নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
শেখ হাসিনার যুগপৎ পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের পর দেশ পরিচালনার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা উঠতে না উঠতেই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম যেন টুপ করে আকাশ থেকে ঝরে পড়ল। তা-ই কি?
কেউ শিখিয়ে দেয়নি, কেউ পড়িয়ে দেয়নি, পুরাকালে সুরাসরের দ্ব›েদ্ব উৎপন্ন অমৃতের মতো হঠাৎ করে ইউনূস কিভাবে উৎপন্ন হলেন? যাঁরা তাঁকে বসিয়েছেন, নামটি হয়তো তাদের হৃদয়ে ছিলো, অনুক‚ল সময়ে সেটি তাদের মুখে উঠে আসে। তারপর থেকে বাংলাদেশে ইউনূস জিকির চলছে।
হাসিনার সঙ্গে তাঁর বিরোধ থেকেই ইউনূস হাসিনা-বিরোধীদের মিত্র। আরো আগে অর্থাৎ ২০০৬-২০০৭ এর সময়ের ফখরুদ্দিন-মঈন ইউ আহমদ-এর ওয়ান ইলেভেন উত্তরকাল থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে চোরা গোপ্তা খেলায় তিনি কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে আলোচনায় ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা কেউ না কেউ হতেন? আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় দেশের জন্য ভালোই হয়েছে। কারণ, তিনি মডারেট, লিবারেল, হিউম্যানিস্ট এবং পরমতসহিষ্ণু মানুষ। কিন্তু তিনি প্যারিস থেকে দেশে এসে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে এবং জামায়াত ও ছাত্র সমন্বয়কদের মুখ থেকে যেসব শব্দ ও বাক্যবাণ নির্গত হচ্ছে, তাতে কবি শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে হয়তো ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’- শীর্ষক আরেকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করতেন। এরশাদের আমলে যখন আটরশির পীরের ওরশ নিয়ে খুবই মাতামাতি শুরু হলো, তখন বিচিত্রায় কর্মরত সাংবাদিক শাহাদাত চৌধুরী, মাহফুজ উল্লাহ, শাহরিয়ার কবির, কাজী জাওয়াদ, চন্দন সরকার, আলমগীর রহমান-রা যেমন ‘আট রশির কাফেলা’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করেছিলেন, ঠিক তেমনি আজো যদি বিচিত্রা প্রকাশিত হত এবং তাঁরা সেখানে কর্মরত থাকতেন, তাহলে অনুরূপ আরেকটি প্রচ্ছদ কাহিনী লিখতেন।
ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে দেশে এসে ঘোষণা করলেন, তাঁর মনে হচ্ছে দেশ যেন দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ কেমন কথার ছিরি ! শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে দেশ বুঝি স্বাধীন হয়ে যায় ? তাহলে শেখ হাসিনা দেশটাকে পরাধীন করে রেখেছিলেন ? তিনি কোন্ দেশ থেকে এসে সৈন্য সামন্ত নিয়ে বাংলাদেশ দখল করেছিলেন? ড. ইউনূস বলতে পারতেন দেশে গণতন্ত্র বা জনগণের বিজয় হয়েছে, কিংবা স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। পÐিতের অসত্য বচন বজ্রাঘাত তুল্য !
ড. ইউনূসের দ্বিতীয় স্বাধীনতার তত্ত¡ থেকে কত কথাই না বেরিয়ে আসছে। চট্টগ্রামে দেয়ালে দেয়ালে ¯েøাগান লেখা হয়েছেÑ ‘স্বাধীনতা এনেছি স্বাধীনতা রাখবো’; ‘বাংলাদেশ এক জাতির বেশ নয়, বহুজাতির দেশ’; ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’।
দেশ কি দু’বার স্বাধীন হয়? দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে তিনি বুঝিয়েছেনÑহাসিনার অপশাসনের অবসান। এরপর থেকে বলাবলি হচ্ছে আমরা নতুন করে স্বাধীনতা লাভ করেছি। আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা দেয়ালে লিখছে স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধীনতা রক্ষা করবো। হাসিনা কি ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ বা পাকিস্তানের মত ঔপনিবেশিক শাসক ছিলেন। হাসিনা কি বিদেশি ? তিনি কি এদেশের নাগরিক নন? তিনি যদি এদেশের নাগরিক হন; তিনি যদি এদেশের মানুষের ভোটে জিতে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর শাসনাকাল কিভাবে পরাধীনতার সঙ্গে তুলনা করা যায়? ড. ইউনূস বড়জোর বলতে পারতেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন হয়েছে, গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে বা ফ্যাসিস্ট হাসিনার দুঃশাসনের কবর থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে। তা’ না বলে তিনি টেনে আনলেন স্বাধীনতার কথা। দেশ তো স্বাধীন একবারই হয়েছে-একাত্তরে। পাকিস্তানিরা পদানত করেছিলো এ দেশকে। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি জাতি, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে-যার আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ড. ইউনূসও সেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন আমেরিকায় জনমত গঠন ও তহবিল সংগ্রহ করে। ৭১-এর পর তো বাংলাদেশ আর কোনো বহিঃশক্তির কাছে স্বাধীনতা হারায়নি।
শেখ হাসিনা অপশাসন কায়েম করেছিলেন, বিভীষিকার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেজন্য একাত্তরে বাংলাদেশের শত্রæ আমেরিকা, পাকিস্তান, ড. ইউনূস, আসিফ নজরুল, ভিপি নূর, মির্জা ফখরুল, ছাত্র সমন্বয় এবং যত সব হাসিনা বৈরি শক্তি একাট্টা হয়ে তাঁকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে শাস্তি দিয়েছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্¦জনপ্রীতি, আত্মসাৎ, নরহত্যা, গুম, খুনের অভিযোগে এনে মামলা দায়ের করে তাঁকে সেসব মামলার আসামি করা হচ্ছে। এখানে পাকিস্তানের আলামত দেখতে পাচ্ছি। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ দফা দেয়ার পর আইয়ুব-মোনায়েম বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের প্রায় সমস্ত জেলায় মামলা দায়ের করে তাঁকে হয়রানি করেছিলো, তিনি সকালে এক জেলার মামলায় জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসার পর সন্ধ্যায় আবার আরেক জেলায় মামলায় গ্রেফতার করে তাঁকে সেই জেলার জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়া হতো। এখন বর্তমান সরকারও যেভাবে তাঁর কন্যার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা রুজু করছে, তাতে তিনিও যদি জামিন নিতে আসেন, তাঁকেও তাঁর পিতার মতো সকালে এক জেল থেকে বের হলে সন্ধ্যায় আরেক জেলে ঢুকতে হবে।
পাকিস্তানের আরো নমুনা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গানকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, সুতরাং হিন্দুর লেখা গান কেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হবে ? তাহলে এটা কি ঠিক হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ মুসলমানের দেশ, হিন্দুর দেশ নয়। কে ঠিক করলো, কখন ঠিক করলো। সেটা ঠিক করার অধিকার কে দিয়েছে?
পাকিস্তানের ¯্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও তো গণপরিষদের উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেনÑ‘আজ থেকে আর আমরা কেউ হিন্দু নই, মুসলমান নই; আমরা সবাই পাকিস্তানি’। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের পর অবিভক্ত বাংলার মানুষ বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে গর্জে উঠে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ করেছিলো। সেই আন্দোলনে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব বাঙালি অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই আন্দোলনের সময়ে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেছিলেন।
স্পষ্টতই আইয়ুব-মোনায়েমের প্রেতাত্মা তাদের কাঁধে ভর করেছে। আইয়ুব ৬১-তে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে বাধা দিতে চেয়েও পারেন নি। বটতলার উকিল মোনায়েম খাঁ তাঁর গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীদের বলেছিলেন, তোমরা কি করো, রবীন্দ্র সঙ্গীত লিখতে পারো না। মুর্খ -মোনায়েম খাঁর মাথায় এটা ঢোকে নি যে তারা লিখলে সেটা তাদের গান হবে, কবিগুরুর গান হবে না। একাত্তরের দালাল চ‚ড়ামণি গোলাম আজমের পুত্র কি বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। তাঁর পিতাও এমন কথা বলেননি।
আল্লামা ইকবালও তো হিন্দুস্থানকে ড়হি করে কবিতা লিখেছেন। তাই বলে তিনি কি হিন্দু হয়ে গেলেন? গোলাম আজমের ছেলে কি ইকবালের মুসলমানিত্ব খারিজ করে দিতে চান। ইকবালকে বাদ দিলে পাকিস্তানের থাকে কি। ইকবালই তো পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা, রহমত আলী অনেক অঞ্চলের আদ্যক্ষর নিয়ে চঅকওঝঞঅঘ শব্দ তৈরি করেছিলেন। আর বাংলার বাঘ এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি কনভেনশনে সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে সংশোধনী এনে ঝঞঅঞঊঝ শব্দকে ঝঞঅঞঊ না করলে বাংলা আলাদা রাষ্ট্র হত, পাকিস্তানের অংশ হত না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব পরে তাঁর ভুল বুঝতে পেরে কিরণ শংকর রায়, শরৎ বসু ও আবুল হাশিমকে নিয়ে অখÐ বাংলা রাষ্ট্রের পরিকল্পনা পেশ করে বাংলা ভাগ রুখতে চেয়েছিলেন।
আল্লামা ইকবাল লিখেছিলেন
“সারা জাহাঁ সে আচ্ছা, হিন্দুসিতান হামারা
হাম বুলবুলে হ্যায় কি, ইহ গুলসিতান হামারা
গুরবত মেট হোন আগর হাম, রাহতা হ্যায় দিল ওয়াট্হান
মেন সামঝো উহিন হামেন ভি দিল হো জাহাঁ হামারা
……………………………………………..
মাহব নাহিন শিখাতা আপস মেন বাইর রাখা
হিন্দি হ্যায় হাম, ওয়াতহান হ্যায় হিন্দুসিতান হামারা
ইউনান ও-মিসর ও-রুমা, সব মিট গা’য়ে জাহাঁ সে
আব তাক মাগর হ্যায় বাকি, নাম ও-নিস্ন হামারা”
১৯১১-য় বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও স্বদেশী আন্দোলনের পর পর ধর্ম পরিচয় ভুলে বাঙালি এক জাতি, এক সত্তা হয়ে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। সেই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন গ্রেট মওলানা শওকত আলী ও মওলানা মোহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয়, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু সিআর দাশ, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মতিলাল নেহেরু জওহর লাল নেহেরু, মওলানা আবদুল্লাহেল কাফী, মওলানা আবদুল্লাহেল বাকী, বর্ধমানের ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, মওলানা আকরম খাঁ, আবুল হাশিম, চট্টগ্রামের দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত, শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা আলী আহমদ ওলি ইসলামাবাদী, শাহ বদিউল আলম, লোকমান খান শেরওয়ানি, শিখ ধর্মগুরু কৃপাল দাস উদাসী, মহিম চন্দ্র দাশ, ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী, তৎকালীন চট্টগ্রামের শীর্ষ ধনী আবদুল বারী চৌধুরী, নজির আহমদ চৌধুরী ও আবদুল গণি চৌধুরী প্রভৃতি সর্বজনমান্য নেতৃবর্গ। তাহলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হিন্দুর আন্দোলন ছিলো-একথা সত্য নয়। সুতরাং সেই আন্দোলনের জন্য রচিত গান ‘আমার সোনার বাংলা’। শুধু হিন্দুর গান ছিলো না, মুসলমান তথা সমগ্র বাঙালি জাতির গানই ছিলো।