মাঠের এক প্রান্তে বাঁশের খুটির ওপর কাঠের পাটাতনে তৈরি মঞ্চ। সামনে খড় বিছিয়ে বসে আছে দর্শক। মঞ্চের ওপর দুইপাশে বসে ঢোল, করতাল, মন্দিরা, বাঁশি নিয়ে প্রস্তুত যন্ত্রশিল্পীরা। ওপর থেকে ঝুলানো মাইক্রোফোনের সামনে এসে রাজা-রানী বলছেন পাশ থেকে প্রম্পটারের শিখিয়ে দেওয়া ডায়ালগ। সঙ্গে সঙ্গে বাঁশির সুর। তারা বিদায় নিতেই মঞ্চে তলোয়ার নিয়ে দু’পক্ষের যুদ্ধ কিংবা প্রেমিক জুটির গান-সবমিলিয়ে জমজমাট সব দৃশ্য দেখে দর্শকদের হাততালি।
বাংলার হাজার বছরের লোকসংস্কৃতির অংশ যাত্রাপালাকে এখনো হৃদয়ে লালন করছেন এ দেশের যাত্রাপ্রিয় বাঙালিরা। তবে নাগরিক জীবন থেকে ‘যাত্রা’ শব্দটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। ষোড়শ শতাব্দীতে বিনোদনের খোরাক ছিল যাত্রাপালা। মঞ্চে অভিনয় করতেন শিল্পীরা। নারী অভিনেত্রীর বড় অভাব ছিল। পুরুষদেরই করতে হতো নারী চরিত্রের অভিনয়। গ্রামীণ যাত্রায় স্থানীয় শিল্পীরা অভিনয় করতেন। এছাড়া পেশাদার শিল্পীরাও মঞ্চ কাঁপিয়ে তুলতেন তাঁদের অভিনয়শৈলি দিয়ে।
যাত্রার জন্মকাল হিসেবে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দশককে ধরা হয়। ১৫০৯ সালে প্রথম অভিনীত যাত্রা পালার নাম ‘রুক্ষ্মিণী হরণ।’ তবে যাত্রাভিনয় এর পরিচিতি প্রকাশ পায় আরো প্রায় আড়াইশ বছর পর। যাত্রাপালা শুরুর দিকে এর বিষয় বিন্যাস ছিল পৌরাণিক কাহিনীনির্ভর। যেমন : রাবণ বধ, সীতা হরণ, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। এর পরেই আসে ঐতিহাসিক সব কাহিনী নিয়ে লেখা পালা। এ ধরনের কয়েকটি পালার নাম : মুঘল-এ-আযম, ঈশা খাঁ, মন্দির থেকে মসজিদ, সোহরাব-রুস্তম ইত্যাদি। অবিভক্ত বাংলার যাত্রাশিল্পে চট্টগ্রাম একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ব্রিটিশ আমলে মুকুন্দ দাসের একটি স্বদেশি যাত্রার গান চট্টগ্রামে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তার ক’টি লাইন-‘এক দুই তিন চার পাছা পেড়ে শাড়ি আর তো মিলবে না, খদ্দর বেচতে এলেম কিন্তু মানুষ তো পেলাম না।’
চট্টগ্রামের যাত্রাগান ঊনিশ শতকের ২য় ও ৩য় দশকে নতুন মাত্রা এনে দেয়। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় গিয়ে কিছু ফিরিঙ্গি ও যাত্রা উৎসাহী চট্টগ্রামের যুবক-যুবতীর সমন্বয়ে ‘কলি রাজার যাত্রা’ পালা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার সমাচার দর্পণ পত্রিকায় সেসময় এই পালাকে ‘নতুন যাত্রা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তারা লিখেছিল, ‘এই সময় থেকেই পুরাতন কৃষ্ণ যাত্রার প্রভাব হ্রাস পায় এবং লঘু কৌতুকসহ নৃত্যগীত ও বাদ্যযন্ত্রবহুল শখের যাত্রার প্রচলন হয়।’ বিশ শতকের প্রথমভাগে এই নতুন যাত্রাগানেরই প্রতিফলন পড়েছিল আনোয়ারার পরৈকোড়ার যোগেশ বাবুর সখের দল (১৯০৫), পটিয়ার সুচক্রদ-ীর বামাচরণের দল, বোয়ালখালীর হাওলা-পোপাদিয়ার সারদা লালার দল (১৯০৭-০৮), চন্দনাইশের জোয়ারার শ্যামাচরণ চক্রবর্ত্তীর যাত্রাপালাগুলোয়। প্রথম অবস্থায় এই দলগুলো রাজা হরিশচন্দ্র, নিমাই সন্ন্যাস, রঘু বসন্ত, বিজয় বসন্ত, চন্দ্রহাস, দেবতার গ্রাস, রামপ্রসাদ, রাজ সন্ন্যাসী, ধ্রুব, ত্রিশক্তি, পণমুক্তি ইত্যাদি পৌরাণিক পালা মঞ্চস্থ করেছিল। পরে ১৯১৬-১৭ খ্রিস্টাব্দে এই ধারা পাল্টে যায়। পটিয়া স্কুল ময়দানে হাজার হাজার দর্শকের সামনে মুকুন্দ দাসের স্বদেশের গানে এবং পণ প্রথার বিরুদ্ধে একটি পালার সফল মঞ্চায়ন হয়।
১৯২০ থেকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ও বহুল পরিচিত বামাচরণ ও শ্যামাচরণ চক্রবর্তীর দল মঞ্চায়ন করে কালা পাহাড় (সুচক্রদ-ীর হিমাংশু পাঠক ছিলেন ওই নাটকের কৌতুক অভিনেতা), সিরাজদ্দৌলা ও টিপু সুলতান। এছাড়া পৌরাণিক যাত্রার ধারায় কেলিশহরের স্মৃতীশ ভট্টাচার্যের দল, নিবারণ সেনের শ্রীকৃষ্ণ অপেরা পার্টি, শাকপুরার সারদা শর্মার দল গ্রামে-গঞ্জে পরিচিতি পায়। চল্লিশের দশকের পূর্বে ও পরে তারাকিংকর ঘোষ, শীতল দত্ত, প্রাণহরি নন্দী, মকবুল, সাদেক নবী, অমলেন্দু বিশ্বাস, মো.শরীফ ও এম এ হামিদসহ আরো অনেকে এই ঐতিহাসিক পালার ধারা বজায় রেখেছিল। যাত্রাপালার একটি বিশেষ অংশ বিবেকের ভূমিকায় কেচিয়াপাড়ার যতীন্দ্র দে, সাতকানিয়ার ব্রজেন্দ্র নন্দী প্রমুখ ছিলেন। বোয়ালখালী, সাতকানিয়া, রাউজান, হাটহাজারী ও পটিয়া থানা এলাকার বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলোতে যাত্রাপালার প্রসার হয়েছিল।
চট্টগ্রামে মহিলা সমন্বিত ১ম যাত্রা দল আমিন শরীফ চৌধুরীর ‘বাবুল অপেরা’। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই দলের কুশীলবদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-তুষার বিশ্বাস, এম এ হামিদ, সাদেক আলী, অজয় চক্রবর্তী, শান্তি বিশ্বাস, মঞ্জুশ্রী মুখার্জী, সাধনা চৌধুরী, মুক্তি চক্রবর্তী, জাহানারা বেগম, নেলী, ডলি, পূর্ণিমা, লক্ষ্মী, নিত্য সেন, বেণী চক্রবর্তী, শান্তি দেবী, হিমাংশু ধর, ঊষা দাশ, জাহানারা বেগম প্রমুখ। জাহানারা বেগম এদেশের প্রথম মুসলিম নারী শিল্পী। বাবুল থিয়েটারে ১৯৫০ সাল থেকে অভিনয় শুরু করেন মঞ্জুশ্রী। বাবুল থিয়েটার ১৯৫৪ সালে ‘বাবুল অপেরা’ নামে রূপান্তরিত হলে মঞ্জুশ্রী এই দলের নায়িকা হন। এছাড়া আরো ২টি যাত্রাদল ছিল। একটি গীতা রুদ্রের গীতশ্রী অপেরা এবং অপরটি হরিপদ ঘোষের নবারুণ অপেরা।
গ্রামাঞ্চলে বাৎসরিক অনুষ্ঠানে মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকায় যাত্রাভিনয় জনপ্রিয় ছিল। শ্রমিক-কর্মচারী সমিতি ও বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে কয়েক দশক আগেও যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হতো। কখনো কখনো স্কুল-কলেজের তহবিল সংগ্রহের জন্যও জনপ্রিয় যাত্রাদলকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। অপেশাদারী পর্যায়ে ত্রিশের দশকে ধলঘাট সংগীত বিদ্যাপীঠ, ডেঙ্গাপাড়া সুহৃদ সংগীত সম্মিলনীও যাত্রা অনুষ্ঠান করতো। এদের মধ্যে ছিলেন সুরেন্দ্র চক্রবর্তী, বিমল সেন, কমলাকান্ত কানুনগো, বিশ্বেশ্বর দাশগুপ্ত, গোপাল সাধু, ভোলানাথ দাশ প্রমুখ, যারা অনেকেই আজ বিস্মৃত।
যাত্রাপালার অনন্য প্রতিভা চট্টগ্রামের অমলেন্দু বিশ্বাসকে বলা হয় এ দেশের যাত্রাপালার মানসপুত্র। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, লেনিন, হিটলার, জানোয়ার প্রভৃতি যাত্রাপালায় অভিনয়ে অসাধারণ নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। এছাড়া বাংলাদেশে সৃজনশীল যাত্রাভিনয়ের যারা সূচনা করেন তাদের মধ্যে তুষার দাশগুপ্ত, শর্বরী দাশগুপ্তা, জোৎ¯œা বিশ্বাস এবং পরবর্তীতে সেলিম সুলতান। চট্টগ্রামের বাবুল অপেরার পরিবেশনায় গণআন্দোলনভিত্তিক পালা ‘একটি পয়সা’ মঞ্চে আসে ১৯৬৮ সালে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার পূজার বাড়িতে (আশানন্দ হলে) ভৈরবনাথ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত পালা প্রথম মঞ্চস্থ হয়। কেন্দ্র্রীয় চরিত্রের অভিনেতা ছিলেন নটস¤্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বাবুল অপেরা যশোরের সাগরদাঁড়ির মধুমেলায় পরিবেশন করে বিধায়ক ভট্টাচার্য রচিত যাত্রাপালা ‘বিদ্রোহী মাইকেল মধুসূদন।’ এ মঞ্চায়নের নেপথ্যে যাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল, তিনি যশোরের তদানীন্তন জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ। মধুসূদন চরিত্রে অভিনয় করেন অমলেন্দু বিশ্বাস। ‘মাইকেল’ যাত্রাপালার মতো এরই ধারাবাহিকতায় পরে গীতশ্রী অপেরার ইউনর লেনিন (১৯৭৪), চারণিক নাট্যগোষ্ঠীর হিটলার (১৯৭৫), বাণীশ্রী অপেরার জানোয়ার (১৯৭৬), নবারুণ অপেরার নটী বিনোদিনী (১৯৭৬), বাসন্তী অপেরার মা-মাটি-মানুষ (১৯৭৯), নিউ গণেশ অপেরার বিদ্রোহী নজরুল (১৯৭৯), শিরিন যাত্রা ইউনিটের ক্লিওপেট্রা ও দস্যু ফুলন (১৯৮০) এবং নবরঞ্জন অপেরার চিড়িয়াখানা (১৯৮১) প্রভৃতি ছিল উন্নতমানের পালা। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ অবলম্বনে ইমাম যাত্রার প্রচলন গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে।
আশির দশকে যাত্রাপালার বাণিজ্যিকীকরণ হয়। যাত্রাশিল্পের কালো দিবস আসে ১৯৯১ সালের ৯ নভেম্বর। এদিন তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর নির্দেশে সারাদেশে যাত্রা অনুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই সরকারের আমলে আরও ৫ বার যাত্রার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। ফলে হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে যাত্রাদলে পুঁজি বিনিয়োগের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন মালিক ও প্রযোজকরা। এক সময় এ দেশে সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ২১০টি যাত্রাদল ছিল। নিষেধাজ্ঞা, যাত্রা প্রদর্শনীর অনুমতির ব্যাপারে হয়রানিসহ কিছু প্রতিকূলতার কারণে দলের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। কয়েক বছর ধরে মাত্র ৫০-৬০টি দল সংগঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ দলেরই আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। এ অচলাবস্থায় নতুন পালা প্রযোজনার সংকট বেড়েছে। ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট ‘যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা’ প্রণয়ন ও তা গেজেটভুক্ত হয়। ফলে এ শিল্পে নতুন প্রাণসঞ্চার হয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮৮টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন দেয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
বর্তমানে এদেশে যাত্রাশিল্পের চর্চা নেই বললেই চলে। অসহনীয় দুর্ভোগ ও কষ্টের মাধ্যমে যাত্রাশিল্পীদের জীবন চলছে। অশ্লীলতার আগ্রাসন ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের অতলে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যাত্রাশিল্পের সার্বিক উন্নয়নে বিচ্ছিন্ন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এর পেশাদারিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে তেমন কোনো বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কেবল কয়েকটি যাত্রা উৎসবের মধ্যেই একাডেমির যাত্রাবিষয়ক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থেকেছে। যাত্রাশিল্পীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যাত্রা-নীতিমালা গেজেটভুক্ত হলেও এর সুফল পাচ্ছে না শিল্পীরা। দুর্ভাগ্যজনক যে, এ দেশে একটিও জাতীয় যাত্রামঞ্চ নেই।
চট্টগ্রামে যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সংস্কৃতিপ্রেমীরা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ১৩ মে আয়োজন করা হয় ১০ দিনব্যাপী যাত্রা উৎসব। এ উৎসবের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। পালাকার জিতেন বসাক ও সুদর্শন চক্রবর্তীর নির্দেশনায় কর্ণফুলি অপেরার প্রথম প্রযোজনা ‘বাগদত্তা’ মঞ্চস্থ হয় উৎসবের শেষদিন। পুরো আয়োজন ছিল লালদিঘী ময়দানে স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চে। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ বলেছিলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাহীন এই শিল্প রক্ষা সম্ভব নয়। স্থায়ী যাত্রামঞ্চ প্রতিষ্ঠায় শিল্পীদের জায়গা খোঁজার অনুরোধ করেন তিনি, যাতে অদূর ভবিষ্যতে সেখানে আধুনিক যাত্রামঞ্চ স্থাপন করা যাবে। কিন্তু সে আশার প্রতিফলন আজো হয়নি।
যাত্রাশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে স্বাধীনতার মাসে দেশ অপেরার উদ্যোগে নগরীতে উত্তর কাট্টলী মোস্তফা-হাকীম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রাঙ্গণে মঞ্চায়িত হয় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনভিত্তিক যাত্রাপালা ‘বাংলার মহানায়ক’। মিলন কান্তি দে রচিত ও নির্দেশিত এ যাত্রাপালায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন-এসএম শফি, আবদুর রশীদ, এম আলিম, মোবারক হোসেন, সুদর্শন চক্রবর্তী, অলিউল্লাহ অলি, নিলয়, কৌশিক, কাজল দত্ত, প্রদীপ চক্রবর্তী, এম ফিরোজ, এম আলম লালু, শংকর সরকার, আলমাস, মোজাম্মেল হক মিলন, মনিমালা, লুৎফুন্নাহার রিক্তা, বিউটি, আদিত্য, শাওন প্রমুখ। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত তিনদিনব্যাপী বিজয় উৎসবে তিনটি যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করে যাত্রাদল দেশ অপেরা। প্রথম দিন সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হয় শান্তি রঞ্জন দে রচিত জনপ্রিয় যাত্রাপালা ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সৃষ্ট ঘটনা নিয়ে রচিত এ পালায় প্রতীকী রূপে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় গাঁথা এবং হানাদারদের শোচনীয় পরাজয়ের কথাচিত্র। প্রদর্শিত হয় শচীন সেন গুপ্তের নবাব সিরাজউদ্দৌলা। উৎসবে প্রদর্শিত হওয়া তিনটি পালারই নির্দেশনা দিয়েছেন দেশ অপেরার স্বত্ত্বাধিকারী যাত্রানট মিলন কান্তি দে। এই পালাগুলোতে অভিনয় করেছেন যাত্রাশিল্পী রিক্তা সুলতানা, গাজী বেলায়েত, এম আলীম, সিরাজুল ইসলাম, সুনীল দে, লুৎফুন্নেসা রিক্তা, মনিমালা, সুদর্শন চক্রবর্তী, ডা. দীপক বণিক, মোবারক আলী, উদয় সরকার, আবুল কালাম আজাদ, নিলয়, অলি, নিভা, বাচ্চু খান, আলমাস এবং এনএ পলাশ। চারুবিকাশ দত্তের ‘বিদ্রোহী চট্টগ্রাম’ পালা মঞ্চস্থ হয় ওই উৎসবে। যাত্রামঞ্চ কাঁপিয়েছেন চিত্রনায়ক পংকজ বৈদ্য সুজন। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মালকা বানু-মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান নিয়ে রচিত যাত্রাপালাও দেখেছে এখানকার দর্শকরা।
যাত্রাপালার সুদিনে কোলকাতা থেকেও নামকরা যাত্রা অপেরার দল আসতো চট্টগ্রামে। তার মধ্যে জয়দুর্গা অপেরা, জয়ন্তী অপেরা, কোহিনুর অপেরা উল্লেখযোগ্য। রাঙ্গুনিয়ায় মহামুনি পৌষ সংক্রান্তির মেলায় মাসব্যাপি যাত্রা অপেরার দল যাত্রাপালা মঞ্চায়ন করতো। দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শকরা সারারাতব্যাপী যাত্রা উপভোগ করতো। চট্টগ্রামের চকবাজারে সবুজ অপেরাও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তাদের। চট্টগ্রামে সেসময়কার অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী আজ বেঁচে নেই। রাউজানের হরি চক্রবর্ত্তী, অজয় চক্রবর্ত্তী, মুক্তি বড়ুয়া, ছবি সরকার, মমতাজ জাহান, দ্বিজেন পারিয়াল, টুন্টু পারিয়াল, নির্মল পারিয়াল, রমানাথ ধর, ডা. শক্তিপদ ঘোষ, সাধন চৌধুরী, নারায়ণ চক্রবর্ত্তী (নালাপাড়া), জব্বার মিয়া, হামিদ আলী, ছাদেক নবী, রাউজানের পশ্চিম গুজরার তুষার কান্তি বিশ্বাস তাঁদের অভিনয়শৈলিতে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন। তুষার কান্তি বিশ্বাস ত্রিশটির বেশী যাত্রাপালায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। তাঁর অভিনীত যাত্রাপালার মধ্যে টিপু সুলতান, রিক্তা নদীর বাঁধ, সোহরাব-রুস্তম, শ্মশানে হলো ফুলশয্যা, গরীবের মেয়ে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, সিরাজুদ্দৌলা, নিমাই সন্ন্যাস ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের স্মৃতিতে এখনো অম্লান হয়ে আছে।
লেখক: সহ-সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ