“রাজধানীতে বড় কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই দেখা যায়, কোনো না কোনো সরকারি সংস্থার গাফিলতি ও তদারকির অভাব ছিল। ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীর আগুন থেকে শুরু করে সর্বশেষ বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড—চিত্রটি একই।কিন্তু কোনো ঘটনায় সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না”{সূত্রঃ প্র/আলো,৩-মার্চ’২৪}।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের বহুতল ভবনে গত ২৯-ফেব্রুয়ারি রাতের আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১১জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।তাঁরা কেউ ‘শঙ্কামুক্ত’ নন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে। অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ ভবনটিত যে আগুনের ঝুঁকি ছিল তা আগেই অবহিত ছিল কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এমনকি ভবন কর্তৃপক্ষও গায়ে মাখেনি। মানুষের মৃত্যুর পর বেরিয়ে এসেছে চরম গাফিলতি এবং অবহেলার দুঃখজনক চিত্র। আসলে এমন অবহেলা এবং গাফিলতির চিত্র শুধুমাত্র ঢাকার নয়, সারা দেশের।
ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন গত ১ মার্চ (শুক্রবার) বেইলি রোডে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পাশাপাশি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)জানিয়েছে, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পণ্য-বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না।
অতীব আশ্চর্যের বিষয়, আগুনের ঝুঁকি ও অনুমোদন না থাকার পরও ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ চলছিল বছরের পর বছর ধরে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে সেখানে খেতে ভিড় করেছিলেন নগরের অনেক মানুষ। অনেকের জীবন চলত ওই ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, “অধিদপ্তরের পরিদর্শনে ভবনে অগ্নিঝুঁকির চিত্র নিয়মিতই বেরিয়ে আসে। যেমন ২০২৩ সালে তারা সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭৪টি ভবন পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ২ হাজার ১১৮টি ভবনে ঝুঁকি খুঁজে পায়। ৪২৪টি ভবনকে তারা অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে”।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সংস্থাগুলোর কোনো কার্যকরী বা দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অগ্নিদুর্ঘটনায় অনাকাঙ্ক্ষিত জানমালের প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি যেন আমলযোগ্য এবং মর্মান্তিক কোনো বিষয় নয়। যেন জন্মিলে মরিতে হইবে এটাইতো অবধারিত এবং নিশ্চিত বিষয়। আমাদের মন-মানসিকতা বড় বিচিত্র এবং জটিলও বটে। দেশের কোথাও যখন অগ্নি, সড়ক, নৌ, রেলসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে তখন আমরা সবাই খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি। প্রিন্টিং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠে। মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে তাঁদের হৃদয়ের আকুতি মিনতি কাকুতি অন্তরের কান্না অযত্ন অবহেলা গাফিলতি এবং যথাযথ তদারকির অভাবের কারণগুলো মানুষের ক্ষোভ হতাশা হয়ে প্রকাশ পায়।মানুষের মন শোকে দুঃখে রাগে ফুঁসে উঠে।বিক্ষুব্ধু হয়ে অনেক সময় অপ্রীতিকর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দেয়।তারপর কয়দিন হৈ-চৈ করে সবাই চুপ হয়ে যায়।বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি সব ভুলে যায়।সম্বিৎ ফিরে পায় আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত মর্মন্তুদ দুর্ঘটনার পর।
“এদিকে ফায়ার সার্ভিস সূত্রের দাবী, ২০২০ সাল থেকে ঢাকায় যেসব ভবনে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সবকটিই তাদের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে, যথাসময়ে অগ্নিঝুঁকি নিবারণে ব্যবস্থা নেওয়া হলে ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার সুযোগ ছিল”। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অবহেলা আর গাফিলতি সহজেই অনুমেয়।
দেশে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই বেরিয়ে আসে গাফিলতির চিত্র। যেমন ঢাকার সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনে গত বছরের ৭-মার্চ ভয়াবহ বিস্ফোরণে ২৬ জনের মৃত্যুর পর রাজউক বলেছিল, অনুমোদনহীনভাবে ৫ তলা ভবনকে ৭ তলা করা হয়েছে।
২০২১ সালের ২৭-জুন সন্ধ্যার পর মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ নামের ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল, আবাসিক ভবনটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। সিদ্দিকবাজারের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তে পুলিশ তিতাস গ্যাসের প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি পেয়েছে। তবে ব্যক্তির দায় নিরুপণ করতে না পারায় অভিযোগপত্র দিতে পারছে না। প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা এবং আইনি দুর্বল কাঠামো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শাস্তির সঠিক এবং কঠোর প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে ঢাকায় নিয়মিত বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
২০১৯ সালের ২০-ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে ৭১জনের মৃত্যু হয়। এর এক মাস পরই এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে ঢাকার মগবাজারে একটি ভবনে এবং ২০২৩ সালে সিদ্দিক বাজার ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার দুটি ভবনে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৪ জন।
ঢাকায় বিগত পাঁচ বছরে হওয়া অন্তত ৯টি বড় অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দুর্ঘটনার পর তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা নিজেদের দায় অন্য সংস্থার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার তদন্তে সরকারি সংস্থার গাফিলতির চিত্র উঠে আসে। কিন্তু তাদের ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হয়। অথচ এসব নানান ধরণের দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সমন্বিত যথাযথ এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য এবং অতীব জরুরি।
“ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হলে ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে; তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। চুড়িহাট্টায় আগুনের পর পুরান ঢাকাকে রাসায়নিকমুক্ত করতে সব সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান শুরু হয়েছিল। তবে কিছুদিন পরই তা থেমে যায়”।
অসহায় মানুষ এমন মানবিক বিপর্যয় থেকে মুক্তি চায়।চায় নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার। সংশ্লিষ্ট সেবা ও শায়িত্বস্বাসিত সংস্থা, বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরগুলো যদি সঠিকভাবে নজরদারি ও তদারকি করে। গাফিলতি এবং অবহেলা রোধে সঠিক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা নিয়ে লোভ লালসার ঊর্ধ্বে উঠে পক্ষপাতহীন নির্মোহভাবে সাহস নিয়ে বিনা বাধায় নির্ভীকভাবে কাজ করে তাহলে এসব অন্যায় নির্মূল করা মোটেই দুঃসাধ্য নয়। পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকেও। প্রয়োজনে আইনের সঠিক এবং সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে দোষীদের জেল জরিমানা এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগী এবং ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, যারা স্বজন হারায়নি তাঁরা স্বজন হারাদের দুঃখ আদৌও বুঝবে না। মানুষের অন্তরের ব্যথা বেদনা মনের অবস্থা ফুটে উঠেছে বেইলি রোডে আগুনে হতাহতের স্বজনদের কথায়, “রাজউক কিছু দেখবে না, সিটি করপোরেশন লাইসেন্স দিয়ে দেবে, ফায়ার সার্ভিস শুধু চিঠি দেবে—তাহলে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কী করে।
বেইলি রোডের আগুনে শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)একটি মানববন্ধন করেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সেখানে শিক্ষার্থীদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল”,‘আজকে নাহিয়ান কালকে কে?’ “এই দায়িত্বহীনতার দায়ভার কার”?
মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী
লেখক-প্রাবন্ধিক