সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ২৪ ভাদ্র, ১৪৩২, ১৫ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭

বাঁশখালীর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক সুভাষ আচার্য্য

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

ভারতে না গিয়ে যাঁরা গ্রামে অবস্থান করে বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুভাষ আচার্য্য অন্যতম। তিনি সুলতান উল কবির চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করতেন এবং তাঁর গ্রæপের নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দক্ষিণ বাঁশখালীর নাপোড়া গ্রামের মানুষ তিনি। সুলতান উল কবির চৌধুরীও দক্ষিণ বাঁশখালীর মানুষ, তাঁর পুইছড়ি, অরইল্যার জমিদার বংশের সন্তান। তাঁর কথায় তিনি একজন গরীব মাস্টারের ছেলে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে আরো কয়েকজন মাস্টারের ছেলে রাজনীতিতে যোগদান করে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। তাঁরা হচ্ছেনÑপটিয়া থানার মনসা গ্রামের আবদুস ছালাম মাস্টারের ছেলে এস এম ইউসুফ ও বাঁশখালীর বেদার মাস্টারের ছেলে শাহ-ই-জাহান চৌধুরী (৭৩-এ এমপি নির্বাচিত) । আরো থাকতে পারেন কিন্তু আমার জানা নেই। অধমও একজন মাস্টারের ছেলে, কিন্তু আমি তো বড় নেতা নই। মহিউদ্দিন চৌধুরীও মাস্টারের ছেলে ছিলেন, তবে স্কুল মাস্টার নয়, স্টেশন মাস্টার। সুভাষ আচার্য্য স্বাধীনতার পর নিজেও মাস্টারি পেশা গ্রহণ করেছিলেন। সুভাষ আচার্য্য সম্পর্কে এখানে একটা কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন মনে হচ্ছেÑসেটা হচ্ছে তিনি আওয়ামী লীগ করলেও তাঁকে অনায়াসে কমিউনিস্ট বলে চালিয়ে দেয়া যেত। কমিউনিস্টদের মতোই সরল, অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক। ঐতিহাসিক ড. মুনতাসির মামুন একটা দামী কথা বলেছেন। সেটা হলো একজন রাজাকার সারা জীবনই রাজাকার থেকে যায়, তার কোন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিন্তা-চেতনা ও কর্মে মুক্তিযোদ্ধা থাকার জন্য সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সবসময় একটি বিপজ্জনক প্রবণতা দেখা যায়। ৪৭-এর দেশভাগের পূর্বে মুসলমানরা নিজের দেশের ঐতিহ্য ও বীর পুরুষদের কথা বলে আরব, ইরান-তুরাণের ঐতিহ্যে মজে সেখানকার বীরপুরুষদের বীরত্বের কাহিনী শুনত রাত জেগে পুঁথিপাঠ শুনতে শুনতে। সাহিত্যেও একটা ইসলামী সাহিত্যের ধারা সৃষ্টি হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালি মুসলমান আবার স্বদেশের পানে ফিরে থাকার অবকাশ পায়। জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্তে¡র বিপরীতে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বনি তুলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অবশ্য ভাষা আন্দোলনেই প্রথম বাঙালি মুসলমান, বদরউদ্দীন উমরের কথায়, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও সংস্কৃতিক ফ্রন্টে লড়াই না হওয়ায় বাঙালি মুসলমানের মনের জমিতে ইসলামী চিন্তার বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার সুযোগ থেকে যায়। এই সাংবাদিক খোন্দকার আবদুল হামিদ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর তত্ত¡ উদ্ভাবন করেন, যার সদ্ব্যবহার করতে জিয়াউর রহমানের কোন অসুবিধা হয়নি। তারপরে ‘বাংলা ভাই’ এবং আরো কতকিছু জন্ম হয় বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বিতাড়িত সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ আবার ফিরে আসে বাঙালি মুসলমানের জনমানসে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেও ঘায়েল করে ফেলে এই সাম্প্রদায়িক ঘুণপোকা। এই কথাটায় বলতে চেয়েছিলেন মুনতাসীর মামুন। তাছাড়া নিজের মধ্যে যে লোভ আছে, মোহ আছে, পাপ আছে, অসত্য, অসুন্দর আছে, তার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। নিরন্তর যুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিজের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তবেই চিরজীবন মুক্তিযোদ্ধা থাকা যায়। সুভাষ আচার্য্যরে কোনো লোভ বা মোহ ছিলো না, উচ্চাশা, ভোগের আকাক্সক্ষা কিছুই ছিলো না। সেজন্য তাঁকে আমি বলি স্বভাব মুক্তিযোদ্ধা, যেমন হয় স্বভাব কবি।
তিনি কেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও অস্ত্রের জন্য ভারতে যাননি, একথা জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে বলেছিলেন “বাঁশখালীর পশ্চিমে সমুদ্র, পূর্বে লম্বালম্বি পাহাড় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত। আমি আত্মগোপনে গেলাম ও স্থানীয়ভাবে ছাত্র যুবকদের যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে থাকলাম। মরহুম মৌলভী সৈয়দ চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করেই গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছেন। আমার সঙ্গে সৈয়দ ভাইয়ের যোগাযোগ হল (মৌলভী সৈয়দের বাড়িও বাঁশখালী)। পূর্বাঞ্চলীয় লিবারেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমদ চৌধুরী এবং বি,এল,এফ-এর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মনি, এম.এ মান্নানের সাথে সৈয়দ ভাইয়ের মাধ্যমে যোগসূত্র স্থাপিত হল। ইতিমধ্যে সৌভাগ্যক্রমে চট্টগ্রাম সিটি কলেজর প্রাক্তন ভি,পি ও জি,এস ও শহর ছাত্রলীগের প্রভাবশালী ছাত্রনেতা জনাব সুলতান উল কবির চৌধুরীর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। দীর্ঘ আলাপের পর তাঁকে আমাদের আস্তানায় নিয়ে আসি। শুরু করলাম উনার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রæপ গঠনের কার্যক্রম।”
বাঁশখালী অবহেলিত জনপদ হলেও বাঁশখালীর অনেক ছাত্রনেতা এবং রাজনৈতিক নেতা অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলার রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তন্মধ্যে ছাত্র রাজনীতিতে মোখতার আহমদ, মৌলভী সৈয়দ, দানেশ আহমদ চৌধুরী ও শাহ-ই-জাহান চৌধুরীর নাম উল্লেখযোগ্য। জেলার রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে বাঁশখালীর জাকেরুল হক চৌধুরী বিশিষ্ট নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সুভাষ আচার্য্য ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন (বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) বলে ৬ দফার আন্দোলন, ১১ দফার আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সূত্র ধরে গণঅভ্যুত্থানের পরে সত্তরের নির্বাচনে একজন ভোটার হিসাবে এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে গণমানুষকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে তাঁরও ভূমিকা ছিল। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জিতল। পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানান রকম টালবাহানা করতে থাকলে বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ছাত্র যুবকদের নিয়ে জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হল। ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হল। সুভাষ জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য হলেন। একদিকে পাকিস্তানিরা ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার ও শোষণ ষড়যন্ত্রের সব রকম পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হল; অপরদিকে বঙ্গবন্ধু এক দফার সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের পতন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ ইত্যাদি আন্দোলন ও অর্জনের কারণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি বাঙালির দৃঢ় আস্থা, বিশ্বাস যেমন জাগ্রত হতে থাকল, সাথে সাথে জনগণ আন্তর্জাতিক শত্রæ ও বন্ধু চিহ্নিত করে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। বাঙালি জাতির জন্য আস্ল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ স্বাধীনতা ঘোষণার দিন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি এবং উক্ত ভাষণের শেষে “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম” বলে স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়ে দেন। তারপর ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচারে গণহত্যা ও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ।
১ কোটির মত মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে শরণার্থী হল। ওখান থেকে যারা মুক্তিযোদ্ধা হল তাদেরকে ট্রেনিং দিল ভারত। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শিক্ষিত সচেতন যুবকদের নিয়ে গঠিত হল বিএলএফ; পলাতক ই,পি, আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাধারণ যুবকদের নিয়ে গঠিত হল এফ,এফ। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত হল প্রবাসী সরকার (অন্তর্বর্তীকালীন) যা মুজিব নগর সরকার নামে খ্যাত। বাঁশখালী থেকেও অনেকে ভারতে গেলেন, আবার তারা থেকে যান দেশের অভ্যন্তরে। সুভাষ আত্মগোপনে চলে যান এবং স্থানীয় ছাত্র যুবকদের যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে থাকেন। মৌলভী সৈয়দ চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করেই গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছেন। তাঁর সঙ্গে মৌলভী সৈয়দের যোগাযোগ হয়। পূর্বাঞ্চলীয় লিবারেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমদ চৌধুরী এবং বি,এল,এফ-এর শেখ ফজলুল হক মনি, এম.এ মান্নানের সাথে মৌলভী সৈয়দের মাধ্যমে যোগসূত্র স্থাপিত হল। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কলেজর প্রাক্তন ভি,পি ও জি,এস ও শহর ছাত্রলীগের প্রভাবশালী ছাত্রনেতা সুলতান উল কবির চৌধুরীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। দীর্ঘ আলাপের পর তাঁকে তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে আসেন। শুরু করেন তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রæপ গঠনের কার্যক্রম।
সুলতান উল কবির চৌধুরীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসিকতার মাধ্যমে তারা একটি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ সংগঠিত করা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করা ও তাদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ইতোমধ্যেই বাঁশখালীতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়েছে। পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনী এবং বিহারী ও স্থানীয় পাকিস্তান সমর্থকরা মিলে বাঁশখালীতে প্রথমবার আক্রমণ চালিয়ে রাস্তার দুই পার্শ্বে বহু বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়। স্থানীয় পাকিস্তান সমর্থকেরা মানুষের বাড়িঘরের সব সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। গ্রামের পর গ্রামে মানুষের স্বজন হারানোর কান্না ও বীভৎসতা এক ভয়াবহ দৃশ্যের অবতরণা করে।
এরই মধ্যে বাঁশখালীর উত্তরে বাণীগ্রামেও একদল যুবক নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ গঠনের চেষ্টা করা হয়। তাতে নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ হাসেম, ট্রেনিং দিয়েছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দিন। দক্ষিণ দিকে সুলতান কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে সুভাষরা পলাতক বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ও ই,পি,আরের লোকদেরকে সংগ্রহ করে তাদের দিয়ে স্থানীয় যুবকদের ট্রেনিং এর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী গ্রæপ গঠন করেন। এরপর তাঁরা ছোটখাট অপারেশান শুরু করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিলোÑচাম্বলের তহসিল অফিস, জলদীতে সার্কেল অফিসারের অফিস অপারেশন। মাঝে মধ্যে পাকিস্তান সমর্থকদের বাড়িতেও তাঁরা আক্রমণ চালান। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় যেমন পুকুরিয়া, চাম্বল, বাণীগ্রাম ও জলদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রæপ গঠিত হয়। পুকুরিয়ায় শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে, বাণীগ্রামে মোহাম্মদ হাসেম ও ছমিউদ্দিনের নেতৃত্বে, চাম্বলে মরহুম ওয়াজেদ আলী খাঁ ও সিরাজুদৌলার নেতৃত্বে, জলদীতে নুরুল কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রæপ গঠিত হয়।
ইতোমধ্যে বাঁশখালীর দক্ষিণ দিকে পাঞ্জাবীরা দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে তাতে একমাত্র নাপোড়ায় একদিনে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৩৫ জনের মত মানুষকে গুলি করে হত্যা করে ও অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। সুলতান গ্রæপের মুক্তিযোদ্ধারা তখন নাপোড়ার গভীর জঙ্গলে ছিলেন। যেদিন পাঞ্জাবীরা নাপোড়া আক্রমণ করল সেদিনের হত্যা, লুট, নারী ধর্ষণ ও অত্যাচারের বীভৎসতা ছিল মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও মারাত্মক। এর পরপরই রাজাকার ও শান্তি কমিটি গঠিত হল। এ এলাকার তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সারসহ আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দের এক বৈঠকে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ মুরিদুল আলম ও ছাত্রনেতা ফরিদুল আলম স্থানীয় রাজাকারদের হাতে শহীদ হন। স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছৈয়দ আহামদ চৌধুরী ও রাজাকার কমান্ডার আহামদ শফির নির্দেশে এই খুনের ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গুনাগরীতে পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনী স্থায়ীভাবে ক্যাম্প করে। এই সময় তারা সুলতান উল কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে বাঁশখালীর সকল মুক্তিযোদ্ধাকে ঐক্যবদ্ধ করে মরণপণ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নাপোড়ার অবস্থান থেকে তারা চকরিয়ার গভীর জঙ্গল মধুখালীতে গিয়ে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। ওখানে গিয়ে শতাধিক যুবককে কঠোর ট্রেনিং দেওয়ার পর তারা পাহাড়ি পথ দিয়ে বাঁশখালীর উত্তর প্রান্তে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে চাম্বল, তারপর জলদী, ওখান থেকে বাণীগ্রাম ও সর্বশেষ পুকুরিয়ার চা বাগানে গিয়ে অবস্থান নেন। যাওয়ার সময় পথিমধ্যে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের অস্ত্রসহ তারা গিয়ে সুলতান উল কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপে একীভূত হয়ে যান।
ডিসেম্বর মাস আসলে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনের জন্য কমান্ডারের উপর চাপ দিতে থাকেন। এর পরিপেক্ষিতে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন গুনাগরী ওয়াপদা বিল্ডিং-এ অবস্থিত বাঁশখালীর সর্ববৃহৎ হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করবেন। তাতে প্রায় ৫০০ মত রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ বাহিনীর লোক ছিল। ১১ ডিসেম্বর তারা গুনাগরীর ওয়াপদা বিল্ডিং-এর সর্ববৃহৎ শত্রæ ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ভারত থেকে আসা ডাক্তার আবু ইউসুফের নেতৃত্বে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধার আর একটি দল। তারা তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ১১ ডিসেম্বর দিনের বেলায় গুণাগরী ওয়াপদা বিল্ডিং ঘেরাও করেন। বাহক মারফত চিঠি দিয়ে শত্রæপক্ষকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু শত্রæপক্ষ আত্মসমর্পণে অস্বীকার করলে যুদ্ধ শুরু হয়। সারারাত গোলাগুলির পর শত্রæরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তারা ১২ ডিসেম্বর বাঁশখালীর সর্ববৃহৎ শত্রæ ঘাঁটি দখল করে গুনাগরীর ওয়াপদা বিল্ডিং-এ প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। বাঁশখালী শত্রæমুক্ত হয়।
বাঁশখালীতে আর একটি ঘটনা ইতোপূর্বে ঘটেছে। যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্বে সাধনপুরে একটি ছোট রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন করতে গিয়ে অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট মহি আলম চৌধুরী রাজাকারের গুলিতে প্রাণ হারান। বাঁশখালীর মুক্তিযুদ্ধে দুইজন বড় ধরনের বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের হারাতে হয়েছে। একজন সার্জেন্ট মহি আলম, অপরজন জেলা আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা মুরিদুল আলম।
বাঁশখালীতে পাঞ্জাবী হানাদার কর্তৃক নিহত হওয়া গণশহীদের দুইটি বধ্যভূমি আছে। একটি বাণীগ্রামের ২নং সাধনপুর ইউনিয়নে, অপরটি গুণাগরী বাঁশখালী মহাবিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বে পাহাড়ে। বাঁশখালিতে দুইবার পাঞ্জাবী হানাদারেরা যাদের গুলি করে মেরেছে সেই গণশহীদের সংখ্যা ১০৮ জন। মানুষের বাড়িঘর পোড়ানোর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের মত। ১২ ডিসেম্বরের পরে বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মোখতার আহমদ তাঁর দলবল নিয়ে ভারত থেকে বাঁশখালীতে আসেন।
৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর মৌলভী সৈয়দ, এসএম ইউসুফ ও মহিউদ্দিন চৌধুরী নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো, সুভাষ আচার্য সেই যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসকে পরাজিত করে জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসলে জিয়াউর রহমান সেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও চুক্তি করেন, যা ফলে দেশাই সরকার ৭১-এর ন্যায় যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো, তাঁদেরকে বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করে। মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ সবাই দেশে ফেরত আসেন। মৌলভী সৈয়দও আসার জন্য সীমান্তে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁকে সেখান থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের যুবকদের বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে একটি মামলা হয়েছিলো। সুভাষও সেই মামলার আসামী হয়ে জেলে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়।
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আহমদ শরীফ মনীর : রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

স্বাধীনতা-উত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে; সেই দলের নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এটা বোধ হয় কারো অজানা

বিস্তারিত »

জান আলীকে নিয়ে মকবুলের কবিতা : তক দে মিয়া বকশিস দিবা আসলত্তুন হানি

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পথিকৃৎ শিল্পপতি এ কে খানের পিতামহ জান আলী খান চৌধুরী ১৮ ও ১৯ একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার ও সমাজপতি ছিলেন। আঠার শতকে

বিস্তারিত »

ভালো মানুষের জন্য খারাপ সময়ে একজন ভালো মানুষের প্রস্থান

জীবন থেকে ছুটি নিলেন মোবারক ভাই। মোবারক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে আমার মধ্য নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন এটা সত্য

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা চলে গেছেন, হারিছই আছেন একা

চট্টগ্রাম শহরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা চলে যাচ্ছেন। সাতজন ছিলেন তাঁরা, পাঁচজন ইতিমধ্যে তাঁদের প্রভুর ডাক পেয়ে এ গ্রহ ছেড়ে চলে গেছেন প্রভুর সন্নিধানে।

বিস্তারিত »

আওয়ামী লীগ, বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণ ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাথা

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৩ বছরের অবিরাম সংগ্রাম এবং অবশেষে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকেই

বিস্তারিত »

সুলতান কুসুমপুরী ও তাঁর কোম্পানি কমান্ডার হাবিলদার আবু’র মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৩জন এমপি সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধে তাদের গ্রæপকে কমান্ড করেন। এই ১৩ জন এমপি

বিস্তারিত »
প্রদ্যোৎ কুমার পাল

৭১-এর দুরন্ত গেরিলা প্রদ্যোৎ কুমার পাল

প্রদ্যোৎ কুমার একজন অসম সাহসী বীরের নাম। মুক্তিযুদ্ধে এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা দক্ষিণ চট্টগ্রামের রণাঙ্গণ মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর অসীম সাহস ও পরাক্রম দিয়ে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চারটি

বিস্তারিত »

দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ক্যান্টনমেন্ট বরকল, শাহজাহান ইসলামাবাদী জিওসি

মুক্তিযুদ্ধের এক কিংবদন্তী শাহজাহান ইসলামাবাদী। দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের তিনিই ছিলেন প্রধান নায়ক। কিংবা এভাবেও বলা যায়, তাঁকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে উঠেছিল। তাঁর

বিস্তারিত »