চট্টগ্রামে জাসদের একটি অধ্যায়ের অবসান হলো। সদ্য প্রয়াত জাসদ নেতা জনাব মঈনুদ্দিন খান বাদলকে দিয়ে এই অধ্যায়ের সূচনা এবং তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে সেই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। জাসদ আছে, জাসদ থাকবে কিন্তু বাদল ভাই জাসদের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রাজনৈতিক ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, সযতœ পরিচর্যায় তাকে লালন করেছিলেন, বিকশিত ও পরিবর্ধিত করেছিলেন, সেটি তো আর রইলো না।
৭২-৭৩ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের বন্দর শহর চট্টগ্রামে জাসদ রাজনীতির উদ্ভবের খবর যারা রাখেন, তারাই একমাত্র আমার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারবেন। আজ যে রাজনীতিক মঈনুদ্দিন খান বাদলকে বাংলাদেশ চেনে, তিনি একান্তভাবে স্বাধীনতার সন্তান, বাংলাদেশের সৃষ্টি। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন; কিন্তু তখনো তাঁর ওপর পাদপ্রদীপের আলো পড়েনি। তিনি সিরাজুল আলম খানের অনুসারী ছিলেন, সে তাঁর মতো অনেকেই ছিলেন। ৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলন যখন দ্রুত বেগে চূড়ান্ত পরিণতি অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছিলো, তখন সিরাজুল আলম খান তাঁকে কিছু পোস্টার আর লিফলেট বিতরণের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে এসে তাঁর সেসব বিলি-বন্দোবস্ত করতে করতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বোয়ালখালীতে তাঁর বাড়িতে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে তেমন কারো সঙ্গে তাঁর জানাশোনা ছিলো না। শহরে তাঁর কন্টাক্ট ছিলো; আগ্রাবাদের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মুক্তিযোদ্ধা মরহুম জালাল ভাই ছিলেন তাঁর খালাতো ভাই আর পতেঙ্গার কাঠগড়ের আড়কাঠি জনাব আলী মেম্বারও ছিলেন তাঁর আত্মীয়। একারণে যুদ্ধ করার জন্য শহরই ছিলো তাঁর পছন্দ আর তিনি নিজেও বই টই পড়ে আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ার-এর ওপর কিছু এলেম হাসিল করেছিলেন। অতএব গোলাগুলির মধ্যে একদিন শহরে এসে আগ্রাবাদে তাঁর খালার বাসায় হাজির হয়ে গেলেন। তাঁর খালার বাসাটা ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি; জালাল ভাই, আলাউদ্দিন ভাই এবং তাঁদের আরো এক ভাই যাঁর নামটা এখন মনে করতে পারছিনা, সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মৌলভী সৈয়দের গ্রুপে কাজ করছিলেন। বাদল ভাইও অনতিবিলম্বে খালাতো ভাইদের অনুসরণ করে সৈয়দ ভাই’র সঙ্গে ভিড়ে গেলেন। বাদল ভাই’র সাহস ছিলো; অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ছিলেন তিনি। অচিরেই তিনি সৈয়দ ভাই’র আস্থাভাজন লেফটেন্যান্ট রূপে পরিগণিত হলেন। আবু সাঈদ সরদার মনে করিয়ে দিয়েছেন, সৈয়দ ভাই তাঁকে অন্যতম বেইজ কমান্ডার নিযুক্ত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি দুনিয়া কাঁপানো ‘অপারেশন জ্যাকপটে’র অন্যতম সমন্বয়কারী ছিলেন। এই অপারেশনের জন্য নৌ কমান্ডো ও তাদের লিমপেট মাইনসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র শহরে আনয়ন, তাদের থাকা-খাওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং অপারেশনের জন্য কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরবর্তী বর্তমান কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা, চরলক্ষ্যা, শিকলবাহা প্রভৃতি গ্রামে পাঠানো এবং অপারেশনের পর তাদের আবার শহরে ফিরিয়ে এনে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার এই কাজটি যত সহজে আমি লিখলাম, তখন এত সহজ ছিলো না। কিন্তু বাদল ভাইরা কী নিপুণভাবে না এই কঠিনতম ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলি করেছিলেন। কোথাও এতটুকু অসতর্কতা বা শৈথিল্যের ফলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারতো। কিন্তু বাদল ভাইদের দক্ষ তদারকি ও ব্যবস্থাপনার কারণে পান থেকে চুনও খসেনি। পাকিস্তানি বাহিনী ছিলো উল্লুক, প্রায় অর্ধশতাধিক নেভাল কমান্ডো মাইন, বিস্ফোরক, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরের বুকের ওপর দিয়ে এলেন গেলেন, থাকলেনও দু’একদিন, কিন্তু মাথামোটা পাকিস্তানি জানোয়াররা কিছুই ঠাহর করতে পারেনি। এইখানেই বাদল ভাইকে আমি বেশি নম্বর দিতে চাই। নেভাল কমান্ডোদের কমান্ডার এ ডব্লিউ চৌধুরী বীর উত্তম, বীর বিক্রম চট্টগ্রামের বিজয় মেলায় এসে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক বক্তৃতায় বাদল ভাই’র কৃতিত্বকে স্বীকার করে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা হারিছদা, ইঞ্জিনিয়ার হারুন ভাই, শাহজাহান খান এবং আনিস কাদেরী প্রমুখের সঙ্গে বাদল ভাই’র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং আজীবন সে সম্পর্ক অটুট ছিলো।
বাদল ভাই’র অনেক পরিচয় এখন বাংলাদেশের মানুষের জানা হয়েছে। যেমন তিনি একজন অসাধারণ সংগঠক, তুখোড় বক্তা, দুর্দান্ত পার্লামেন্টারিয়ান, প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, জনদরদী রাজনীতিক এবং চট্টলপ্রেমি নেতা ছিলেন। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, বাদল ভাই’র সম্পূর্ণ পরিচয় ‘ইহাতে’ পাওয়া যায় না। তিনি যে একজন ড্রিম মার্চেন্ট ছিলেন, রোমান্টিক বিপ্লবী ছিলেন, যেটা তিনি গণতান্ত্রিক ও পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে প্রবিষ্ট হওয়ার পর সচেতনভাবে আড়ালে রেখে দিয়েছিলেন, সেইখানে আদি ও অকৃত্রিম মঈনুদ্দিন খান বাদলকে পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধের দুরন্ত দিনের পলাতক সময়ে তিনি রেজিস দেব্রে, জুলিয়াস ফুচিক, চেগুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, জেনারেল গিয়াপ, মাওসেতুং-এর বই পড়ে পড়ে তাঁর বিপ্লবী চেতনাকে শাণিত করে তুলেছিলেন। আমার একথার সমর্থনে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। স্বাধীনতার পরপরই বাদল ভাই, রুশ্নি ভাই, সম্ভবত শাহাজাহান ভাইও (খান) জুবিলি রোডে ইউসুফ চৌধুরীর (পরবর্তীকালে পূর্বকোণের মালিক) সিগনেট প্রেসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আড্ডা জমালেন এবং কিছুদিনের মধ্যে তাঁরা ‘গণমত’ নামে একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা প্রকাশ করলেন। ঐ পত্রিকায় বাদল ভাই ক্যাস্ট্রোর ‘ঐরংঃড়ৎু রিষষ ধনংড়ষাব সব’ বইটির ধারাবাহিক অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশে বিপ্লব চর্চার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। পাকিস্তান আমলে যা’ ছিলো স্বর্গের নিষিদ্ধ ফল ‘গন্ধম’, যা’ খেয়ে মা হাওয়া ও বাবা আদম স্বর্গচ্যুত হয়ে ধরণীপ্রপাত হয়েছিলেন এবং ধরাধামে মানবজাতির সূচনা করেছিলেন বলে পবিত্র কেতাবে বর্ণিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই নিষিদ্ধ ফল ‘বিপ্লব’ ভক্ষণের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। পাকিস্তান আমলে অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন, সুধাংশু বিমল দত্ত, পূর্ণেন্দু দস্তিদার-সুখেন্দু দস্তিদার-শরদিন্দু দস্তিদার ভ্রাতাত্রয়, দেবেন শিকদার, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, আবদুস সাত্তার, কালীপদ চক্রবর্তী, পূর্ণেন্দু কানুনগো-রা বছরের পর বছর আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন কাটিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে কিন্তু বিপ্লবচর্চার ওপর কোন বাধা-বিঘœ রইলো না। ফলে সিরাজ শিকদার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলেন। বনেদী বিপ্লবীরা তখন নকশালবাড়ির পথ পেয়ে গেছেন। ওদিকে বহু বছর বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতার ম্ক্তু হাওয়ায় আনন্দের ওড়াওড়ির মধ্যে আওয়ামী লীগের অনুগামী ছাত্র সংগঠন খোদ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরেই বিপ্লবের দামামা বেজে উঠলো এবং বিদ্রোহী গরিষ্ঠ অংশ ও আওয়ামী লীগ থেকেও ক্ষুদ্র একটি অংশ বেরিয়ে গঠন করে ফেললেন একটি সমাজতান্ত্রিক দল। যার পোশাকি নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সংক্ষেপ জাসদ। স্বাধীন বাংলাদেশের জঠর থেকে উদ্ভূত প্রথম বিরোধী দলও জাসদই ছিলো। স্বাধীনতার বেশ আগে থেকেই এই দিনটির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন নিউক্লিয়াসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ-এর চার প্রধানের অন্যতম জনাব সিরাজুল আলম খান। সুতরাং কর্ষিত জমিতেই তিনি বিপ্লবের (জাসদের সৃষ্টিকে ‘বিপ্লব’ বলতে আপত্তি থাকলে আওয়ামী লীগে ‘বিদ্রোহ’ বললে নিশ্চয়ই আপত্তি হবে না; এই বিদ্রোহও তো এক অর্থে বিপ্লবই) বীজ বুনলেন এবং ভালোই ফসল উৎপন্ন করলেন।
চট্টগ্রামে জাসদের বেশ সাড়াই মিলেছিলো। জাসদের জন্ম বাদল ভাইয়ের বিপ্লবী চেতনার পরিপোষকতা করলো। ‘দাদা’ অর্থাৎ সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে পূর্ব যোগাযোগের সূত্রে তিনি চট্টগ্রামে জাসদে দাখিল হলেন।
এই প্রসঙ্গেই আমার পূর্বের কথার জের টেনে বলতে চাই, চট্টগ্রামের জাসদ রাজনীতিতে বাদল ভাইয়ের অন্তর্ভুক্তি একটি স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করেছিলো। কেন চট্টগ্রামে জাসদের রাজনীতি দুই ধারায় প্রবাহিত হয়েছিলো, তার কারণ আমি বলতে পারবো না। তবে তা’ গোপন ছিলো না। আন্দরকিল্লায় একটা জাসদ অফিস ছিলো বটে; কিন্তু জাসদ নেতা-কর্মীদের কাছে সেই অফিসের চেয়ে ‘সাগর হোটেল’ ও ‘বাংলা হোটেল’-এর আকর্ষণই ছিলো বেশি।
চট্টগ্রাম শহরের মুক্তিযুদ্ধের এক প্রধান নায়ক এবং মৌলভী সৈয়দের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ও অপারেশন কমান্ডার আবদুল্লাহ আল হারুন, যাঁকে আমি বড় ভাই ও মুরুব্বী জ্ঞানে খুবই মান্য করি, তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে বাদল আমার সঙ্গে ছিলো। তিনি অত্যন্ত সাহসী, উৎসাহী, আন্তরিক এবং সৎ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি তাঁকে প্রথম শ্রেণিতে স্থান দিতে চাই। মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের অর্থাৎ সৈয়দ ভাই’র গ্রুপে অনেক বেইজ ওয়ার্কার ছিলেন; তন্মধ্যে চারজন ছিলেন প্রধান-হারিছদা, আবু (আবু সাঈদ সরদার) ও বাদলের নাম একসঙ্গেই বলতে হয় এবং জালাল ভাই।
সাগর হোটেলের অবস্থান এনায়েতবাজার বাটালী রোডে, বাংলা হোটেল কাজির দেউড়িতে। সাগর হোটেলের কেন্দ্রীয় চরিত্র আহমদ শরীফ মনীর (অধ্যক্ষ); মনীর ভাইয়ের সিনিয়র মোখতার ভাই, সমসাময়িক ছাবের ভাই (ছাবের আহমদ আজগরী) ও মঞ্জু ভাইও (অধ্যাপক নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু) সাগর হোটেল-কেন্দ্রীক রাজনীতির মুখ্য সংগঠক ছিলেন। শরীফ ভাই তাঁদের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে জাসদের বিশাল সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। আমার মামা অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদের অবদানও অনস্বীকার্য। তিনি তো সবার সিনিয়র; মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস কথা স্বাধীনতাপন্থী রাজনীতির তিনিই তো প্রধান সংগঠক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতে যেতে পারেন নি, এটাই ছিলো তাঁর একমাত্র দুর্বলতা। ভারতে যেতে পারলে তিনিই হতেন চট্টগ্রামে জাসদের মূল নেতা এবং কেন্দ্রেরও অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। আমার মামা বাংলা ও সাগরের মধ্যে শাটল করতেন এবং দু’গ্রুপের মধ্যে সেতুবন্ধ স্বরূপ ছিলেন। বাংলা হোটেল পরে তাঁর শ্বশুর বাড়ি হয়ে যায়।
সাগর হোটেলের মালিক ছিলেন শরীফ ভাইয়ের বড় ভাই ইমাম শরীফদা। জাসদের জন্য তিনি যে অপরিসীম ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছেন তার কোন তুলনা হয় না। কিন্তু তাঁর কথা এখন কেউ বলেন না। অর্থ দিয়ে, তাঁর আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাসাও জাসদ নেতা-কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে তিনি নবীন রাজনৈতিক দলটিকে চট্টগ্রামের মাটিতে শিকড় গাড়তে ব্যাপক অবদান রাখেন। আমি আরিফ ভাই, মার্শাল মনি ভাই, জিকু ভাই, ইনু ভাই, মাহবুব ভাইকে তাঁর বাসায় রাত্রিযাপন করতে দেখেছি। তিনি সমাজতন্ত্রের অনুরাগী এবং মওলানা ভাসানী ও এমএ আজিজের অনুরাগী ছিলেন।
বাংলা হোটেলের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন বাদল ভাই। বাদল ভাই’র প্রথম আখড়া ছিলো রুবী মুদ্রণালয়। পরে ৫ দল, বাসদ ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিশিষ্ট নেতা কাজী শাহাজাহান ছিলেন রুবী মুদ্রণালয়ের মালিক। পুরো কাজির দেউড়িই ছিলো কাজিদের সম্পত্তি। কাজির দেউড়ির প্রতিষ্ঠা করেন মীর আবদুল গণি; তাঁর বংশের সবচেয়ে কীর্তিমান পুরুষ মীর ইয়াহিয়া। কাজিরা চট্টগ্রামে প্রথম আরবি শিক্ষা প্রচলনের জন্য একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কাজি বংশের সর্বশেষ গৌরব বা মহিমান্বিত পুরুষ ছিলেন কাজি এনামুল হক; তাঁরই পুত্র কাজি শাহজাহান এবং জামাতা অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ। বাদল ভাইয়ের সিনিয়র আগরতলা মামলা-খ্যাত বিধানদা (বিধান কৃষ্ণ সেন), অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ, হাশেম ভাই (অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম), রুশ্নি ভাই (শওকত হাফিজ খান রুশ্নি), ফজলু ভাই (এসএম ফজলুল হক), এ বি এম নিজামুল হক, শাহজাহান ইসলামাবাদী, কাজী শাহজাহান, তসলিম চৌধুরী, প্রমুখ রুবী মুদ্রণালয়কে আলোকিত করে নিত্য জমজমাট রাজনৈতিক আলোচনা ও গল্প-গুজবের আসর বসাতেন। তাঁদের সাহায্য ছাড়া বাদল ভাই মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জাসদে একটি স্বকীয় ও স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করে শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে টিকে থাকতে পারতেন কিনা সে ব্যাপারে আমার ঘোর সন্দেহ রয়েছে। তা সত্ত্বেও সত্য এটাই যে, প্রথমে রুবী মুদ্রণালয় ও পরে বাংলা হোটেলকে ঘিরে জাসদ নেতা-কর্মীদের যে একটি বলয় সৃষ্টি হয়েছিলো সেটি ‘বাদল গ্রুপ’ নামেই পরিচিতি পেয়েছিলো।
আমি সেই সময়ের কথা বলছি, যখন এক ঝাঁক উজ্জ্বল তাঁরার ঝলকানিতে বাংলা হোটেল ঝলমল করে উঠেছিলো। বাদল ভাইকে ঘিরে যেন চাঁদের হাট বসে গিয়েছিলো। যখন বন্ধুবর আবু জাফর মাহমুদ আমেরিকায় যান নি, সৈয়দ আবদুল মাবুদ লন্ডন প্রবাসী হন নি, সুরজিত বড়–য়া ব্যাংকক প্রবাসী হন নি, নাওজীস মাহমুদ (শামীম ভাই), ইফতেখার সেলিম, কাজল, মিজানরা কাস্টম কর্মকর্তা হন নি, কামরুল, মনি, খালেদ নোমান নমী, বশর দেশত্যাগ করেন নি। ভালো মানুষ কামরুল বিদেশেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চিরতরে আমাদের ছেড়ে চলে যান। বাংলা হোটেলে যাঁরা যাতায়াত করতেন, তাঁদের অনেকের কথা চারদশকের ব্যবধানে ভুলে গিয়েছি, যাঁদের কথা মনে পড়ছে, তাঁরা হলেনÑ চকরিয়ার ডা. জামাল, অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন, অ্যাডভোকেট মুছা, ইফতি ভাই, সাথী দাশ, আনিস কাদেরী, তিন নুর মোহাম্মদ-স্টিল মিল, বড়পোল এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নুর মোহাম্মদ, ভানু রঞ্জন চক্রবর্তী, বর্তমানে বড় ব্যবসায়ী সীকম-খ্যাত আমিরুল হক, বাঁশখালীর মোস্তফা আলী, চকরিয়ার আফসার ভাই, সীতাকু-ের প্রিয়বন্ধু আবুল কালাম আজাদ ও মোজাফফর, সীতাকু-ের শ্রমিক নেতা ইসহাক কাদের চৌধুরী, বর্তমানে কক্সবাজারে বসবাসকারী বড়পোলের ইউনুস চৌধুরী, পাথরঘাটার মিনু, চকরিয়ার মজনু, রাউজানের আজিম, মোর্শেদ, বন্ধুবর সুশীল বড়–য়া, প্রভাকর বড়–য়া ও শ্রীমান বড়–য়া, আমিনুর রসুল বাবুল, মিরসরাইর রাষ্ট্রদূত ওয়াহিদুর রহমান (ওয়াহিদ সম্পর্কে বলা প্রয়োজন আমি যখন কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত হয়েছিলাম, তখন ওয়াহিদ আমার সঙ্গে সহমত হয়েছিলেন এবং আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর ভাবী স্ত্রীকেও তিনি আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন, তাঁর হবু স্ত্রী আমার বিয়ের সময় আমার স্ত্রীর জন্য একটি সুন্দর ব্লাউজের কাপড় দিয়েছিলেন; ওয়াহিদের সঙ্গে এমন আন্তরিক সম্পর্কের কথা কিভাবে যেন ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমার লেখায় উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম, এ ঘটনা সম্ভবত দু’বার ঘটেছে; ওয়াহিদ সেজন্য মনে কষ্ট পেয়েছেন, পাওয়ারই কথা, সেজন্য আমি তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি) কবির ও তবারক, পটিয়ার মনসা গ্রামনিবাসী মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম, মোতালেব হোসেন মিন্টু, ডা. মাসুদ, ডা. জসিম, হাটহাজারীর নজরুল ইসলাম (পরে পুলিশের চাকরি নিয়ে এসপি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন), শ্রমিক নেতা সরওয়ার কামাল, তেল শফি এবং টিঅ্যান্ডটি’র লতিফ। তেল শফি আক্ষরিক অর্থেই তেল বিক্রি করতো, কিন্তু সেজন্য তাঁকে অবহেলা করা ঠিক হবে না। কারণ তেল শফিরাই ছিলেন জাসদের সম্পদ। দুদিকেই ছিলো এমন ডেডিকেটেড লোক। স্টিল মিলের নুর মোহাম্মদ ভাই, সরওয়ার কামাল এবং লতিফও শফির মতো সৎ, ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন। সাগর গ্রুপেও এমন সৎ, আন্তরিক, অকৃত্রিম, ডেডিকেটেড নেতা ছিলেন। যেমন মনছুর আহমদ শফি, আমানবাজারের সেকান্দর, পটিয়ার স ম ইউসুফ, ইউনুস, ইদ্রিস (পরে সিরাজ শিকদার গ্রুপে গিয়ে শাহাদাত বরণ করে), কালাম, আবুল হোসেন, টুকু, ছগীর, বাহুলীর মাহবুব ও আবদুন নুর, সৈয়দ ভাইয়ের ভাই মাহবুব, হুলাইনের ননীগোপাল ও নুরুল আমিন, করণখাইনের মিলন সেন, এয়াকুবদ-ীর ইসহাক, লড়িহরার আবুল হাশেম, দৌলতপুরের পুরাতন কাপড় ব্যবসায়ী কাশেম, আবদুল্লাহ আল মামুন (পরে শ্রমিক নেতা), ছাবের (পরে পুলিশ কর্মকর্তা), লক্ষ্যারচরের রশিদ ভাই, দোহাজারীর কামাল, তাহের, চকরিয়ার তাহের, রফিক, বাঁশখালীর শফি, ইমাম শরীফ, শাহ আলম, আসহাবউদ্দিন, নুর আলী মিয়ার হাটের করিম, বোয়ালখালীর মনমথ, নজরুল, আবদুন নুর, রতন, হোসেন, বনবিহারী, দীপক ও সমর এবং ফটিকছড়ির এয়াকুব প্রমুখ ছিলেন জাসদের প্রাণশক্তি।
সাগর হোটেলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যাঁরা রাজনীতি করতেন, তাঁদেরকে সাধারণভাবে ‘শরীফ গ্রুপ’ নামেই চিহ্নিত করা হতো। যদিও সেখানে এমন সব বিশিষ্ট নেতারও যাতায়াত ছিলো, যাঁরা স্বতন্ত্র মর্যাদা ও দীপ্তিতে উজ্জ্বল ছিলেন। মোখতার ভাই, ছাবের ভাই ও মঞ্জু ভাই’র কথা আগেই বলেছি, মাহফুজ ভাই (ডা. মাহফুজুর রহমান), তারিক ভাই (তারিক মঞ্জুর), গোফরান ভাই (ডা. গোফরানুল হক), অধ্যাপক জাফর আহমদ মোস্তফা, জাকারিয়া ভাই (আ.ই.ম জাকারিয়া চৌধুরী), ইউসুফ ভাই (ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী), সরওয়ার ভাই (মৌলভী সরওয়ার কামাল-সাতকানিয়া), আমিন ভাই (ফজলুল আমিন মাস্টার-নূর আলী মিয়ার হাট), সৈয়দ ভাই, আহমদ নূর ভাই (পটিয়া), ইন্দুদা (ইন্দু নন্দন দত্ত), ওহীদ ভাই (ওহীদুল হক-মিরসরাই), আহাদ ভাই (আবদুল আহাদ-মাদারবাড়ি), মান্না ভাই (মাহমুদুর রহমান মান্না), মাদার্শার কাশেম ভাই ও সেলিম ভাই, কক্সবাজারের কৃষ্ণদা (কৃষ্ণ প্রসাদ চৌধুরী), রামুর ওবায়দুল হক, গর্জনিয়ার তৈয়বুল্লাহ চৌধুরী, বোয়ালখালীর রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী ও আ.হ.ম. নাসিরউদ্দিন, আনোয়ারার সেলিম ভাই, সাতকানিয়ার ইব্রাহিম-বিন খলিলকে সে অর্থে শরীফ গ্রুপ বলা বোধ হয় সমীচীন হয় না। শরীফ গ্রুপ এবং বাদল গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চট্টগ্রামে যখন জাসদের রাজনীতির মেরুকরণ ঘটছিলো তখন এমন কেউ কেউ ছিলেন যাঁরা সাগর হোটেল ‘জেয়ারত’ করে আবার বাংলা হোটেলও ‘তওয়াফ’ করতে যেতেন।
যাই হোক, চিন, রাশিয়া, কিউরার বিপ্লবের ইতিহাস অধ্যয়ন এবং মুক্তিযুদ্ধের আগুনে বাদল ভাইয়ের অন্তরে যে বিপ্লবের বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়েছিলো, জাসদের শ্রেণি সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের তত্ত্ব তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলো। মঈনুদ্দিন খান বাদল প্রদীপ্ত সূর্যের ন্যায় জ্বলে উঠলেন। অনেককাল তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছে, তিনি যেন এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি-মাঝে মাঝে তার অগ্নি উদগীরণ হয়, তখন তপ্ত লাভার ¯্রােত নির্গত হয়ে চারপাশটা ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিপ্লবের আগুনে। শরীফ ভাই এবং বাদল ভাইকে নিয়ে আমি মনে মনে তুলনামূলক আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, একজন (শরীফ ভাই) শান্ত, ‘নারায়ণ’-এর ন্যায় স্থিতধী, সমাহিত; আর একজন (বাদল ভাই) অশান্ত, ‘মহাদেব’-এর ন্যায় কুপিত, ভয়ংকর এবং প্রলয় নাচন নটরাজ; একজন বিনীত, নমিত-আরেকজন বেপরোয়া, আগ্রাসী; একজন নি¤œকণ্ঠ-আরেকজন উচ্চকণ্ঠ; একজনের ব্যক্তিত্বের মধ্যে মুগ্ধ করার মতো জাদুকরী সম্মোহন আছে কিন্তু কাছে না গেলে টের পাওয়া যায় নাÑআরেকজনের ব্যক্তিত্বের দুর্নিবার আকর্ষণ এড়ানো দুঃসাধ্য; ঘরোয়া কর্মীসভা না হলে একজনের বাকবৈদগ্ধ ও জ্ঞানের বহর পরিমাপ করা যায় নাÑ আরেকজনের কণ্ঠ গম্ভীর, ভারি, ওজনদার এবং ডম্বরুর ন্যায় আওয়াজ করতো, গমগম করতো, লালদিঘির জনসভায় মহাসাগরের জলকল্লোলের ন্যায় তাঁর কণ্ঠ থেকে উৎসারিত শব্দবোমা পাশের পুলিশ পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে লালদিঘির মধ্যে প্রত্যাগত প্রতিধ্বনি দর্শক-শ্রোতার দেহমনে যেন আগুন ধরিয়ে দিতো।
বাদল ভাইয়ের উত্থান মসৃণ ছিলো না। খুব বিসর্পিল পথ বেয়ে, অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে তাঁকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে। প্রথম প্রথম তাঁর টিকে থাকাও কঠিন মনে হয়েছিলো। অন্য কেউ হলে হাল ছেড়ে দিতো। কিন্তু মানুষটার নাম মঈনুদ্দিন খান বাদল বলে কথা, যিনি প্রকৃত হারার আগে হারতে জানতেন না, যাঁর অভিধানে অসম্ভব বলে কোন শব্দ ছিলো না। আমি ইতিমধ্যে নানাভাবে বলতে চেয়েছি, বাদল ভাই খুব জেদী, একরোখা ও নাছোড়বান্দা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। ফলে বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি নিজের জন্য একটি ইৎবধঃযরহম ংঢ়ধপব তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রথম দিকে তাঁর প্রতি কেন্দ্রেরও সুনজর ছিলো না। তখন মনে করা হতো শরীফ গ্রুপই কেন্দ্রের সমর্থনপুষ্ট। এমনকি কেন্দ্র থেকে আসা নেতারাও প্রায় সবাই সাগর হোটেলেই উঠতেন। পার্টি গঠন প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, তখনো শরীফ গ্রুপেরই প্রাধান্য ছিলো।
’৭৪-এর ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাওয়ের পর যখন জাসদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার নেমে আসে, তখন জাসদ আধা আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যায়। এসময় জাসদের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রামের চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। অতঃপর জাসদও অস্ত্রের ভাষায় পুলিশ, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের জবাব দিতে থাকে। এসময় গণবাহিনী গঠিত হলে বাদল ভাই প্রথমবারের মত জাসদে কিছুটা সুবিধাজনক স্থান করে নিতে সক্ষম হন। বাদল ভাইও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং পুলিশের গুলিতে আহত হলে তাঁর পিতা পুলিশ কর্মকর্তা আহমদ উল্লাহ খান তাঁকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। বাদল ভাই চট্টগ্রামে গণবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।
বাদল ভাই’র রাজনৈতিক প্রতিভা ছিলো, সংগঠন গড়ে তোলার নৈপুণ্য বা ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ, দুর্দমনীয় সাহস ছিলো, নিজের বিশ্বাসকে অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করার অদ্ভূত ‘অলৌকিক’ ক্ষমতা ছিলো, অসামান্য বাগ্মী ছিলেন, যিনি শুধু কথার জাদুতে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং নেতৃত্বের সহজাত ক্ষমতা ছিলো বলেই তিনি চট্টগ্রামের গ-িতে আবদ্ধ থাকেন নি। চট্টগ্রাম জয় করে অচিরেই তিনি দেশ জয় করার মিশনে ঢাকা পৌঁছে গেলেন। চট্টগ্রামের মানুষ এবং জাসদ নেতা-কর্মীদের কাছে মঈনুদ্দিন খান বাদল একজন ভালো নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু দেশ তখনো তাঁকে চিনতো না। ঢাকায় রাজনীতি শুরু করার পর দেখা গেলো, সেখানে জাতীয় নেতাদের ভিড়ে বাদল ভাই হারিয়ে যান নি। স্বতন্ত্র ঔজ্জ্বল্যের দীপ্তি নিয়ে তিনি জাতীয় রাজনীতিতেও নিজের স্থান করে নিয়েছেন এবং নিজের জন্য নেতৃত্বের একটি আলাদা আসন তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। চট্টগ্রামের বাদল এবং ঢাকার বাদলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। চট্টগ্রামে নেতা হওয়া যত সহজ, ঢাকায় তত কঠিন। চট্টগ্রাম থেকে তাঁর সিনিয়র যা সমসাময়িক কোন নেতা ঢাকায় গিয়ে নেতা হতে পারেন নি। এইখানে বাদলের শ্রেষ্ঠত্ব। ক্রমান্বয়ে বাদল ভাই জাসদের কার্যকরী সভাপতি হলেন, এমপি হলেন এবং ১৪ দলের নেতা হলেন। বাদলের নেতৃত্বের গন্তব্য হয়তো আরো কিছু ছিলো কিন্তু মৃত্যু তাঁকে থামিয়ে দিলো। মৃত্যু বড়ো নির্মম এবং নিষ্ঠুর।
যখন যেখানে যে ফোরামে তিনি গিয়েছেন, অনেক তারার ভিড়ে হারিয়ে যান নি তিনি। এমপি হিসেবে পার্লামেন্ট কাঁপিয়েছেন তিনি ফ্লোর নিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করে। তাঁর মধ্যে যে একজন পার্লামেন্টারিয়ানের ক্ষমতা ছিলো, এমপি না হলে তা জানাই যেত না। যুক্তি, রেফারেন্স উদ্ধৃত করে তিনি জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করতেন পার্লামেন্টে। একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলতেন। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদের ওপর খড়গহস্ত ছিলেন। আর নিজের সাংসদীয় এলাকা বোয়ালখালীর কথা কখনো বিস্মৃত হতেন না। সুযোগ পেলেই সংসদে চান্দগাঁও-বোয়ালখালীর জনগণ, তাদের সমস্যা, অভাব-অভিযোগ তুলে ধরতেন আর কর্ণফুলীর ওপর বোয়ালখালী সেতু নির্মাণের জন্য গলা ফাটিয়ে সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন জানাতেন।
তিনি যখন ১৪ দলীয় কর্মীসভা বা জনসভায় বক্তৃতা করতেন, তখন তাঁর মধ্যে একজন জাতীয় নেতার প্রতিচ্ছবিই খুঁজে পাওয়া যেত। দেশ ও জাতির কথা মাথায় রেখেই দায়িত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন। কখনো হাল্কা রসিকতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের তীক্ষè হুল ফুটিয়ে, কখনো বা গুরুগম্ভীর, কখনো উদাত্ত কণ্ঠে-মোট কথা ভাব অনুযায়ী, বক্তব্য-বিষয়ের আলোকে যখন যেভাবে প্রয়োজন, স্বরক্ষেপণ করে যে বক্তৃত্য করতেন, সেটা দর্শক-শ্রোতাগণকে উজ্জীবিত-উদ্দীপিত করতো।
জাসদের সাংগঠনিক কাঠামোতে সিনিয়র আম্বিয়া ভাইর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে সভাপতির পদে বৃত করে তিনি কার্যকরী সভাপতি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সবাই জানতো জাসদের এক নম্বর বা মূল নেতা তিনিই। ঢাকায় বিভিন্ন সভা-সমিতি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং পার্লামেন্টে তাঁর যুক্তিপূর্ণ, তথ্যবহুল জ্ঞানগর্ভ ভাষণ প্রদানের ফল হয়েছিলো এই- টিভি চ্যানেলগুলির টক শোর অ্যাংকরদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় তাঁর প্রতি। অতঃপর টিভি চ্যানেলের টক শোতে তাঁর সারগর্ভ বক্তব্য উপস্থাপনের ফলে সারাদেশের মানুষ তাঁর টক শো শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো।
বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী পড়ে, দেশ-বিদেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে, জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ওঠাবসা, বিভিন্ন দলীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে দেশ ও দলের প্রতিনিধিত্ব করে তিনি একজন আলোকিত মানুষ, জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন।
বিশ্ব পরিসরেও বাদল ভাই’র বিচরণ ছিলো। দক্ষিণ এশিয়া তথা উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার বলিষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন তিনি। বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও সমরসজ্জার বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র প্রতিবাদী বক্তব্য দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিবাদী ও মানবতাবাদী নাগরিক সমাজের মধ্যে গভীর আশাবাদ, আগ্রহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিলো। তিনি ‘বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান পিপলস ফোরাম’ নামে ত্রিদেশীয় একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার সঙ্গে তিন দেশের বিবেকবান, যুক্তিবাদী, গণতান্ত্রিক ও মানবিক সংস্কৃতির অনুরাগী মানুষগুলো জড়িত হয়েছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পালা করে এই সংগঠনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। এ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লকের জেনারেল সেক্রেটারি দেবব্রত বিশ্বাস এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাদল ভাই। সংগঠনটির সাতটি সম্মেলন হয়েছিলোÑদু’বার বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামে এবং পাঁচবার ভারতে। সেদেশের পশ্চিম বঙ্গের নদীয়ায় একবার ও কলকাতায় দু’বার, দিল্লি ও পাঞ্জাবে একবার করে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
তাঁর একটি স্বপ্ন ছিলো শহরের সঙ্গে বোয়ালখালীর জনগণের যাতায়াত সুগম করার জন্য কর্ণফুলী নদীর ওপর আর একটি সেতু প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৩০ সালে নির্মিত কালুরঘাট সেতু সময়ের বিবর্তনে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিলো। সেটি ছিলো মূলত রেলসেতু। দোহাজারি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনে তৈরি ওই সেতুর ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কও নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেটি ঠিক বোয়ালখালী সেতু নয়। শাহ আমানত সড়ক সেতু হওয়ার পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগের জন্য কালুরঘাট সেতুর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। পটিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এবং কক্সবাজার জেলার যানবাহনগুলো শাহ আমানত সেতু দিয়েই চলাচল আরম্ভ করে। বোয়ালখালী একপাশে পড়ে যাওয়ায় বোয়ালখালীর মানুষ শাহ আমানত সেতুর সুবিধা থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি কালুরঘাট সেতুও বোয়ালখালীর মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারছেনা। এই পরিস্থিতিতে বোয়ালখালীর সাংসদ হিসেবে বাদল ভাই কর্ণফুলীর ওপর বোয়ালখালী সেতু নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। তিনি পার্লামেন্টেও বিভিন্ন সময়ে কালুরঘাট সেতুর প্রয়োজন তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। তিনি এই সেতু নির্মাণের দাবিতে বোয়ালখালীর মানুষকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন, জনসভা এবং মিছিল করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নটি পূরণ হলো না। তিনি বোয়ালখালী সেতু দেখে যেতে পারলেন না। বোয়ালখালী সেতু না হলে হয়তো তাঁর আত্মাও শান্তি পাবে না।
ব্যক্তিগত তথ্য : মরহুম মঈনুদ্দিন খান বাদল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আহমদ উল্লাহ খান পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং এসপি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
জনাব বাদলের চার ভাই ও তিন বোন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ডিগ্রি নিয়েছিলেন।
তাঁর সহধর্মিনীর নাম সেলিনা বাদল। তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা ছিলেন।
বাদল ভাইয়ের সঙ্গে যাঁরা রাজনীতি করেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই লিখতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী সাথী দাশ, নাওজীস মাহমুদ, আবু জাফর মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল মাবুদ-এঁরা প্রত্যেকেই লেখার ক্ষমতা রাখেন। একদা বাদল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী প্রিয়সখা সুশীল বড়–য়া এখন বিএনপি করলেও তিনিও বাদল ভাইয়ের অবিচুয়ারি লিখলে কোন ক্ষতি ছিলো না। কিন্তু তাঁরা কেউ লিখলেন না। কেন আমি জানি না। তাঁরা না লেখায় আমাকে কলম ধরতে হলো। বাদল ভাইয়ের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছি কিনা, সেটা জাসদের নেতা-কর্মীরাই বলবেন। যদি না পেরে থাকি সেটা ইচ্ছাকৃত নয়, আমার অজ্ঞতা বা অক্ষমতা ধরে নিয়ে আমাকে মার্জনা করার জন্য করজোড়ে মিনতি করছি।