প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটছে বলে শুনতে পাচ্ছি তা ঘটা উচিত নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেই প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আন্তর্জাতিকখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এবং সর্বজনমান্য বুদ্ধিজীবী, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. অনুপম সেন দীর্ঘদিন ধরে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্যের পদ অলংকৃত করে এটিকে উচ্চমানে উন্নীত করে মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি একজন নিপাট ভদ্রলোক, নিরীহ, নির্বিরোধী, শান্ত, স্থিতধী মানুষ। আমার দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি একজন অসাধারণ জ্ঞানী ও পন্ডিত। জ্ঞানচর্চার মধ্যেই অতিবাহিত হয় তাঁর জীবন ও জগৎ। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, প্রফেসর সেন এই নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করে সর্বমানবের প্রতি অপরিসীম মমতায় পূর্ণ করে রেখেছেন তার হৃদয়। ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, শ্রেণী নয়, মানুষকে মানুষ হিসেবেই তিনি দেখেন এবং এই তাঁর মানুষকে বিচারের মাপকাঠি। এতদিন জানতাম প্রফেসর অনুপম সেন অজাতশত্রু; তাঁর প্রতি কেউ শত্রুভাবাপন্ন হতে পারে, এটাই ভাবাই যায় না। যেহেতু তিনি নিজে কারো প্রতি অসূয়া, বিদ্বেষ পোষণ করেন না, তাঁর প্রতি কেউ কেন বিদ্বেষ পোষণ করবে? তারা যদি তাঁর ছাত্র হয়, তাহলে এ কথা আরো বেশি করে প্রযোজ্য। তিনি চট্টগ্রামে আছেন, এটা চট্টগ্রামের সৌভাগ্য। আমি ড. ইউনুসকে নিয়ে লেখা আমার সাম্প্রতিক এক লেখায় বলেছি, প্রফেসর ড. ইউনুস, প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এবং প্রফেসর ড. অনুপম সেন- এই চারজন মনীষী চট্টগ্রামের ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডর, অর্থাৎ বহিঃবিশ্বে এঁরাই চট্টগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করেন।
প্রফেসর ড. ইউনুস এবং প্রফেসর ড. অনুপম সেন সমসাময়িক কালের মানুষ। আমি চেক করে দেখেছি, উভয়েরই জন্ম ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে, উভয়েই একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। প্রফেসর ড. অনুপম সেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে প্রফেসর ইউনুস দেশের ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করছেন আর ড. অনুপম সেন তাঁর সরকারের আমলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাত্র। ড. সেনকে নিয়ে প্রিমিয়ারে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে, তাতে, আমার মনে হচ্ছে প্রফেসর ড. ইউনুসকেই অসম্মান করা হচ্ছে।
ড. সেন পটিয়া থানার ঐতিহাসিক ধলঘাট গ্রামের মনীষাদীপ্ত আলোকপ্রাপ্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জ্যাঠামশাই কবিভাস্কর শশাঙ্কমোহন সেন ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। তিনি চট্টগ্রাম আদালতে ওকালতি করতেন, নিরবে করতেন সাহিত্যচর্চা। তাঁর পান্ডিত্য ও বিদ্যাবত্তার সংবাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাংলার বাঘ, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে তিনিই শশাংকবাবুকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনায় নিযুক্ত করেন এবং তাঁকে দিয়েই তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ আরম্ভ করেন। মনীষী অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার বলেছেন, বাংলাদেশে বিশ্বসাহিত্যের খবর বলতে পারেন দুজন- আচার্য্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ও শশাঙ্কমোহন সেন। জ্যাঠামশাই এর সমস্ত প্রতিভার উত্তরাধিকার নিয়েই জন্মেছেন ড. অনুপম সেন। তিনি শুধু সমাজবিজ্ঞান পড়ান না, তিনি বাংলা সাহিত্যেরও একজন অনুসন্ধানী পাঠক; কবিতা লেখেন, শেলী, কীটসের ইংরেজি কবিতার অনুবাদ করেছেন। মননশীল প্রবন্ধ রচনায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত। চিন্তাউদ্দীপক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক ধারার প্রবন্ধ উপহার দিয়ে তিনি চিন্তাজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
প্রফেসর অনুপম সেনের কোন পিছুটান নেই। প্রফেসর অনুপম সেন আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তাঁকে যখন উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন তিনি না করতে পারেন নি, কারণ তিনি ভদ্রলোক। না করলে শেখ হাসিনা মনে কষ্ট পেতে পারেন, এটা ভেবে তিনি আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন নি। ভদ্রলোক কখনো কারো মনে দুঃখ বা কষ্ট দিতে পারেন না।
প্রিমিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল একটি মহল আমাকে বলেছেন যে, প্রফেসর সেন নাকি আন্দোলনকারী ছাত্রদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, এ কারণেই সৃষ্টি হয়েছে সাম্প্রতিক ছাত্র অসন্তোষ। ড. অনুপম সেনকে বিগত ৪০ বছর ধরে আমি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি এবং জানি। সেই চেনা জানার অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এটা সত্য নয়। ড. সেন ছাত্রদের সম্পর্কে এমন বিরূপ মন্তব্য করতেই পারেন না। ছাত্রদেরকে তিনি সন্তানের মত জানেন এবং ভালোবাসেন। তাছাড়া ভদ্রলোকের সমস্যা হলো তাঁরা কারো কথায় মনে কষ্টে পেলে বা আহত হলে সেটা প্রকাশ করেন না। মনে চেপে রাখেন। কাজেই এটা ধরে নেওয়া যায় যে, ড. সেন ছাত্রদের সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য করেননি। এটা কোন স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার।
দলীয় লোক বা দলের প্রতি সহানুভূতিশীল লোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য হয়েছেন এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি দেওয়া যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া, প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন ও প্রফেসর আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী উপাচার্য্য হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ও অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি সমর্থিত অধ্যাপক বদিউল আলম এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত অধ্যাপক আবু ইউসুফ ও অধ্যাপক আবদুল মান্নান উপাচার্য্য হয়েছেন। সুতরাং প্রফেসর সেন যে প্রিমিয়ারের উপাচার্য্য হলেন সেটা আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টার কারণে নয়। তাঁর জ্ঞান এবং প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে প্রিমিয়ারের বোর্ড অব গভর্নরস তাঁকে উপাচার্য্য পদে নিয়োগ দান করেছেন।
প্রফেসর অনুপম সেন যে চট্টগ্রাম আছেন প্রিমিয়ারের উপাচার্য্য হয়ে, সেটা তাঁর দয়া। তিনি চট্টগ্রামকে ভালোবাসেন, সে কারণে চট্টগ্রামের মাটির টানে পরে আছেন, চট্টল ভূমে। তাঁর কোন পিছু টান নেই। তাঁর স্ত্রী বিগত, একমাত্র কন্যা স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করেন। প্রিমিয়ারকে দেশের সেরা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবেন, মনে মনে এমন একটি সংকল্প নিয়ে ড. সেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য-এর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর যদি মনে হয় চট্টগ্রামের মানুষ তাঁকে আর চাচ্ছে না, তিনি প্রাপ্য মর্যাদা পাচ্ছেন না, তখন তাঁকে কেউ আর ধরে রাখতে পারবে না। আমি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি করজোরে মিনতি করে বলছি প্রফেসর অনুপম সেনকে আর বিরক্ত করবেন না। প্রফেসর সেনকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে তাঁকে চট্টগ্রাম তথা প্রিমিয়ারে ধরে রাখার চেষ্টা করুন। প্রফেসর অনুপম সেন আমাদের চেতনার প্রহরী, আমাদের আলোকিত বাতিঘর। তিনি যদি অভিমান করে চট্টগ্রাম থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন,তাহলে আমাদের চেতনার আলোকিত বাতিঘরটি নিভে যাবে।