাক’ ও ‘মুখর অরণ্য’ শীর্ষক দু’টি কবিতা সংকলন যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেন, তাতে তাঁর নিজের লেখা বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। তিনি কিছু গানও রচনা করেছিলেন, অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী হরিপ্রসন্ন পালসহ অনেক বিখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে সেসব গান বহু জনসমাবেশে পরিবেশিত হয়েছে। তিনি একুশ মেলার উৎসাহী দর্শক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
২০১০ সালের ৯ অক্টোবর এই নন্দিত রাজনীতিবিদ লোকান্তরিত হন।