শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২, ১৭ জিলকদ, ১৪৪৬

শহীদ অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকাণ্ড

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হওয়ার পর এটা নিশ্চত হয়ে যায় যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি এবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, যে কোন মূল্যেই তারা ন্যায্য দাবি আদায় করে ছাড়বেই । তারপরের ঘটনা প্রবাহ খুব দ্রæত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়। ১ মার্চ ৭১ জাতীয় পরিষদের পূর্বাহূত অধিবেশন স্থগিত করে দেয়ার পর সারা বাংলাদেশ সেই যে গর্জে উঠল, সেই গর্জন স্বাধীনতা করায়ত্ত না করা পর্যন্ত আর থামেনি। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানি। সেনাবাহিনী ট্যাংক, কামান, বুলেট, বেয়নেট দিয়ে সেই গর্জন থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু মুক্তিপাগল বাংলার দামাল ছেলেমেয়েরা কণ্ঠের শ্লোগানের পরিবর্তে তখন হাতে তুলে নেয় অস্ত্র এবং বুলেটের জবাব বুলেটেই দিয়ে স্বাধীনতার বহ্নিশিখা প্রজ্জ্বলন রেখেছিল। সেই অগ্নিঝরা সময়ে গোটা বাংলাদেশ, সমগ্র জাতি স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল। কুÐেশ্বরীর অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ তখন বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন।
বাঙালিমাত্রই সেদিন স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলো। বিপ্লবীদের ‘মন্ত্রগুপ্তি’নয়, ‘বজ্রকণ্ঠের’ বজ্রনির্ঘোষের পর স্বাধীনতা শব্দটি তখন প্রতিটি বাঙালির মুখে মুখে ঘরে ঘরে। স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল আগে বুকের গভীরে সঙ্গোপনে লুকিয়ে রাখা এক নিষিদ্ধ ‘গন্ধম’, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা লুকোচুরি খেলত ধানের ক্ষেতে বটের ছায়ায়। সেই স্বাধীনতাকে মূর্ত করেছেন মহানায়ক, বাক্সময় করেছেন মহাকবি, রেসকোর্সে একাত্তরের সাত মার্চ। অতঃপর স্বাধীনতার কথা বলাবলি হতে লাগলো হাটে মাঠে ঘাটে, ধনীর প্রাসাদে, গরিবের পর্ণকুঠিরে, চায়ের দোকানে, মিল-কারখানায়, কোথা হতে মুক্তি পেয়ে এলো যে স্বাধীনতা, সেটা যেন সকলের হয়ে গেল।
বয়োবৃদ্ধ হলেও, স্বাধীনতার ওপর নূতন বাবুুর অধিকার জন্মাল, স্বাধীনতার সঞ্জীবনী মন্ত্রে তাঁর অশক্ত শরীরও জেগে উঠলো। আগেই তাঁকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ঋষি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যখন তিনি ৭০- এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কুÐেশ্বরীতে পদধূলি দিয়ে কুÐেশ্বরীর মাটিকে ধন্য করেছিলেন। নূতন বাবুর মধ্যে স্বদেশানুরাগ সুপ্তভাবেই ছিলো, বঙ্গবন্ধু তাকে উস্কে দিলেন। এখন জাতি যখন মাতৃমুক্তির পণ করে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, তখন মহান দেশব্রতী নূতন বাবুর কি পিছিয়ে থাকা চলে? তাঁর কুÐেশ্বরীর বিশাল বিস্তৃত প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করে দিলেন মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য। গোলার ধান, পুকুরের মাছ, ক্ষেতখামারের ফসল গণদেবতার সেবায় ও ভোগে নিবেদিত হয়ে ধন্য হলো। তখানো পাক বাহিনী রাউজানে প্রবেশ করেনি, কুÐেশ্বরী ছিল মুক্তাঞ্চল। যেসব এলাকা পাক বাহিনীর দখলে চলে যাচ্ছে, সেসব এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দসহ মুক্তি সংগ্রামী ‘জয় বাংলা’ বাহিনী, রণক্লান্ত সৈনিক, হানাদার বাহিনীর হামলার ভয়ে পলায়নপর নারী-পুরুষ – আবাল – বৃদ্ধ-বণিতা খাদ্য ও সাময়িক বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতিস্থল হিসেবে কুÐেশ্বরীকেই বেছে নিচ্ছিল। রাউজানের প্রধান সড়কের পার্শ্বস্থিত কুÐেশ্বরী সত্যিই এক ট্রানজিট ক্যাম্পে পরিণত হয়েছিল সেই ভয়ংকর দুঃসময়ে।
১৩ এপ্রিল এখন বাংলা বছরের শেষদিন, তখনো হয়তো তাই ছিলো। একারণেই দিনটি বিদায়ের করুণ রাগে বেদনাবিধুর। জীর্ণ পুরাতন ঝেড়ে মুছে ফেলার প্রস্তুতি যেমন এদিন থেকেই শুরু হয়, তেমনি পুরাতন বছরকে বিদায় জানাতে হয় বলে মনটা খুব ভারি ও বিষণœ হয়ে ওঠে। ঠিক এমনি বিয়োগবেদনায় ¤øান ও বিবর্ণ এক অপয়া দিনে (বাংলার ১৩ ইংরেজির থারটিন সংখ্যাটিকে আনলাকি বা অপয়া মনে করে সবাই সভয়ে এড়িয়ে চলে), ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল, কুÐেশ্বরীতে হাজির হয়েছিলো নূতন বাবুর যমদূত। সেই যমদূত আর কেউ নয়, রাউজানের এক চিহ্নিত দালাল। সঙ্গে নিয়ে আসে পাঞ্জাবী সৈন্যদের একটি দল আর তার স্থানীয় চেলাচামুÐা গোষ্ঠী। সময় আনুমানিক সকাল ১০টা। প্রতিদিনকার মতো নূতন বাবু তখন মাতৃমন্দিরের ভেতরে উপাসনায় মগ্ন, বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণরূপে বিযুক্ত হয়ে ইষ্টদেবতার চরণে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন, বাইরে কে আসল কে গেল, কি হচ্ছে না হচ্ছে কোনদিকেই খেয়াল নেই তাঁর। অবশ্য পাক সৈন্যদের এটিই প্রথম দল নয়, যারা সেদিন কুÐেশ্বরীতে এসেছিল। সাত সকালে হাজির হয় বেলুচ রেজিমেন্টের একদল সৈন্য। তারা নূতন বাবুর সাথে কথা বলে চলে যায়। এরপর আরো একটি দল এসে চলে যায়। তৃতীয় দফায় আসে পাঞ্জাবী সৈন্য, যাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে উক্ত দালাল। পাঞ্জাবী সৈন্যরা এমনিতেই চরম বাঙালি-বিদ্বেষী, ঔদ্ধত্যপূর্ণ রূঢ় আচরণ, অশালীন খিস্তি-খেউড়ের জন্য যাদের কোন জুড়ি নেই, তদুপরি উক্ত দালাল তাদেরকে নূতন বাবু সম্পর্কে অনেক মিথ্যা, বানোয়াট কথা বলে বাজে ধারণা দিয়ে এমনভাবে ক্ষিপ্ত করে নিয়ে আসে যে, তাদের অবস্থা তখন নূতন বাবুকে পেলে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। তারা নূতন বাবুর কথা জিজ্ঞেস করে জেনে নেয় যে তিনি মন্দিরে আছেন। মন্দিরকে অপবিত্র করে তারা মন্দিরের ভেতর ঢুকে যায় এবং তাকে জোর করে ধরে টেনে হিঁচড়ে মন্দিরের সামনে এনে ফেলে দেয়। তখনো পাঞ্জাবীদের মনে তাঁকে মারবার ইচ্ছা উদয় হয়নি। কিন্তু উক্ত দালাল তাদেরকে বাধ্য করে নূতন বাবুকে মারবার জন্য। পাঞ্জবী সৈন্যদেরকে সে জানায়, তার বাবা অর্ডার দিয়েছেন নূতন বাবুকে মেরে ফেলবার জন্য। সে তাদেরকে একথা বলে প্ররোচিত করার চেষ্টা চালায় যে, নূতন বাবু কুÐেশ্বরীতে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের আশ্রয় দিয়েছেন, খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। সে আরো জানায় যে, কুÐেশ্বরীতে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে। এরা হিন্দু, এদের সাথে ভারতের যোগাযোগ রয়েছে। এরপর পাঞ্জাবী বেটাদের আর হুঁশ থাকার কথা নয়। তারা ট্রিগার টিপে দেয়, একসঙ্গে অনেকগুলো আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে ওঠে। রাউজানের দানবীর, শিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত , দীনবন্ধু, করুণার সিন্ধু অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের পুণ্যদেহ সেই বুলেট বৃষ্টিতে ঝাঁঝরা হতে হতে এক সময় নিথর হয়ে লুটিয়ে পড়ে। নূতন সিংহের পবিত্র রক্তে ভিজে যেতে থাকে কুÐেশ্বরীর মাটি, ধীরে ধীরে সেই রক্তে সিক্ত হতে হতে গোটা কুÐেশ্বরী কমপ্লেক্সই আবৃত করে ফেলে।
নয় মাস পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, নূতন বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র সিংহ পরিত্যক্ত কুÐেশ্বরী ভবনে যখন প্রথম প্রবেশ করে তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় বাবাকে যে স্থানে হত্যা করা হয়েছিলো সেই স্থানটি পরিদর্শন করেন তখন তিনি দেখতে পান রক্তের চিহ্ন ধুয়ে মুছে গেছে, এক জায়গায় মাটিতে একটা গোল দাগ। জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারেন সেখানেই পিতার বুকের তাজা রক্ত পুকুর তৈরি করেছিল।
প্রফুল্ল বাবু আরো দেখেন, মন্দিরের দেবীর হাত পা মুখ ভাঙা। ২৫০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিলো দেবীর দেহে, একটিও আর অবশিষ্ট নেই, সবই লুট করে নিয়ে গেছে লুটেরারা। কাউকে এসব অলংকারে হাত দিতে দেননি তাঁর বাবা। পোড়ো বাড়ি, ভূতুড়ে বাড়িতেও বাড়ির কিছু চিহ্ন থাকে, কিন্তু হানাদার পাকিস্তানিদের দালালরা এমনভাবে কুÐেশ্বরীতে লুটপাট চালিয়েছিলো যে, সেখানে বাড়ির কোন চিহ্নই তারা রাখেনি। শুধু দেয়ালগুলি ছিল-বাড়ির দরজা-জানালা, কড়ি-বরগা, খাট-পালঙ্ক, সমস্ত আসবাবপত্র, হাড়ি-পাতিল, তামা-পিতল-কাসার সকল সামগ্রী, লেপ-তোষক-বালিশ একটি একটি করে খুলে নিয়ে যায়, তারা মামুলি চোর-ডাকাত নয় যে, তাড়াতাড়ি লুটপাট করে গৃহস্থ জেনে ফেলার কিংবা লোক এসে পড়বার ভয়ে তাদের সরে পড়তে হবে। তারা পাকিস্তানের সেবক, চৌধুরী সাব আছেন মাথার ওপর, তারা ‘স্পেশাল’ ডাকাত, তাই ধীরে সুস্থে রয়ে সয়ে একটি পেরেকও যেন বাদ না যায় সেভাবেই লুট করে নূতন সিংহের ভিটা সাফ করে ফেলে। হরিলুটের পর কুÐেশ্বরী ঔষধালয়ের কাঁচামালসমূহ গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। স্থানীয় আমানত খাঁ চেয়ারম্যান তখন জীবিত ছিলেন, দিদারুল আলম চৌধুরীও ছিলেন, তিনিও প্রাক্তন চেয়ারম্যান। তাঁদের সঙ্গে দেখা করে প্রফুল্ল বাবু জানতে পারলেন হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের নির্মম করুণ কাহিনী। প্রফুল্ল বাবু এটা জেনে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন যে কুÐেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির ও মহাবিদ্যালয়েকেও তাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই দেয়নি দুর্বৃত্তরা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলি ত নূতন বাবু জনসাধারণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাড়িতে গিয়ে ধ্বংস¯তুপের ভেতর পেলেন ৩৫ হাজার টাকার ব্যাংক ড্রাফট, অফিসের কাগজপত্র ছিঁড়ে তছনছ করে টাল মেরে ফেলে রাখা হয়েছিলো, তার মধ্যেই পাওয়া গেল ব্যাংক ড্রাফট। ভেতর বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, কারণ সেখানে এক বুক ঘাস উঠে গেছে। দরজা-জানালা না থাকায় বাতাসের লুটোপুটি, শোঁ শোঁ আওয়াজে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
একাত্তরে যেদিন বাবাকে ফেলে বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলেন, সেদিনের কথা স্মরণ করে প্রফুল্ল বাবু আমাকে জানিয়েছেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের পতনের পর আশংকা করছিলাম যেকোন দিন পাঞ্জাবীরা এসে পড়বে। অতএব, আর থাকা যুক্তিযুক্ত নয়, সব অবরোধ, প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানি হায়েনারা আসছে। আমাদের এদিকে আবার ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসার সুবিধা রয়েছে। অতএব, ১১ এপ্রিল ৭১ বিকেল ৫ টায় আমরা বাড়ি ছাড়লাম। দুটি জিপে করে আমরা রওনা হলাম, গন্তব্য রামগড়। বাড়িতে রেখে গেলাম বাবা, মা, তিন জ্যেঠতুতো ভাই ও তাদের স্ত্রী, কাজের লোক, অফিস ও কারখানার মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন কর্মচারী। প্রচÐ বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন, রাতেও থামাথামি নেই। আমরা নানুপুর পৌঁছে স্থানীয় এমপি মির্জা মনসুরের বাড়িতে আশ্রয় নিই। পার্শ্ববর্তী একটি বাড়িতে আমাদের রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা হয়, পরদিন আবার যাত্রা, কাঁচা রাস্তা ভিজে কর্দমাক্ত হয়ে গিয়েছিলো, সে পথ উজিয়ে অনেক কষ্টে পৌঁছলাম রামগড়। তারপর ফেনী নদী পেরিয়ে সীমান্তের ওপারের ভারতীয় অঞ্চল সাবরুমে গেলাম।
২৫ মার্চের কদিন আগে নূতন বাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিল্পী-লেখক চিত্ত রঞ্জন সিংহ কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিক কল্যাণ বসু ওরফে রূপম বসুকে নিয়ে পৈত্রিক বাড়িতে বেড়াতে আসেন এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। ২৮ মার্চ চিত্ত সিংহ ও কল্যাণ বসুর সহযোগিতায় এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী ও আতাউর রহমান কায়সার প্রমুখ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও প্রতিরোধ যুদ্ধের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ মানিক চৌধুরী নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সাবরুম হয়ে আগরতলা যান এবং সেখানে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের সাথে দেখা করেন। নেতৃবৃন্দ তাঁর মাধ্যমে ভারতের প্রধানন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা সম্পর্কিত সমস্ত বিষয় অবহিত করান। পরে এম আর সিদ্দিকী দিল্লীতে যান ম্যাডাম গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। উল্লেখ্য, শচীন্দ্র লাল সিংহের সাথে চিত্ত রঞ্জন সিংহের পূর্ব পরিচয় ছিল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ জন শিক্ষক তাঁদের পরিবারবর্গ সমেত কুÐেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের বিভিন্ন কক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারা কুÐেশ্বরী বিদ্যামন্দিরে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত অবস্থান করেন। এই সময়ে এম এ হান্নানকে নিয়ে নূতন বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ দু’দিন রামগড়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের রামগড় যাবার উদ্দেশ্য ছিল পথের অবস্থা দেখা এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে কতটুকু সাড়া জাগছে সেটা প্রত্যক্ষ করা।
এপ্রিলের প্রথম দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ কুÐেশ্বরীতে থাকাটা আর নিরাপদ মনে করতে পারছিলেন না। বেশ কয়েকজন শিক্ষক আগেভাগে অন্যত্র সরে গিয়েছিলেন। তবে ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. রশীদুল হক নূতন বাবুকে তিনদিন ধরে ক্রমাগত বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে, কুÐেশ্বরীতে থাকা আর কারো পক্ষে নিরাপদ নয়, তাঁর পক্ষে ত নয়ই। এবার সকলেরই সীমান্তের ওপারে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু নূতন বাবুর এক কথা-“আমি এই দেশ, এই মাটি আর আমার মাকে ছেড়ে যাব না। সবাই যদি দেশ ছেড়ে যাই তাহলে দেশের অন্যান্য মানুষদের কি হবে? আপনারা চলে যান, ভারতের সাহায্য নিয়ে দেশকে হানাদার মুক্ত করুন।”
এর আগে ৫ এপ্রিল নূতন বাবুর মধ্যম পুত্র সত্য রঞ্জন সিংহ ও জামাতা কৃষ্ণ প্রসাদ মহাজনকে রামগড়ে চলে যেতে হয়েছিল মুসলিম লীগের স্থানীয় কিছু দালালের অপপ্রচারের জন্য। বাড়িতে একা পি আর সিনহা, সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। প্রফুল্ল বাবুও তাঁর বাবাকে বোঝাতে বহু চেষ্টা করেছিলেন। তিনি একবার মত দেন আবার মত পাল্টান। এর মধ্যে স্থানীয় এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন, তাঁর ভাই আবদুল্লাহ আল নোমান (পরে বিএনপি নেতা ও মন্ত্রী), অপর ভাই আবদুল্লাহ আল হান্নান কুÐেশ্বরী এসে বেশ কয়েকবার নূতন বাবুকে অনুরোধ করে যান সীমান্তের ওপারে চলে যাবার জন্য। আবদুল্লাহ আল হারুন একাও একবার আসেন নূতন বাবুর মত পরিবর্তনের চেষ্টায়। তখন বাড়িতে তিনি প্রায় একা, কনিষ্ঠ পুত্র পি আর সিনহাও ততদিনে ভারতে চলে গেছেন কিন্তু এতজন লোকের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। সেকালের নীতিবান মানুষ নূতন চন্দ্র সিংহকে তাঁর আদর্শ থেকে এক চুলও নড়ানো কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ক্যান্টনমেন্ট বরকল, শাহজাহান ইসলামাবাদী জিওসি

মুক্তিযুদ্ধের এক কিংবদন্তী শাহজাহান ইসলামাবাদী। দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের তিনিই ছিলেন প্রধান নায়ক। কিংবা এভাবেও বলা যায়, তাঁকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে উঠেছিল। তাঁর

বিস্তারিত »

স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের অগ্রসৈনিক মিরসরাইর অহিদুল হক

অহিদুল হক মুক্তিযুদ্ধে যে অসাধারণ বীরত্ব, অসীম সাহস ও শৌর্যবীর্যের পরিচয় দেন, তা মিরসরাই থানার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে জাতীয় মুক্তির

বিস্তারিত »
বাংলাদেশে পিএইচপির উদ্যোগে মালয়েশিয়ার বিশ্ববিখ্যাত প্রোটন ব্রান্ডের গাড়ি তৈরির কারখানা উদ্বোধনের পর মোনাজাত করছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ এবং পিএইচপির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সুফি শিল্পপতি মিজানুর রহমান ।

দার্শনিক শিল্পপতি সুফি মিজানুর রহমান পুরুষোত্তম

বাংলাদেশে পিএইচপির উদ্যোগে মালয়েশিয়ার বিশ্ববিখ্যাত প্রোটন ব্রান্ডের গাড়ি তৈরির কারখানা উদ্বোধনের পর মোনাজাত করছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ এবং পিএইচপির

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধে দোহাজারীর বীর চতুষ্টয় : খসরু-জাফর-রতন-কামাল

চট্টগ্রামের সভ্যতা মানুষ ও নদীর যুগ্ম-সৃষ্টি। ঐতিহাসিক কাল থেকে চট্টগ্রামে তিনটি বড় নদী পরিদৃষ্ট হয়। সর্ববৃহৎ কর্ণফুলী, অনতিবৃহৎ হালদা ও শঙ্খ নদী। কর্ণফুলী সদর ও

বিস্তারিত »

ষাটের_দশকের_ছাত্রনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সিরাজুল আলম

কাজী সিরাজুল আলম ষাটের দশকের শেষদিকে চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ছিলেন। ৬৯-৭০-এ তিনি ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। তাঁর বাড়ি সীতাকুÐে; তিনি সীতাকুÐে ৬৯-এর

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধে_চিকিৎসকদের অবদান ও ডা.শৈবাল কান্তি দাশ

মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের ভ‚মিকা নিরূপণের চেষ্টা করা হয়নি। তবে তাঁরা না হলে মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে গেরিলা যোদ্ধাদের পক্ষে যুদ্ধে সফল হওয়া মুস্কিল ছিল। ইনফ্যান্ট্রি, আর্টিলারি, ক্যাভালরি

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধে এ কে খানের ভাই এম আর খান ও তাঁর তিন পুত্রের অন্তর্ধান দিবস

সে এক ঘোর অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিলো এই বাংলায়। সেই ঘন তমসা ভেদ করে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষার প্রহর গুণে গুণে কত দুঃখিনি মায়ের প্রাণবায়ু বেরিয়ে

বিস্তারিত »

জালালাবাদের যুদ্ধে চট্টল বিপ্লবীদের কাছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বাহিনীর পরাজয়

৩০-এর ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার (দামপাড়া, বর্তমানে পুলিশ পাহাড়) দখলের পর ইস্টার্ন রিপাবলিকান আর্মির সদস্যরা অস্ত্রাগারের সম্মুখে সমবেত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা

বিস্তারিত »

প্রভাবশালী আ.লীগ নেতা চাচা খালেক এবং ফটিকছড়ির বাদশা বাদশাহ আলম

এম এ খালেক (চাচা খালেক) অতীতে আওয়ামী লীগে এমন কিছু নেতা-কর্মী ছিলেন, যাঁরা পাগলের মতো আওয়ামী লীগকে ভালোবাসতেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কিছু বুঝতেন

বিস্তারিত »