দলের ভিতরে একটি ছেলে তার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিটা সজারু কাঁটার মতো খাড়া হয়ে আছে। ওর মতো কেউ আর এ রকম চোখ নিয়ে তাকাচ্ছে না। পাশে আরও চার-পাঁচজন ছেলে। অবশ্য একজনকে ছেলে বলা মুশকিল। দাড়ি-গোঁফে তাকে যুবক বলা যায়। নওশা মাথায় আনতে পারে না তাকে দেখতে আসা ছেলেটি কে। হলুদ টি-শার্ট পরা ছেলেটি নাকি আকাশি শার্টের ফরসা চেহারার ওই ছেলেটি। নওশা ভাবে ওই দুটোর মধ্যে একজন তো হবেই। বুয়েটের ছেলেপেলেদের দেখলেই বোঝা যায়।
ভাবিরা নওশাকে সাজুগুজু করতে বেশ চেপে ধরেছিল। ঠোঁটে একটু হালকা লিপিস্টিক মাখতে বলেছিল। বড় ভাবির কাছে আছে দামি দামি আইলোনা। দামি দামি ফেসওয়াশ আর ডজন কালারের লিপস্টিক। সবসময় ভাবি শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে ওসব লাগায়। সাজলে ভাবিকে মায়াবী পরির মতো লাগে।
ছোটভাবির সাথে বড়ভাবির অদ্ভুত গড়মিল। চলাফেরায়ও বেশ অমিল। অথচ শ্যামলা মেয়েরাই সাজগোছের ব্যাপারটা সকাল বিকাল মাথায় রাখে। কিন্তু ছোটভাবি কখনো এসবের ধারেকাছে থাকে না। ওর গায়ের রং শ্যামলা হলেও তার চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দরে ভরা। কারুর চোখ ওচোখে স্থির হলে কেউ সহজে আর সরাতে চায় না। ছোটভাবি অবশ্য তার চোখের সৌন্দর্য বুঝতে পারে কিনা সে জানে না। নাহলে আয়নার সামনের দাঁড়িয়ে সে রাতদিন চোখ দেখত। কিন্তু ছোট ভাবিকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। নিজেকে নিয়ে বড়ই আত্মভোলা ছোটভাবি।
দাঁড়িঅলা লোকটা হঠাৎ মুখ খুলল।
কী নাম বোনের?
নওশার কাছে লোকটিকে বেশ ভদ্রই মনে হলো। আজকাল তো বোন ডাকাডাকি উঠেই যাচ্ছে। কীসব আজেবাজে সম্বোধন চালু হয়ে গেল এ দেশে।
আপনার নাম জানতে চাইছি। আমার নাম আবদুল কালাম। আমি আশিকের বড় ভাই।
লজ্জায় পড়ে গেল নওশা। সে বলল, নওশাত আরা।
খুব সুন্দর নাম বোনের। আপনি কি কবিতা লিখেন?
জি, মাঝে মাঝে লিখি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, কবিতা তো মাঝে মাঝে লিখেন কবিরা। গত শুক্রবার প্রথম খবরে আপনার একটি কবিতা পড়লাম। কবিতাটি আমি ঘরের সবাইরে পড়ে পড়ে শুনালাম। মা-বাবা প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হলেন। চোখ বড় বড় করলেন।
নিজের প্রশংসা শুনে নওশার মনটা দ্রুত ভালো হয়ে যেতে থাকল। কিছুক্ষণ আগেও তার চেহারায় যে মলিমতার ছাপ ছিল এখন সেটা আর লক্ষ করা যাচ্ছে না।
আবদুল কালাম বললেন, মায়ের কাছে হুমায়ূনের আপাদমস্তক সব বই-ই আছে। যেদিন হুমায়ূন চলে গেলেন সেদিন মায়ের কী অঝোরধারা কান্না। তারপর মা হুমায়ূনের বইপড়াই বন্ধ করে দিলেন।
কেন হুমায়ূন স্যারের বইপড়া বন্ধ করে দিলেন’ এ মুহূর্তে প্রশ্নটা উপরের দিকে উঠে আসলেও হঠাৎ কী বুঝে নওশা আগের মতোই চুপ হয়ে থাকল।
মাঝখানে বসা একটি ছেলে কিছু বলার জন্য উসখুস করতে থাকল। পাশের বাকি তিনটে ছেলে নতজানু দৃষ্টিতে কেমন মিইয়ে মিইয়ে আছে। যে ছেলেটি কথা বলবে বলবে মনে হয়েছিল সে শেষতক কিছুই বলল না। সে ঘরের দেয়ালের চারপাশে চোখ ঘুরাতে থাকল।
আবদুল কালাম বললেন, হলুদ শার্ট পরা ছেলেটি আমার ছোটভাই। বুয়েট থেকে পাশ। ভালো ছাত্ররা সাধারণত একটু বোকাসোকা হয়। সেও তার ব্যতিক্রম নয়। তার চাকরির ওজনটা খারাপ না। কাজকর্মে বেশ কাবিল ছেলে। ভাই বলে ওর প্রশংসা করছি না। তার সিনিয়ররা তাকে বেশ সমীহের চোখে দেখছে। এই অল্প সময়ে সে অফিসের ছোট বস হয়ে গেছে। তার নেগেটিভ দিকও আছে। মেয়েমানুষের সাথে সাবলিল ভাষায় কথা বলতে পারে না। তুমি নিজেই খেয়াল করেছ তোমাকে দেখতে এসে সে এখনো মাথাটা নিচু করে রেখেছে। তুমি ওকে দেখে নাও। তোমার পছন্দ-অপছন্দ আমাদের পরে জানালে চলবে।
নওশা ছেলেটির দিকে আড়চোখে তাকাল। ছেলেটি আগের মতোই নিজের কোলের দিকে চোখ ফেলে রেখেছে। তার অবস্থা দেখে নওশার ঠোঁটে একচিলতে হাসি ঠাঁই নিল।
নওশার বড়ভাই এসে ওদের মেলায় হাজির হলেন। চমৎকার সপ্রতিভ দেখাচ্ছে তাঁকে। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক উপচে আছে। তাঁর উপস্থিতি পরিবেশটা হঠাৎ পাল্টে গেল।
আসুন, আপ্যায়নের জন্য আসুন। নওশার বড়ভাই বললেন।
নওশা আগেভাগে উঠে পড়ল। মা-বাবা থাকলেও বড় ভাই-ই এখন এই বাড়ির কর্তা। বড়ভাইকে সবাই সামলে চলেন। এই বাড়ির জন্য উনিই আইন তৈরি করেন। সে আইনেই এ বাড়ির আচার-আচরণ চলে।
নানান আয়োজনে টেবিলটা ভরে গেছে। ঝাল থেকে শুরু করে মিষ্টির কোনো আইটেম আর বাকি নেই। দু’চার রকম হাতের বানানো পিঠাও পড়েছে। মাথার ওপরে ফ্যান চলছে সাঁ সাঁ করে। নাস্তার ঘ্রাণটা সবার নাকেমুখে এসে আছড়ে পড়ছে।
একপাশে জায়গা পেয়েছে বুয়েটের ছেলেটি ও নওশা। ছেলেটি কিছুটা মাথা উঁচু করে একদিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারায় জোছনার কণা বেড়ে চলেছে। সে এ মুহূর্তে টসটসে সুপুরুষ হয়ে উঠেছে।
সবাই আয়েসে খাবারের প্রতি মনোযোগী হলো। নওশা কাঁটা চামচ দিয়ে মুরগির পোড়া মাংস আলাদা করার চেষ্টা করছে। এবং মুখে পুরে দিয়ে আবার টিস্যুর সাহায্য নিচ্ছে।
একটু কথা বলবেন? প্রশ্ন করে ছেলেটি যেন এটম ফাটাল।
ছেলেটির কথায় সবাই সচকিত হলো। লাজুক লাজুক ছেলেটির হঠাৎ যেন সাহস বেড়ে গেল। বড়ভাই অপ্রস্তুত হয়ে নওশার মুখে তাকিয়ে আছেন। নওশার মুখ থেকে কী কথা নেমে আসে তিনি শুনার জন্য অস্থির হয়ে থাকলেন।
নওশা বলল, জি, বলুন।
আপনার নামটা বলবেন কি?
নওশাত আরা। সবাই নওশা নওশা বলে।
আপনি কি কবিতা লেখেন?
জি, লিখি।
একটি কবিতা শোনাবেন?
আমি আবৃত্তি পারি না। সব কবিরা আবৃত্তি পারে না।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তাও ঠিক। আবৃত্তি এক জিনিস, কবিতা অন্য জিনিস। আমার প্রশ্ন শেষ। আপনি কি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন?
না না, একদম না।
ধন্যবাদ আপনাকে।
খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে সবাই সোফায় গিয়ে বসল। বুয়েটের ছেলেটির নাম এ পরিবারে কেউ জানে না। নাম নিয়ে এখনো কারুর মাথাব্যথা নেই। পছন্দের জায়গাটি ঠিক হয়ে গেলে নামের পালাটি পরে আসবে।
আজ বিছানায় যেতে নওশার বেশ রাত হলো। ছেলেকে নিয়ে প্রকাণ্ড কানাঘুষা চলতে থাকল রাত অবধি। সাময়ের দিকে কারুর খেয়াল নেই। সবাই খোশমেজাজে একে অপরের কথা শেয়ার করছে। বড়ভাবি পড়ালেখার চেয়ে ছেলের শারীরিক কাহিনি বর্ণনা করছে। এ রকম সুদর্শন ছেলে নাকি ভাবি তার জীবনে কস্মিনেও দেখেনি।
রাতের আড্ডাটা যখন নিভুনিভু পর্যায়ে তাখন বড় ভাইয়ের মোবাইলটা বেজে উঠল। সবার কান-চোখ বড় ভাইয়ের কাছে নিপতিত হলো। সবার উৎসুক্য দৃষ্টি। সবার মনে বিরাট আশংকার বুদবুদানি। কারুর কারুর নিশ্বাসও আটকে যাচ্ছে।
বড়ভাই বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
উপস্থিত সবার মনে আলহামদুলিল্লাহর প্রতিধ্বনি হলো।
মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। মা বললেন, কার ফোন, কীসের ফোন?
ওরা ফোন করেছে। নওশাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। কথা পাকাপাকির জন্য সময় চাইছে।
মা বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
বড়ভাবি বলল, সবার জন্য চা বানাবো?
এতো রাতে বড়ভাবি কেন চা বানাতে বলল বিযয়টা কারুর মাথায় এলো না। তারপরেও মায়ের মুখ থেকে ফসকে বের হয়ে গেল, “বানাও”। বড়ভাবি চা বানাতে চলে গেল।
নওশা ঘরে এসে সিটকানি এঁটে দিল। ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। মাথাটা অবিরাম ঘুরতে থাকল গ্রহ-নক্ষত্রের মতো। ঘাড়ের উপরের অংশে প্রচণ্ড ব্যথা কাজ করছে। মোবাইলটা দূরে ছুঁড়ে দিল বিছানার অন্য প্রান্তে। পেট গুলাচ্ছে সমান তালে। বমির আভাস দিচ্ছে গলার কাছাকাছি। একটা বিরাট কাড়ফাটা চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে নওশার। কিন্তু চিৎকারের শক্তিটা কিছুতেই সে সঞ্চয় করতে পারছে না।
ও বন্ধ জানালাটা খুলে দিল। বাইরে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে লাইটপোস্টের আলো জ্বলছে। চচ্-চরর জাতীয় শব্দ হলো আমগাছ কি নিমগাছের কোথাও। অন্য সময় হলে সে ভয়ে ঠিকই কেঁপে উঠতো। তার স্নায়ুতন্ত্র বোধহয় আহত হয়ে কোথাও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। নিজের অস্থিত্বটা যেন সে নিজেই আন্দাজ করতে পারছে না। হাতড়িয়ে বালিশটা ও আঁকড়ে ধরল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
আধা ঘণ্টা কি একটা ঘণ্টা নওশা এভাবে নীরব মগ্নতায় পড়ে রইল। সে ধীরে ধীরে বালিশ থেকে মাথাটা আলাদা করার চেষ্টা করল। শেষতক সে ঠিকই মাথাটা আলাদা করতে সক্ষম হলো। অযত্নে পড়ে থাকা মোবাইলটা কাছে টেনে নিল। বটম টিপল অনেকগুলো। কিন্তু অন্যপাশ থেকে মোবাইল বন্ধের ঘোষণা বাজছে। অসহ্যের মাত্রাটা তার মস্তিষ্কের চারপাশে তোলপাড় করতে থাকল।
ঘুম আসছে না। ঘুমের কী হলো আজ? ও চোখ বুজে সবকিছু ভুলতে চাইল। বুয়েটের সুদর্শন ছেলেটির প্রতি তার অসম্ভব মায়া হলো। ফেরেশতার মতো একটি ছেলে। তুখোড় মেধাবী মায়াময় একটি ছেলে। স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ছেলে। সংসারের জন্য এ রকম ছেলেই তো মেয়েরা চায়। এই ছেলেটির বউ নিশ্চয় ভাগ্যবতী হবে। দুনিয়ার সেরা সুখি হবে এই মেয়েটি।
শেষ রাতের দিকে এক পশলা ঘুম এসেছিল নওশার। বড়ভাবি ডাক না পাড়লে হয়তো আরও কিছুক্ষণ ঘুমুতো সে। নাশতা এসেছে টেবিলে। সপ্তাহে একটি দিন সবাই একসাথে বসে নাশতা করে। বড়ভাবি রুটি-ভাজি বন্টনে ব্যস্ত হয়ে আছে। ছোটভাবি এটা-ওটা দিয়ে বড়ভাবিকে সাহায্য করছে। মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। মেয়েকে সুপাত্রের হাতে তুলে দিয়ে মা জনমের মতো নির্ভার হয়ে যাবে। আহা, মায়েরা কতো সোজাসাপটা চিন্তা করে!
বড়ভাই চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, কীরে, রাতে ঘুমুসনি? চোখ ফোলা ফোলা হয়ে আছে কেন? মার্কেটে যাবি? ঠিক আছে, বিকেলে সবাই রেডি থাকবি। আজ সাফ্ফানে যাবো। সাফ্ফানে গোল গ্রিল খাবো।
বড়ভাবি বলল, গোল গ্রিল আবার কী রকম?
গেলেই দেখবে, নতুন রেসেপি। ঝাল ঝাল মিষ্টি।
ঝাল ঝাল মিষ্টি? প্রশ্ন করে বড়ভাবি শব্দ করে হাসল।
বাইরে কারুর পদশব্দ হচ্ছে। হকারের গলার স্বরও শোনা গেল। শুক্রবার এ বাড়িতে দুটো পত্রিকা আসে। নওশা বিরাট সময় নিয়ে সাহিত্যপাতা চষে বেড়ায়। কবিতা দেখে। তার কবিতা ছাড়াও সে আরেকজনের কবিতা দেখে। একই দিনে দুজনের কবিতা ছাপা হলে সেদিন নওশা আকাশে উড়ে বেড়ায়। ওকে ফোন দেয়। ফোনে না পেলে ও অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে। সেদিন তার মনটা ভেজা আকাশের মতো মেঘলা হয়ে যায়। আজকের পত্রিকায় সাহিত্যপাতা নেই। আছে পুরো পাতাজুড়ে সরকারি বিজ্ঞাপন। লাখ টাকার কাছে আজ সাহিত্যপাতা হেরে গেল। রাজ্যির দুঃখ তার গোটা বুকে ছড়িয়ে যেতে থাকল।
মোবাইলটা কতো বার টিপল নওশার হিসাব নেই। এক সমায় ইচ্ছে হলো মোবাইলটা দূরে কোথাও ছুড়ে দেয়। যে মোবাইল সময়ে কাজে আসে না সেই মোবাইল অযথা বহন করে লাভ কী? সে কোনোকিছুই ধীরস্থিরভাবে ভাবতে পারছে না।
প্রচণ্ড রোদের শহর আজকের ঢাকা শহর। ঢাকা শহরে কি আগেও কোনোদিন এ রকম রোদ পড়েছিল? ধাঁধানো রোদে-ঘামে নওশার কামিজের পেছনের অংশ জবজবে হয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে কোথায় থাকতে পারে আশিক? বেকার ছেলেপেলেদের সময় কাটানোর নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। যেখানে রাত হয় তারা সেখানে কাত দেয়। একবার আশিকের বাসার দিকে পা চালানোর মনস্থির করে নওশা। একটা রিকশা দেখে ইশারা দেয় সে। সাজাহানপুর এখান থেকে দুই মাইলের রাস্তা। জ্যামে না পড়লে দশ মিনিটেই পৌছে যাবে সে।
দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে সিটকিনি খোলার শব্দ হলো। মহিলা দরজা খুলে তীব্রদৃষ্টি ফেলে নওশার চোখেমুখে তাকিয়ে আছেন। দুজনই জন্ম-বোবার মতো কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকলেন। তারপর মহিলা বললেন, ভেতরে এসো।
নওশা ভেতরে ঢোকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকল।
বসো। মহিলা নরম করে বললেন।
নওশা সিংগেল সোফায় বসে পড়ল।
আশিকের মুখে তোমার ব্যাপারে জেনেছি। ও তোমার বিষয়ে যা বলেছে আসলে তুমি তাই।
নওশা মাথা নিচু করে রাখল।
মহিলা আবার মুখ খোলেন। বলেন- আশিক এখনো বেকার। কবিতা নিয়ে রাতদিন পড়ে থাকে। তাকে কোনোকিছুতে আমি বাধা দেই না। চাকরি খুঁজে বেড়াতেও চাপ দেই না। ও তো বড় হয়েছে। দুনিয়াদারি বোঝে। বোঝে বলেই তোমার কথা ভাবে। একটা চাকরি-বাকরি নাহলে আমি তোমার পরিবারের কাছে কীভাবে হাত পাতি? আমাদের ইনকামের অন্যকোনো সোর্স নেই। ওর বাবার ভাতার টাকায় চলছি। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?
জি।
কাল তোমাকে কি কেউ দেখতে এসেছিল?
জি।
ছেলে বুয়েট থেকে পাশ। ভালো চাকরি করে। তোমার কি ওখানে অসুবিধা আছে?
জি।
কী অসুবিধে আছে আমি জানতে চাই না। তবে তোমার অসুবিধার কথা শুনে আমার বুকেও যন্ত্রণা বাড়ছে। কষ্টের স্রোত ক্রমশ বাড়ছে। তোমাকে একগ্লাস সরবত দেবো? তোমার নিশ্চয় তেষ্টা পেয়েছে?
নওশা চুপ হয়ে থাকে। তৃষ্ণায় তার বুকটা শুকনো হয়ে আছে। ঢাকা শহরটা আজ ভারি গরম। কাঠফাটা গরম। বাইরে একজোড়া কাক পাখি হাঁপাচ্ছে। ঢাকা শহরে এখন আর কোথাও পুকুর নেই। জলের খাল-বিল নেই। পশু-পাখিরা এখন আর বুড়িগঙ্গায় মুখ দেয় না। ওরাও জেনে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি মানেই বিষ। এই বিষ খেয়ে তারা আত্মহত্যা করতে চায় না।
মহিলা বললেন, সরবত নাও।
নওশা এক টানে সরবতের শেষ প্রান্তটি ছুঁয়ে দিল। তারপর মহিলার দিকে নরম চোখ ফেলে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
নওশার বিমর্ষ চেহারা কাল হয়ে গেল পুরো পরিবারের। সে আগের মতো আর কারুর সাথে কথা বলছে না। কেউ কিছু জিগ্যেস করলে তার ঢিলেঢালা জবাব দিচ্ছে। রুম থেকে সে কচিৎকদাচিৎ বের হচ্ছে প্রয়োজন মেপে। তার এমন দূরে দূরে অবস্থানটা কারুর নজর এড়াতে পারছে না। আশিকের সাথে কঠিন সম্পর্কের কথাটা এ পর্যন্ত সে কারুর কানে দেয়নি। একবার ভেবেছিল বড়ভাইয়ের সাথে সাহস করে কথাটা বলবে। কিন্তু বলবে বলবে করে আর বলা হয়নি।
সারা রাত অঝোর ধারায় কাঁদল নওশা। তাকে সান্তনা দেওয়ারও যেন কেউ কাছে নেই। পৃথিবীর সব কষ্ট তার বুকের আশেপাশে এসে জড় হতে শুরু করল। সে এখন কী করবে তারও দিশকুল করতে পারল না।
নাশতার টেবিলে বড়ভাই নওশার দিকে মুখ তোলে চোখ কপালে তুলল। তার আদুরে বোনটার চেহারাসুরত বিদঘুটে হয়ে আছে। নাশতার টেবিল থেকে তার মনোযোগ নওশার দিকে নিবদ্ধ হলো।
রাতে কি ঘুম হয়নি? বড়ভাই জিগ্যেস করলেন।
নওশা চুপ হয়ে থাকে। তার গলাটা যেন চেপে ধরেছে কোনো অদৃশ্য শক্তি। কাল বৈশাখি ঝড়ের মতো হু হু করছে তার ভেতরেরটা। সে বড়ভাইয়ের চোখে চোখে তাকাতে পারছে না। মা-ভাবিরা অপলক দৃষ্টি ছুড়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। বড়ভাইয়ের প্রশ্নের কাছে তার তাবৎ ইচ্ছেশক্তির যেন আচমকা অপমৃত্যু ঘটছে।
কী, চুপ হয়ে আছিস ক্যান? এই বিয়েতে কি তোর কোনো আপত্তি আছে?
নওশা আার নিজেকে সামলাতে পারল না। প্রচণ্ড গতির ক্ষীপ্রবেগের কান্নাকে কোনোমতেই আর ঠেলে রাখতে পারল না। তার কান্নার শব্দটা দ্রুত এ-পাশ ও-পাশের দেয়ালে বাড়ি খেতে থাকল। বড়ভাই সময়ক্ষেপণ না করে নওশার মাথাটা বুকের কাছে টেনে ধরলেন। কান্নার ছোঁয়াশে থেকে তিনিও আর নিজেকে আর রক্ষা করতে পারলেন না।
বাড়ির পরিবেশটা হঠাৎ একেবারে হীমশীতল হয়ে গিয়েছে। গতকাল এ বাড়িতে হইহুল্লোড়ের যে একটা আবহ গড়ে উঠেছিল সেটারও আর কোথাও অবশিষ্ট থাকল না। সবাই সবার মতো করে পড়ে রইল। সারাদিন নওশার সাথে মা একটি কথাও বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। ওমের কোনো প্রজাতির মতোই তিনি নিজেকে সারাদিন গুটিয়ে রাখলেন। একজন চটপটে স্বভাবের মহিলা কীভাবে সারাদিন নিথর হয়ে থাকলেন একমাত্র তিনিই ভালো জানেন।
বড়ভাই আজ রাত করে বাড়ি ফিরলেন। অথচ অন্যদিন তিনি অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসেন। অফিসের কাপড় বদলিয়ে বাগানে নেমে এটা-ওটা করতে থাকেন। নার্সারি থেকে ভিন দেশের নতুন নতুন ফুলের চারা এনে নিজের হাতে চারা লাগান। এবং চারাগুলো বড় হওয়ার দৃশ্যে সজাগ নজর রেখে চলেন।
বড়ভাবি কাছে এসে বললেন, মোবাইল বন্ধ রেখেছ কেন, কোনো সমস্যা-টমাস্যায় পড়েছিলে নাকি?
নওশা কোথায়?
ঘরে আছে।
মাকে বলো একজন নতুন অতিথি এসেছে।
নতুন অতিথি? নতুন অতিথি আবার কে?
নাম বললে চিনবে না।
বড়ভাবি দ্রুত সোফার কুশন ঠিকঠাক করতে লেগে গেল। ছোটভাবি এসে ফুলদানিগুলো জায়গামতো আছে কিনা চোখ চালাতে থাকল। বড়ভাবি নিঃশব্দে গজর গজর করতে থাকল। কাউকে কিছু না বলে এভাবে কেউ নতুন অতিথি আনে? অতিথি বিদায় হলে নিশ্চয় আজ বড়ভাইয়ে খবর আছে।
বড়ভাই দরজার কাছে গিয়ে বললেন, আসুন।
সুড়সুড় করে নীরবে ঢুকে পড়ল নতুন অতিথি।
বড়ভাই বললেন, বসুন।
অতিথি অপরাধীর মতো চুপচাপ সোফায় বসে পড়ল।
বড়ভাই ভেতরে গিয়ে বললেন, সবার জন্য খাওয়া রেডি করো। সবাই বসে একসাথে খাব।
বড়ভাবি তড়িৎ লাফ দিয়ে ওঠে বলল, একসাথে খাবে মানে? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
মা কি অপরিচিত লোকের পাশে বসে কিছু খায়? কোনোদিন দেখেছ?
আজকে বসবেন। একদিন নতুন অতিথির সাথে বসে কিছু খেলে কিছুই যায় আসবে না।
মা বড়ভাবির পাশ ঘেঁষে এসে বললেন, তর্ক করো না বউমা। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। জলদি টেবিল রেডি করো।
টেবিল রেডি করতে সময় লাগল না। অতিথি গুটিসুটি মেরে একপাশে বসে আছে। মা-বড়ভাবি-ছোটভবি চেয়ারে গিয়ে বসল। সবাই নতুন অতিথিকে আউরে ঠাউরে দেখে চলেছে। অতিথি মাথা নিচু করে রেখেছে। আসছি আসছি বলে নওশার এখনো আসা হয়নি। বড়ভাই দাঁড়িয়ে সবার সামনে বাসন এগিয়ে দিচ্ছে। ফ্যানের বাতাসে অতিথির দুচারটা চুল উড়ছে। লজ্জার কাছে হার মেনেছে নতুন অতিথি।
আশিক…
নওশার মুখের একটি শব্দে সারা টেবিল চমকে উঠল। সবার মুখগুলো নওশার দিকে হাঁ হয়ে আছে। কেউ কিছু আন্দাজ করতে পারছে না। সবার চোখের বিস্ময়গুলো সারা ঘরময় উড়তে থাকল।
বড়ভাই বললেন, নতুন অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। আশিক আহমেদ। বাংলাদেশের বিস্ময়কর উদীয়মান তরুণ কবি। আমার আদুরে বোনের আদুরে বর। নওশার বিয়ের কথাবার্তা শুনে ঘরের এককোনায় বসে কেঁদে কেঁদে কবিতা লিখছিল। তাকে আবিষ্কার করতে আজ আমার মহা ঝামেলা পোহাতে হলো।
ছোটভাবি নতুন অতিথির দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। বড়ভাবি অন্যরকম দৃষ্টি ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মা আনন্দের অশ্রু ফেলে ওকে চেখে চলেছেন। নওশা বড়ভাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে ফ্যাসফ্যাস করতে থাকল। তরুণ কবি এই অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখে সবকিছু স্বপ্নের জগৎ মনে করতে থাকল।