রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ১২ মাঘ, ১৪৩১, ২৫ রজব, ১৪৪৬

কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী সাম্প্রদায়িক তমসায় এক চিলতে রোদ্দুর : নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে আন্দোলরত ছাত্রদের ওপর বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা যখন ঘটে, মাহবুব উল আলম চৌধুরী তখন চট্টগ্রামে অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর বসন্ত হয়েছিলো। সারা গায়ে বসন্তের ফোস্কা পড়েছে, প্রচ- জ্বরে ব্যথায় তিনি কাতরাচ্ছেন; এমনি সময়ে তাঁর কাছে খবর আসলো ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার চেষ্টা চালালে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে এবং বেশকিছু ছাত্র হতাহত হয়েছে। এখবর শুনে মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রচ- ক্রোধে আগ্নেয়গিরির ন্যায় জ্বলে উঠেন এবং কোনমতে বিছানায় উঠে বসেন। তাঁর ওপর তখন কাব্যদেবী ভর করেছে। তিনি কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসেন, তাঁর কলম থেকে যেন কালি নয়, রক্তের আলপনা আঁকা হচ্ছে কাগজের বুকে। এক সময় হাঁপাতে হাঁপাতে কবির শ্বাস পতন দ্রুততর হয়, দেখা যায় একটি রক্তিম পদাবলী লিখে ফেলেছেন তিনি, যার শিরোনাম দেন “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।” পরে জানা গেল যে, তাঁর কবিতাটিই একুশের ঘটনার অভিঘাতে রচিত প্রথম কবিতা।
এই কবিতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে এত খ্যাতি এনে দেয় যে, তাঁর অন্যান্য অবদান চাপা পড়ে যায়। ফলে কেউ মনে রাখেন না যে, তিনি চট্টগ্রামে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের প্রধান সংগঠক এবং তখন ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন। কেউ মনে রাখেন না যে, তিনি ১৯৫১ সালের ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ মার্চ চারদিনব্যাপী চট্টগ্রাম শহরের মোমিন রোডের হরিখোলা মাঠে (চেরাগী পাহাড়ের অনতিদূরের এই মাঠটিতে বর্তমানে হিন্দু ফাউন্ডেশনের একটি ভবন নির্মিত হয়েছে।) অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সংস্কৃতি সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং অভ্যর্থনা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। সভাপতি ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল এবং যুগ্ম আহবায়ক সাহিত্যিক শওকত ওসমান ও সায়ীদুল হাসান (একাত্তরে শহীদ)। আমরা ভুলে যাই যে পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টায় প্রান্তিক গণনাট্য সংঘ গঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র আড়াই মাস পরে তাঁর সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে ‘সীমান্ত’ নামে একটি প্রগতিশীল মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় (১৯৪৭-১৯৫২)। পত্রিকাটি নামে সীমান্ত, কিন্তু কাজে সীমান্ত মানতো না। ৪৭-এর ১৪ আগস্ট র‌্যাডক্লিফের রোয়েদাদ অনুযায়ী বৃহত্তর বাংলা ভাগ হয়ে যায় এবং একটি সীমান্ত দ্বারা পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ নামে চিহ্নিত হয়। কবি এই সীমান্ত মানেন না অর্থাৎ দেশভাগ তাঁর মনঃপুত নয়, সেটা বোঝানোর জন্যই যেন তিনি ব্যঙ্গ করে তাঁর সাময়িকীর নাম রাখলেন ‘সীমান্ত’। উভয় বাংলার সাহিত্যিকদের লেখাই তিনি প্রকাশ করতেন এবং প্রথম সংখ্যার মলাটে পূর্ববঙ্গের গভর্ণরের বাণী না দিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষের বাণী ছেপেছিলেন।
সাতচল্লিশের দেশভাগের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িকতা প্রচ্ছন্ন, সেটা অনেকে বুঝলেও কেউ তা’ প্রকাশ করতে সাহস পান নি। সাম্প্রদায়িকতার সেই তমসাবৃত সময়ের (১৯৪৬-১৯৫১) বিবর থেকে উষার দুয়ারে আঘাত হেনে রাঙা প্রভাত ছিনিয়ে এনেছিলেন যে ভোরের পাখিরা, তাঁরা সবাই চট্টগ্রামের শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মী। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, সুচরিত চৌধুরী, আজিজ মিসির, মোস্তফা নুরুল ইসলাম, এবনে গোলাম নবী, কলিম শরাফী, চিরঞ্জীব দাশশর্মা, গোপাল দাশ, মাহবুব হাসান, রুহুল আমিন নিজামী, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, চিত্ত বিশ্বাস ও মাহবুব উল আলম চৌধুরীরা চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে তার মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন।
সাতচল্লিশে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে (পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান) কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সাম্প্রদায়িক চেতনা এত প্রবল আকার ধারণ করে যে, হিন্দুরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। এমনকি বৌদ্ধরাও শংকিত হয়ে পড়ে। ইসলামী জোশে কিছু মানুষ ইসলামী ছাপমারা সাহিত্য রচনা ও সংস্কৃতি চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়ে। আরব ও পারস্যের রূপকথা, লোককাহিনীকে মুসলমানের ঐতিহ্য মনে করে তার রস আস্বাদনে মেতে ওঠে মুসলমান সমাজ। পাকিস্তান শব্দ যুক্ত করে কিছু মানুষ হাট-বাজার, ক্লাব-সমিতির নামকরণে উৎসাহী হয়ে ওঠে। যেমন রাতারাতি “পাকিস্তান বাজার” লেখা সাইনবোর্ড নাম পাল্টে হয়ে গিয়েছিলো ‘বাংলা বাজার’। অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার লালন অঘোষিততভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। একমাত্র চট্টগ্রাম থেকেই এ সময় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ শোনা গিয়েছিলো। অনেক অনেক দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার পর হঠাৎ একদিন যেমন এক চিলতে রোদ্দুর মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ার মতোই যেন লৌহ যবনিকা ভেদ করে চট্টগ্রামের সাহসী উচ্চারণে পরম নির্ভরতা ও আশ্বাস ধ্বনিত হয়েছিলো। মৌন মুক জাতির আশা ভাষা পেয়েছিলো যাদের কণ্ঠে, বয়স্ক বিদ্রোহী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আবুল ফজলের গম্ভীর ডম্বরুর সঙ্গে তরুণতর মাহবুব উল আলম চৌধুরীর তরুণ কণ্ঠের বজ্র নির্ষোষও ধ্বনিত হয়েছিলো। মাহবুব উল আলম চৌধুরীরা হিন্দু-মুসলিম বিভেদ নয়, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের যে সমন্বয়ের কথা বললেন, তা’ থেকেই পরবর্তীকালে জন্ম হয়েছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এদিক থেকে ভেবে দেখলে মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে যুগ¯্রষ্টা বলেই মনে হয়। একাত্তর সালে বাঙালি জাতি যে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে, মাহবুব উল আলম চৌধুরী কত আগেই না সে ইতিহাসের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মুখ্য চরিত্র। এই দশকের সূচনা হয় পাকিস্তানের মূলনীতি বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা উল্লেখ ছিল না । বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার স্বীকৃতি ছিল না। তাই মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে মানুষ আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলনকালে গঠিত মূলনীতি রিপোর্ট বিরোধী কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। অন্য যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের মাহবুবুল হক। এর বিরুদ্ধে লালদীঘি মাঠে অনুষ্ঠিত বিশাল সভায় মাহবুব উল আলম চৌধুরী বক্তৃতা করেন এবং মিছিলের নেতৃত্ব দেন।
পূর্ব পাকিস্তানে বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রথম শাখা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী উক্ত পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। সভাপতি ছিলেন আবদুল হক দোভাষ। এই পরিষদ আণবিক বোমা নিষিদ্ধকরণের দাবিতে সাত লক্ষাধিক স্বাক্ষর সংগ্রহ করে। এর স্বীকৃতিস্বরূপ মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে স্টকহোমে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো।
ভারতীয় বিশ্বশান্তি পরিষদের নেতা ফটিকছড়ির কৃতী সন্তান কমরেড চিত্ত বিশ্বাসকে নিয়ে তিনি দিল্লীতে কবি পাবলো নেরুদার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। পাবলো নেরুদা তাঁকে জবংরফবহপব ড়হ ঊধৎঃয বইটি উপহার-স্বরূপ দিয়েছিলেন।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনে তিনি চট্টগ্রাম থেকে পাঁচজন প্রতিনিধি নিয়ে যোগদান করেন, উক্ত সম্মেলনে পূর্বপাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হয়।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টায় গঠিত হয় প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ। কুমিল্লায় যে সংস্কৃতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তিনি তাতে প্রান্তিকের শিল্পীদের নিয়ে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে তিনি নজরুল সঙ্গীতের আসর উদ্বোধন করেন এবং সাহিত্য অধিবেশনে ‘সমাজ ও সাহিত্য’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিহত শহীদদের স্মরণে তাঁর কবিতা “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি”। পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হওয়ার পরেরদিনই অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করে এবং কবি ও কবিতা প্রকাশকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে।
১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে প্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পার্টি গণতন্ত্রী দল গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সম্পাদক। জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি বদিউস সালাম।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রামে কবি নজরুল নিরাময় সমিতি গঠন করেন। এই সমিতির সদস্য ছিলেন শওকত ওসমান, এস এ জামান, আহমেদুল কবির, কবীর চৌধুরী, বদিউস সালাম প্রমুখ। এই কমিটি চট্টগ্রাম থেকে ১৭ হাজার টাকার মতো অর্থ সংগ্রহ করে । এই কমিটির অর্থায়নে ১৯৫৩ সালের ১৪ মে নজরুলকে নিয়ে রবিউদ্দিন, কবিপতœী, ছেলে অনিরুদ্ধ, সেবিকা ঘোষকে নিয়ে সিন্ধিয়া কোম্পানির জাহাজে করে বোম্বে থেকে বিদেশ যাত্রা করেন। একাত্তরে শহীদ সয়ীদুল হাসানও বিলেত থেকে এই তহবিলে অর্থ সংগ্রহ করে দেন। ভিয়েনায় তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর পাসপোর্ট নবায়ন করতে দিলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে। পাসপোর্ট না পাওয়ায় দীর্ঘ ১৯ বছর তিনি দেশের বাইরে যেতে পারেননি। একই সালে চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে দাঙ্গাবিরোধী শান্তি পরিষদ ও শান্তি ফৌজ নামের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়। তারও সম্পাদক ছিলেন তিনি এবং সভাপতি ছিলেন আবদুল হক দোভাষ।
১৯৫৪ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রতিনিধি ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে তিনি ‘সাহিত্যে সমাজ চেতনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করার জন্য চট্টগ্রামে যে কর্মী শিবির গঠিত হয় তিনি ছিলেন তার আহবায়ক।
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর মে মাসে ৯২-ক ধারা জারি করা হলে মাহবুব উল আলম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৫৫ সালে তিনি আত্মগোপন অবস্থা থেকে ফিরে আসেন। তিনি চট্টগ্রাম শাখা যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে আন্তঃকলেজ সম্মেলনে তাকে প্রধান অতিথি করা হয়।
১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ প্রাঙ্গণে যে আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তিনি ছিলেন তার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি চট্টগ্রাম কৃষ্টি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সুয়েজখাল সংকটের সময় তিনি লালদীঘির ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ করেন এবং মিসরের পক্ষে বিরাট মিছিল বের করেন। তাঁর লেখা ‘মিসরের মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়।
১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের একটি সাংস্কৃতিক স্কোয়াড নিয়ে তিনি মওলানা ভাসানী আহূত কাগমারী সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে মাহবুব উল আলম চৌধুরী বক্তৃতা করেন। কাগমারী সম্মেলন আওয়ামী লীগের বিভক্তি ও ন্যাপ-এর জন্মের জন্য প্রসিদ্ধ।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
১৯৫৯, ১৯৬১ সালে তিনি চট্টগ্রামে অধ্যাপক আবুল ফজলকে নিয়ে বৃহৎ আকারের দুটি সংবর্ধনার আয়োজন করেন।
১৯৬৪ সালে শাসকগোষ্ঠীর প্ররোচনায় আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তিনি চট্টগ্রামে দাঙ্গাবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক হিসেবে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বিধানের লক্ষ্যে গ্রাম পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠন করেন।
১৯৬৫ সালে ২ জানুয়ারি বুনিয়াদী গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন ধার্য হয়। তাতে সম্মিলিত বিরোধী দলের (ঈঙচ) ৯-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ফাতেমা জিন্নাহ্ প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত হন। তিনি ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে চট্টগ্রামে কমিটি গঠন করে ব্যাপক প্রচারণায় নামেন। ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে আবার প্রগতিশীল কর্মীদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। তিনি গ্রেফতার এড়াতে পুনরায় আত্মগোপনে চলে যান।
১৯৬৫-৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে দুই লাইনের সংগ্রামের পরিণতিতে পার্টি দু’ভাগ হয়ে গেলে তিনি প্রচ- মানসিক আঘাত পান এবং রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৯৬৬ সালে নোবেল প্রাইজ বিজয়ী ফাদার পীয়ের-এর সাহায্য-সহায়তায় গ্রামের উন্নতির জন্য শান্তির দ্বীপ নামক প্রকল্প স্থাপন করেন নিজ গ্রামে।
১৯৭১ সালে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে জড়িত করেন। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতা’ (১৯৭২-৮২) পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি ছিলেন। ডিসেম্বর মাসে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে যান।
নব্বই দশকে প্রায় আটবছর ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন। দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আমৃত্যু তিনি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত লোকসঙ্গীত সম্মেলন, যুব উৎসব প্রভৃতি কার্যকলাপে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
২০০৬ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয়ভাবে তাঁর ৮০তম জন্মজয়ন্তী পালিত হয়। এই উপলক্ষে ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী: এক অবিস্মরণীয় কবিতার জনক’ নামের প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠার একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
২০০৭-এর জুলাই মাসে তাঁর রচিত বিভিন্ন কবিতা এবং গান সম্বলিত ‘সময়ের স্মৃতি’ সিডির মোড়ক উন্মোচন করে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী।
১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর রাউজান থানার গহিরা আসাদ চৌধুরী বাড়িতে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্ম। পিতার নাম আহমদুর রহমান চৌধুরী, মাতা রওশন আরা বেগম। মাহবুব উল আলম চৌধুরী মাতুলালয়ে প্রতিপালিত হন।
জন্মসূত্রে মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম বিজয়ী মোগল বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি শেখ মোহাম্মদ আদম লস্করের (বড় আদম লস্কর) বংশধর। চট্টগ্রামের অনেক মনীষী এবং বিখ্যাত পরিবারের উৎপত্তি বড় আদম লস্কর থেকে। দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক, দৈনিক আজাদীর দীর্ঘ সময়ের সম্পাদক ও সাবেক এমএনএ অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, দৈনিক আজাদীর বর্তমান সম্পাদক এমএ মালেক, উনিশ শতকের খাতুনগঞ্জের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম চৌধুরী (সুলতানপুর নিবাসী; সাংবাদিক আতাউল হাকিমের দাদা), মৌলভী আবুল কাশেম বিএল. চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম এমবি ডা. আবুল হাশেম, সাবেক জজ আবু মোহাম্মদ হোসেন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা মওলানা আবদুল্লাহেল কাফী ও আবদুল্লাহেল বাকী ভ্রাতৃদ্বয়, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ফজলুল কবির ও তাঁর পুত্র রাউজানের বর্তমান এমপি ফজলে করিম চৌধুরী এবং গহিরা আসাদ চৌধুরী বড় আদম লস্করের উত্তর পুরুষ। এই আসাদ চৌধুরীরই বংশের কৃতী পুরুষ মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তাঁর নানা গহিরার আবদুল লতিফ মাস্টার; মামারা হলেন আহমদ কবীর চৌধুরী, আহমদ সগীর চৌধুরী ও লুৎফে আহমদ চৌধুরী বা এল.এ. চৌধুরী। আহমদ কবীর চৌধুরী ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী-সাবেক এমপি আবদুল্লাহ আল হারুন এবং সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের পিতা। আহমদ সগীর চৌধুরী রেয়াজউদ্দিন বাজারের মালিক শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর জামাতা; তাঁর পুত্র শাহেদ আজগর চৌধুরী, রাশেদ আজগর চৌধুরী ও ওয়াহেদ আজগর চৌধুরী ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে খ্যাতিমান। রাজনীতিক এলএ চৌধুরী কন্যার বিবাহ সূত্রে সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর পুত্র বিখ্যাত শিল্পী সবিহ উল আলম তাঁর জামাতা।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী রাজনৈতিক আবহাওয়ায় লালিত পালিত হন। তাঁর মেজ মামা আহমদ সগীর চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি, তবে প্রগতিশীল মানুষ। মেজ মামা এলএ চৌধুরী ছিলেন শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের শিষ্য ও চট্টগ্রামে কেএসপির প্রধান নেতা। ৫৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন পরিচালনার জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম যুক্তফ্রন্টের আহবায়ক করা হয়েছিলো।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী মূলত মেজ মামার কাছেই মানুষ হন। এই মামাই চট্টগ্রাম বিদ্রোহের বিপ্লবীরা ১৯৫৪ সালে কারামুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসলে তাদেরকে তাঁর মালিকানাধীন সিমেনা হল ‘খুরশীদ মহল’Ñএ সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সে সময় বিপ্লবীদের খুব কাছ থেকে দেখার ও তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন থেকেই তাঁর মধ্যে বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি আগ্রহ জন্মে এবং পরবর্তীকালে তিনি যে বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছিলেন এটাই ছিলো তাঁর কারণ। বিপ্লবীরাও প্রায় সকলে মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।
লক্ষ্যণীয় মাহবুব উল আলম চৌধুরী মুসলিম ছাত্রলীগ না করে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র কংগ্রেসে যোগদান করেন। ছাত্র কংগ্রেসের কর্মী হিসেবে ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ বিরোধী ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
পরে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার আরো এক ধাপ অগ্রগতি হয়। তিনি ১৯৪৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গ সংগঠনে ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। এবছর চট্টগ্রামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে কলকাতা থেকে আসেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, ভবানী সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। সম্মেলনের কর্মী হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ বছর অনুষ্ঠিত আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের জন্মজয়ন্তী উদযাপন কমিটির অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। আমিন জুট মিল এলাকায় ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের ক্যাম্প। সেই ক্যাম্প থেকে দু’জন সৈনিক নিকটস্থ কাঁহারপাড়া গ্রামে একজন মহিলার শ্লীলতাহানি করলে পাড়ার লোকেরা তাদের মারধর করে। পরের দিন সেনাবাহিনীর একটি দল নিয়ে তারা পেট্রল দিয়ে সমস্ত কাঁহারপাড়া পুড়িয়ে দেয়। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে তীব্র ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৬ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বীর বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত হয় দাঙ্গাবিরোধী শান্তি কমিটি। সভাপতি ছিলেন জেলা জজ শৈবাল গুপ্ত, সম্পাদক আহমদ সাগীর চৌধুরী। এ দাঙ্গাবিরোধী কর্মতৎপরতায় তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখেন। তাঁর লেখা পুস্তিকা ‘বিপ্লব’ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। এবছরই চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম নজরুল জয়ন্তী উদযাপিত হয়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন উদযাপন কমিটির সম্পাদক এবং অধ্যাপক আবুল ফজল সভাপতি।
তিনি ১৯৪৭ সালে গহিরা হাইস্কুল থেকে বৃত্তিসহকারে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন আই.এ. পড়ার জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে পড়া অসমাপ্ত রেখে কলেজ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৪৭ সালের নভেম্বরে মাহবুব উল আলম চৌধুরী ‘সীমান্ত’ প্রকাশ করেন। সীমান্তের দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা (১৯৫০) দুই বাংলার প্রগতিশীল আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করে। সীমান্ত পাঁচ বছরে মোট ৪৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল । তার মধ্যে ১৩টি সংখ্যা খুঁজে পাওয়া গেছে। ড. ইসরাইল খান ও জওশন আরা রহমানের সম্পাদনায় এই ১৩টি সংখ্যা সীমান্ত সংগ্রহ’ নামে প্রকাশিত হয় (২০০৫)।
১৯৪৮ সালে তাঁর সম্পাদিত ‘সীমান্ত’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে ‘সংস্কৃতি বৈঠক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের প্রথম গণহত্যা সংঘটিত হয় হাটহাজারী থানার মাদার্শায় হালদা নদীর ‘টেক’-এ। এ ‘টেক’ কাটলে ওই অঞ্চলের কৃষকদের প্রভূত উপকার সাধিত হতো। পাকিস্তানি মুসলিম লীগ সরকার কোনোমতেই সেই ‘টেক’ কাটতে দেবে না। কৃষকেরা জোর করে ‘টেক’ কাটতে গেলে পুলিশের গুলিতে ১৮ জন কৃষক নিহত হয়। এর প্রতিবাদে মিটিং-মিছিল করে চট্টগ্রামের মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। যাঁরা এই আন্দোলনে নেতৃত্বে দেন, তাঁদের মধ্যে এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের ও মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রচেষ্টায় গহিরা হাইস্কুলের সাহায্যার্থে স্কুল মাঠে ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
১৯৪৯ সালে ২২ ও ২৩ নভেম্বর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে যে বিশ্বশান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেই সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে মাহবুব উল আলম চৌধুরী এবং শহীদ সাবের যোগদান করেন। ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আবদুস সালাম। সেখানে কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, শান্তির সংগ্রাম ও বাঁচার সংগ্রাম এক হয়ে গেছে। সম্মেলন শেষে মিছিল বেরুলে পুলিশ মিছিল থেকে মাহবুব উল আলম চৌধুরীসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে তালতলা থানায় নিয়ে যায় এবং আলীপুর জেলে প্রেরণ করে। তিনদিন পর তাঁদের মুক্তি দেয়া হয়।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী লোহাগাড়া থানার চুনতি গ্রামের একটি উচ্চ শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিদূষী তরুণী ভাষা সংগ্রামী জওশন আর রহমানের পাণি গ্রহণ করেন। এই বিয়ের সূত্রে তিনি চট্টগ্রামের কিংবদন্তীতুল্য মুন্সেফ শুকুর আলীর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত হন। ঊনবিংশ শতাব্দিতে চট্টগ্রামে দু’জন মুন্সেফ বিশেষ খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। একজন উপর্যুক্ত শুকুর আলী মুন্সেফ ও অপরজন পটিয়া থানার ভাটিখাইনের হরচন্দ্র মুন্সেফ।
হরচন্দ্র মুন্সেফের কনিষ্ঠ পুত্র কেদারনাথ দাশগুপ্ত স্বদেশব্রতী, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও নাট্যকার হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকালে কলকাতায় “লক্ষ্মীর ভা-ার” নামে স্বদেশী দ্রব্যদি বেচাকেনার জন্য একটি জাতীয় ভা-ার খোলেন। কিছুদিন পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্পাদক করে “ভা-ার” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
কেদারনাপ পরে লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি “টহরড়হ ড়ভ ঊধংঃ ধহফ ডবংঃ” নামে একটি সমিতি গঠন করে নিজে তার সম্পাদকের কার্যভার গ্রহণ করেন। তিনি একজন উচ্চ শ্রেণির অভিনেতা ও নাট্যকার ছিলেন। তাঁর রচিত ‘শকুন্তলা’ ও ‘ভারত’ নামীয় ইংরেজি নাটকদ্বয় লন্ডন শহরের প্রসিদ্ধ রঙ্গমঞ্চসমূহে অভিনীত হয়ে দর্শকদের প্রশংসাধন্য হয়। উক্ত নাটকের প্রথম অভিনয়ে ভারত স¤্রাট ও স¤্রাজী উপস্থিত থেকে নাট্যকারের উৎসাহ বর্ধন করেছিলেন। তিনি পরে আমেরিকা চলে যান। তিনি আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে দুটি আন্দোলন চালান। প্রথম আন্দোলন তিন সত্য প্রতিষ্ঠা যথা (১) টহরড়হ ড়ভ ঊধংঃ ধহফ ডবংঃ (২) খবধমঁব ড়ভ হবরমযনড়ঁৎং (৩) ঋবষষড়ংিযরঢ় ড়ভ ভধরঃযং দ্বিতীয় আন্দোলন অষষ ড়িৎষফ মধহফযর ঋবষষড়ংযরঢ় (নিখিল বিশ্ব গান্ধী সংঘ প্রতিষ্ঠা)।
হরচন্দ্র মুন্সেফের একজন বংশধর মধুমিতা দাশগুপ্তকে আমি জানি। তিনি একজন শিক্ষা সংগঠক ও বিখ্যাত শিক্ষক। ইংরেজি সাহিত্যে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই বিদ্বান ও রুচিবান নারী এক সময় সাইডার ইন্টারন্যাশনাল ও মাস্টারমাই-ের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর পিতা তুষারেশ্বর দাশগুপ্ত (হারু বাবু) একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তিনি জীবনে যত উপার্জন করেছেন, তার সিংহভাগ সৎ কাজে ব্যয় করেছেন। চট্টগ্রামের প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক দলকে তিনি নীরবে মোটা দাগে অর্থ সাহায্য প্রদান করতেন।
বাঙালি জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদের সময়ে একাত্তরের ২৮ মার্চ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচ- আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আওয়ামী লীগ নেতা এমএ মান্নান, ইদরিস আলম ও মোহাম্মদ হারিছ রেস্ট হাউসের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে দিয়ে পাথরঘাটায় হারুদার বাসায় আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন। পরে তাঁরা কোরবানীগঞ্জে হাকিম-জলিল ম্যানসনে চলে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ হারুদাকে কতটা বিশ্বাস ও তার ওপর কতটা নির্ভর করতেন, তারই প্রমাণ পাওয়া যায় উপর্যুক্ত ঘটনায়।
জওশন আরা রহমানের সঙ্গে বিয়ের সুবাদে মাহবুব উল আলম চৌধুরী কবি সুফিয়া কামাল, বাংলাদেশে নৃত্যকলার আদিগুরু বুলবুল চৌধুরী, খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হন। জওশন আরা রহমানের তিন ভাই-ই উচ্চ শিক্ষিত এবং পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা আহমদ ফরিদ সিএসপি ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। জওশন আরা রহমান বাংলাদেশে ইউনিসেফ-এর প্রধান এবং উপদেষ্টা ছিলেন।
৭ নভেম্বর ২০০৮, মহাপ্রয়াণের পর কবির ৮২তম জন্মবার্ষিকীতে, তাঁর অনুরাগীদের রচনা, অনুষ্ঠিত শোকসভা, সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন স্মরণিকায় শ্রদ্ধা নিবেদনের বিবরণ ইত্যাদি সংকলিত করে তুমি রবে নীরবে’ শিরোনামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ হয়। নভেম্বর ২০১১ কবির ৮৫তম জন্মবার্ষিকীতে ‘স্মরণে বরণে’ শিরোনামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেলোশীপ এবং ২০০৯ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

কবিয়াল ফণী বড়ুয়া দেশ-কালের আদর্শ

লোকসংস্কৃতি ও আধুনিক কবিগানের রূপকার কবিয়াল ফণী বড়ুয়া। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী, প্রগতিপন্থী, আজীবন ত্যাগী ও নিরলস সংগ্রামী জীবন চেতনার প্রতীক, দেশ ও কালের আদর্শ। ফণী

বিস্তারিত »

মুজিব আমার

বঙ্গ তুমি বন্ধু তুমি মুজিব রহমান সূর্য তুমি চন্দ্র তুমি তুমি আমার প্রান। জনক তুমি স্বজন তুমি মুক্ত মুজিব দেশে খাঁচা ভেঙ্গে দোয়েল পাখি উঠলো

বিস্তারিত »

নতুন অতিথি

দলের ভিতরে একটি ছেলে তার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিটা সজারু কাঁটার মতো খাড়া হয়ে আছে। ওর মতো কেউ আর এ রকম চোখ

বিস্তারিত »

মৃত্যুঞ্জয়ী লৌহমানবী

অসংখ্যবার মানববেষ্টনীর মাঝে এত ভালবাসা এত প্রিয় জননী বাংলার, লৌহমানবী তুমি! মৃত্যুভয় জয় করে ইস্পাত কঠিন মনোবল। গুলি, বোমা, গ্রেনেড আরও কত কী – একবারও

বিস্তারিত »

বঙ্গবন্ধুর যোগ্যকন্যা

হঠাৎ শুনি পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টে বঙ্গবন্ধু খুন হয়েছন মন ভেঙে যায় কষ্টে! চারিদিকে শোকের মাতম অশ্রুঝরা চোখ পিতার শোকে কাতর হলো সারাদেশের লোক! যে মানুষটি

বিস্তারিত »

শেখ হাসিনা

মুখখানা বেশ হাসিখুশি একফালি চাঁদ-তারা আগস্টের এক কালো রাতে মা-বাবা-ভাই হারা! দুর্বিসহ বিভীষিকার চাপা কষ্ট বুকে মা-বাবা-ভাই সব হারিয়ে ক্যামনে থাকে সুখে? নিদারুণ এক বহ্নিশিখা

বিস্তারিত »

জননেত্রী শেখ হাসিনা

মমতায় তুমি আগলে রেখেছ মাটি, অন্তরে প্রেম তাঁর তরে আছে খাঁটি! মানুষের দুখে চলে আসে চোখে জল, উন্নয়নের এনেছ জোয়ার ঢল। দৃঢ়তায় তুমি দেখতে চেয়েছ

বিস্তারিত »

শুভ জন্মদিন

মেঘ মুলুকের পাহাড় থেকে সানাইয়ের সুর এসে দিচ্ছে হাওয়ার পাল উড়িয়ে নিবিড় ভালোবেসে যাচ্ছে কারা বাঁধনহারা গুনগুনিয়ে আজ বঙ্গজুড়ে কিসের আভাস মিষ্টি মধুর সাজ। সাগরতীরের

বিস্তারিত »

মধুমতীর কন্যা তুমি: নদী বাংলার ঢেউ

তুমি হেঁটে গেলে আকাশের পাবন দেবতা তোমার আঁচলে একমুঠো শান্ত হাওয়া ঢেলে দেয় তুমি যখোন উদাসীন দুপুরে একা একা অদূরে বউটুবানীর নরোম শাক তোলো বিলের

বিস্তারিত »