জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের জন্য ঘোষিত আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় ২৪জন নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামের ২জন নারীও স্থান পেয়েছেন। এই ২ নারী হচ্ছেনÑ ফটিকছড়ির খাদিজাতুল আনোয়ার সনি ও টেকনাফের শাহীন আখতার। এক সময় সংসদে নারীর জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষিত রাখা হতো। ঠাট্টা করে বলা হতো ৩০ সেট অলংকার। সংসদের শোভা বর্ধনের জন্য এই অলংকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নারীর প্রতি এমনি তুচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো সমাজের। সে অবস্থা থেকে নারীর সম্মান অনেকটা তুলে এনে নারীকে মর্যাদাবান করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি নিজেও একজন নারী এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী। নারীকে তিনি সংসদের উপনেতা এবং স্পিকারও করেছেন। মন্ত্রী তো আছেনই। তা সত্ত্বেও নারী অবহেলিত এবং পুরুষের চেয়ে ন্যুন ও হীন। সংসদে নারীকে পুরুষের সমান আসন দেওয়া না হলে নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত হবে না।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নারী জাতির অহংকার, মাতৃশক্তির প্রতীক। চারবার দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়ে তিনি নারী জাতির ক্ষমতায়নের জন্য অনেক কিছু করেছেন। যেমন একবার তিনি যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা, তখন সংসদের উপনেতা করেছিলেন তিনি সাজেদা চৌধুরীকে। সংসদের স্পিকারও তিনি করেছেন একজন নারীকে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি এবং বৃহত্তর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ময়েজ উদ্দিন আহমেদের কন্যা মেহের আফরোজ চুমকিকে সংসদ সদস্য করেছেন। অভিনেত্রী তারানা হালিমকে মন্ত্রী করেছেন। এমনিভাবে শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন স্তরে নারীদের পদায়ন করে নারীশক্তির জাগরণ ঘটাতে চেয়েছেন।
একসময় জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষিত রাখা হতো। কিন্তু নারীও যে পুরুষের মতো সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন সেটা বহুদিন আমাদের উপলব্ধিতে ছিলো না। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বিপ্লবী কল্পনা দত্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দেশপ্রিয় জেএম সেনগুপ্তের পত্নী ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাবেক সভানেত্রী নেলী সেনগুপ্তা। সেটাও সাধারণ আসনের নির্বাচন ছিল না। নির্বাচনে কল্পনা দত্ত হেরে গিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে আনোয়ারা খাতুনও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালেও এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এরপর ১৯৫৪ সালে ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে তোহফাতুন্নেছা আজিম নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাও সংরক্ষিত আসনে। তিনি ব্যারিস্টার আনোয়ারুল আজিমের পত্নী এবং সাবেক উপমন্ত্রী অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দিনের মাতা। তার এক পুত্রের সঙ্গে চট্টল শার্দুল এমএ আজিজের কন্যার বিয়ে হয়েছে।
অধ্যাপক নুরজাহান মোরশেদ ও অধ্যাপক বদরুন্নেসা আহমেদ ১৯৫৪ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নুরজাহান মোর্শেদ ১৯৭০ সালেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। বদরুন্নেসা আহমেদ ১৯৭০ এবং ৭৩ সালেও নির্বাচিত হন।
ষাটের দশকে সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ শামসুন্নাহার মাহমুদ জাতীয় সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী সুলতান আহমদের কন্যা নুরজাহান বেগম সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে নয়।
সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী রাফিয়া আখতার ডলি এবং খালেদা খানম ১৯৭৩ সালে মহিলা আসনে নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আমলে যখন ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রীদের ছাত্র ইউনিয়ন করার দিকে ঝোঁক ছিলো, তখন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী), রাফিয়া আখতার ডলি, চট্টগ্রামে খালেদা-রাশেদা দু’বোন এবং জাহানারা আঙ্গুর প্রায় নারী-বর্জিত ছাত্রলীগে নারীর সমারোহ ঘটিয়েছিলেন।
নারীর এখন সাধারণ আসনে নির্বাচন করতে অসুবিধা নেই। কিন্তু যারা নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেন, তারা নারীকে প্রার্থী মনোনীত করার বিষয়টি ঠিক তাদের বিবেচনায় আসে না।
এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ব্যতিক্রম। তিনি নিজে নারী হওয়ায় বিভিন্নক্ষেত্রে নারীদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি সবসময় চেষ্টিত থাকেন। আগামী নির্বাচনের জন্য আজ (রোববার ২৬ নভেম্বর) আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের যে তালিকা প্রকাশ করা হল তাতে, ২৪জন নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন শাম্মী আহমেদ বরিশাল-৪ আসনে, নিলুফার আনজুম ময়মসিংহ-৩ আসনে, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রংপুর-৬ আসনে, সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী শেরপুর-২ আসনে ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি চাঁদপুর-৩ আসনে, গাজীপুর-৪ আসনে সিমিন হোসেন (রিমি), গাইবান্ধা-২ আসনে মাহবুব আরা বেগম, গাইবান্ধা-৩ আসনে উম্মে কুলসুম, বগুড়া-১ আসনে সাহাদারা মান্নান, বাগেরহাট-৩ আসনে হাবিবুন নাহার, কিশোরগঞ্জ-১ আসনে সৈয়দা জাকিয়া নূর, মানিকগঞ্জ-২ আসনে মমতাজ বেগম, মুন্সিগঞ্জ-২ আসনে সাগুফতা ইয়াসমিন, গাজীপুর-৫ আসনে মেহের আফরোজ, কুমিল্লা-২ আসনে সেলিমা আহমাদ ও গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে আফরোজা বারী, আওয়ামী লীগের আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমানের (বদি) স্ত্রী শাহীন আক্তার কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে, সুলতানা নাদিরা বরগুনা-২ আসনে এবং
সংরক্ষিত আসনের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক রুমানা আলী গাজীপুর-৩ আসনে, চট্টগ্রাম-২ আসনে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি আওয়ামী লীগ থেকে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন।
চট্টগ্রাম থেকে ২জন ফটিকছড়ির সনি ও টেকনাফের শাহীন মনোনয়ন পেলেও আরও বেশ ক’জন নারী রাজনীতিতে সক্রিয় ও আলোচিত ছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভের জন্য ফরম কিনেছিলেন কিনা আমি জানি না। তা সত্ত্বেও নির্বাচনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হতে পারেন, এমন নারীনেত্রী চট্টগ্রামে দুর্লভ ছিলো না। উদাহরণস্বরূপ আমি এখানে তিন জনের নাম উল্লেখ করতে চাই। একজন কক্সবাজারের, দুজন চট্টগ্রামের। এরা হচ্ছেন ওয়াসিকা আয়েশা খান এমপি, শামীমা হারুন লুবনা এবং কক্সবাজারের রামু এলাকার সাবেক এমপি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলমের কন্যা নাজনীন সরওয়ার কাবেরী। ওয়াসিকা দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। সেটি হলো অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক। তাঁর পিতা সাবেক রাষ্ট্রদূত আতাউর রহমান খান কায়সারও দীর্ঘদিন উক্ত পদ অলংকৃত করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় দলের পক্ষ থেকে বিকল্প বাজেটও উপস্থাপন করেছিলেন। ওয়াসিকা উচ্চ শিক্ষিত বিদূষী নারী, নানা গুণে গুণান্বিত। লুবনা বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ভাষা সংগ্রামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল হারুনের কন্যা। লুবনাও উচ্চ শিক্ষিত এবং ভাল লেখাপড়া জানা একজন নারী। তারা কেউ মনোনয়ন পেলে সম্ভবত সংসদ সুন্দর ও মর্যাদাবান হতো।
কাবেরী কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবছার কামাল চৌধুরীর পুত্রবধূ। এটি নিছক তথ্য হিসেবে পেশ করা হলো, কাবেরীর যোগ্যতা প্রমাণের জন্য নয়। কাবেরীর যোগ্যতা অন্যখানে। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্র রাজনীতি করতেন এবং ছাত্রনেতা ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে উচ্ছেদ করার জন্য একসময় ছাত্রলীগ যে আন্দোলন করেছিল, কাবেরী সে আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ছিলেন। তার স্বামী অকালপ্রয়াত আসিফ কামাল লাবু চট্টগ্রাম মহানগরের একজন শীর্ষস্থানীয় সংগ্রামী ছাত্রনেতা ছিলেন। কাবেরী অপশন দিয়ে কক্সবাজারে গিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে তিনি ইতিমধ্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।