পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্য এবং নিকট আত্মীয়স্বজনকে পৈশাচিক উপায়ে হত্যা করার পর দেশে চরম ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কঠোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে টুঙ্গীপাড়ায় তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়। বিদেশে অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘাতকদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। পনের আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশে সামরিক শাসন জারি করে জনগণের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিলো। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং ব্যাপক ধরপাকড় এবং নেতা-কর্মীদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এমন চরম আতংকজনক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিলো যে, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতেও কেউ সাহস পেত না তখন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গ্রেফতারের ভয়ে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। এমনি ভয়াবহ, নিষ্ঠুর বৈরি পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত, আওয়ামী লীগ কর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এজাহার মিয়া ভয়-ভীতির তোয়াক্কা না করে টুঙ্গীপাড়া চলে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কবর জেয়ারত করতে। চট্টগ্রাম থেকে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে প্রথম যে প্রতিবাদী মিছিল বের হয়েছিলো, তাতেও এজাহার মিয়া অংশগ্রহণ করেছিলেন। মিছিলের পর মৌলভী সৈয়দ একাত্তরের ন্যায় ভারতে গিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এজাহার মিয়া এই প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিকল্পনার সাথেও জড়িত ছিলেন।
¬সবাই তাঁকে নিষেধ করেছিলো, এখন যাবেন না। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় দেখেন। পুলিশ মিলিটারির তৎপরতা কমে কিনা দেখুন। এজাহার মিয়ার এক কথা, যতক্ষণ বঙ্গবন্ধুর কবর জেয়ারত করতে না পারব, ততক্ষণ আমি শান্তি পাবো না। বঙ্গবন্ধু তো জাতির জন্য, দেশের জন্য জীবন দিয়ে বেহেশতে চলে গেছেন। তিনি সেখান থেকে তাকিয়ে আছেন, কে কে তাঁর কবর জেয়ারত করতে আসছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাকছেন, আমি যাবোই। তাঁর নাছোড়বান্দা জেদের কাছে সবাই হার মানতে বাধ্য হন। তিনি টুঙ্গীপাড়া গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কবর জেয়ারত করে চলে আসেন। নিজের জীবনের ওপর বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন এজাহার মিয়া। তবে তিনি যে সফল হয়েছিলেন, সেটাই সবার মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিলো।
এজাহার মিয়াকে দেখে তাঁর পরে অনেকে টুঙ্গীপাড়া যাতায়াত শুরু করেছিলেন। কিন্তু প্রথম যিনি জেয়ারত করেন, তার তো আলাদা একটা মূল্য আছেই। এজাহার মিয়া এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক। এজাহার মিয়া সেজন্য কিছু চাননি, বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে। কোন কৃতিত্ব নিতে চাননি, কোন বৈষয়িক সুবিধা নিতে চাননি। এমনই নিঃস্বার্থ মানুষ ছিলেন তিনি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তিনি কোন সরকারি সহযোগিতা পাননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী একাধিকবার কারাবরণও করেছেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে তৎকালীন বাংলাদেশ কার্যালয়ের সামনে ১৫দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশ তাঁর উপর গুলি চালালে চট্টগ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। এ ঘটনায়ও এজাহার মিয়া পুলিশ কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে ধরে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। সেবার তিনি দু’দিন জেলে ছিলেন।
এজাহার মিয়া এখন জীবিত নেই, তাঁর ছেলেমেয়েদের যুগ চলছে। এজাহার মিয়ার বাড়ি হামজারবাগ গোল্লা সওদাগর বাড়ি। গোল্লা সওদাগরের আসল নাম নুর হোসেন সওদাগর। তিনি এজাহার মিয়ার দাদা। এজাহার মিয়া পিতার নাম মকবুল আহমদ, মাতা আম্বিয়া খাতুন। এজাহার মিয়া বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স হতো ৭৪ বছর। তাঁর ৩ পুত্র, ১ মেয়ে। ১৯৩৮ সালের ১২ মে তাঁর জন্ম, ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এজাহার মিয়া ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালে এই দলের সদস্য হন এবং আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতিরই অনুশীলন করেছেন। তার আগে ১৯৫২ সালে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ, সভাপতি শেখ মোজাফফর আহমদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, ডা. আনোয়ার হোসেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও সংস্কৃতিসেবী চৌধুরী হারুনর রশিদের নেতৃত্বে যখন চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হচ্ছিলো, তখন চতুর্দশ বর্ষীয় ছাত্র এজাহার মিয়া মিয়াও হামজারবাগ থেকে হেঁটে আন্দরকিল্লা, লালদিঘির পাড়ে গিয়ে চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনের মিটিং-মিছিলে অংশ নিতেন। তাঁর এলাকার কাছাকাছি মুরাদনগর মৃধাপাড়া থেকে কবি বদন মিয়া দীদারিও ভাষা আন্দোলনের মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য সেখানে যেতেন।
এজাহার মিয়া মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গেই রাজনীতি করতেন। তার একটা কারণও আছে। জহুর আহমদ চৌধুরী শ্রমিক সংগঠন করার জন্য আমিন জুট মিলে যেতেন। আর আমিন জুট মিল এলাকাতেই এজাহার মিয়ার বাড়ি। এইভাবে এজাহার মিয়া জহুর আহমদ চৌধুরীর নজরে পড়েন এবং তাঁকে তিনি আওয়ামী লীগ ও ট্রেড ইউনিয়নের কাজের জন্য রিক্রুট করেন। এজাহার মিয়া পরবর্তীকালে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতি ও আন্দোলন সংগঠিত করেন।
এজাহার মিয়া একজন অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ। তিনি ৫২ থেকে ৯০ পর্যন্ত এদেশের সকল প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৮১ সালে ড. কামাল হোসেনকে প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলো। এজাহার মিয়া সেই নির্বাচনে এজেন্ট ছিলেন। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জোর করে ব্যালেট বাক্স ছিনিয়ে নিতে চাইলে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। সেজন্য তাঁকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বেধড়ক প্রহার করা হয়েছিলো।
১৯৯৪ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মেয়র নির্বাচনের সময় তিনি ৭নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক ছিলেন। সে সময়ও কারচুপির প্রতিবাদ করায় তিনি প্রতিপক্ষের হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন। এরশাদের আমলে তিনি পৌরসভা নির্বাচনে প্যানেল চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। আরেকবার তাঁর বড় ভাই ই্সহাক মিয়া প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এজাহার মিয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চট্টগ্রাম শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি চকবাজার, হামজারবাগ এলাকা, ষোলশহর, চশমা পাহাড় ও ফিরোজশাহ কলোনী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অপারেশনে লিপ্ত ছিলেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এজাহার মিয়ার ছেলেরা বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ কামরুজ্জামান একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করে তার নামকরণ করেছেন পিতার নামে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. এজাহার মিয়া নিবাস’। তাঁর ছেলেরা সবাই চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মান-সম্মান নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে।
এজাহার মিয়া একটি রাজনৈতিক পরিবার উপহার দিয়ে গেছেন দেশবাসীকে। তাঁর পরিবার আওয়ামী রাজনীতির অনুসারী। জ্যেষ্ঠপুত্র মো. কামরুজ্জামান পিতার পদাংক অনুসরণ করে ছাত্র জীবনে রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি একজন সাবেক ছাত্রনেতা, স্কুল ও কলেজে ছাত্রলীগের সংগঠক ছিলেন। তিনি ৭নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক (১৯৯৫-৯৮) এবং হামজারবাগ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি (১৯৯৪-৯৬)। এছাড়া তিনি আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান চট্টগ্রাম মহানগর কমান্ড-এর উপদেষ্টা। ছাত্রজীবনে শেষে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। পিতার কাছ থেকে সুস্থ রাজনীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার উত্তরাধিকার লাভ করেছেন কামরুজ্জামান। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা তাঁর এলাকায় একটি উদার, মানবিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নতুন প্রজন্মকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। মো. কামরুজ্জামান একজন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী ও প্রথম শ্রেণির করদাতা।
এজাহার মিয়ার আত্মজরা তাঁদের পিতার নামে ‘এজাহার মিয়া ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মো. কামরুজ্জামানের অর্থায়নে ফাউন্ডেশনের কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এজাহার মিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফাউন্ডেশেনের ১ম কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয় ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ সালে। দুঃখী মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণের মাধ্যম ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমে শুরু হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এজাহার মিয়ার রাজনৈতিক সহকর্মী, চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
হাত খরচ কর্মসূচি : ২৫জন বয়স্ক দুঃখ ও গবির নারী ও পুরুষের মাঝে মাসিক ৫০০ টাকা প্রদান।
শিক্ষা বৃত্তি : ২০জন গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাসিক ৫০০ টাকা করে বৃত্তি প্রদান।
চিকিৎসা সহায়তা : ৬ জন দুরারোগ্য বাধিতে আক্রান্ত নারী ও পুরুষকে আর্থিক সহায়তা প্রদান।
বিবাহে সহযোগিতা : ২০জন হত দরিদ্র বিবাহযোগ্য মেয়েকে বিবাহের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান।
গৃহ ঋণ : ৩টি গৃহহীন দরিদ্র পরিবারকে গৃহ নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান।
ইফতার সামগ্রী প্রদান : প্রতি বছর রমজানে ১০০ পরিবারকে ইফতার সামগ্রী প্রদান।
করোনায় খাদ্য সহায়তা : করোনাকালীন ৭০০ পরিবাকে খাদ্য সহায়তা প্রদান।
মশক নিধন কর্মসূচি : ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মশক নিধন কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়, যা এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে।
জনসচেনতা বৃদ্ধি : জনসচেনতা বৃদ্ধির লক্ষে নিয়মিত এলাকার যুব সমাজের সাথে মত বিনিময় সভা আয়োজন।
ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অর্থ সাহায্য : ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নিয়মিত অংশগ্রহণ এবং ক্রীড়াক্ষেত্রকে জনপ্রিয় করার জন্য নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক খেলার আয়োজন।
মেধাবী ছাত্রদের ভর্তিতে সহায়তা : গত ৪ বছর ধরে প্রতিবছর ২৫ জন গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ৬ষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে ভর্তিতে সহায়তা প্রদান।