প্রদ্যোৎ কুমার একজন অসম সাহসী বীরের নাম। মুক্তিযুদ্ধে এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা দক্ষিণ চট্টগ্রামের রণাঙ্গণ মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর অসীম সাহস ও পরাক্রম দিয়ে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চারটি থানা পটিয়া, বোয়ালখালী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়ায় তিনি দাপটের সাথে একের পর এক অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বুকে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি যুদ্ধের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। অপারেশন করার জন্য সবসময় তাঁর হাত নিশপিশ করতো। ক্যাপ্টেন করিম, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, আ হ ম নাসির উদ্দিন ও সোলায়মান, এাদের অধীনে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন এবং যুদ্ধে যাবার জন্য তাঁদেরকে সবসময় অস্থির করে তুললেন।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ৩ জুন পটিয়া থানার মঠপাড়া গ্রামে প্রদ্যোৎ কুমার পালের জন্ম। তাঁর পিতা মৃত নিরেন্দ্র পাল, মাতা মৃত স্নেহলতা পাল। তাঁর পিতা পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বার্মায় ব্যবসা করতেন। সেখানে তাঁর দুটি দোকান ছিল, পরে বিক্রি করে চলে আসেন।
প্রদ্যোৎ কুমার পাল ছোটবেলায় মঠপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি মোজাফফরাবাদ এন জে হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীকালে পটিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। পটিয়া কলেজে পড়াশোনা করা অবস্থায় তিনি কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুল আলম। সে সময় পটিয়া থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুদ্দিন এবং সভাপতি ছিলেন চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ।
প্রদ্যোৎ পাল ১৯৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে কচুয়াই ও খরনা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সভাপতি ছিলেন মাহবুবুর রহমান চৌধুরী। পরবর্তীকালে প্রদ্যোৎ পাল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম সংগ্রাম কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া কলেজ ছাত্রলীগ নির্বাচনে প্রদ্যোৎ কুমার পাল ড্রামা সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। সেখানে প্রচুর মারামারি হয়েছিল। সিটি কলেজ থেকে ছাত্রনেতা সুলতানুল কবির চৌধুরী সেখানে গিয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন। প্রদ্যোৎ কুমার পাল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রদ্যোৎ পাল সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে যান। সেখানে বিএসএফ-এর বগাফা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিলো, সেখানে এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দেয়ার পর পটিয়ার করনখাইন নিবাসী অধ্যাপক শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে পটিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রæপ গঠন করা হয় এবং তাকেও সেই গ্রæপের সদস্য করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
প্রদ্যোৎ পাল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে চারটা থানা পটিয়া, বোয়ালখালী, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। এ চার থানায় তিনি বেশ কয়েকজন কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করেন। কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, সোলায়মান ও আ হ ম নাসির উদ্দিন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, প্রদ্যোৎ পাল সহ ৩২ জনের একটা গ্রæপ নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু অধ্যাপক শামসুল ইসলামের গ্রæপটি তেমন সুবিধা করতে পারেনি। প্রথমদিকে তারা নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করে এবং বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ করে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এরপর ক্যাপ্টেন করিম আসেন দক্ষিণ চট্টগ্রামে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তিনি ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারত থেকে দেশে প্রবেশ করেন। ক্যাপ্টেন করিম মে মাসের শেষের দিকে পটিয়ার গৈড়লা গ্রামে পোস্টমাস্টার আহমদ হোসেনের সাহেবের বাড়িতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গোপন মিটিং করেন। সে মিটিংয়ে অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন করিম, প্রদ্যোৎ কুমার পাল ও আহমদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। তারা সকলে মিলে যৌথ কমান্ডে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
ক্যাপ্টেন করিমের অত্যন্ত আস্থাভাজন যোদ্ধা ছিলেন প্রদ্যোৎ কুমার পাল। ক্যাপ্টেন করিমের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রদ্যোৎ কুমার পাল তাঁর সাথে ছিলেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধারা পটিয়া থানার সবচেয়ে বড় অপারেশন জিরি মাদ্রাসা অপারেশন করেন। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এই অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে মাদ্রাসার ভিতর রাজাকারদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন করিম জিরি মাদ্রাসা অপারেশনের জন্য রেকি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রদ্যোৎ কুমার পালকে। তিনি ১৫ দিনের বেশি সময় রেকি করে স্থানীয় এক লোকের সহায়তায় অপারেশনের সকল তথ্য জোগাড় করেছিলেন। ক্যাপ্টেন করিম সে তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটা নকশা তৈরি করেছিলেন এবং জিরি মাদ্রাসা আক্রমণ করেছিলেন। জিরি মাদ্রাসা অপারেশনে শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপের ৫ জন, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন করিম গ্রæপের ৫ জন করে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া মহসিন খান গ্রæপ, শামসুদ্দিন আহমদ গ্রæপ ও আহমদ নবী এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
অপারেশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী দুটি গ্রæপ দু’দিকে অবস্থান নিয়েছিলেন। জিরি মাদ্রাসা পুকুরের উত্তর পাশে বড়বাজার, সেখানে অবস্থান নেন ক্যাপ্টেন করিম, প্রদ্যোৎ কুমার পাল, আ হ ম নাসির উদ্দিন, হাবিলদার গোলাপুর রহমান, ওবায়েদ, নায়েক আজিজ, ইউসুফ চৌধুরী, তারা সেখানে অ্যাম্বুশ করেছিলেন। মাগরিবের আজানের সময় রাজাকারের হেড মাওলানা সাহেব পুকুরের পাড়ে আসলেন। ক্যাপ্টেন করিম গ্রæপ তাকে আক্রমণ করেন, ওই গেটে দু’জন রাজাকার ছিল তারা ফায়ার করার চেষ্টা করলে মওলানা সাহেব বারণ করেছিলেন। মওলানা সাহেবকে বন্দি করে ক্যাপ্টেন করিম বললেন, আপনাকে মেরে ফেলা হবে, মওলানা সাহেব বললেন, আমি জানি। ক্যাপ্টেন করিম বললেন, আপনাকে মারবো না যদি আমাদের সহযোগিতা করেন। পরে মওলানা সাহেবের কাছ থেকে অস্ত্রের গোডাউন এর চাবি নিয়ে ২২টি রাইফেল ও ছয় পেটি গুলি উদ্ধার করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
ক্যাপ্টেন করিম মাওলানা সাহেবকে বললেন, আপনাকে আজকে মারলাম না। যদি আপনি এখানে রাজাকারের ট্রেনিং বন্ধ না করেন এক সপ্তাহ পরে আমরা আবার আসব আর ম্যাসাকার করে দেব আপনার মাদ্রাসা। জিরি মাদ্রাসা অপারেশনে মনসা গ্রাম নিবাসী ইউসুফ চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
পরে অস্ত্র ও গুলির পেটিগুলো ৩ গ্রæপে সমানভাবে ভাগ করে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের সেল্টারে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরদিন থেকে জিরি মাদ্রাসায় রাজাকারের ট্রেনিং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন পরে পাঞ্জাবীরা সেখানে আসে এবং অসম্ভব গোলাগুলি করেছিল। যার ফলে দুজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছিল।
প্রথম অবস্থায় ক্যাপ্টেন করিম গ্রæপের শেল্টার ছিল বিনিনেহারার ডাক্তার শামসুল আলম চৌধুরীর বাড়িতে। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন করিমসহ গ্রæপ কমান্ডারবৃন্দ বসে পটিয়া, বোয়ালখালী ও রাউজানে যে সকল তহসিল অফিস আছে, যেগুলো থেকে পাকিস্তান সরকারের রেভিনিউ আসে, সেগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। প্রথমে ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে পটিয়ার কেলিশহর ও বোয়ালখালীর কালাইয়াহাট তহসিল অফিস মুক্তিযোদ্ধারা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রায় দুই মাস পরে মুক্তিযোদ্ধারা বোয়ালখালীর বেঙ্গুরা তহসিল অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এই অপারেশনে প্রদ্যোৎ পাল অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেন।
প্রদ্যোৎ পালের আরেকটি সাহসী অপারেশন ছিল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে বোয়ালখালী থানা অপারেশন। এই অপারেশন খুবই কঠিন ছিল। কারণ থানার ভিতরে পাঞ্জাবীদের বাঙ্কার ছিল। এই অপারেশনে ক্যাপ্টেন করিম ছিলেন না, অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, আ হ ম নাসির উদ্দিন ও অ্যাকশন কমান্ডার হিসেবে ছিলেন প্রদ্যোৎ কুমার পাল। তারা তিন গ্রæপে ভাগ হয়ে তিন দিক থেকে থানা আক্রমণ করেছিলেন। রাত ২ টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাঞ্জাবীদের গোলাগুলি হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বুঝতে পারলেন এখানে পাঞ্জাবীদের সংখ্যা বেশি, তাদের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়, আর ওদিকে সকাল হয়ে আসছে । তাই তারা সূর্য ওঠার পূর্বে ৩ গ্রæপ তিন দিক দিয়ে সরে গিয়েছিলেন। প্রায় আড়াই ঘণ্ট পাঞ্জাবীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি যুদ্ধ হয়েছিল। পরে মুক্তিযোদ্ধারা বড়–য়াপাড়ায় নিরাপদ সেল্টারে চলে গিয়েছিলেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ধলঘাট হাসপাতাল অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন প্রদ্যোৎ কুমার পাল। ধলঘাট হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন ডাক্তার বদিউল আলম। তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। গ্রামের অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করতেন। তার হাসপাতালের পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের গোডাউন ছিল। ডাক্তার বদিউল আলমের একজন অতি সুন্দরী মেয়ে ছিল। বেঙ্গুরার পেশকারের একজন ছেলে ওই মেয়েকে বিয়ে করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তারা ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক।
প্রদ্যোৎ পাল ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর এসেছিল রাজাকাররা ধলঘাট হাসপাতাল ঘিরে ফেলেছে। প্রদ্যোৎ পাল সহ মুক্তিযোদ্ধারা বডুয়াপাড়া থেকে ফায়ারিং করে হাসপাতালের দিকে ছুটে এসেছিলেন। একজন মিলিশিয়া লোককে সেখানে প্রদ্যোৎ কুমার পাল সহ মুক্তিযোদ্ধারা আটক করে ফেলেন এবং পরে তাকে মেরে ফেলেছিলেন। মূলত মিলিশিয়া দুজন রেকি করতে এসেছিলো, মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে একজন পালিয়ে গিয়েছিলো আর অন্যজন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে।
প্রদ্যোৎ পালের পরবর্তী অপারেশন ছিল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে। পরীক্ষা বাতিলের দাবি নিয়ে প্রদ্যোৎ কুমার পাল ও আ হ ম নাসিরউদ্দিন ওই কলেজের অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীরের পরে (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) সাথে দেখা করেছিলেন। প্রদ্যোৎ কুমার পাল ও নাসিরউদ্দীন প্রিন্সিপাল সাহেবকে অনুরোধ করেছিলেন পরীক্ষা না নিতে। যদি পরীক্ষা নেয়া হয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দেবেন। প্রিন্সিপাল সাহেব বলেছিলেন, আমাকে কে মারবে, কে বাধা দেবে, আমার অনেক ছাত্র। পরে মুক্তিযোদ্ধারা পরীক্ষার্থীদের সকল এডমিট কার্ড সেখানে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রিন্সিপাল সাহেব কিংবা কলেজের কোন ক্ষতি করেননি। পরদিন মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান, রাজাকাররা প্রিন্সিপাল সাহেবকে হত্যা করে ফেলেছে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাঙ্গুনিয়ার পোমরায় ৩৫ হাজার ভোল্টের কেবল যুক্ত গার্ডার ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেন। এই অপারেশনে ক্যাপ্টেন করিম, আ হ ম নাসিরউদ্দিন, প্রদ্যোৎ কুমার পাল, মনসুর ও আর্মির দুজন ইঞ্জিনিয়ার কোরের সদস্য হাবিলদার খোন্দকার রহমান ও তার ভাই অংশগ্রহণ করেছিলেন। কাপ্তাই থেকে এ ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাপ্লাই করা হতো চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। ক্যাপ্টেন করিম রেকি করে দেখেছিলেন এ গার্ডার ধ্বংসের জন্য তাদের পাহাড়ে উঠতে হবে। ক্যাপ্টেন করিমের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যথাসময়ে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক কষ্ট করে এক্সপ্লোসিভস ও আর্মস নিয়ে পাহাড়ে উঠে যান। ক্যাপ্টেন করিম পাশের পাহাড়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা পাহাড়ে উঠে দেখেন নিচে পাঞ্জাবীরা ঘোরাফেরা করছে, প্রদ্যোৎ পাল সহ মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে এক্সপ্লোসিভ নিয়ে পাশের পাহাড়ে ক্যাপ্টেন করিম এর কাছে ফিউজ নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিউজে আগুন দিতেই এক মিনিটেরও কম সময়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছিল এক্সপ্লেসিভ। পরদিন মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেলেন সমস্ত চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্ট বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে এ অপারেশন মুক্তিযোদ্ধারা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন।
ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে অপর একটি অপারেশন ছিল ফয়েজ প্রকাশ টিক্কা খান রাজাকার কমান্ডার অপারেশন। ক্যাপ্টেন করিম রাউজানের লাম্বুরহাট এর পাশে বডুয়া পাড়ায় অবস্থান করছিলেন সেসময়। বড়–য়া পাড়া সেল্টারের উত্তর দিকে চৌধুরীহাট। সেখানে একটা রাজাকার ক্যাম্প ছিল। সেখানে ফয়েজ প্রকাশ টিক্কা খান বলে একজন প্রখ্যাত রাজাকার থাকতো। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে তাকে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ক্যাপ্টেন করিম সে অপারেশনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রদ্যোৎ কুমার পালকে। প্রদ্যোৎ পাল রেকি করে সেই অপারেশনের একটা ড্রইং তৈরি করে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন সাহেবকে। অপারেশনটা করা হয়েছিল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ঈদের দু-তিন দিন পূর্বে। ভরা বাজারে আক্রমণ করা হয়েছিল রাজাকার টিক্কা খানকে। প্রদ্যোৎ কুমার পাল নিজ হাতে গুলি করেন সে রাজাকার টিক্কা খানকে। পরে ক্যাপ্টেন করিম ও প্রদ্যোৎ কুমার পাল সহ মুক্তিযোদ্ধারা বাজারে একটি কাপড়ের দোকানে যান এবং গøাসের আলমারিগুলো ভেঙে কাপড় জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যাশবাক্সের মধ্যে পাওয়া নগদ টাকাগুলো বাজারের লোকজনকে দান করে দিয়েছিলেন।
পরে প্রদ্যোৎ কুমার পাল সহ মুক্তিযোদ্ধারা বোয়ালখালীতে রাজাকার এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। বোয়ালখালী রাজাকার হেডকোয়ার্টার ছিল গোমদÐী। আ হ ম নাসির উদ্দিনের বাড়িতে তখন প্রদ্যোৎ কুমার পাল সহ মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ এসে খবর দিলেন রাজাকাররা আ হ ম নাসির উদ্দিনের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। তখন সে বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা নাসির উদ্দিন চৌধুরীর পিতা শামসুল ইসলাম চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির পিছনে বের হয়ে যাওয়ার রাস্তা আছে কিনা। তারা কি পালিয়ে যাবেন, নাকি প্রতিহত করবেন?
জনাব শামসুল ইসলাম চৌধুরী (নাসিরের পিতা) জবাব দিলেন, বাঁচতে হলে বীরের মতো বাঁচবে, পালিয়ে যাবে কেন?
সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ৬ জন, অস্ত্র ছিল ৯টা। প্রদ্যোৎ কুমার পাল সহ মুক্তিযোদ্ধারা বাঁশঝাড়ের পাশে অ্যাম্বুশ নিলেন। রাজাকারেরা ফায়ারিং রেঞ্জ এ আসার সাথে সাথে ফায়ার শুরু করলেন মুক্তিযোদ্ধারা। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পরে রাজাকারেরা পিছু হটে যায়। রাজাকারেরা কিছুটা পিছু হটলে সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কানুর দিঘির পাশে চলে যান এবং সেখান থেকে পরে করলডেঙ্গা পাহাড়ে চলে যান। পরে রাজাকারেরা পাঞ্জাবীদের নিয়ে আবার এসেছিলো এবং আ হ ম নাসির উদ্দিন চৌধুরীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো।
করলডেঙ্গা পাহাড়ে আ হ ম নাসির উদ্দিন চৌধুরী ও প্রদ্যোৎ পাল এর দেখা হয় ওস্তাদ ফজলু ও আলমগীরের সাথে। তারা টি এম আলী সুবেদার গ্রæপের লোক ছিলেন । তারা রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া থেকে এসেছিলেন। তারা সেখানে এসেছিলেন রাজাকার হেডকোয়ার্টার অপারেশন করতে। প্রদ্যোৎ পাল, নাসির উদ্দিন সহ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সাথে সে অপারেশনে যোগদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। করলডেঙ্গার তলদেশে লিচুতলায় যোগাযোগের স্থান নির্ধারণ করেছিলেন দুই গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা। রাতে টি এম আলী সুবেদার গ্রুপের লোকেরা এসে টর্চের আলো দিয়ে সিগন্যাল দিলে দুই গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে মিলিত হয়েছিলেন।
রাতে যথাসময়ে জ্যেষ্ঠপুরা গ্রæপ কমান্ডার সোলায়মানের সেল্টার থেকে প্রদ্যোৎ পাল সহ মুক্তিযোদ্ধারা লিচুতলায় পৌঁছালেন। দুই গ্রæপ একত্রিত হয়ে তিন ভাগে বিভক্ত হলেন। এক গ্রæপ সার্চিং গ্রæপ, এক গ্রæপ গোমদন্ডী স্টেশনে দক্ষিণ দিকে পজিশন নিলেন এবং অপরটি চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী রেল পথে ১৩ নম্বর ব্রিজ এ অবস্থান নিলেন। প্রদ্যোৎ পালের দলে ছিলেন আ হ ম নাসির উদ্দিন চৌধুরী, ও আই জেড, বেবি, ফজলু, মনসুর সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে বোয়ালখালী টিএনও অফিসে ছিল রাজাকারদের অবস্থান। সেসময় ভবনটা ছিল দোতলা। ওস্তাদ ফজলু লুকিয়ে এগিয়ে গেলেন এবং নিচের তলায় দরজা হালকা খুলে হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করলেন। বিকট শব্দে চারদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে দোতলায় থাকা রাজাকারেরা ফায়ার শুরু করে। ওস্তাদ ফজলু যখন দোতলার দিকে যাচ্ছিলেন হঠাৎ একটা গুলি এসে তার গায়ে লাগে, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সে অপারেশনে ও আই জেড ও বেবি এ দু’জনও শহীদ হয়েছিলেন।
সেদিনের সে অপারেশনে ১৩ নম্বর ব্রিজে যারা অবস্থান নিয়েছিলেন তারা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে রেল আটকাতে পারেনি। পাঞ্জাবীদের ট্রেন চলে এসেছিল অপারেশন স্থলে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং সেখান থেকে ফিরে আসে। সেই অপারেশনে নিহত ৩ জন সহযোদ্ধার লাশও মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে আনতে পারেননি।
ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে ধলঘাট ট্রেন অপারেশন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। সে অপারেশনে ত্রিমুখী আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। যখন ট্রেন আসতে শুরু করলো পূর্ব প্ল্যান অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা বø্যাঙ্ক ফায়ার শুরু করলেন। সে অপারেশনে রেলের কিছু আর্মড পুলিশকে ধরে ফেলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধরে দুলাল সেনের বাড়ির দোতলায় নিয়ে বন্দি করে রেখেছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সন্ধ্যায় তাদের হত্যা করা হবে। এ হত্যার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল প্রদ্যোৎ পালকে। সন্ধ্যায় প্রদ্যোৎ পাল যখন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন, বন্দী আর্মড পুলিশগুলো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলো। তারা বললো, পেটের দায়ে চাকরি করছি, আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই। আমাদের ব্যবস্থা করে দিন। পরে মুক্তিযুদ্ধারা পদুয়ার টি এম আলী সুবেদার গ্রুপের কাছে তাদের নিয়ে গেলেন এবং ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে পরবর্তী অপারেশন ছিল কাপ্তাই রোড পথেরহাট এর পাশে বৈদ্যুতিক লাইন ধ্বংস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে রাঙ্গুনিয়ায় এ অপারেশন হয়েছিল। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে প্রথম দিনের অপারেশনে তিনটি বৈদ্যুতিক লাইন ধ্বংস করা হয়েছিল।
কিছুদিন পরে ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে আবারো বৈদ্যুতিক লাইন ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে একজন ওয়াপদা ইঞ্জিনিয়ার রাতে ক্যাপ্টেন করিম ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। সেই ইঞ্জিনিয়ার জানালেন, আপনারা অপারেশনে গেলে মারা যাবেন। প্রত্যেক বৈদ্যুতিক খাম্বার সাথে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে।
একথা শুনে ক্যাপ্টেন করিম তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন পাঁচ-সাতটা মুরগি জোগাড় করতে। পরে তিনি নির্দিষ্ট দিনে অপারেশনে গেলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন মুরগির পায়ে রশি বেঁধে সেগুলো গার্ডারের দিকে ছুঁড়ে মারতে। এতে করে কোন কোন গার্ডারে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে তা সনাক্ত করা যাবে। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন করিম এর নির্দেশ অনুযায়ী গার্ডারগুলো মুরগি দিয়ে পরীক্ষা করলেন। সে অপারেশনেরও দায়িত্বে ছিলেন প্রদ্যোৎ পাল। প্রদ্যোৎ পাল সবগুলো গার্ডার পরীক্ষা করে এসে বললেন, তিনটির মধ্যে দুটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। পরে ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে দুটি গাডারে কাটিং চার্জ লাগিয়ে এক্সক্লুসিভ দিয়ে ধ্বংস করে দেন মুক্তিযোদ্ধারা।
ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর পটিয়ার মিলিটারি পোল অপারেশন করা হয়েছিল। সে অপারেশনে একজন পুলিশের হাবিলদার নিহত হয়েছিলো। মিলিটারি পোলটি তখন আন্ডার কনস্ট্রাকশন সাইট ছিল। এর নিচে যে খালটি ছিল তার পশ্চিম পাশে একটা ছনের ঘর ছিল। সেখানে রাজাকাররা সাধারণ গ্রামবাসী লোকজনকে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করত। মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফের (মনসা নিবাসী, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) বাড়িতে বসে মিলেটারি পুল অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। সে অপারেশনে ক্যাপ্টেন করিম, প্রদ্যোৎ পাল, ওবায়েদ (বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ও দুইজন পুলিশের হাবিলদার অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর রাঙ্গুনিয়ার কোদালা চা বাগান অপারেশন হয়েছিল। এটি পাঞ্জাবি সৈন্যদের দখলে ছিল। ক্যাপ্টেন করিম, প্রদ্যোৎ পাল সহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এই কোদালা চা বাগান অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোদালা চা বাগান অপারেশনের জন্য ক্যাপ্টেন করিম টি এম আলী সুবেদারের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। মূলত ক্যাপ্টেন করিম কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও লোকজন জোগাড় করতে টি এম আলী সুবেদারের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। ক্যাপ্টেন করিম সেখান থেকে এস এল আর চালাতে সক্ষম দুজন লোক ও তিনটি এলএমজি নিয়ে এসেছিলেন। রাত চারটার দিকে ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কোদালা চা বাগান আক্রমণ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা পাঞ্জাবিদের সাথে যুদ্ধের পরে পাঞ্জাবীরা পিছু হটে যায় এবং পাহাড় দিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ চায়ের পেটি উদ্ধার করেছিলেন। চায়ের পেটিগুলোও রাঙ্গুনিয়ার বিএলএফ কমান্ডার নুরল আলম পরে (এডিশনাল আইজি) তার কাছে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে নুরল আলম ও ক্যাপ্টেন করিমের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে ক্যাপ্টেন করিম এর মৃত্যু হয়েছিল।
প্রদ্যোৎ পাল এর পরবর্তী অপারেশন ছিল কমান্ডার সোলায়মান এর নেতৃত্বে ধলঘাট কৃষ্ণখালি ব্রিজ অপারেশন। রাজাকাররা এই ব্রিজটা পাহারা দিত। কমান্ডার সোলায়মান এর নেতৃত্বে সন্ধ্যার পরে প্রদ্যোৎ পালসহ মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে গিয়ে ফায়ার করেন এবং রাজাকারদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। পরে ব্রিজটিতে কাটিং চার্জ লাগিয়ে রেলের গার্ডার নষ্ট করে দিয়েছিলেন। সে অপারেশন করে মুক্তিযোদ্ধারা দোহাজারী থেকে চট্টগ্রামের ট্রেন সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সে অপারেশনে শহীদ ইব্রাহিম উলঙ্গ হয়ে নিজের লুঙ্গি দিয়ে কাটিং চার্জ লাগানোতে সহায়তা করেছিলেন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে চলে যান উত্তরদিকে গেট ঘরে। সেখানে রেলের পাথর সরিয়ে এন্টি ট্যাংক মাইন লাগিয়েছিলেন। কালুরঘাট থেকে ট্রেন যখন এসে মাইনের উপর উঠেছিল মাইন বিস্ফোরিত হয়ে ট্রেনের ইঞ্জিন ঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বোয়ালখালী থানার কধুরখীলে রাজাকারদের এ্যাম্বুস করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে এই অপারেশন করা হয়েছিল। এই অপারেশনে চারজন রাজাকারকে অস্ত্রসহ আটক করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের সকলকে বন্দী করে জ্যৈষ্ঠপুরা সোলায়মানের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সন্ধ্যায় তাদের কর্ণফুলী ঘাটে নিয়ে গিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
ক্যাপ্টেন করিমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন হলো মগধাই রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মধ্যে প্রচÐ গোলাগুলি হয়েছিল কিন্তু কোন হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। প্রদ্যোৎ পাল এই অপারেশনের অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের ২৯ তারিখ পদুয়া রাজারহাট থেকে চার মাইল ভিতরে ধোপাছড়ি থেকে কাপ্তাই এর দিকে একটা মাটির রাস্তা গিয়েছিল। খবর এসেছিল রাজাকার ও মিলিটারির একটা দল এদিক দিয়ে আসবে। রাত তিনটার দিকে ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথের ধারে পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যাম্বুশ নিয়েছিলেন। রাজাকার ও মিলিটারি দল তাদের ফায়ারিং রেঞ্জ এর ভিতর আসলে গ্রেনেড চার্জ করার নির্দেশ ছিল। মুক্তিযোদ্ধারাও তাই করলেন। গ্রেনেড চার্জ এর কিছুক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন করিম কমান্ড দিলেন ব্যাক করতে। মুক্তিযোদ্ধারা গড়িয়ে পাহাড়ের নিচে ছড়াতে নেমে পড়লেন। পরে ছড়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাহাড়ে এলোপাতাড়ি গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন।
পরদিন রাতে খবর এসেছিল টি এম আলী সুবেদার ক্যাম্পে পাঞ্জাবীরা বম্বিং করবে এবং হাতি দিয়ে রেইড করবে। ক্যাপ্টেন করিম খবর পেয়ে সাথে সাথে প্রদ্যোৎ পালকে নিয়ে টি এম আলী সুবেদারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। টি এম আলী সুবেদার খবরটা শুনে জানালেন তিনি তার দল নিয়ে (১৭৬ জন ইপিআর) রাতে ভারত চলে যাবেন। তিনি প্রতিরোধ করবেন না।
ক্যাপ্টেন করিম সেখান থেকে ফিরে এসে রাঙ্গুনিয়ার বিএলএফ কমান্ডার নুরুল আলমের সাথে দেখা করতে চলে যান। নুরুল আলম সিরিয়া ফরেস্ট অফিসে থাকতেন। তার সাথে যোগাযোগ করে ক্যাপ্টেন করিম গ্রæপ নিয়ে আসবেন এমন কথা বলেই তিনি প্রদ্যোৎ পালকে রেখে চলে যান। প্রদ্যোৎ পালকে বলে গেলেন, একটা নৌকা ঠিক করে রাখতে। বেশ কিছুক্ষণ সময় গড়িয়ে গেল কিন্তু ক্যাপ্টেন করিম ফিরে আসছেন না। বেশ কিছুক্ষণ পরে ৫-৬ জন লোক আসলো প্রদ্যোৎ পালকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে। একজন সেন্ট্রি বলল, কমান্ডার সাহেব আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে বলেছেন। প্রদ্যোৎ পাল তাদের সাথে গিয়ে দেখলেন, নুরুল আলম ক্যাপ্টেন করিমকে অ্যারেস্ট করেছেন। রাত তিনটার দিকে ক্যাপ্টেন করিমকে একটা ঘরে এবং প্রদ্যোৎ পালকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য আরেকটা ঘরে। রাত চারটার দিকে ক্যাপ্টেন করিমের ওপর অত্যাচার শুরু করা হয়, শব্দ শুনে প্রদ্যোৎ পাল পাশের রুম থেকে বুঝতে পারলেন। পরের দিন সকালে শহীদ ইব্রাহিম ক্যাপ্টেন করিমকে খুঁজতে গেলেন নুরুল আলমের ফরেস্ট অফিসে। নুরুল আলম বললেন, ভারত সরকারের নির্দেশে ক্যাপ্টেন করিমকে ভারতে পাঠানো হয়েছে। পরে ইব্রাহিম ফরেস্ট অফিস থেকে ক্যাপ্টেন করিমকে ছাড়া যেতে না চাইলে তাকেও অ্যারেস্ট করেন নুরুল আলম।
ফরেস্ট অফিসের অপরদিকে ভবানী মিলে ছিল পাঞ্জাবীরা। মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বুঝতে পেরে পাঞ্জাবীরা দুপুরে ফায়ার শুরু করে ফরেস্ট অফিসের দিকে। নুরুল আলম একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। প্রদ্যোৎ পাল বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে দেখলেন, বিএলএফ এর প্রথম গ্রæপ স্বপন কুমার চৌধুরী, সরওয়ার কামাল (সাতকানিয়া), রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী (বোয়ালখালী), ডাক্তার ইউসুফ (বাঁশখালী) সকলেই সেখানে উপস্থিত। তখন নুরুল আলম ফরেস্ট অফিস ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলেন। রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী প্রদ্যোৎ পালকে দেখে চিনে ফেললেন এবং নুরুল আলমকে বললেন প্রদ্যোৎ পাল আমাদের সাথে যাবে।
সেদিন রাজেন্দ্র প্রসাদ অজান্তে জীবন বাঁচিয়েছিলেন প্রদ্যোৎ পালের। আর এদিকে নুরুল আলম ক্যাপ্টেন করিম, ইব্রাহিম ও ইঞ্জিনিয়ার কোর এর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে যান।
উল্লেখ্য ওই দিন রাতে স্বপন কুমার চৌধুরী পাঞ্জাবিদের হাতে অ্যারেস্ট হন এবং তাকে ধামাইরহাট নিয়ে গিয়ে জীপের পিছনে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে মেরে ফেলেছিলো পাঞ্জাবীরা।
কিছুদিন পরে প্রদ্যোৎ পাল সকলকে ক্যাপ্টেন করিম ও ইব্রাহিম এর ব্যাপারে খুলে বললেন। মুক্তিযোদ্ধারা সকলে মিলে পরে ক্যাপ্টেন করিমকে খুঁজতে এসেছিলেন কিন্তু আর খুঁজে পাননি। পরে মুক্তিযোদ্ধারা যে যার যার বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
প্রদ্যোৎ পাল সেখান থেকে লাম্বুরহাট ভাÐারজুরি হয়ে সোলায়মানের জ্যৈষ্ঠপুরা ক্যাম্পে যান। সেখানে দেখা হয় বোয়ালখালীর এমপি ডাক্তার মান্নানের সাথে। ডাক্তার মান্নান প্রদ্যোৎ পাল এর হাতে একটা চিঠি দিলেন, চিঠিটি ছিল মেজর রফিক এর লেখা।
চিঠিতে রফিক সাহেব লিখেছিলেন, “করিম তোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপবাদ, আমি গাইড পাঠিয়ে দেখলাম এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ভিত্তিহীন। স্বপন চৌধুরীকে পাঠালাম কালুরঘাট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত তোদের অধীনে রইল। আমি নোয়াখালী সেক্টর দিয়ে আসছি আর ভুটানি সৈন্যরা ধোপাছড়ি দিয়ে আসবে”।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর নুরুল আলমের সাথে যারা গিয়েছিল ক্যাপ্টেন করিম, ইব্রাহিম ও ইঞ্জিনিয়ার কোর এর একজন ঢাকার ছেলে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকদিন পরে একটি পাহাড়ে ক্যাপ্টেন করিম এর লাশ পাওয়া গিয়েছিলো কিন্তু বাকি দু’জনের লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রদ্যোৎ পাল ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিট কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর স্ত্রীর নাম আরতি পাল। বৈবাহিক জীবনে তাঁর একমাত্র ছেলে অ্যাডভোকেট রাজেশ কুমার পাল। তাঁর ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি ও এল এল এম পাস করে চট্টগ্রাম আদালতে ওকালতি পেশায় নিয়োজিত আছেন।