মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের ভ‚মিকা নিরূপণের চেষ্টা করা হয়নি। তবে তাঁরা না হলে মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে গেরিলা যোদ্ধাদের পক্ষে যুদ্ধে সফল হওয়া মুস্কিল ছিল। ইনফ্যান্ট্রি, আর্টিলারি, ক্যাভালরি ইত্যাদি ভাগে ভাগ করে নিয়মিত সেনাবাহিনীকে সাজানো হয়। তাছাড়া কমান্ডো ব্যাটালিয়ন, প্যারাট্রুপার, সিগনাল ইত্যাদি গ্রæপেও সৈনিক ও অফিসারদের নিয়োগ করা হয়। ক্যাভালরি হয়ত এখন আর হয় না। এই বিভাগগুলি ছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং, এডুকেশন, মেডিকেল ইত্যাদি কোরও থাকে। গেরিলা যোদ্ধাদের তেমন ভাগ করার সুযোগ নেই। তবে বিভিন্ন স্থানে গেরিলা কমান্ডারেরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ কিংবা সময়ে যাদেরকে পাওয়া যাবে, এমন ডাক্তারের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে রাখতেন, যাতে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঐ ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়। যুদ্ধে হতাহতের ঘটনা ঘটেই থাকে। তাদেরকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন হলে বিশ্বস্ত ডাক্তারদের ডাকা হত এবং তারা চিকিৎসা দিয়ে যেতেন। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে অস্ত্রোপচার করতেন। এগুলি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে করতে হত।
পটিয়া এবং বর্তমান চন্দনাইশ থানার মুক্তিযুদ্ধকালীন কয়েকজন চিকিৎসকের কথা এ প্রসঙ্গে আলোচনা করছি। তাঁরা হচ্ছেন : পটিয়া থানায় ধলঘাট হাসপাতালে ডা. বদিউল আলম, বুধপুরা বাজারে সরকারি হাসপাতালের ডা. রায় বাবু, জিরি ইউনিয়নের মহিরা গ্রামের ডা. শৈবাল কান্তি দাশ এবং কুসুমপুরা ইউনিয়নের বিনিনেহারা গ্রামের ডা. শামসুল আলম। চন্দনাইশ থানার বরকলে শাহজাহান ইসলামাবাদীর ঘাঁটিতে ডা. গোলাম মওলা। ধলঘাটে বোয়ালখালীর সারোয়াতলী গ্রামের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আ হ ম নাসির উদ্দিন চৌধুরীর শেল্টার ছিল। সেই শেল্টারে অবস্থান করে তিনি পটিয়া, বোয়ালখালী, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায়ও অপারেশন করেছেন। তখন তাঁর প্রয়োজনে তিনি ধলঘাট হাসপাতালের ডা. বদিউল আলমের সাথে কথা বলে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য নিয়োজিত করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল ছিলেন। তাঁর পুরো পরিবারই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। পরে ক্যাপ্টেন করিম যখন দক্ষিণ চট্টগ্রামে যুদ্ধ করতে আসেন, তখন আ হ ম নাসিরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় এবং তাঁরা উভয়ে একসঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনায় সম্মত হন। ক্যাপ্টেন করিম ছিলেন বিমান বাহিনীর বৈমানিক। তিনি ছুটি কাটাতে তার বাড়ি রাউজানের নোয়াপাড়ায় যখন অবস্থান করছিলেন, তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তিনি অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে (২৬ মার্চ — ২ মে ’৭১) প্রথমে চট্টগ্রাম শহরের রেস্ট হাউজে আওয়ামী লীগের কন্ট্রোল রুম এবং পরবর্তীকালে মদুনাঘাট ও মহালছড়ি সহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাঁর অসীম সাহস ও বীরত্বের শৌর্য বীর্য প্রদর্শন করেন। পরে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণায় ১ নং সেক্টরে যোগাযোগ করে যুদ্ধের দায়িত্ব নিয়ে আবার দেশের অভ্যন্তরে চলে আসেন। ক্যাপ্টেন করিম ছিলেন একজন অসমসাহসী অক্লান্ত যোদ্ধা। তিনি দু’দÐ কোথাও ঠাঁই গেড়ে বসে থাকতে পারতেন না। শত্রæ হননের জন্য তিনি সব সময় উন্মুখ হয়ে থাকতেন, তাঁর হাত নিশপিশ করত। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর চট্টগ্রামের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পটিয়া, বর্তমান চন্দনাইশ, কর্ণফুলী থানা ও আনোয়ারায় একের পর এক গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর দুর্ভাগ্য তিনি চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের কন্ট্রোল রুম রেস্ট হাউজ থেকে যুদ্ধ শুরু করেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে বিশ্বস্ত থাকতে পারেননি। তাঁকে আওয়ামী লীগ বিরোধী নকশালবাদী বামপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে মৃত্যুদÐ প্রদান করা হয় এবং স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তাঁকে চক্রান্ত করে আলোচনার জন্য রাঙ্গুনিয়ায় একটি বৈঠকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধারা নির্মমভাবে হত্যা করে। একজন শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাকে কিছু মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখতে দেয়নি। তখন হয়ত রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ের ওপার থেকে স্বাধীনতার নবীন সূর্য উঁকি দিচ্ছিল। যারা তাঁকে বেকায়দায় ফেলে বন্দী করে হত্যা করল, তারা সাহসে, অস্ত্র চালনায় তাঁর ধারে কাছেও আসার যোগ্য ছিল না।
যাই হউক, ধলঘাটের কথায় ফিরে আসি। কমান্ডার আ হ ম নাসিরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ক্যাপ্টেন করিমও আ হ ম নাসিরের ধলঘাটের শেল্টারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ধলঘাটের বিখ্যাত ট্রেন অপারেশনে অংশ গ্রহণ করে এবং তখন ডা. বদিউল আলমের পরিবার একটি বীরত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। ক্যাপ্টেন করিম ও আ হ ম নাসিরের গ্রæপ যৌথভাবে বোয়ালখালী থানা অপারেশনও করেন।
বোয়ালখালীতে হাজিরহাটস্থ ইকবাল পার্কে সরকারি হাসপাতালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান চিকিৎসক ছিলেন ডা. হাবিবুর রহমান। তাঁর বাড়ি রাউজানে। মুক্তিযুদ্ধে লোকজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। এমনকি রাত হলে সাইকেল চালিয়ে করলডেঙ্গা পাহাড়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্বাদের ঘাঁটিতে গিয়ে তাদেরকে চিকিৎসা করতেন।
পটিয়ার মোজাফফরাবাদে একটি হাসপাতালে জনৈক বড়–য়া ডা. কর্মরত ছিলেন। কালুরঘাট যুদ্ধে ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী আহত হলে তাঁকে প্রথমে মোজাফফরাবাদ হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়। বড়–য়া ডাক্তার তাঁর চিকিৎসা করেন।
পশ্চিম পটিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ডা. শামসু ও ডা. শিবু বাবু দুটি উজ্জ্বল নাম। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে জিরি মাদ্রাসা অপারেশন থেকে পশ্চিম পটিয়া মুক্তিযুদ্ধের মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। এমনকি পশ্চিম পটিয়াকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের হেডকোয়ার্টার বললেও অত্যুক্তি হয় না। জিরি ইউনিয়নের সাঁইদাইর গ্রামের আহমদ শরীফ মনীর এবং বিনিনেহারার ডা. শামসুল আলম ও মাস্টার রফিকুল আলম চৌধুরী অসহযোগ আন্দোলন থেকে ফকিরা মসজিদকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পটিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলছিলেন। ফকিরা মসজিদেরই অদূরে গোরনখাইন গ্রামে ছিল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর বাড়ি। তাঁর নির্বাচনী কর্মকাÐের প্রধান কার্যালয় ছিল ফকিরা মসজিদ বাজারে। তখন থেকে ফকিরা মসজিদ এলাকা ছিল রাজনীতি চর্চার জন্য আলোচিত। শান্তিরহাট থেকে বুধপুরা রাস্তার উপর কিছু দোকানপাট নিয়ে গড়ে ওঠা ফকিরা মসজিদ বাজার সবসময় রাজনীতি সচেতন ছাত্র-জনতার ভিড়ে গমগম করত। ফকিরা মসজিদ যেন পশ্চিম পটিয়ার নাভি হয়ে উঠেছিল। শুধু জিরি, কুসুমপুরা, গোরনখাইন, হরিণখাইন, মহিরার মানুষ নয়, এক অদৃশ্য দুর্নিবার আকর্ষণে মোহাম্মদনগর কালারপুল থেকে ছাত্রনেতা ফেরদৌস চৌধুরী, এজহারুল হক, দ্বীপকালারমোড়ল থেকে অধ্যাপক জাফর আহমদ মোস্তফা ও আলী আহমদ, শিকলবাহার মাস্টারহাট থেকে নেছার, ফরিদ, জামাল, কামাল, জহুর, তাহের, চরলক্ষ্যা থেকে রশিদ, সিদ্দিক, এয়াছিন, শাহমীরপুর থেকে কামাল, দৌলতপুর থেকে আবু তাহের বাঙালি, লক্ষ্যারচর থেকে এম এন ইসলাম, কুসুমপুরা থেকে রুস্তম, কৈয়গ্রাম থেকে শামসুল হক, মোজাম্মেল, এখলাস, আমিন, জিরির আবদুস ছবুর চৌধুরী ও আবুল বশর চৌধুরী দুই ভাই, ফরিদ, ফজল, ইসহাক, ফরিদ, আবু তাহের বাঙালি, আবদুল হাকিম, ফজলুল হক, এমদাদ, ইউসুফ, বিনিনেহারার আবু তৈয়ব, আবু তাহের, আবুল কাশেম ও আবু বকর (আমেরিকা প্রবাসী), ইউসুফ এস্কারী, আবদুল গফুর, গোরনখাইনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা রায়হান ফিরদাউস মধু, এনামুল হক সিকদার, ইউসুফ সুলতান, ইদ্রিস সুলতান, জুলফিকার, নুরুল আলম, হাসান আবুল কাশেম, হরিণখাইনের ছালেহ আহমদ খলিফা, ডা. মুসলিম চৌধুরী ও তাঁর সন্তান মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, মহিরার ডা. শিবু, অজিত আইচ, সাঁইদাইরের আবুল হোসেন মাস্টার, আহমদ শরীফ মনীর, ইসহাক, বুধপুরার কমান্ডার সুলতান, দ্বারক পেরপেরার ব্রজেন্দ্র লাল বর্ধন, সুনীল বর্ধন, অসিত বর্ধন, পিঙ্গলার তেমিয় বাবু, ডা. মিলন, দুলাল মাস্টার, মনসার আবুল কাশেম, আবদুস ছালাম, নুরুল ইসলাম, সিরাজুল হক, নাজিমুল হক, হুলাইনের হাশেম মাস্টার, আসলাম, রফিক, নাসির, হাবিলাসদ্বীপের স্বপন চৌধুরী, চরকানাই’র নুরুল আমিন, রফিক, রফিকুল আলম চৌধুরী, নাইখাইনের আফসার, নিমতলের আবুল হাশেম, সাদারপাড়ার মাহবুব, হামিদুল হক, এয়াকুবদÐীর ইসহাক সহ ছাত্র ও তরুণ যুবকেরা প্রতিদিন ফকিরা মসজিদে ছুটে না আসলে যেন তাদের ভাত হজম হত না। ফকিরা মসজিদে গোরনখাইনের ছাত্রদের একটি ক্লাব ছিল। সেই ক্লাবটির মাঠে প্রতিদিন তরুণ যুবকদের বৈকালিক আড্ডা জমে উঠত। মুক্তিযুদ্ধই ছিল আড্ডার প্রধান বিষয়। তাছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে পরিবেশিত সংবাদ ও কথিকা শুনে সেগুলি নিয়েও সিরিয়াস আলোচনা হত।
ছাপরা খাসমহাল অপারেশন, জিরি মাদ্রাসা অপারেশন, লাখেরা অয়্যারলেস স্টেশন অপারেশন, চরকানাই মুন্সির হাটে নাজির অপারেশন ইত্যাদি খÐযুদ্ধের বেশ কিছু ঘটনায় পশ্চিম পটিয়ায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের দু’জন সেনাপতি ক্যাপ্টেন করিম ও সার্জেন্ট আলম, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অধ্যাপক শামসুল আলম, মহসীন খান, শামসুদ্দিন আহমদ, বরকলের শাহজাহান ইসলামাবাদী, হাবিলদার হাবিব, কমান্ডার আ হ ম নাসির উদ্দিন, আহমদ নবী প্রমুখ প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনায় পশ্চিম পটিয়া যখন সরগরম ছিল। জিরি মাদ্রাসা অপারেশনে মনসা গ্রামের ইউসুফ গুলিবিদ্ধ হলে তাঁকে বুধপুরা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয় এবং তখনই মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভ‚ত হয়। এসময় গোরণখাইনের ডাক্তার শামসুল আলম ও জিরির ডা. শৈবাল কান্তি দাশ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসক হিসেবে আবিভর্‚ত হন। ক্যাপ্টেন করিম বোয়ালখালীর একটি অপারেশনে আহত হলে তাঁকে ডা. শামসুল আলমের বাড়িতে এনে চিকিৎসা করা হয়। সে থেকে ডা. শামসু শুধু চিকিৎসক নন, মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হয়ে যান। তাঁর বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে তদানিন্তন পটিয়ার এমপিএ সুলতান আহমদ কুসুমপুরী ছিলেন স্থানীয় বড় নেতা ও মুরুব্বি। তিনি সহ এলাকার গণমান্য ব্যক্তিবর্গ প্রায়ই ডাক্তার শিবুর চেম্বারে আড্ডা দিতেন। কিছুদিনের মধ্যে ডা. শিবুর চেম্বার হয়ে উঠলো এলাকার সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের যোগাযোগ ও আস্থার ঠিকানা। ডাক্তারি পড়ে তিনি যেমন মানবতার ব্রত নিয়েছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি থেকে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রগুপ্তি। সাংগঠনিকভাবে আদর্শিক ও শিক্ষিত মানুষগুলো যাতে আওয়ামী লীগে যোগ দেয় সেই পরামর্শ ও কাজগুলো তিনি করতেন। তিনি সাংগঠনিকভাবেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
সমাজসেবা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও মুজিব ভক্তদের পশ্চিম পটিয়ায় একটি অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো ডা. শিবুর চেম্বার। সুলতান আহমদ কুসুমপুরী, আবদুস সবুর, আবুল বশর, খলিলুর রহমান, মীর আহমদ সওদাগর, লায়ন শামসুল হক, মাস্টার রফিকুল আলম চৌধুরী, আবুল হোসেন মাস্টার, মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আহমদ, আবদুল হাকিম, ফজল আহমদ, বাদশা, মেম্বার শেখ বদি, এখলাস চেয়ারম্যান, কিরিটি বড়–য়া, নির্মল বড়–য়া, শিক্ষক নুরুল ইসলাম আরো অনেকে নিয়মিত হাজিরা দিতেন ডা. শিবুর চেম্বারে এবং দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনায় মশগুল হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। এর মধ্যে ডা. সাহেব আরেকটা কাজ করতেন, কিছুক্ষণ পর পর দোকান থেকে চা অর্ডার দিয়ে আনিয়ে সবাইকে চা-নাস্তায় আপ্যায়িত করতেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধে তিনি তাঁর চেম্বার ও মহিরা গ্রামের বাড়ি সহ সর্বস্ব হারান রাজাকারদের হাতে। আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী বড়লিয়া ইউনিয়নের কর্ত্তালা গ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব কিরিটি বিকাশ বড়–য়া ও পিয়ানাজ চৌধুরী বাড়িতে। সেখানে থেকেও তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরসহ সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতেন, সংগঠকদের নিয়মিত তথ্য ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য দেশে আসার পর আমার টাইফয়েড হয়ে যায়। তখন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী জুলফিকার আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমার তখন প্রচÐ জ্বর, শরীর পুড়ে যাচ্ছে তাপে। জুলফিকার এবং তার বড় ভাই বক্করদা আমাকে দেখার জন্য একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসেন। সেই ডাক্তারই শিবু বাবু। তিনি আমার জ্বর মাপছেন, ওষুধ খাওয়াচ্ছেন, কখনও ইনজেকশান দিচ্ছেন এবং এসব কাজ করতে করতে তাঁর মুখে কথার খৈ ফুটছে। আমি মুক্তিযোদ্ধা জেনে মুক্তিযুদ্ধের কথা যেমন বলছিলেন, তেমনি সারা দুনিয়ায় কোথায় কি হচ্ছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জাতিগত সংঘাত, বর্ণ বৈষম্য ইত্যাদি তিনি অনর্গল বকে যাচ্ছিলেন। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম, একজন সাধারণ ডাক্তার, তিনি এত খোঁজ খবর কিভাবে রাখেন। বিশেষ করে তখন আয়ারল্যান্ডে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ক্যাথলিক, প্রটেস্ট্যান্ট, রোমান ক্যাথলিক ইত্যাদি নানা গ্রæপের মধ্যে কোথায় বেলফাস্টে গোলাগুলি, বোমাবাজি হচ্ছে এসব খবর তিনি যেন রানিং কমেন্ট্রি দিয়ে যাচ্ছেন সেভাবে পরিবেশন করছিলেন। সম্ভবত আমি ১০/১৫দিন জুলফিকারের বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলাম। সেসময় তাঁর পরিবারের সকল সদস্য আমার মা-বাবা, ভাই-বোনের মত যেভাবে আমাকে সেবা-শুশ্রƒষা করেছিলেন, তা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না এবং তাঁরা আমাকে যে অপরিশোধ্য ঋণ ও কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন তা আমি কখনও শোধ করতে পারব না।
ডা. শৈবাল দাশ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল মহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শুধাংশু বিমল দাশ, মাতা মণি কুন্তলা দাশ। তাঁর পিতা বার্মা রেলওয়ে কোম্পানিতে চাকরি করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি জিরি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কর্তালা বেলখাইন মহাবোধি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ ভ‚মিকা পালন করেন। জরাজীর্ণ মহিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পুনঃনির্মাণের সমস্ত ব্যয়ভার তিনি নিজেই বহন করেন। সনাতনী সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতপাতের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।
অল্প বয়সে মাতৃহারা হন শৈবাল দাশ। সামান্য একটি রোগ হয়েছিলো তাঁর মায়ের, কিন্তু এলাকায় তেমন কোন ডাক্তার না থাকায় অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাঁর মা। পশ্চিম পটিয়ায় তখন ডাক্তারের অভাবে মানুষের মৃত্যু ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক একটি ঘটনা। মায়ের মৃত্যুতে ডাক্তার সংকটের ব্যাপারটা শৈবাল দাশের মনে গভীর রেখাপাত করে।
ডা. শৈবাল কান্তি দাশ কর্তালা বেলখাইন মহাবোধি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর পিতৃ আদেশে সংস্কৃতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ না করে সুদূর কুমিল্লায় গিয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে এলএমএফ ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং পশ্চিম পটিয়ার সাধারণ মানুষের সেবায় জিরি ইউনিয়নে ফকিরা মসজিদ বাজারে ‘বাপ্পি ক্লিনিক’ নামে একটি ঔষধের দোকানসহ চেম্বার প্রতিষ্ঠা করেন এবং রাতদিন মানুষের সেবায় নিয়োজিত হন।
’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শেষে মহিরা গ্রামের পোড়া ভিটায় আবার নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করে সপরিবারে বসবাস আরম্ভ করেন। আবার চিকিৎসা সেবা ও এলাকার উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
ডা. শৈবাল দাশের জীবন সঙ্গিনী ছিলেন সুনীতি দাশ। তাঁদের তিন পুত্র, দুই কন্যা। প্রথম পুত্র প্রদীপ কুমার দাশ জেলার একজন সম্মুখ সারির বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা। মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটিকে নিয়ে যখন ডা. শিবু উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলেন, তখন তাঁর প্রথম পুত্র কর্তালা বেলখাইন মহাবোধি উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার পাথেয় সংগ্রহ করছিলেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভালোভাবেই এসএসসি পরীক্ষায় উতরে গেলেন। তাঁর পিতার ইচ্ছা হলো বংশের প্রদীপটিকে পটিয়ার কোন কলেজে ভর্তি না করে চট্টগ্রামের তখনকার সময়ের অত্যন্ত নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি বাণিজ্য কলেজে ছেলেকে ভর্তি করবেন। তখন সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক এবং তা অত্যন্ত কঠিন ছিল। ডা. শিবু প্রাক্তন এমপি সুলতান আহমদ কুসুমপুরী ও এলাকার অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে পটিয়া থানার লাখেরা গ্রামের কৃতি সন্তান প্রফেসর আবদুর রহিম চৌধুরীর সহযোগিতায় ছেলেকে সরকারি বাণিজ্য কলেজে ভর্তি করতে সমর্থ হন। প্রফেসর রহিম চৌধুরী পরে কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ হন। তিনি ডা. শিবুর পুত্র প্রদীপের পিতৃতুল্য অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। প্রদীপ স্কুল থেকেই রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। কলেজে প্রকাশ্যে রাজনীতি চর্চার সুযোগ না থাকলেও প্রদীপ অন্তরে রাজনীতির একটি জ্বলন্ত প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। প্রফেসর রহিম চৌধুরী তার রাজনৈতিক উত্তরণে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করেন।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন। প্রদীপ স্কুল জীবনেই জিরি ইউনিয়নের সাঁইদাইর গ্রামের কৃতি সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ শরীফ মনির সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ভিত্তিতে তাঁর চেতনাকে নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে সামরিক সরকারের আমলে সন্ধ্যার পর থাকত কারফিউ, রাজনীতি তো নিষিদ্ধ ছিলই। স্বাধীনতার সপক্ষের ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নেতাকর্মীদের অবর্ণনীয় দুঃখ, দুর্দশা ছিল বিদ্যমান। তদুপরি সরকারি বাণিজ্য কলেজে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) সমর্থিত চকরিয়ার কামাল ছিলেন ভিপি ও পটিয়ার সোলায়মান খান ছিলেন জি.এস। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিলো বেশি।
এর মাঝে প্রদীপ দিশারি সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেন। পরবর্তীকালে কলেজের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন ও ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সাহায্যে ও আগ্রহে প্রদীপ দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত হন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সম্মেলনে পর্যায়ক্রমে (২০১৩ -২০২২) দীর্ঘ ১০ বছর সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বিগত ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন কিন্তু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পূর্ব অবস্থায় রেখে নতুন কমিটিতে জননেতা প্রদীপ কুমার দাশকে ১ম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত করা হয়।
রাজনৈতিক কর্মকাÐ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন।
রাজনীতিবিদ প্রদীপ দাশের স্ত্রী অধ্যাপিকা পিংকু দাশ অর্থনীতি বিষয়ে হাজি নুরুল হক ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা করেন। পাশাপাশি স্থানীয় আজাদী পত্রিকা সহ বিভিন্ন পত্রিকা ও প্রকাশনায় তিনি কলম লেখক হিসেবে পরিচিত। ইতিমধ্যে তার ‘বঙ্গবন্ধু একাই ইতিহাস’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর দুই পুত্র কানাডায় লেখাপড়া করেন।
২০ সেপ্টেম্বর ২০০০ খ্রিস্টাব্দে মানবকল্যাণকামী জনদরদী চিকিৎসক ডা. শৈবাল কান্তি দাশের বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।