ট্রেড ইউনিয়নের কথায় মনে পড়লো তিনি সাংবাদিকতা করা কালে সাংবাদিকদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য তৎপর ছিলেন। তিনি ১৯৮০ ও ৮১ খ্রিস্টাব্দে পরপর দু’বার চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাংবাদিকদের জন্য একটি মাথা গোজার ঠাঁই করে দেবার জন্য অনেকের সঙ্গে তিনিও চট্টগ্রাম সাংবাদিক হাউজিং কো–অপারেটিভ সোসাইটি গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো–অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রজীবনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদ–উপনিবেশবাদ–সামন্তবাদবিরোধী প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আয়ুব–মোনেম বিরোধী আন্দোলনে চাকরিচ্যুত হন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে গণ অভ্যুত্থানকালে ‘নিরস্ত্র সৈনিক’ ছদ্মনামের ‘ছন্দের নাম বুলেট’ নামে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশ করলে সরকারি হয়রানির শিকার হন। ফলে শিক্ষকতায় ফিরে আসেন।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দৈনিক আজাদীর সহ–সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি তিনি গল্প, কবিতা, নাটিকা রচনায় মনোনিবেশ করেন। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সমাজে তিনি ‘ভূতের বাতি’ নামে ধারাবাহিক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতাযুদ্ধে নিজ অবস্থান থেকে স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা পালন করেন।
মাহবুব উল আলম রাজনীতিতে বামপন্থার অনুসারী ছিলেন। এর পরিচয় পাওয়া যায় যখন দেখা যায় তিনি চেম্বারে চাকরি করতে গিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করছেন এবং এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি নিযুক্ত হয়েছেন। সাংবাদিকতা করতে গিয়েও বামপন্থী পত্রিকা বেছে বেছে কাজ করেছেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক লাল পতাকা পত্রিকার প্রকাশনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কৃষক নেতা বদিউল আলম চৌধুরী। তিনি প্রকাশ্যে ভাসানী ন্যাপ করলেও দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, এমএ মালেক, মাহবুব উল্লাহ প্রভৃতি বামপন্থি কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করতেন। বদিউল আলম চৌধুরী কৃষকনেতা এবং কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাহবুব উল আলম নিজেও বামপন্থী ছিলেন, তাই তিনি বামপন্থীদের পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত হতে বিলম্ব করেননি। লাল পতাকা বৌদ্ধ মন্দির সড়ক থেকে প্রকাশিত হতো।
মাহবুব উল আলম মজনুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন ও ধর্মীয় চিন্তার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। জীবনের এক পর্যায় তিনি মওলানা ভাসানীর সান্নিধ্য লাভের জন্য সস্তোষে চলে যান। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভাসানীর সাপ্তাহিক ‘হক কথা’র বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ভাসানীর মৃত্যুর পর আবার তিনি চট্টগ্রামের আজাদীতে যোগ দেন।
তবে মওলানা ভাসানীর খেদমত, বামপন্থী রাজনীতি, ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষকতা যাই করুন না কেন, তিনি মূলত সাংবাদিকই ছিলেন। সংবাদপত্র নিয়েই সব সময় ভাবতেন এবং সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েই জীবন যাপন করতে ভালোবাসতেন। দৈনিক আজাদী এবং সাপ্তাহিক হক কথা ও লাল পতাকায় কাজ করা ছাড়াও তিনি নিজে আশির দশকের গোড়ারদিকে ঘাটফরহাদবেগ হাজি হাকিম আলী রোডে একটি অফিস ভাড়া করে নিজেই ‘ইশতেহার’ নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকাটি ছিলো তাঁর মানস সন্তান, পত্রিকার জন্য তিনি তাঁর সহায় সম্পদ সব বাজি ধরে উজাড় করে দিয়েছিলেন। তাঁর ছোট দু’ভাই কলেজ শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মাহমুদ উল আলম এবং কলেজ শিক্ষক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক অধ্যাপক জহুর উল আলমকে পত্রিকার কাজে জড়িত করেছিলেন। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্য দু’জন মানুষকে আমি তাঁদের জীবনের সর্বস্ব বাজি ধরে জুয়া খেলায় হেরে যাওয়ার মত হেরে যেতে দেখেছি। দু’জনের একজন হচ্ছেন–দৈনিক আজাদীর প্রথম বার্তা সম্পাদক ও ইস্টার্ন এক্সামিনারের বার্তা সম্পাদক হাবিবুর রহমান খান এবং মাহবুব উল আলম। আমি তখন জেল থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করে রাজনীতির সঙ্গে শিথিলভাবে জড়িত থেকে ঘোরাফেরা করছিলাম। আমাকে পিতাকে তিনি চিনতেন, তাই তিনি আমাকে ডেকে তাঁর পত্রিকায় সাংবাদিকতার শিক্ষানবিশীতে নিয়োজিত করেছিলেন। ইশতেহারকে দাঁড় করানোর জন্য কী কঠিন সংগ্রামই না তিনি করেছিলেন। কিন্তু সংবাদপত্র জগত বড় নির্মম, কঠিন। কারো চোখের জলে চিবুক ভিজে গেলেও সহযাত্রীদের চোখ ভিজবে না। মাহবুব উল আলম সাহেব পরে খতিয়ান নামেও একটি পত্রিকা বের করেছিলেন। সেটি সম্ভবত মাহমুদ ভাই এবং জহুর ভাই দেখাশোনা করতেন।
মাহবুব উল আলম মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের ভক্ত ছিলেন। শাহানশাহ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীকে তিনি দেখেছেন, তাঁর সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন এবং তাঁর কারামতের (অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ) অনেক কিছু তিনি জানতেন, হয়তো কোন ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষও করেছেন। বিশেষ করে কোথাও দূরপথের যাত্রায় তাঁর জিপের তেল ফুরিয়ে গেলে ড্রাইভার তাঁকে যখন সেকথা বলে, তখন হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী তাঁকে না কি বলেছিলেন এখানে তেল কোথায় পাবে, পানি ভরে দাও এবং পানি ভরে দেওয়ার পর সত্যি সত্যি না কি গাড়ি চলতে শুরু করেছিলো। পথে আর কোথাও গাড়ির তেলের সমস্যা হয়নি। আমার একথা শুনে হিটলারের সেনাপতি ফিন্ড মার্শাল রোমেলের কথা মনে পড়েছিলো। রোমেল আফ্রিকা অভিযানে হিটলারের ট্যাংক রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন। পথে ট্যাংকের তেল ফুরিয়ে গেলে সেকথা যখন চালক রোমেলকে জানান, তখন তিনি না কি বলেছিলেন ‘Fill the tank with the blood’ সত্যি সত্যি রোমেলের কথায় রক্ত ভরা হয়েছিলো কি না এবং অচল ট্যাংক সচল হয়েছিলো কি না সেটা আমি জানি না। তবে এটা বলা যায়, যে রোমেল হযরত জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (নাউজুবিল্লাহ) নন এবং তার এমন কোন অলৌকিক ক্ষমতা ছিলো না যে, সৈন্যদের রক্তে তেলের ট্যাংক ভর্তি করলেও ট্যাংক চলবে। রোমেলকে বলা হতো ‘Fox of the desert’.
হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর মুরিদ এবং অনুসারীরা ‘আলোকধারা’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। এই সাময়িকী সম্পাদনা ও প্রকাশনা সঙ্গে মাহবুব উল আলম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। এছাড়া সাপ্তাহিক ইশতেহার, খতিয়ান ও মাসিক আলোকধারার সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন।
মাহবুব উল আলমের সাহিত্য প্রতিভাও ছিলো। তিনি সাংবাদিকতা না করে সাহিত্য চর্চা করলে তিনি একজন ভালো সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারতেন। তাঁর রচিত বেশকিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, এসবের মধ্যে ‘আদর্শের চেয়ে মানুষ বড়’, ‘ঐশী আলোর জলসাঘর’, স্বাধীনতার চাষী, ফাগুনের পদাবলী, মহান একুশের কবিতা সঙ্কলন, স্বাধীনতা মোর কাজল ভোমরা কাব্যগ্রন্থ, স্বাধীনতার কাছে স্মারকলিপি, অনুপস্থিত ভূস্বামী। সম্পাদিত গ্রন্থাবলি: মওলানা ভাসানী, ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব; হজরত শাহজাহান শাহ, অভেদম প্রভৃতি।
তিনি পত্রিকায় কলাম লিখতেন। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস আসলে তিনি দৈনিক আজাদীতে ‘ফাগুনের পদাবলী’ নাম দিয়ে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য নিয়ে কলাম লিখতেন। এটি আজাদীর শীর্ষ কলাম হিসেবে প্রকাশিত হতো। এছাড়া মাহবুব উল আলম ‘লোকে বলে, বলে রে’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীতে দীর্ঘ সময় ধরে কলাম লিখেছেন।
রোগে ভুগে দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দীর্ঘদিন বিছানায় মাহবুব উল আলমের শায়িত জীবনের শেষের সেদিন অবশেষে ঘনিয়ে এসেছিলো ২ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে। সেদিন তাঁর আত্মা নশ্বর দেহ থেকে উড়াল দিয়ে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়ে তাঁর প্রভুর কাছে চলে যায়। পেছনে রেখে যায় তাঁর অমর স্মৃতি, স্ত্রী, দু’মেয়ে ও এক ছেলে। এক মেয়ে পিএইডি অর্জন করেছেন।
মাহবুব উল আলম সম্পর্কে শেষ যে কথা বলা দরকার সেটা হচ্ছে তিনি ছিলেন খুব মেধাবী, জ্ঞানী সাংবাদিক। নানা বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা ছিলো তাঁর। জ্ঞানী মানুষরা যা হন অস্থির, ছটপটে, মাহবুব উল আলম ছিলেন তাই। তিনি সুফি ও বাউল দর্শনে অনুরক্ত ছিলেন। সারা জীবন তারা কিছু একটা বা মনের মানুষকে খুঁজে বেড়ান কিন্তু কেউ পান কেউ পান না। অবশেষে সবাই ফুরিয়ে যান। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ৩১ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়া হত্যা–কাণ্ডের সময় জেনারেল আবুল মনজুর ছিলেন চট্টগ্রাম ডিভিশনের জিওসি। অভ্যুত্থানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কি না সেটা এখন আর জানার কোন উপায় নেই। কারণ তাঁকে ফটিকছড়ি থেকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আনার পর তাঁকে হত্যা করা হয়। কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম), জেনারেল মনজুর (বীর উত্তম) এবং কর্নেল জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম) মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন এবং সেখান থেকে পালিয়ে এসে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিন স্বাধীনতার পর কর্নেল তাহেরের সহযোগে হলিডে পত্রিকায় একটি আর্টিকেল লিখে জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে যান, কর্নেল তাহের আরো কিছুদিন থেকে পরে তিনিও বেরিয়ে যান। জিয়াউদ্দিন সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিয়ে সিরাজ শিকদারকে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করে বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করেন। মাহবুব উল আলম জিয়াউদ্দিনকে সমর্থন করতেন। চট্টগ্রামে জিয়া হত্যার পর সে হত্যাকাণ্ডের দায় জেনারেল মনজুরের উপর বর্তায়। তিনি সহ চট্টগ্রাম সেনানিবাসের প্রায় সমস্ত অফিসার ও সৈন্য চট্টগ্রামকে দখলে রেখেছিলেন। ফেনী পর্যন্ত তাঁদের অধিকারের সীমানা। এরকম সময়ের কোন একদিন মাহবুব উল আলমের সাথে কাজির দেউড়ি মোড়ে আমার দেখা হয়। তিনি তখন হন্তদন্ত হয়ে ঘেমে নেয়ে কোথায়ও ছুড়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে বললেন, কোর্ট বিল্ডিং–এ যাচ্ছি জেনারেল মনজুরের সমর্থনে পত্রিকা বের করছি। সেখানেও মাহবুব উল আলমের মুখে পত্রিকার কথা। যেখানেই তিনি যেতেন তাঁকে সবাই লেখালেখি বা পত্রিকার কাজে লাগিয়ে দিতেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।