শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২, ২৫ জিলকদ, ১৪৪৬

সংবিধানেই আছে বঙ্গবন্ধুই জাতির পিতা

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর আমাদের দেশে কিছুদিন পর পর এমন সব কথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, জাতিপরিচিতি ভুলিয়ে দেওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যেই এসব উক্তি করা হচ্ছে।
কোন সময় জাতীয় সঙ্গীত, কোন সময় আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, কোন সময় জাতির পিতা, কোন সময় স্বাধীনতা, কোন সময় ৭ মার্চ, কোন সময় ২৬ মার্চ নিয়ে এমন সব কথা ইতিমধ্যে উচ্চারিত হয়েছে যা শুনে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার শরীরে জ্বালা ধরে গেছে। একাত্তরের পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী চক্র, রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী প্রকাশ্যে যে কথা বলতে সাহস করে না, এদের মুখে সে কথা শুনে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে হয়ে রক্ত ঝরছে। আমি কোন ধরনের স্বস্তি পাচ্ছি না। আমার মনে হয় শুধু আমি নই, আমার মত হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরাও স্বস্তি পাচ্ছেন না, জীবন ধারণ করে শান্তি পাচ্ছেন না।
এমন অবস্থা ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর একবার হয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মুশতাক ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশ বেতার – রেডিও বাংলাদেশ, জয় বাংলা – বাংলাদেশ জিন্দাবাদ হয়ে গিয়েছিল। মুশতাক একটি জাতীয় পোশাকও প্রবর্তন করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ৩রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় এবং খুনীদেরকে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাদের বিচার যাতে হতে না পারে সেজন্য সংবিধানে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংযোজন করা হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর সংবিধান থেকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রকে মুছে দিয়েছিলেন। পরে সংবিধানে বিছমিল্লাহ সংযোজন করা হয়। রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, আবদুল আলীম ও আবদুল মতিন চৌধুরীকে মন্ত্রী এবং আবদুর রহমান বিশ্বাসকে প্রেসিডেন্ট করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের উপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশকে মুক্তিযোদ্ধার মূলধারা থেকে বিপথে চালিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। এরশাদ এসে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন।
ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদ ক্ষমতাসীন হয়। উপদেষ্টা পরিষদের শাসনকালে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য এবং জাতি পরিচিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপন হতে থাকে। ’৭১ এর রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমের ছেলে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আবার কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ নিয়ে তাদের ক্ষুব্ধ বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। আমি যদি ভুল না শুনে থাকি, তাহলে টেলিভিশনে একজনকে বলতে শুনলাম ৭ মার্চ কেন, আরও ইতিহাস আছে পেছনে। পাকিস্তান আমলের আগে ব্রিটিশ আমল আছে। কথাটা এমনভাবে বলা হলো যে, পাকিস্তান আমলে যদি শেখ মুজিব আন্দোলন করে থাকেন তাহলে ব্রিটিশ আমলে যারা আন্দোলন করেছেন তাদের কথাও বিবেচনায় আনতে হবে। এসব কথা তাদের মাথায় কে ঢুকিয়েছে জানি না, কিন্তু যিনি ঢুকিয়েছেন তিনি এ কথাটা ভাবেননি যে, ব্রিটিশ আমলে যে আন্দোলন হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার জন্য সমগ্র ভারতে সে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে মহাত্মা গান্ধী নেতা। গান্ধীকে মানতে না চাইলে ভারতের শেষ ভাইসরয় আছেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন, তিনি এসে যাবেন। সুতরাং শেখ মুজিবকে বাদ দিতে গেলে উত্তপ্ত কড়াই জ্বলন্ত আগুন থেকে পড়তে হবে। বাংলায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব ছিল হিন্দুদের হাতে এবং বাংলা ভাগ রদ হওয়ার পর বঙ্গীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে হিন্দুদেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা ঐতিহাসিকভাবে হয়েছিল। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুরা মুসলমানের চেয়ে সংখ্যায় বেশি ছিল। আর বাংলার রাজধানী ছিল কলকাতা, সেখানেও ছিল হিন্দু প্রাধান্য। মুসলমানেরা ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে ইংরেজি শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার কারণে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে হিন্দুর চেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। হিন্দুরা এগিয়ে ছিল এটা হিন্দুদের দোষ নয়। মুসলমানেরা পিছিয়ে ছিল এটা মুসলমানদের দোষ। সুতরাং যারা পাকিস্তান বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের অবদানকে অস্বীকার করার জন্য ব্রিটিশ আমলের কথা বলার জন্য মন্ত্রগুপ্তি দিচ্ছেন, তারা মনে হয় ব্রিটিশ আমলে গেলে যে পরিস্থিতি হতে পারে সেটা চিন্তা করেন নি। ব্রিটিশ আমলে একটা অগ্নিযুগ ছিল। সে অগ্নিযুগে শতকরা ৯৮ ভাগ হিন্দুর ছেলেরাই গুলি, বোমা নিয়ে জীবন মৃত্যু পায়ের ভিত্তি করে আগুন নিয়ে হোলি খেলেছিল। হিন্দুর ছেলেরাই দলে দলে ফাঁসি কাষ্ঠে প্রাণ দিয়েছে, দ্বীপান্তরে আন্দামানে গেছে, বছরের পর বছর জেল খেটেছে, জেলের মধ্যে অনেকে পঁচে মরে গেছে।
অনেকে পালিয়ে পালিয়ে প্রায় সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। সুতরাং সেখানেও মুসলমান নেতা পাওয়া যাবে না। অগ্নিযুগে গেলে নেতা হবেন বাঘা যতীন অথবা মাস্টাদা সূর্য সেন।
তারা একটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে শেখ মুজিবের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিচার করছেন। মুখে খোলাখুলি না বললেও তাদের মনের কথা হচ্ছে এই ভারতের সহযোগিতায় শেখ মুজিব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমনকি পাকিস্তানের প্রতিও তাদের প্রচ্ছন্ন দুর্বলতা সবসময় চাপা থাকে না। মুক্তিযুদ্ধে সেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমান ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-কৃষক তথা আপামর জনসাধারণ যুদ্ধ করে যুদ্ধ জয়ী হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যেমন হিন্দুর ছেলেরা অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, তেমনি ’৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান ছেলেরা লাখে লাখে প্রাণ দিয়েছে। আজকে এ কথাটা জোর গলায় বলার সময় এসেছে যে, বাংলাদেশ হিন্দুর সৃষ্টি নয়, বাংলাদেশ মুসলমানের সৃষ্টি। একটু ভুল হলোÑবাংলাদেশ মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের মিলিত সৃষ্টি। মুসলমানের সাথে বাঙালি হিসেবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাত্র-যুবকরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ ছিলো বাঙালির যুদ্ধ, বাংলাদেশ বাঙালির যৌথ সৃষ্টি। তবে সাম্প্রদায়িকতার ধ্বজাধারীদের জ্ঞাতার্থে বলতে হয় যে, অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মুসলমান। সুতরাং যারা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের গায়ে হিন্দুর গন্ধ খোঁজেন, তাদের একথাটা মনে রাখা দরকার।
শেখ মুজিব ছাড়া বাংলাদেশ হতো না। শেখ মুজিবের চেয়ে বয়সে বড়, তাঁর সমসমায়িক এবং তাঁর চেয়ে কিছু ছোট আরও অনেক নেতা পাকিস্তান বিরোধী ২৩ বছরের আন্দোলনে ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা কেউ শেখ মুজিবের মতো তাঁদের রাজনীতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রশ্নে আপসহীন এবং অবিচল ছিলেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শেখ মুজিবের মত নাছোড়বান্দা জিদ ধরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন পরিচালনা করেননি। তারা কেউ ছয় দফা দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত¡¡াকে জাগ্রত ও সংহত হওয়ার কর্মসূচি দেননি। শেখ মুজিব ’৬৯ সালে ঢাকায় তিন নেতার মাজারে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায় পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করেছিলেন। অন্য কোন নেতা মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশ উচ্চারণ করেননি। মওলানা ভাসানী ৫৭ খ্রিস্টাব্দে কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে আবার আইয়ুবের সঙ্গে দহরম মহরম করেন। শেখ মুজিব যখন ৬১ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ করবার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, মনি সিং-খোকা রায়রা তাতে সায় দেননি। শাহ মোয়াজ্জেম তাঁর বইতে লিখেছেন, শেখ মুজিব ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলা মুক্তিফ্রন্ট গঠন করে তার নামে লিফলেট প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাসায় তাঁকে বিলি করার জন্য দিয়েছিলেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমদ, আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য নিউক্লিয়াস নামে যে গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, শেখ মুজিবের সম্মতিক্রমেই সেটা তাঁরা করেছিলেন। সিলেটের চা বাগানের মালিক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীরা শেখ মুজিবকে ভারতের মধ্য দিয়ে লন্ডন নিয়ে দিয়ে নেতাজী সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের স্টাইলে প্রবাসী সরকার গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ যখন ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগান দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছিলো, কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা-কর্মীরা তখন জয় সর্বহারা ¯েøাগান দিতেন। তারা কেউ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সৈনিকদের সংগঠিত করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংঘটিত করার পরিকল্পনা করেননি। তারা কেউ সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য ভারতের সাহায্য চাইতে আগরতলায় যাননি। তাদের কারো দল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করার রায় পাননি। তারা কেউ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠের ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের খোলসে কার্যত: বাংলাদেশ কায়েম করেননি। তারা কেউ ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। যেমন শেখ মুজিব করেছেন। শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে তাঁর সহকর্মীরা ’৭১ সালে ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। শেখ মুজিবের নামে এবং তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, স্বাধীনতা এসেছে। এই ইতিহাস মানলে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার না করে কোন উপায় থাকে না।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন সেটি পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত করতে পারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই তার প্রমাণ। তার এই ভাষণকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ঐতিহাসিক গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এ কারণে ইউনেস্কো এই ভাষণটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আর আমাদের নবীন নেতারা ৭ মার্চকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন। হায় খোদা! নির্মলেন্দু গুণের কবিতা মনে পড়ে যাচ্ছে, যেখানে তিনি বলেছেন –
শত বছরে শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন ।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা । কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের ।

এসব বিষয় আমাদের জাতীয় ইতিহাসে, জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এগুলি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করা জাতিদ্বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির শত্রæরাই মীমাংসিত বিষয়কে বির্তক বস্তুতে পরিণত করতে চায়।
বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতির পিতাকে যারা অস্বীকার এবং বিতর্কের বিষয়ে পরিণত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তারা আসলে কি চায়? তারা জাতিকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশকে অস্বীকার করলে পাকিস্তানে যেতে হয়, পাকিস্তানতে মানতে হয়। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর যারা একথাগুলো বলছে, তারা কি আসলে পাকিস্তানই চায়? বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা না মানলে তাহলে জিন্নাহকেই কি তারা আমাদের জাতির পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়? এক জায়গায় দেয়াল লিখন দেখলাম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম। হজরত ইব্রাহিম আমাদের ধর্মীয় পিতা হতে পারেন, কিন্তু জাতির পিতা কী করে হন? হজরত ইব্রাহিম তো বাংলাদেশের মানুষ নন। তাহলে বাংলাদেশের জাতির পিতা তিনি কী করে হন? বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণে তাঁর তো কোন অবদান নেই। আবার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হজরত আদমকেই পিতা মনে করা হয়, ইসলাম ধর্মমতে তিনি গোটা মানব জাতির পিতা।
ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠিত হলে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইত্যাদি পৃথক পৃথক রাষ্ট্র হতো না। অনুরূপভাবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ভিন্ন ভিন্ন কত রাষ্ট্র আছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হতে হবে তাও ঠিক নয়। তাহলে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হতো কিন্তু হয়নি। অথচ প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্কের খেলাফত ভেঙে দেয়া হলে সেই খেলাফত রক্ষার জন্য আমরা ভারতে কত আন্দোলন করেছি।
বাঙালি মুসলমানের সমস্যা হলো তারা ঐতিহ্যের জন্য তাকিয়ে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। এক সময় ছিলো বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ভুলে মুসলমানরা ইরান, তুরান, বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের বীরদের কাহিনী সম্ব^লিত পুঁথি পাঠ শুনে রাতভর মজে থাকতো। সোহরাব –রুস্তম, আমীর হামজা, সোনাভান, ইউসুফ-জুলেখা, সয়ফলমুলক-বদিউজ্জামাল এসব পুঁথির রসাস্বাদন করেই বাঙালি মুসলমান তৃপ্তি খুঁজে পেত। নিজের দেশে বীরের অভাব ছিলো না, কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা ধর্মীয় আবেগে তাদের দিকে ফিরে তাকাবার ফুরসৎ পায়নি। অতীতাশ্রয়ী মানসিকতার কারণে বাঙালি মুসলমান বর্তমানের দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পায়নি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি মধ্যপ্রাচ্য থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। এই নবজাগ্রত বাঙালিকেই শেখ মুজিব তাঁর রাজনীতির উপজীব্য করলেন এবং ক্রমান্বয়ে তাঁদের চেতনায় শান দিতে দিতে বাঙালির জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নে উজ্জীবিত করতে থাকেন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্তে¡র স্থলে বঙ্গবন্ধু হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের সমন্বয়ে একজাতিতত্ত¡ প্রচার করতে থাকেন। এটাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এমনি করে পূর্ববঙ্গের অন্য কোন নেতা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রচার করেননি। সেজন্যই শেখ মুজিব বাঙালি জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা একথা আমাদের সংবিধানেই লেখা আছে। সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বল পড়ে দেখলেই জানা যাবে, সংবিধানেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ এমএনএ ও এমপি-রা আগরতলায় বসে একটি সাধারণ ঘোষণা তৈরি করেছিলেন। সেদিন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারও গঠন করা হয়, যে সরকার ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করেন। উক্ত ঘোষণাই সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বল হিসেবে সন্নিবেশিত হয়েছে। সুতরাং শেখ মুজিবকে জাতির পিতা না মানলে সংবিধানকে অস্বীকার করা হবে। শেখ মুজিব জাতির পিতা নন, যারা একথা বলছেন, তাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন করছেন।
স্বাধীনতার পর অর্ধশতাধিক বছর কেটে গেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জাতির পিতার আসন নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি। সত্যিই বঙ্গবন্ধু মহাকাব্যের এক ট্রাজিক হিরো। তাঁর মতো ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকেও হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে ঠিকই জাতির পিতার আসনে সসম্মানে রেখে দিয়েছে ভারত। সেখানে জনতা, বিজেপি, কত রকম সরকার এলো গেলো কিন্তু মহাত্মা গান্ধীকে জাতির পিতৃত্বের আসন থেকে সরানোর দুর্বুুদ্ধি সেদেশে কারো হয়নি। পাকিস্তানে জিন্নাহও জাতির পিতা রয়ে গেছেন। ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ণ, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক জাতির পিতার আসনে সমাসীন আছেন। শুধু আমাদের দেশেই এমন কথা শুনা যায়, বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা নন, তাঁকে কে জাতির পিতা বানিয়েছে?
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর বঙ্গবন্ধু বিরোধী মুশতাক, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের আমলেও বঙ্গবন্ধুর জাতির পিতার আসন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। তারা কেউ বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার আসন থেকে সরাতে চাননি। এখন যারা বলছে , তাদের জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মাটিতে, জলহাওয়ায় তারা বেড়ে ওঠেছেন। তারা তাদের পিতা, পিতামহদের জিজ্ঞেস করলে তারাই বলতেন, শেখ মুজিব কিভাবে জাতির পিতা হলেন? তাকে কে বা কারা জাতির পিতা বানিয়েছে। তাদের ঘর থেকে তারা যেটা জানতে পারতেন, সেটা নিয়ে দেশে কেন শোরগোল পাকাচ্ছেন?

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আলবিদা ২০২৪

২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া লাইফ ইন এ মেট্রো ছবির আলবিদা শিরোনামের গানের লাইন এটি। (উল্লেখ্য বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী জেমসের গাওয়া)। সত্যিই তো আর মাত্র

বিস্তারিত »

‘দিনের পর দিন অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ চলতে পারে না’

সংস্কারের কারণে দিনের পর দিন অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ চলতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) জাতীয়

বিস্তারিত »

সচিবালয়ে প্রবেশ: সাময়িক অসুবিধায় দুঃখ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চায় সরকার

সচিবালয়ে প্রবেশ ইস্যুতে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চেয়েছে সরকার। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভয়াবহ

বিস্তারিত »

পিকনিক বাসে  বিদ্যুতায়িত হয়ে ৩ ছাত্রের  মৃত্যু ঘটনায় তদন্ত কমিটি

গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি পিকনিক বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট

বিস্তারিত »

৫ বসতঘর আগুনে পুড়ে ছাই চট্টগ্রাম বোয়ালখালীতে

বোয়ালখালী ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো.সাইদুর রহমান জানান, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে টিনশেড মাটির ৫টি বসতঘর পুড়ে গেছে। খবর পেয়ে বোয়ালখালী

বিস্তারিত »

সেনাকুঞ্জে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া এক যুগ পরে

দীর্ঘ এক যুগ পর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলে আজ বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) বিকাল

বিস্তারিত »

পদত্যাগ তিন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, কাজী রেজা-উল হক ও এ.কে.এম. জহিরুল হক

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। হাইকোর্টের তিন বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। তারা হলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক

বিস্তারিত »

এবি পার্টির নতুন আহ্বায়ক হলেন আব্দুল ওহাব

আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) নতুন আহ্বায়ক হলেন খ্যাতিমান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার। মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) রাতে

বিস্তারিত »