আতাউর রহমান খান কায়সার চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আনোয়ারার জমিদার এয়ার আলী খান বঙ্গীয় আইন পরিষদ ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাতা গুলশান আরা বেগম। মাতামহ খান বাহাদুর আবদুস সাত্তার।
আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৫৫ সালে সেন্ট প্ল্যাসিড্স স্কুল থেকে জুনিয়র ক্যাম্ব্রিজ পাস করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন সর্বাধিক ভোটে। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি মেধাবৃত্তি পান। এ সময় তিনি ছাত্রশক্তিতে যোগ দেন এবং কার্যকরী পরিষদের কর্মকর্তা নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হন এবং এতে নেতৃত্ব দেন। এ বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৩ সালে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র রাজনীতি ছাড়াও তিনি ছাত্রাবস্থায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।
পড়াশোনা শেষ করে আতাউর রহমান খান কায়সার পারিবারিক ব্যবসায় জড়িত হন। পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। তিনি সাবেক চকবাজার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম মহানগর থেকে সম্মিলিত বিরোধী দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলির সদস্য নির্বাচিত হন।
আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রবাহে যুক্ত হন ১৯৬৮ সালে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে যান। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আনোয়ারা, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। নির্বাচন পরবর্তীকালে বাঙালিদের অধিকার আদায়ে চট্টগ্রামে গণআন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে ব্যাপক ও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত মেজর জিয়ার (পরবর্তীকালে জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) ভাষণে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে জিয়া একই দিন দ্বিতীয়বার সংশোধিত ঘোষণা পাঠ করেন। এ সংশোধিত ঘোষণাটি এ. কে. খানকে দিয়ে লেখানো এবং মেজর জিয়াকে দিয়ে পড়াতে যারা উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আতাউর রহমান কায়সার। তিনি ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুজিব নগর সরকার কর্তৃক এক নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক সমন^য়কারি হিসেবে নিযুক্ত হন। বাঁশখালী ও চকরিয়ার দুর্গম অরণ্যে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন কর দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে ডবলমুরিং এমপিএ ইসহাক মিয়া ও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের একবারে শুরুতে তিনি ভারতে যান; পরে তিনি বাঁশখালী ও চকরিয়ার দুর্গম অরণ্যে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন, সেখানে তাঁর সঙ্গে ডবলমুরিংয়ের এমপিএ ইসহাক মিয়া ও ছিলেন, ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন।
’৭২ পরবর্তী সময়ে পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৭ পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫-এর আগস্ট থেকে ১৯৮৭-এর আগস্টের মধ্যে সামরিক সরকারের হাতে দু’বার গ্রেফতার হন এবং এগার মাস কারাভোগ করেন। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক নির্বাচিত হন। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার উপর পুলিশের নির্বিচার ও জঘন্য হামলায় অনেকের সঙ্গে তিনিও আহত হন। চট্টগ্রাম গণহত্যা নামে চিহ্নিত এ ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। ১৯৯১-১৯৯২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে, আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে এন. ডি. আই. ওয়াশিংটনের উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনার/কর্মশালায় যোগদান করেন। তিনি ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক পদে পুনঃনির্বচিত হন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থানরত পার্বত্য চট্টগ্রামের শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের নিমিত্তে চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও ১৯৯২ সালে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং ঐ সময়ের পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া মূল্যায়ন ও চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত সহায়তাকারী অর্থনীতিবিদের প্যানেলের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
আতাউর রহমান খান কায়সার বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে ঙওঝঈঅ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকল্পে ১৯৭৪ সালে জাপান সফর করেন; গণচিনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চিনের সঙ্গে হংকং-এর পুনরেকত্রীকরণ উৎসবে যোগদান উপলক্ষে ১৯৯৭ সালের জুন-জুলাইতে চিন সফর করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে সরকারি ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে গমন করেন।
অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালনের পর তিনি ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ পদে আসীন ছিলেন।
আতাউর রহমান খান কায়সার বরাবরই খেলাধুলায় উৎসাহী ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৫৬ ও ১৯৫৮ সালে কলেজ ক্রিকেট দলের সদস্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আন্তঃকলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৯-৬২ সাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস. এম. হলের ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সিটি রোভার’স ক্লাব, ইয়ং স্টার্স ক্লাব-এর পক্ষে চিটাগাং ক্রিকেট লীগে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সমিতির (বর্তমান চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা) পরিচালনা পর্ষদ-এর সদস্য ছিলেন; তিনি ১৯৭২ সাল থেকে চিটাগাং রাইফেল ক্লাবের আজীবন সদস্য এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম আবাহনী ক্রীড়াচক্রের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
শিক্ষানুরাগী আতাউর রহমান খান কায়সার শিক্ষা বিস্তারেও ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি আনোয়ারা ডিগ্রী কলেজ ও মাহতা পাটনিকোটা হাই স্কুল (আনোয়ারা), রাজাখালী এয়ার আলী খান হাই স্কুল (চকরিয়া)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, টি.বি. এরশাদ আলী হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও চেয়ারম্যান, খাসখামা উচ্চ বিদ্যালয় ও চন্দনপুরাস্থ গুল-এজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭৯-৮০ সালে চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান; ১৯৯০-৯১ সালে রোটারি ক্লাব, চট্টগ্রাম-এর প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৯১-৯২ সালে রোটারি জেলা গভর্নর-এর গ্র“প প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি চিটাগাং ইনস্টিটিউট লিমিটেড (সিনিয়রস ক্লাব)-এর আজীবন সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আঞ্চলিক ত্রাণ কমিটি, চট্টগ্রাম-এর সমন্বয়কারী ছিলেন।
তিনি ভাটিয়ারি গল্ফ ও কান্ট্রি ক্লাব-এর সদস্য, চট্টগ্রাম ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের আজীবন সদস্য ও সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন চট্টগ্রাম শাখার আজীবন সদস্য ও উপদেষ্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী সমিতি-চট্টগ্রাম সম্মেলন শাখার সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৮৪-১৯৯২ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ স্টিমার এজেন্টস এসোসিয়েশন-এর নির্বাহি কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৮-৯২ সালে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনে বাংলাদেশ স্টিমার এজেন্টস এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি ছিলেন।
আতাউর রহমান খান কায়সার একজন সাহিত্যসেবী, শিল্প-সংস্কৃতির অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি অবসরে কবিতা লিখতেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ‘চক্রবাক’ ও ‘মুখর অরণ্য’ শীর্ষক দু’টি কবিতা সংকলন যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেন, তাতে তাঁর নিজের লেখা বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। তিনি কিছু গানও রচনা করেছিলেন, অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী হরিপ্রসন্ন পালসহ অনেক বিখ্যাত শিল্পীর কণ্ঠে সেসব গান বহু জনসমাবেশে পরিবেশিত হয়েছে।
২০১০ সালের ৯ অক্টোবর এই নন্দিত রাজনীতিবিদ লোকান্তরিত হন।