সোমবার, ৭ জুলাই, ২০২৫, ২৩ আষাঢ়, ১৪৩২, ১১ মহর্‌রম, ১৪৪৭

ঐতিহাসিক ৭ জুন, ৬ দফা দিবস

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

৭ জুন, ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস চলে গেল কোন ফাঁকে আমি খেয়াল রাখতে পারিনি। মনে পড়লো এক মাস পড়লো আজ ৭ জুলাই। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। তবুও ইংরেজিতে কথা আছে না—বেটার লেট দ্যান নেভার—সেকথা মনে করে আজই লিখে ফেললাম ৭ জুনের বৃত্তান্ত। ৫৯ বছর ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্বলিত বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ৬ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের দাবিতে আওয়ামী লীগের ডাকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়েছিলো।
হরতাল যাতে সফল না হয়, হরতালের আহবানে যাতে কোন সাড়া না পড়ে, সেজন্য পাকিস্তান সরকার কঠোর দমননীতি প্রয়োগ করে। সরকার আওয়ামী লীগের প্রচারকার্যে বাধা হিসেবে পোস্টার ছাপানোয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, কর্মীদের বেআইনিভাবে আটক রাখার কৌশল অবলম্বন করে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী পত্র-পত্রিকায় সরকারের এ ধরনের বাধার তীব্র সমালোচনা করে একটি বিবৃতি প্রদান করলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান পাল্টা বিবৃতির মাধ্যমে ৬-দফার আন্দোলন “কঠোর হস্তে” দমনের হুমকি প্রদান করেন।
২ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, ঢাকা জেলা ও নগর কমিটির বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় । আওয়ামী লীগের সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলকেই গ্রেফতার করে কারাগার ভর্তি করা হয়। অবশিষ্ট নেতৃবৃন্দ অনেকে আত্মগোপন করেন।
সরকার ৭ জুন হরতাল উপলক্ষে ব্যাপকভাবে ধর-পাকড় করে, পত্রপত্রিকাসমূহের ওপর অঘোষিতভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণও আরোপ করে। ইত্তেফাক ব্যতীত কোনো পত্রিকাতেই ঐ সময় হরতালের কোনো খবর কোনোভাবেই ছাপা হয়নি, তারপরও গোটা দেশেই ৭ জুনের হরতালের খবর জানাজানি হয়ে যায় এবং হরতাল পালিত হয়।
শত নির্যাতন উপেক্ষা করে জনগণ সারা প্রদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালন করে। কলকারখানা, গাড়ির চাকা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ব বাংলার নাগরিক জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে প্রচণ্ড বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বেঙ্গল বেভারেজে চাকরিরত সিলেটের অধিবাসী মনু মিয়া পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত হন। মনু মিয়ার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা তেজগাঁওয়ে ট্রেন থামিয়ে দেয়। তেজগাঁওয়ের আজাদ এনামেল এ্যান্ড এ্যালুমিনিয়াম কারখানার নোয়াখালীর শ্রমিক আবুল হোসেনকে ইপিআর বুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তেজগাঁও শ্রমিক এলাকা ও ঢাকা শহর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ৬ জন শ্রমিক নিহত হয়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে শত শত মিছিল বের হয়, নারায়ণগঞ্জ শিল্প এলাকা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক-জনতা ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। এমনি সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস, গুলিবর্ষণ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশ দেড় হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। জনতা অনেক কর্মীকে থানা থেকে ছিনিয়ে নেয়। উত্তেজিত জনতা অনেক বাস, গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা তেজগাঁওয়ের ভূমি জরিপ অধিদপ্তর ও নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। জনগণের ধারণা ছিল সংবাদপত্রে পুলিশী নির্যাতন ও গ্রেফতারের সংবাদ জানতে পারবে। কিন্তু সরকার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছে। হরতাল সংক্রান্ত সংবাদ কোন পত্রিকায় ছাপতে দেয়া হয়নি। সকল পত্রিকায় সরকারী প্রেসনোট প্রকাশিত হয়। প্রেসনোটে বলা হয়— “ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১০ জন নিহত হয়। দুপুরে আদমজী, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা এলাকার শ্রমিকগণ ১৪৪ ধারা লংঙ্ঘন করে শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। ঢাকা নগরীর দুই মাইল দূরে ইপিআর বাহিনী একটি শোভাযাত্রার গতিরোধ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলিবর্ষণ করে। বেলা ১১টায় সমাবেশ-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। হরতালের পরের দিন গুলিতে আহত একজনের মৃত্যু হয়। সরকারী ভাষ্য অনুসারে ১১ জনের মৃত্যু স্বীকার করা হয়; তবে নিহতদের সংখ্যা বেশি ছিল। ঐদিন সন্ধ্যার পর সরকার কারফিউ জারি করে; পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ সমর্থক সদস্য ৭ জুনের পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানায়। প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলের নেতা আবদুল মালেক উকিল পরিষদে বলেন, ‘আইয়ুব শাহীর নির্যাতন কঙ্গোর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।’
৭ জুনের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন আরো বৃদ্ধি পায়। জেলা, থানা পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতার শুরু হয়। তেজগাঁও, আদমজী, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় শ্রমিকদের গ্রেফতার, হয়রানি চলে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিল শ্রমিক সমাজ। ১৩ জুন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় স্তরের নেতারাও গ্রেফতার হয়। জনতার নির্ভীক সৈনিক পূর্ব বাংলার ৬ দফার সোচ্চার কণ্ঠ দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক, রাজনৈতিক মঞ্চের লেখক মুসাফিরকে ১৫ জুন আইয়ুব-মোনায়েমের নির্দেশে পুলিশ পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘খ’ ধারা অনুসারে তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করে। সেদিন দৈনিক ইত্তেফাক অফিস থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এ.কে.এম. রফিকুল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ জুন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৫২ নম্বর উপধারায় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রেস- ১নং রামকৃষ্ণ প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে বিরোধী দল মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করার পর তা স্পীকার বাতিল করলে বিরোধী দল ওয়াক আউট করে।
ইতোমধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মোল্লা জালালউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, শেখ শহীদুল ইসলাম প্রমুখ গ্রেফতার হন।
৭ জুনের হরতালে সরকারের কঠোর নিপীড়ন নির্যাতন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ৬ দফা আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসেনি। চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে হরতালে আশাতীত সাফল্য ৬ দফার প্রতি তাদের অকুষ্ঠ সমর্থন ও আস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। হতাশতাগ্রস্থ সরকার আবারও ধরপাকড় আরম্ভ করে। ২২ জুন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে চাঁদপুরে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে গ্রেফতার করার পর সরকার ধারণা করেছিলো আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার মতো কোনো নেতা থাকবে না। আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণে দলের মহিলা সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগমকে ১৯৬৬ সালের ২৩, ৩৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করে। সরকার আমেনা বেগমেরও উপর চাপ সৃষ্টি করে, কিন্তু তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে অনড় থাকেন। সরকার তাঁকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিবৃত্ত করতে না পেরে ২২ ডিসেম্বর তাঁর স্বামীকে চাকরিচ্যুত করে।
৬ দফাকে বানচাল করার জন্য সরকার আওয়ামী লীগের কিছু আপসকামী বয়োবৃদ্ধ লোক দিয়ে পিডিএম গঠন করায়। পিডিএম ৬ দফার বিকল্প হিসেবে ৮ দফা কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতিতে জল ঘোলা করার অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু তাও হালে পানি পায়নি। তাতে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের বিভ্রান্ত করা যায়নি। এত কিছুর পরও আওয়ামী লীগকে দমন করতে না পেরে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রূজু করে । এতে রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ীসহ আরো ৩৪ জনকে আসামি করা হয়। শেখ মুজিবকে ১নং ও লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে ২নং আসামী করা হয়। এই মামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয় এবং চলমান ৬ দফা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দুর্বার জঙ্গী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ততদিনে ছাত্ররাও ৬ দফার সঙ্গে তাদের কিছু দাবি-দাওয়া যোগ করে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে ৬ দফা, ১১ দফা ও আগতরলা মামলা বিরোধী ত্রিমুখী আন্দোলন ৬৯-এর প্রচণ্ড গণ অভ্যুত্থানে রূপ নিলে তাসের ঘরের মত উড়ে যায় আইয়ুব শাহী। শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীরা মুক্তি পান। ছাত্র সমাজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা প্রদান করে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করে।
৭ জুনের হরতালের সাফল্যে ৬ দফার প্রতি জনসমর্থন উত্তেরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ৬ দফাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। পাকিস্তান সরকার স্বায়ত্তশাসনের দাবি না মানায় জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে শাসন ক্ষমতার দাবিদার হয়। কিন্তু বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটা পাঞ্জাবি অধ্যুষিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি। ফলে আওয়ামী লীগের চাপের মুখে ইয়াহিয়া ৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন আহবান করেও ১ মার্চ আকস্মিক এক ঘোষণার মাধ্যমে সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে বাঙালি রাজপথে নেমে আসনে এবং পূর্ব পাকিস্তান রাতারাতি বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় (বর্তমানে অপারেজয় বাংলা) ডাকুসর ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ৩রা মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হাউস ও ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়েনি। কোথাও পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিলো না। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক ভাষণে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি প্রদান করলে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযোগ শুরু করেন। আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানের নির্দেশে প্রশাসন পরিচালিত হতে থাকে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু সে রাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত করার আহবান জানান।
বঙ্গবন্ধুর আহবানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পরিণামে বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে।
এই আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ৭ জুনের হরতালের সাফল্য থেকে পরবর্তীকালের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় একের পর এক আন্দোলন সংঘটিত হতে হতে বাঙালি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় ও স্বাধীনতার লক্ষ্যের প্রতি ধাবিত হয় এবং অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার বন্দরে উপনীত হয়। সুতরাং ১৯৬৬ সালের ৭ জুনকে স্বাধীনতার প্রসূতি বললেও অত্যুক্তি হয় না। ৭ জুন বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন।
৬ দফা আন্দোলনের জন্য চট্টগ্রামকেই সর্বাপেক্ষা গৌরব প্রদান করতে হয়। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম থেকে প্রথম ৬ দফা ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রামেরও ৭ জুন সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৭ জুন সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। কোন পিকেটার ছিল না। সরকার হরতালের কোন কিছুই প্রকাশ করতে দেয়নি। এমনকি রাস্তার মাঝখানে ও দেয়ালে ৭ জুন হরতাল লেখা দেখলেই তা গোবর দিয়ে ঢেকে দিতো। তবুও সকাল দশটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে কোন গাড়িঘোড়া চলেনি।
চট্টগ্রাম জেলা ও শহর আওয়ামী লীগ ৬ দফা প্রচারে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামেন। এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ হান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুন, এম এ মান্নান, মানিক চৌধুরী, ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী, এম এ ওহাব, একে এম আবদুল্লাহ মন্নান, খালেক চাচা, মিঞা ফারুকী, আবদুল কালাম আজাদ, আবু ছালেহ, মুরিদুল আলম (শহীদ) প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং এসএম ইউসুফ, আশরাফ খান, মোখতার আহমদ, ইদরিস আলম, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী (শহীদ), গোলাম রব্বান, আবু মোহাম্মদ হাশেম, দানেশ আহমদ চৌধুরী, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, শেখ মোহাম্মদ আইয়ুব বাঙালি, গাজী গোফরান, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, ছাবের আহমদ আসগরী, ডা. মাহফুজুর রহমান, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, তোহা গাজী, গোফরানুল হক প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ ৬ দফার প্রতি জনসমর্থন সৃষ্টির জন্য দিনরাত কাজ করেন।
৬ দফা আন্দোলনে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগ থেকে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন ইদরিস আলম, আশরাফ খান, বদন দীদারি, নুর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলম। ইদরিস আলম ‘বাঙালির মুক্তিসনদ’ আখ্যা দিয়ে ৬ দফার ব্যাখ্যা পুস্তিকাও রচনা করেছিলেন। ইদরিস আলম ও আশরাফ খান জুটিকে বলা যায় ‘বাগযোদ্ধা’। দু’জনই আগুনঝরা বক্তা; যখন মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলা শুরু করতেন, তখন খই ফুটতো; কণ্ঠ থেকে অনর্গল নির্গত শব্দমালা আগুনের হল্কার ন্যায় দর্শক-শ্রোতার দেহমনে আগুন ধরিয়ে দিত। বদন দীদারি ৬ দফার গুণকীর্তন করে গান বেঁধে সুর করে গেয়ে গেয়ে মানুষের মন মাতিয়ে দিতেন। কখনো বা শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ ভূইয়া তাঁর গান পরিবশেন করে শ্রোতার মনে তীব্র আন্দোলন উপস্থিত করতেন। নুর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলমেরও কাজ ছিলো। তাঁরা মিটিং অর্গানাইজ করতেন, সভার শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন; আবার মুসলিম লীগের মিটিংয়ে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি করতেন।
পঞ্চপাণ্ডরের এই টিমটাকে পরিচালনা করতেন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে শাহ বদিউল আলমের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী সংবর্ধনা গ্রন্থ থেকে “৬ দফা কর্মসূচি জনসমক্ষে আসার পর এই কর্মসূচিকে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ডা. ছৈয়দুর রহমান বিরামহীনভাবে দিনরাত প্রচারণা চালিয়ে গেছেন। প্রায় প্রতিদিনই মিটিং মিছিলের কর্মসূচি দিয়ে সংগঠনকে সক্রিয় ও নেতা-কর্মীদের ব্যস্ত রাখতেন। প্রথমদিকে এসব মিটিং মিছিলে মানুষের তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু আস্তে আস্তে ৬ দফার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। ৬ দফার মিটিং মিছিলে জনসমাগম হতে থাকে। এটা ডা. ছৈয়দুর রহমানের অবদান। ৬ দফা প্রচারের জন্য তিনি একটা টিমই গঠন করেছিলেন। সেই টিমে ছিলেন ইদরিস আলম, আশরাফ খান, নুরুল আলম চৌধুরী, নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, শাহ বদিউল আলম, বদন দীদারি, জয়নাল আবেদীন প্রধান, আবুল হাশেম (আমিন জুট মিল) প্রমুখ। ইদরিস আলম, আশরাফ খান বিভিন্ন জায়গায় ৬ দফার সমর্থনে আয়োজিত সভা-সমাবেশে গিয়ে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিতেন। বদন দীদারি ৬ দফার জন্য গান বেঁধে তা’ জনসভায় গেয়ে শোনাতেন। এইভাবে ডা. ছৈয়দুর রহমানের পরিচালনায় ৬ দফার পক্ষে সংঘবদ্ধ প্রচারণার ফলে ৬ দফার অনুকূলে জনজোয়ার সৃষ্টি হতে থাকে।’

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা চলে গেছেন, হারিছই আছেন একা

চট্টগ্রাম শহরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা চলে যাচ্ছেন। সাতজন ছিলেন তাঁরা, পাঁচজন ইতিমধ্যে তাঁদের প্রভুর ডাক পেয়ে এ গ্রহ ছেড়ে চলে গেছেন প্রভুর সন্নিধানে।

বিস্তারিত »

আওয়ামী লীগ, বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণ ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাথা

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৩ বছরের অবিরাম সংগ্রাম এবং অবশেষে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকেই

বিস্তারিত »

সুলতান কুসুমপুরী ও তাঁর কোম্পানি কমান্ডার হাবিলদার আবু’র মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৩জন এমপি সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধে তাদের গ্রæপকে কমান্ড করেন। এই ১৩ জন এমপি

বিস্তারিত »
প্রদ্যোৎ কুমার পাল

৭১-এর দুরন্ত গেরিলা প্রদ্যোৎ কুমার পাল

প্রদ্যোৎ কুমার একজন অসম সাহসী বীরের নাম। মুক্তিযুদ্ধে এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা দক্ষিণ চট্টগ্রামের রণাঙ্গণ মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর অসীম সাহস ও পরাক্রম দিয়ে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চারটি

বিস্তারিত »

দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ক্যান্টনমেন্ট বরকল, শাহজাহান ইসলামাবাদী জিওসি

মুক্তিযুদ্ধের এক কিংবদন্তী শাহজাহান ইসলামাবাদী। দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের তিনিই ছিলেন প্রধান নায়ক। কিংবা এভাবেও বলা যায়, তাঁকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে উঠেছিল। তাঁর

বিস্তারিত »

স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের অগ্রসৈনিক মিরসরাইর অহিদুল হক

অহিদুল হক মুক্তিযুদ্ধে যে অসাধারণ বীরত্ব, অসীম সাহস ও শৌর্যবীর্যের পরিচয় দেন, তা মিরসরাই থানার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে জাতীয় মুক্তির

বিস্তারিত »
বাংলাদেশে পিএইচপির উদ্যোগে মালয়েশিয়ার বিশ্ববিখ্যাত প্রোটন ব্রান্ডের গাড়ি তৈরির কারখানা উদ্বোধনের পর মোনাজাত করছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ এবং পিএইচপির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সুফি শিল্পপতি মিজানুর রহমান ।

দার্শনিক শিল্পপতি সুফি মিজানুর রহমান পুরুষোত্তম

বাংলাদেশে পিএইচপির উদ্যোগে মালয়েশিয়ার বিশ্ববিখ্যাত প্রোটন ব্রান্ডের গাড়ি তৈরির কারখানা উদ্বোধনের পর মোনাজাত করছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ এবং পিএইচপির

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধে দোহাজারীর বীর চতুষ্টয় : খসরু-জাফর-রতন-কামাল

চট্টগ্রামের সভ্যতা মানুষ ও নদীর যুগ্ম-সৃষ্টি। ঐতিহাসিক কাল থেকে চট্টগ্রামে তিনটি বড় নদী পরিদৃষ্ট হয়। সর্ববৃহৎ কর্ণফুলী, অনতিবৃহৎ হালদা ও শঙ্খ নদী। কর্ণফুলী সদর ও

বিস্তারিত »

ষাটের_দশকের_ছাত্রনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সিরাজুল আলম

কাজী সিরাজুল আলম ষাটের দশকের শেষদিকে চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ছিলেন। ৬৯-৭০-এ তিনি ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। তাঁর বাড়ি সীতাকুÐে; তিনি সীতাকুÐে ৬৯-এর

বিস্তারিত »