জীবনের এমন একটা চৌরাস্তায় উপনীত হয়েছি, যেখান থেকে আর কোনদিকে যাওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। পথ অনেক, কিন্তু পথের শেষে কি আছে জানি না। কোথায় পৌঁছবো সেটা জানতে না পারলে যাই কি করে। অতএব গন্তব্য খুঁজে না পেয়ে চৌরাস্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। আর অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলাম। জীবনে এত ভুল করলাম যে এখন মনে হচ্ছে আমার সম্পূর্ণ জীবনটাই ভুলে ভরা। এমন সময় কেউ একজন আমাকে বললো অনলাইন নিউজ পোর্টাল করুন। আপনাকে অনেক লোক চেনে জানে। আপনি অনলাইন পেপার করলে বিস্তর লোকের কাছ থেকে সাড়া পাবেন। বিজ্ঞাপনও পাবেন।
চেয়েছিলাম জীবনে বড় কিছু হবো। সেটা হওয়ার পথে বাধা এলো একাত্তরে, আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। সবার আগে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলাম।
২০১৫ সালে হার্টের বাইপাস করার মাস কয়েক পরেও সুস্থ হয়ে উঠতে না পারায় পূর্বদেশ-এর চাকরি ছেড়ে দিলাম। না দিয়ে উপায় ছিলো না। কারণ কর্তৃপক্ষ কতদিন আমাকে কাজ ছাড়া বেতন দিয়ে যাবেন। তারও একটা সীমারেখা তো থাকা উচিত। মনের সঙ্গে এইসব বোঝাপড়া করতে করতে দুম করে একদিন ইস্তফা পত্র পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকা অফিসে। সেই থেকে আমার নাম উঠেছে বেকারের খাতায়।
অবশ্য বেকারত্বের অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছিলো। সকলেই জানেন, আমি পূর্বকোণের বার্তা সম্পাদক ছিলাম। ২০০৫ সালে ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের সময় আমি, পূর্বকোণের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক জনাব আতাউল হাকিম, চিফ সাব-এডিটর জনাব ইস্কান্দর আলী চৌধুরী, সিনিয়র সাব-এডিটর জনাব আ.জ.ম ওমর-আমরা চারজন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি যৌথ দরখাস্ত দিয়ে বেতন বৃদ্ধির আবেদন করেছিলাম।
তাতে লেখা একটি বাক্যের আইনগত ব্যাখ্যা দিয়ে পূর্বকোণের উকিল বাবু বললেন পদত্যাগ হয়ে গেছে। গণপদত্যাগ আইনের ধোপে টেকে কিনা সে প্রশ্ন তুললাম না। চাকরির নিয়োগ যদি ব্যক্তিগত হয়, পদত্যাগ কি করে যৌথ হয়? যাই হোক আমাদের দরখাস্তকে গণপদত্যাগ ধরে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বিদায় করে দিতে চাইলেন। কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে থাকার কোন মানে হয় না। অতএব, আমাদের জীবন থেকে পূর্বকোণ অধ্যায়ের অকাল পরিসমাপ্তি ঘটলো।
আমাদের জীবনে প্রকৃত বেকারত্বের সূচনা ঘটলো তখনই। তারপর থেকে ছদ্ম বেকারত্ব শুরু হলো আমার জীবনে। পূর্বকোণের একদা’র মিরসরাই সংবাদদাতা নিজামউদ্দিনের ‘বন্দর নগরী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ডিক্লারেশন ছিলো। সাংবাদিকতায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টায় আমি আর হাকিম ভাই নিজামের ডিক্লারেশন ধার ধরে কিছুদিন এক্সপেরিমেন্ট করলাম। কোন লাভ হলো না। ‘বন্দর নগরী’কে কোনো বন্দরে ভিড়াতে পারলাম না। অবশেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম।
এরপর চসিক মেয়র, চট্টগ্রাম মহাগনর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আমাকে সম্পাদক করে কর্পোরেশনের মুখপত্র হিসেবে একটি দ্বি-ভাষিক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করলেন। প্রথমে ‘নগর বার্তা’ পরে ‘নগর সংবাদ’ নামে সেই পত্রিকা চার সংখ্যা প্রকাশের পর দেশে সামরিক শাসন জারি হলো। ‘ওয়ান ইলেভেন’ নামে বহুল পরিচিত সেই ঘটনায় মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেফতার হয়ে গেলে ‘নগর সংবাদ’-অকালে অক্কা পেলো।
অতঃপর ঢাকা থেকে ‘জনকণ্ঠে’র একটি অফার পেয়ে ঢাকা চলে যাই। জনকণ্ঠে যোগ দিলাম সহকারী সম্পাদক পদে। ক’মাস সেখানে কাজ করতে না করতেই আমাকে পেলো শাহজাহান সরদার। তার সঙ্গে আমার আগে থেকে পরিচয় ছিলো। সে ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার ছিলো। ইত্তেফাক ছেড়ে আসার পর সে ‘ভোরের ডাক’ নামক একটি দৈনিকে উপদেষ্টা সম্পাদক’ হিসেবে যোগদানের অফার পেয়েছিলো। সে পত্রিকাটা ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে তো সারাজীবন রিপোর্টারের চাকরিই করেছে, পত্রিকার গেট আপ, মেক-আপ তার অজানা। কুদ্দুস আফ্রাদ বা আশীষ সৈকতের কাছে শাহজাহান খবর পেয়েছিলো পূর্বকোণের নাসির চৌধুরী ঢাকায় আছে। সে আর বিলম্ব করে নি। আশীষের মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার সাহায্য চাইলো। শাহাজাহানের একটা জিনিস আমার ভালো লাগে। সেটা হলো তার মধ্যে কোন ভন্ডামী নেই। সে যা জানে না সেটা অকাপটে স্বীকার করে নিতে পারে। সে আমাকে বলেছিলো, ভাই একটা কাগজের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। কিন্তু পত্রিকার গেট আপ মেকআপ তো আমি বুঝি না, আপনিই সেটা ভালো বোঝেন। আমি আপনার সাহায্য চাই। আপনি জনকণ্ঠের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভোরের ডাক-এ যোগদান করুন। আমি জনকণ্ঠের চাকরি ছাড়তে চাইনি। কারণ জনকণ্ঠে কলাম লিখে আমি মজা পেয়েছিলাম। স্বীকৃতিও পাচ্ছিলাম। বিচারপতি হাবিবুর রহমান আমার লেখার প্রশংসা করে তাঁর একটি লেখায় আমার কলাম থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। তাই বললাম জনকণ্ঠের চাকরির ফাঁকে আমি কিছুদিন ভোরের ডাক-এ গিয়ে গেটআপ, মেকআপ দেখিয়ে দেব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল আমাকে জনকণ্ঠ ছেড়ে পুরোপুরি ভোরের ডাক-এ নির্বাহী সম্পাদক পদে চলে আসতে হলো। মাস ছয়েক কাজ করতে না করতেই ভোরের ডাক-এর হাট ভেঙ্গে গেলো। বসুন্ধরার চেয়ারম্যান আহমদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম আমাদেরকে তাঁর অফিস ও বাসায় কয়েক দফা ডেকে নিয়ে বোঝালেন, তাঁকে একটি পত্রিকা করে দিতে হবে। সেই পত্রিকা ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। ছ’ মাস প্রতিদিন বের করতে না করতে আমার হৃদযন্ত্র বিগড়ে গেলো। ২০১০ সালের জুন মাসে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গভীর রাতে আমার হার্ট অ্যাটাক হলো। সাংবাদিক মিয়া মোস্তাফিজ (বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) আর শান্তনু চৌধুরী ধরাধরি করে আমাকে কোনমতে নিকটবর্তী হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে প্রাণ বাঁচালো। এরপর এনআইসিভিডিতে বুকে স্টেন্ট লাগিয়ে ডাক্তারের নির্দেশে চট্টগ্রাম চলে আসলাম।
২০১৩ সালে স্মার্ট গ্রুপের এমডি ও বর্তমান পূর্বদেশ সম্পাদক মুজিবুর রহমান সাহেব আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন পূর্বদেশটা দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্য। পূর্বদেশ দাঁড়ালো। কিন্তু আমার হৃদযন্ত্রের বৈকল্য আবার ধরা পড়লে ২০১৫ সালের নভেম্বরে কলকাতা গিয়ে মুকুন্দপুরের মেডিকা সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালে ভর্তি হলাম। চট্টগ্রামের রাউজান থানা নিবাসী বিপ্লবী বিভূতিভূষণ সরকারের পুত্র স্বনামধন্য কার্ডিয়াক সার্জন ডা. কুনাল সরকার আমার বুকে বাইপাস সার্জারি করলেন। তার পরের কথা প্রথমে বলেছি।
প্রায় তিন বছর বসে আছি। অপারেশন করেও হার্টের রোগ ভালো হয় নি সেটা আগে বলেছি। মাঝে মাঝে সমস্যা হয়, তখন আবার আমাকে নিয়ে টানাটানি পড়ে; ডাক্তার, হাসপাতাল দৌড়ঝাপ হয়। বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষী ও নিকটজনের বদান্যতায় বেঁচে আছি।
কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, তিন বছর বসে থাকার পরও আমার কাছে কোন পত্রিকা থেকে কেন কোন অফার আসলো না। মাঝখানে শুধু একবার ফোর এইচ গ্রুপ আমার ওপর আস্থা রেখে আমাকে দিয়ে একটি পত্রিকা করতে চেয়েছিলো। ডিক্লারেশন নিয়ে, একটা সুন্দর অফিস তৈরি করে এবং আমাদের চার পাঁচজনকে সাত/আট মাস বেতন দিয়ে কেন তারা পিছিয়ে গেলেন, সে রহস্য আজো আমি ভেদ করতে পারি নি। গওহর জামিল আর মামুন সাহেব খুব ভালো মানুষ। জামিল সাহেব উদার, হাতখোলা মানুষ। কিন্তু তারা একবার ‘না’ করার পর শত চেষ্টা করেও আমি আর ‘হ্যাঁ’ করাতে পারিনি।
চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত সাংবাদপত্র মালিকরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন এবং জানেন। আমি কি পারি, কি না পারি সেটাও তাঁরা ভালো করে জানেন। তবুও কেন তাঁরা আমাকে তাঁদের পত্রিকায় কাজ করার জন্য আহ্বান জানালেন না, সেটা আমার বুদ্ধির অগম্য। এটা হতে পারে, তাঁরা হয়তো ভেবেছেন আমি অসুস্থ-আমি ঠিক মতো কাজ করতে পারবো না।
কিন্তু আমি দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে চাই, রেসের মাঠে সাংবাদিকতার দৌড়ে আমি এখনো অনেক তরুণের চেয়ে ভালো দৌড়াতে পারবো। আমার ওপর বাজি ধরলে দেখবেন তাদের ঘোড়াই জিতেছে। সাংবাদিকতার প্রায় সব কাজ-জুতা সেলাই থেকে চ-ীপাঠ-আমি জানি। সার্কুলেশন, বিজ্ঞাপন, প্রশাসন, ফিচার, সম্পাদকীয়, রিপোর্টিং, বার্তা-সব বিভাগের কাজই আমি সম্যক জানি। তথাপি, ‘অতি সুন্দরীর যেমন বরভাগ্য’ হয় না, তেমনি আমিও মালিকের নেকনজরে আসতে পারলাম না। ‘দশ জনে চিনে মেজবানে না কয়’ -চাটগাঁইয়া প্রবাদের মতোই আমার অবস্থা।
আমার দুঃখ চট্টগ্রামের সংবাদপত্র এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। অথচ চট্টগ্রামের সংবাদপত্র থেকে নতুন কিছু চায় পাঠক সমাজ। সেই নতুন কি, সেটা হয়তো আমি জানি। সেটা যতক্ষণ পাঠক না পাচ্ছেন, তাকে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাতে হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনে একটা কথাই শুধু আমি বলতে চাই পূর্বকোণ দিয়ে এক সময় আমরা চট্টগ্রামের সংবাদপত্র জগতে বিপ্লব সাধন করেছিলাম, প্রতিদিন ফিচার পাতা এবং লেখক সম্মানী আমরাই চালু করেছিলাম।
আমাকে যিনি অনলাইন পেপার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁর কথা মেনে আমি একটি অনলাইন ওয়েব পোর্টাল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওই পোর্টালের নাম দিয়েছি ‘সঁশঃর৭১.পড়স’। ‘মুক্তি’’ আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেটা মনে রেখে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মু্িক্তযোদ্ধার স্মরণে পোর্টালের নামকরণ করেছি ‘মুক্তিযোদ্ধা (মুক্তি) ৭১.কম’। আমাদের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে অনির্বাণ শিখা জ্বলছে তারই আলোয় পথ কেটে কেটে এগিয়ে যাবে আমার নিউজ পোর্টাল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সর্বাগ্রাধিকার দিয়ে আমার পোর্টাল চালাবো। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তি কমিটির সদস্য তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার ছড়িয়ে দেবো। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছি আমি ও আমার সহকর্মীরা। অবশ্যই সংবাদ প্রধান বিষয় হিসেবে থাকবে। তাছাড়া সম্পাদকীয়, ভাষ্য, মন্তব্য, টীকা-টিপ্পনি, ব্লগ, সংলাপ তো থাকবেই।
আমার অনেক বন্ধু, সুহৃদ, শুভাকাক্সক্ষী, ভক্ত-অনুরক্ত-সমর্থক আছেন বলে শুনি। আত্মীয়-স্বজনও কম নয়। সকলের কাছে আমার বিনীত আবেদন, আমার অনলাইন পোর্টালটা পড়–ন, লাইক দিন, শেয়ার করুন, অভিমত পেশ করুন, সামর্থ্য থাকলে বিজ্ঞাপন দিন। সম্ভব হলে আপনার পরিচিত জনকে উদ্ব্দ্ধু করুন-তারা যেন আমার পোর্টালে বিজ্ঞাপন দেন। আমার জীবনের শেষবেলার উদ্যোগটা যেন বিফলে না যায়, সেজন্য আপনাদের সমর্থন, সাহায্য-সহযোগিতা ভীষণ প্রয়োজন মনে করছি এবং আপনাদের কথাও খুব মনে পড়ছে। অতীতের সুখ-দুঃখের সকল স্মৃতি মনে করে নিশ্চয়ই আপনার সক্রিয়তা দিয়ে আমার নতুন উদ্যোগ ফলপ্রসূ করে তুলবেন এমন আশা করা কী অসঙ্গত হবে?
 
								 
											 
 
													







