নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
সাতচল্লিশে ভারত ভাগের প্রাক্কালে বাংলার ভাগ্যাকাশে ১৭৫৭’র মতো আবারও কালোমেঘ ঘনিয়ে আসে। মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব মেনেও যুক্তবঙ্গকে নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ ছিলো। কিন্তু ৪৬-এর দিল্লিতে মুসলিম লীগের অধিবেশনে জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাবের নতুন ব্যাখ্যা (ঝঃধঃবং নয়, ‘ঝঃধঃবং) দিলে ‘স্বাধীন বাংলা’ রাষ্ট্রের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও শরৎ বসু, আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দী ও কিরণশংকর রায় ‘অখণ্ড বাংলা’র প্রস্তাব উত্থাপন করে শেষ চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন; কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। কারণ ততদিনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বড় বড় নেতারা বাংলার ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলেছেন। সুতরাং সাম্প্রদায়িক ছুরির কোপে বাংলাকে দু’টুকরো করে পূর্ব বঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম দিয়ে পাকিস্তানের ভাগে ফেলা হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের দু’টি ধারা
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামÑসশস্ত্র ও নিরস্ত্র-সমান্তরাল বা দুটি ধারায় যেন হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হয়েছিলো তার লক্ষ্যের পানে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও বড় লাট জিন্নাহ একমাত্র তখনকার রেসকোর্স, বর্তমান সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানে উদর্ুুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে, এই ঘোষণার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ছাত্রদের উচ্চারিত ‘না’ ‘না’ ধ্বনির মাধ্যমে যে প্রতিবাদ ঘোষিত হয়, তাকেই যদি বাংলাদেশ সংগ্রামের বীজ বপনের ক্ষণ ধরা যায়, তাহলে আমরা দেখবো কিছুটা পূর্বে হলেও (জুলাই ৪৭), প্রায় সমসময়েই নিয়তান্ত্রিক আন্দোলনের বাধা সড়ক এড়িয়ে স্বাধীনতার জন্য গোপন বৈপ্লবিক প্রচেষ্টাও শুরু হয়ে যায়। ঐ সময় স্বাধীন বাংলার জন্য মোয়াজ্জেম চৌধুরীর ‘ইনার গ্র“প গঠনের মধ্যে সেই প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় এবং বিস্ময়ের ব্যাপার হলো শেখ মুজিব এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মোয়াজ্জেম চৌধুরী এবং তাঁর সহকর্মীরা শেখ মুজিবকে তাঁদের পরিকল্পিত স্বাধীন দেশের প্রধান হিসেবে দেখতেন। তাঁরা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে গোপনে বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং স্বাধীনতার পক্ষে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতেন। নেতাজী সুভাষ বসু যেমন বিদেশে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারত স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন, ‘ইনার গ্র“প’-ও তেমনি শেখ মুজিবকে বিদেশে (লন্ডন) নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করতে চেয়েছিলেন ৫৬ সালে একবার মোয়াজ্জেম চৌধুরী কলকাতায় গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঘিত করার চেষ্টা চালান।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী লিখেছেন,
“সম্ভবত এটাই সর্বপ্রথম সংগঠিত প্রচেষ্টা ছিল কিন্তু তাদের ধরন ছিল কিছুটা ভিন্ন। তাদের কার্যক্রম ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তার ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল ছিল। ১৯৫৮ সালের পর তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠে।
মোয়াজ্জেম চৌধুরীদের রাজনীতির শুরু কলকাতায় এবং তাদেরকে ৪৭Ñপূর্ব রাজনীতির মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিরোধী বিক্ষুব্ধ অংশ বলা যেতে পারে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির অভ্যন্তরে যে-ক্ষোভ দানা বাঁধছিল তার প্রভাব ঢাকার বাইরে বা জেলা পর্যায়ে যেসব তরুণ রাজনীতিক ছিলেন তাঁদের মধ্যেও পড়েছিল। জামালপুর জেলায় ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি’ নামে একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলা হয়, সেটা স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নেওয়া অন্যতম প্রধান উদাহরণ”।১
এই সংগঠনের সদস্যদের মতে, দলের মূল সংগঠক ছিলেন জামালপুর নিবাসী জনৈক আলী আসাদ। তিনি মনে করতেন পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে বাঙালিদের দুরবস্থার কোন সমাধান সম্ভব নয়।
অন্য আরেক সংগঠক ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুর রহমান সিদ্দিকী। যার তথ্য অনুযায়ী মার্শাল ‘ল’ ঘোষণার তিন-চার মাস পরে বা ১৯৫৯ এর গোড়ার দিকে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন এম সাঈদ, আখতারুজ্জামান প্রমুখ। এছাড়া কিছু খণ্ডকালীন বা অনিয়মিত সদস্য এর সাথে জড়িত হয়। জামালপুর এলাকায় বিভিন্ন গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং এক সময় ৩০/৩৫ জন সদস্য এর সাথে যুক্ত হন।
এই সংগঠনের সমর্থন, অস্ত্র এবং রসদ যোগাড় করার ব্যাপারে কয়েকজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় সদস্য আবুল মনসুর আহমদের সাথেও দেখা করেন।
আবদুর রহমানের তথ্য অনুযায়ী, তাঁরা ভারতীয় দূতাবাসের জনৈক মধ্যপর্যায়ের কর্মকর্তার সাথেও যোগাযোগ করেন। তিনি তাঁদেরকে সাহায্য না করলেও উৎসাহ দেন। তখন তাঁরা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ভারতের সাহায্য আদায় করতে বিভিন্ন দলের অন্যান্য নেতার সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ হয়েছিল।
তাঁরা কিছু প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেছিলেন। বিশেষ করে ঢাকার সেক্রেটারিয়েট কর্মকর্তাদের মাঝে তাঁরা এ প্রচারপত্র বিলি করেন। এর মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা’।
আঞ্চলিক পর্যায়ে কিছু সিনেমা হল বা এরকম জমায়েতে গোপনে কিছু লিফলেট বিলি করা হয়। তবে দলটির এইসব কার্যক্রম শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই বেশির ভাগ কর্মী ধরা পড়ে যায়। নেতা আলী আসাদ তখন ভারতে অবস্থান করছিলেন। তাঁর আর কোন খবর পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি।
আবদুর রহমান সিদ্দিকী জানান, ভারতে অবস্থানরত বেশ কিছু মানুষ যেমন, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আদিবাসী নেতা ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য øেহাংশু আচার্য এবং আরো কয়েকজন বাঙালি নেতা তাঁদেরকে সাহায্য করেন। ঢাকায় তাঁরা ফকিরাপুল ও পল্টন ময়দান এলাকায় মিলিত হতেন এবং এখান থেকেই পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের হাতে তাদের কয়েকজন ধরা পড়ে। ধারণা করা হয়, দলের ভেতর থেকে কেউ খবর দিয়ে দেয় বলে গোয়েন্দারা তাদের সহজে ধরে ফেলতে পারে। এতে অন্যতম সদস্য আবু সাঈদের উপর ব্যাপক নির্যাতন করা হয় এবং জেলেই তার মৃত্যু হয় বলে মনে করেন আবদুর রহমান সিদ্দিকী।
১৯৬২ সালে মার্শাল ‘ল’ উঠিয়ে নেয়ার পর এদের কয়েকজনকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং কয়েকজন রাজনীতি থেকে দূরে মিলিয়ে যায়। যদিও আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে এদের যোগাযোগ ছিল কিন্তু এটা কোন দলীয় প্রচেষ্টা ছিল না।
সেই পর্যায়ে এসে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাÑ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি’Ñতাদের জন্য একটা ধাক্কা হিসেবে দেখা দেয়।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ এর মধ্যে পাকিস্তানিরা চেষ্টা করেছিল ধরপাকড়, তোষামোদ বা তোফার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী ধারাকে দুর্বল করতে। কিন্তু সে রকমটি ঘটেছিল বলা যায় না। যেহেতু এই সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা নানাবিধ আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ে, এর মধ্যে রয়েছে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে সারা প্রদেশে হরতাল ও বিক্ষোভ পালন।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে সোহরাওয়ার্দীকে অন্তরীণ করার একদিন পর ১ ফেব্র“য়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং ৬ ও ৭ ফেব্র“য়ারি ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভের মুখে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। তাদের মার্শাল ‘ল’ বিরোধী এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ, তরুণ রাজনীতিকদের সবল করে তোলে, কারণ দু’টি আন্দোলন সমার্থক হয়ে যায়। ১৯৬২ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি শাসনতন্ত্র ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভাব্য ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলন মোকাবেলার পরামর্শ দিয়ে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সদস্যরা ছিল সমাজের বিবিধ শ্রেণী ও অবস্থান থেকে আগত। তবে এর নেতৃত্ব ছিল সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে। প্রধান নেতা ছিলেন নৌ-বাহিনীর সদস্য লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। তাদের মধ্যে যে বিষয়টি মৌলিক ছিল তা হলো সেনা সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব। এই প্রথমবার সেনাবাহিনীর সক্রিয় চাকরিরত মানুষ স্বাধীনতার প্রচেষ্টার জড়িত হয়। তখন এটা কেবল রাজনীতির বিষয় থাকে নি, প্রতিরক্ষার বিষয়ও হয়ে যায়। এর ফলে বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যে জঙ্গি চরিত্র আসে সেটা পরবর্তীতে আন্দোলনের আলামত দেয়। একে অর্থে ১৯৭১ সালে যেসব বাঙালি সেনাসদস্য পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করে তাদের প্রকৃত পূর্বসূরি হচ্ছে এই মামলার সেনাসদস্যরা।
‘ইনার গ্র“প’ ও ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’কে একটি জঙ্গি জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ধারার দুটি ধাপ বলা যায়। যেটা শুরু হয়েছিল মোয়াজ্জেম চৌধুরীদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে, তারই সম্প্রসারণ ঘটেছিল লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমের প্রচেষ্টায়। প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টি ছিল বেশি সংহত ও পরিকল্পিত। এ ছাড়া উভয় প্রচেষ্টাই শেখ মুজিবকে কেন্দ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে পরিকল্পিত হয়।
‘ইনার গ্র“পে’র কার্যক্রমে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মীদের চরমপন্থি প্রচেষ্টা ছিল। মোয়াজ্জেম চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘ইনার গ্র“প’ প্রতিষ্ঠার সূত্র ছিল, ১৯৪৭ সালের রাজনীতিতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জিন্নাহ বিরোধী অংশ। মোয়াজ্জেম চৌধুরীর লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী শেখ মুজিবের সহায়তার ১৯৪৭ থেকে তারা স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালান।২
এই গ্র“পের অন্য সদস্যরা ছিলেন মো. নাসের, তারেক চৌধুরী এবং অন্য একজন, যিনি চাননি জীবিতাবস্থায় তাঁর নাম কেউ জানুক। এ অনুরোধ এখানে রক্ষা করা হলো। এ দলের সাথে ভারতীয় দূতাবাসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। দূতাবাসের জনৈক কর্মকর্তা বিপি সরকারের সহায়তার সিলেটের মধ্য দিয়ে শিলং হয়ে তাঁরা প্রথমবার কলকাতায় পৌঁছান। এটা ঘটে মার্শাল ল’ প্রতিষ্ঠার পূর্বে।
মোয়াজ্জেম চৌধুরী লিখেছেন, ১৯৫৬ সালে তাঁরা কলকাতায় চার মাস অবস্থান করেন। অন্য এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে তাঁরা ভেবেছিলেন তাদের প্রচেষ্টার প্রতি সবার সমর্থন থাকবে এবং এটিকে কেন্দ্র করে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু তেমন সাড়া তাঁরা পাননি।
১৯৬২ সালে শেখ মুজিবের সঙ্গে আবার তাঁদের যোগযোগ হয় এবং তিনি তখন চেষ্টা করেন শেখ মুজিবকে ভারত হয়ে বিলেতে নিয়ে যেতে, যাতে সেখান থেকে নেতাজী সুভাষ বোসের আদলে একটি আন্দোলন করতে পারেন, যাতে সবাই যোগ দেবে। শেখ মুজিব এই প্রস্তাবে রাজি হন এবং শ্রীমঙ্গল দিয়ে আগরতলা পৌঁছাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই ব্যাপারে ভারতীয় দূতাবাসের মি. ঘোষ সহায়তা করেন। শেখ মুজিব সীমান্ত পার হয়ে আগরতলায় যান। কিন্তু পূর্ব থেকে তাঁর যাবার বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত না করায় সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কারো সাথে তাঁর দেখা হয়নি বরং ভারতীয় পুলিশ তাঁকে অন্তরীণ করে ফেলে। এতে তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত হন এবং ভারতীয় সহযোগিতার প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠেন।
দুইদিন পরে তিনি আগরতলা থেকে ফেরেন এবং ঢাকায় ফেরার পরপরই অন্য একটা কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।৩
১৯৬৪ সালে ‘ইনার গ্র“পের’ উদ্যোগে আবার শেখ মুজিবকে বিলেতে পৌঁছাবার একটা প্রচেষ্টা নেয়া হয়, কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হয়ে যায়।৪
পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের পরে শেখ মুজিব বিলেতে গেলে তাঁর সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগের একটা উদ্যোগ নেয়া হয়, কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হয়েছিল।
শেখ মুজিব ও স্বাধীনতার প্রচেষ্টা
যে বিষয়টি আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে মূল ধারার বা গুরুত্বপূর্ণ সকল প্রচেষ্টার সাথে শেখ মুজিবের একটি সম্পর্ক ছিল। মোয়াজ্জেম চৌধুরী ‘ইনার গ্র“প’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেখ মুজিবকে নেতা হিসেবে চিন্তা করে এবং তাদের সকল প্রচেষ্টা ছিল শেখ মুজিবকে দেশ থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে একটি আন্দোলন চালানোর উদ্দেশ্য। ১৯৬২ সালে তারা শেখ মুজিবকে ভারতে নিয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে ‘ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন পার্টি’ আওয়ামী লীগের যে সব নেতাদের সাথে দেখা করেছিলেন বা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বলে জানাচ্ছেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবই ছিলেন প্রধান।
১৯৬২ সালে কয়েকটি প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আলোচনা এবং কাজী জাফর এবং তার সহকর্মীদের সাথে আলোচনায়ও শেখ মুজিব ছিলেন।
আওয়ামী লীগ-কমিউনিস্ট পার্টি বৈঠক
১৯৬১ সালের শেষার্ধ থেকে বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়। সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী এ ব্যাপারে দুই দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। আওয়ামী লীগ থেকে শেখ মুজিব ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মণি সিংহ ও খোকা রায় এসব গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আন্দোলনের প্রশ্নে কয়েক দফা কার্যক্রমের একটি খসড়া তাঁরা অনুমোদন করেন। ঠিক হয় যে, আইয়ুবের প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র জারি হওয়ার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রদের দিয়ে প্রথম আন্দোলনের সূত্রপাত হবে এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা সম্মিলিতভাবে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেবে। আন্দোলনের রূপরেখা ও কর্মসূচিটি প্রণয়ন করেছিল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি। এতে ভলা হয়েছিল :
১। পাকিস্তানের কেন্দ্রে ও প্রদেশে গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকার গঠন
২। পূর্ববঙ্গের জন্য স্বায়ত্তশাসন
৩। পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট প্রথা বাতিল করে সেখানকার জাতি সমূহের জন্য স্বায়ত্তশাসন
৪। রাজবন্দিদের মুক্তি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
৬। শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি
৭। কৃষকের খাজনা-ট্যাক্স হ্রাস
৮। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অবলম্বন শীর্ষক নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন।
শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি
বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব কর্মসূচিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বৈঠকে বলেন :
ওদের সাথে আমাদের আর থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে: আন্দোলনের প্রোগ্রামে ঐ দাবি রাখতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য নীতিগতভাবে এ ব্যাপারে একমত ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন: এই দাবির মধ্যে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নটি নিহিত রহিয়াছে এবং ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র গড়িয়া উঠা আমরা অস্বাভাবিক বা অসম্ভব বলিয়া মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে…‘স্বাধীন পূর্ব বাংলার’ দাবি উঠিতেছে তাহা রাজনৈতিক দিক হইতে যুক্তিসঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য নয়। তাহা ছাড়া বর্তমানে এইরূপ দাবি উত্থাপন করা আমরা অপরিপক্ষ এবং অসমরোচিত মনে করি।…
বাঙালি ধনিক ও বুদ্ধিজীবীরা পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী উগ্র স্বদেশী এবং একমাত্র নিজেদের সঙ্কীর্ণ শ্রেণীস্বার্থের দিক হইতে এই দাবিটি তুলিতেছেন তাহারা ইহা অর্জনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনতার প্রধান শত্র“ ও শোষক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতার আশা রাখেন…পূর্ববাংলার জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের গঠনতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের প্রধান শক্তি হইবে এখানকার শ্রমিক কৃষক ও মেহনতী মানুষেরা।…
এইপরিস্থিতির স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি এখন একটি পাঠকারী দাবি।… তাই বর্তমানে আমরা পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করিব।…
কিন্তু যাহারা স্বাধীন পূর্ববাংলা দাবি উত্থাপন করিবেন আমরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকিব। আমাদের খেয়াল রাখিতে হইবে যে, এই দাবির মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাক্সক্ষার প্রকাশ রহিয়াছে, যদিও বর্তমান অবস্থায় এই দাবি হঠকারী আমরা এই কথা তাহাদেরকে বুঝাইতে চেষ্টা করিব। বর্তমানে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সঠিক পথ বুঝাইতে এখন তাহাদিগকে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন হইতে বিরত করিতে চেষ্টা করিব। মাত্র দেড় মাস পরে এই পার্টির ভিন্ন আরেকটি গোপন দলিলে এই প্রসঙ্গে আরো অভিমত প্রকাশ করা হয় যে:
এই রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা যত বৃদ্ধি পাইবে এবং জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলন যত জোরদার হইবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শগত ভিত্তিও তত দুর্বল হইয়া পড়িবে। এই অবস্থায়, বিভিন্ন ভাষাভাবী জাতি বিশেষত পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের মতো দুইটি পৃথক অঞ্চল নিয়া একটি মাত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি থাকিবে বলিয়া মনে হয় না। সুতুরাং ভবিষ্যতে পাকিস্তান রাষ্ট্র একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হইয়া পড়িতে পারে।
কমিউনিস্ট পার্টির এসব গোপন দলিল অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৫৯ সাল থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন পূর্ববঙ্গের চিন্তাধারা সুস্পষ্টভাবেই এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ ছাত্র-যুবক সমাজের মনে জেগে উঠেছিল।
১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস (চতুর্থ সম্মেলনে) ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত যে রাজনৈতিক রিপোর্ট উত্থাপিত হয় তাতেও এই স্বাধীনতা সম্পর্কে কর্মী মহলে চিন্তা ভাবনার পর্যালোচনা করা হয়। এ সম্পর্কে প্রবীণ দুই কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ ও অমল সেন দুটি ভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেন :
স্বাধীনতা সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির এই সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গির কারণ হল এমনিতে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। তার উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কমিউনিস্টদের উপরই ছিল খড়গহস্ত। এ আমলে সবচেয়ে নির্যাতিত ছিল কমিউনিস্টরা। কিছু হলেই কমিউনিস্টদের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া হত। ফলে কমিউনিস্টরা সব ব্যাপারে একটু সতর্ক ছিল।
তাঁরা বলেন : সত্যি কথা বলতে কি, আমরা ভাবিনি, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়টি এত দ্রুত আগাবে। তবে মনে আকাক্সক্ষা ছিল, বিশ্বাস ও ছিল। আসলে জনগণের মাঝে, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনে, বিচ্ছিন্নভাবে এসব চিন্তা ছিল। তবে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরে খুব দ্রুতই জনগণ এটা গ্রহণ করে নেয়। এত দ্রুত যে, সবকিছু ভালো করে বোঝার আগেই ঘটনাটা শুরু হয়ে যায়, এমনকি প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ-কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে, কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দলিলের মূল্যায়নের আলোকে শেখ মুজিবের প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনা করেন। অবশেষে শেখ মুজিব বিষয়টি অসময়োচিততা ও অপরিপক্বতার’ যুক্তি মেনে নেন। এ ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন ছাড়াও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শকে শেষ মুজিব গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতিস্বরূপ প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ঠিক নিয়েছিল, এই লক্ষ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণতন্ত্রের দাবিতে করাচী থেকে সর্বপ্রথম শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি বিবৃতি দেবেন।
কিন্তু বিবৃতিদানের পূর্বেই এই গোপন শলাপরামর্শের কথা সামরিক সরকারের কাছে পৌঁছে যায়। ৩০ জানুয়ারি বিকেলে করাচীতে কোনোপ্রকার প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৬ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শেখ মুজিব আলোচনা করেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। তাদের মতে শেখ মুজিব কেবল নেতা ছিলেন না, তাদের আদর্শগত উৎস ছিল অনেকটা ছয়দফা ভিত্তিক। এর অন্যতম সদস্য আহমেদ ফজলুর রহমান এই দফা প্রণয়ন ও প্রচারে অংশগ্রহণও করেছিল।
এ ছাড়া প্রশাসন বিভাগের যে সব সদস্য এর পক্ষে জড়িত ছিলেন তারাও বলেছেন যে তাদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রচেষ্টা শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে এবং এটি ছিল ছয়দফার একটি জঙ্গি সংস্করণ।
এমন-কি ঘোর আওয়ামী লীগ বিরোধী সিরাজ সিকদারও মার্চ মাসে শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে একটি প্রচারপত্র বিলি করেন যাতে বলা হয় স্বাধীনতা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই শেখ মুজিবের প্রধান দায়িত্ব। অতএব বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পুরুষ সম্পর্কে বিতর্ক থাকার অবকাশ নেই।
১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব দলের প্রধান নিয়ন্ত্রক হলে পাকিস্তান কেন্দ্রিক আওয়ামী লীগ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং এটা পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক একটি দলে পরিণত হয়। যার সাথে ১৯৪০Ñএর পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলনের মিল লক্ষণীয়।
আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী আহমেদ ফজলুর রহমান একটি সাক্ষাৎকারে জানান যে তাঁর মাধ্যমে ভারতের নেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের আলাপ হয় বিলেতে থাকা অবস্থায় ১৯৬৯ সালে। মোয়াজ্জেম চৌধুরীও একই কথা বলেন।
উভয় প্রচেষ্টাতেই শেখ মুজিবকে কেন্দ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে পরিকল্পিত হয়। অবশ্য শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা ‘ইনার গ্র“পের’ সাথেই বেশি ছিল যার নেতা মোয়াজ্জেম চৌধুরী তার কলকাতার রাজনৈতিক জীবনের সহযোগী ছিলেন। তবে শেখ মুজিব সবাইকে সব কিছু জানিয়ে কাজ করেননি।
আবদুর রাজ্জাকের এক সাক্ষাৎকারে থেকে জানা যায়, ১৯৬১ সালে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কায়েম কর’ নামে একটি লিফলেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলি করেছিলেন। শেখ ফজলুল হক মনি তাঁকে ঐ লিফলেট বিলি করতে দিয়েছিলেন। পরে তিনি শেখ মুনির কাছ থেকে জানতে পারেন শেখ মুজিবই উক্ত লিফলেট প্রকাশের উদ্যোক্তা, শেখ মুজিবও পরে তাঁর কাছে সে কথা নিশ্চিত করেন। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
শেখ মুজিব দু রকম উপায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি চিন্তা করতেন। প্রথমটি হলোÑনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে নির্বাচনের মাধ্যমে স্বায়ত্বশাসন অর্জন। পরে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুতির মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। দ্বিতীয়টি হলোÑ বাধা আসলে সৈনিক জনতার সমন্বয়ে বিপ্লবী গ্র“পের সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন। এক সাক্ষাৎকারে আগরতলা মামলার আসামী বিধান কৃষ্ণ সেন জানান,
“পূর্ববাংলা মুক্তিফ্রন্ট’, ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’, ‘কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস’ এবং বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছিল একই সূঁতোয় গাথা। শেখ মুজিব ৬১ সালেই ‘পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট’ নামে একটি গোপন সংগঠনের জন্ম দেন। এর মাধ্যমে কৌশলে ছাত্রসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে প্রয়োজনীয় জনমত সৃষ্টি ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা চিন্তা করছিলেন তিনি। পাশাপাশি চলে ছাত্রদের মধ্যে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এর অংশ হিসেবে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী প্রগতিশীল ও বাছাই করা বিশ্বস্ত কর্মীদের নিয়ে ১৯৬২ সালে গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ।’ ১৯৬৪ সালে গঠন করেন পরিষদের ‘কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস’। শুরুতে এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যুক্ত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। ৬৬ সাল থেকে আরো পরে এ সংগঠনের সাথে এমএন মান্নান, আবুল কালাম আজাদ, তোফায়েল আহমদ, আ. স. ম আবদুর রবসহ অনেকেই যুক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও পরামর্শে তারা ছাত্র জনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ছয় দফা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির আড়ালে স্বাধীনতার পক্ষে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালাতে থাকেন”।৫
শেখ মুজিব নিজের দল এবং মূলধারার রাজনীতির মধ্যে অবস্থান করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতার ব্যাপারে কাউকে নিরুৎসাহিত করেননি এবং যোগাযোগের সম্পর্কগুলো রক্ষা করেছিলেন। স্বাধীনতার ব্যাপারে অর্থাৎ পাকিস্তানে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের যে ঐতিহ্য তার তিনি অংশ ছিলেন কিন্তু সেটাকে তিনি দেখেছিলেন মূলধারার রাজনীতির কাঠামোর ভেতরে। এর মধ্যে একাধিক জঙ্গি স্বাধীনতাকামী ধারা যে থাকবে সেটা তিনি বোধহয় বুঝেছিলেন এবং এক সময় তার অংশ হলেও ক্রমেই মূল আইনী ধারার সঙ্গে বেশি যুক্ত হয় পড়েন যার নেতা ছিলেন তিনি।
১৯৬২ সালে আগরতলা গমনের পর তিনি বিদেশি যোগাযোগ নির্ভর প্রচেষ্টাকে অস্বীকার না করলেও মূলত দেশের অভ্যন্তরের রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবগুলি জানলেও প্রধানত রাজপথের আন্দোলনের দিকেই মনোনিবেশ করেন। অর্থাৎ গোপন প্রচেষ্টাসমূহ তিনি নিরুৎসাহিত করেননি, তবে সে সবের কেন্দ্রিয় বা ঘনিষ্ঠ ভূমিকায় তিনি ছিলেন তেমন কোন প্রমাণ নেই, কেউ তা দাবিও করেনি। তিনি এই গোপন ধারাকে অস্বীকার না করে এটি প্রয়োজনীয় উপধারা হিসেবে দেখে থাকতে পারেন।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের জানার বাইরেও বঙ্গবন্ধু অনেককে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছেন। ৬১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের কথা। একদিন মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) আমাকে ডেকে কাগজে মোড়ানো কতগুলো প্রচারপত্র দিয়ে বললেন, ‘এগুলো রাত তিনটার দিকে ভার্সিটি এলাকার হলে হলে, ঘরে ঘরে খুবই সাবধানে বিলি করতে হবে।’ তিনি চলে যাওয়ার পর সেগুলো খুলে দেখে প্রথমে আমি ঘাবড়ে যাই। কারণ সেখানে যা লেখা-ধরা পড়লে ১৪ বছর জেল নির্ঘাত। শিরোনামে ছিল ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কায়েম কর’। নিচে লেখা ছিল ‘সংগ্রামী জনতা’। সেখানে বাঙালিদের ওপর পশ্চিমাদের শাসন-শোষণ এবং সশস্ত্র বাহিনী ও রাজনীতিতে কীভাবে বাঙালিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তার বিবরণ দেওয়া ছিল। এসব শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য বাঙালি ছাত্র-জনতাকে প্রস্তুত হওয়ায় আহ্বান জানানো হয় ওই প্রচারপত্রে। আমার মনের ভেতর যেহেতু স্বাধীনতার চেতনাটা ছিল, তাই সাহস করে রাতের মধ্যে ফজলুল হক হলের বিভিন্ন ঘরে গিয়ে দরজার নিচে দিয়ে প্রচারপত্র ঢুকিয়ে দিয়ে চলে আসি। বাকিটুকু একটি টয়লেটের বেসিনের ওপর রেখে রুমে এসে শুয়ে থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি। সকালে আমার রুমমেট বাইরে গিয়ে ফিরে এসে বললো, ‘বাইরে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের লিফলেট পাওয়া গেছে’। আমি কিছু না জানার ভান করে বললাম, ‘এগুলো বিপজ্জনক, বাইরে ফেলে দে, কাউকে কিছু বলিস না’
এই প্রচারপত্রও আমাদেরকে স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত হতে প্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৬২ তে নিউক্লিয়াস গঠনের সময় বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল। মনি ভাই বলেছিলেন, ‘এটা বঙ্গবন্ধু করিয়েছেন। মানিক মিয়াও (তোফাজ্জল হোসেন মানিক, ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠতা সম্পাদক) এতে যুক্ত আছেন।’ পরে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেও বিষয়টি জেনেছি। ৬৭ সালে মানিক মিয়াও এটি স্বীকার করেন।
আগরতলা মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর পরিষ্কার জানতে পারলাম যে বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকের শুরু থেকেই এসব কাজ ভেতরে ভেতরে চালাচ্ছিলেন।
১৯৬৯ সালে লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের কাউন্সিলর কাউন্সিলর আই সিং-এর বরাত দিয়ে মূলধারা ৭১ গ্রন্থের লেখক মঈদুল হাসান জানাচ্ছেন, তিনি (আই সিং) তাঁকে বলেছেন যে, আগরতলা মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর শেখ মুজিব যখন চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান, সেই সময় লন্ডন সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সঙ্গে শেখ মুজিব বৈঠক করেছিলেন। আই সিং যিনি ছিলেন আসলে লন্ডনে ‘র’-এর প্রধান তিনি শেখ মুজিবুর ও ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেন তাঁর বাড়িতে। সেই বৈঠকে শেখ মুজিব রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা জানি নির্বাচনে আমরা বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতব। কিন্তু ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না। ঠিক ১৯৫৪ সালের মতো হবে। আবার কেন্দ্রীয় শাসন জারি করবে। ধরপাকড় করবে। কিন্তু এবার আমি তা হতে দেব না। আমার কিছু ছেলেকে তোমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর একটা বেতারযন্ত্র দিতে হবে, যেখান থেকে তারা যাতে প্রচার করতে পারে যে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’
আই সিংহের ভাষ্য মোতাবেক মঈদুল বলছেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী সহানুভূতির সঙ্গেই শেখ মুজিবকে আশ্বাস দেন যে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। ঘটনা ঘটুক, দেখা যাক’।
মুক্তিযুদ্ধের জন্য বঙ্গবন্ধুর যে পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো, তার একটা অকাট্য প্রমাণ হলো তিনি ১৯৬৮ সালে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন সুতারকে কলকাতায় পাঠিয়েছেন। তাঁকে যেখানে একটি ভবানীপুরের রাজেন্দ্র প্রসাদ রোডে বাড়ি ভাড়া (বাড়ির নাম ‘সানি ভিলা’) করে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । তাঁর কাজ ছিলো ভারতীয় উচ্চ মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তাদের সহানুভূতি অর্জন করা এবং মুক্তি সংগ্রামীদের ভারতে আশ্রয়, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের জন্য আগাম বন্দোবস্ত ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করা।
….১৯৭১-এর মার্চ মাসে পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হওয়ার মুখে শেখ মুজিব যুব নেতাদের চিত্তরঞ্জন সুতারের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন। স্পষ্টতই একটা পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই এটা ঠিক করা হয়েছিলো…’৬
১৯৬১ সালে ভারতীয় কূটনীতিক শ্রী শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি যিনি ১৯৬১ সালে ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরত থাকাকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো, তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে (জাতীয় শেখ দিবস সংখ্যা ২০১০) বলেছেন, ৬১ সালেই শেখ মুজিব তাঁর কাছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কয়েকবার দেখা হবার পর তিনি (শেখ মুজিব) একদিন বললেন, ‘ব্যানার্জি বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে। এখানে বসে তো হবে না। আমি ইংল্যান্ড যাব। সেখান থেকে’Ñআমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘দাঁড়ান’-দাঁড়ান, কী বলছেন এসব? স্বাধীনতা এত সোজা? তিনি বললেন, বন্ধু দেশগুলো সহযোগিতা করলে সোজা।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের স্বীকৃতি চাইলে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি ভারতীয় হাই কমিশনার সৌর্যকুমার চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর গোপন বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। বৈঠক হয়ে ইত্তেফাক অফিসে। ব্যানাজি থাকতেন ইত্তেফাক অফিসের পাশে চক্রবর্তী ভিলায়। দুই অফিসের মধ্যবর্তী দেয়ালের আড়াল ব্যানার্জির ভাষায়-ইত্তেফাক-সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লোকজন ভেঙে রাখার একদিন গভীর রাত দুটোর সময় সেই ভাঙাল দেয়াল পার হয়ে ভারতীয় হাই কমিশনার, ইন্টেলিজেন্স চিফ কর্নেল শৈলেশ চন্দ্র ঘোষ, ব্যানার্জি ইত্তেফাক অফিসে ঢুকে পড়েন শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে। তাঁদেরকে শেখ মুজিব বললেন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চান এবং সেজন্য ভারতের সাহায্য চান। তাঁরা বলেন দিল্লির সঙ্গে কথা বলে ভারতের মনোভাব তাঁকে জানানো হবে।
তারপর হাই কমিশনার এস কে চৌধুরী দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে কথা বলেন। মন্ত্রিসভার এক গোপন বৈঠকে দেশরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের উপস্থিতিতে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হয়। এস কে চৌধুরী দিল্লি থেকে ফিরে কর্নেল ঘোষকে নিয়ে আবার গোপনে মানিক মিয়ার বাড়িতে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে ভারতের সহযোগিতার আশ্বাস দেন বটে, তবে সেই মুহূর্তে নয়। চিনের সঙ্গে সস্য সমাপ্ত যুদ্ধে পরাজয়ের পর ভারতের পক্ষে এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিলো না। এতে শেখ মুজিব রেগে গিয়ে নিজেই আগরতলা চলে যান; তাতে তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যায় নি। ভারতের তরফ থেকে তাঁকে বলা হয়, আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছার পূর্বে ভারতের পক্ষে সমর্থন জানানো কঠিন। কারণ তাতে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন জানানো হবে, অপর পক্ষ অন্তত সেরকমটি অভিযোগ করবে।
এরপর, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সঞ্চিতাকে ব্যানার্জি বলেন, ‘তিনি (মুজিব) জনমত গঠনের জন্য যাঁরা দেশে উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছেন।’ কিন্তু সেটা আরো পরে, ৬ দফা দেয়ার পর।
ব্যানার্জি বলছেন, ‘আমাকে শেখ মুজিবের কাছ থেকে একটা বড় রকমের প্রতিশ্র“তি চাওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বলা হয়েছিলো। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যদি ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক আদর্শভিত্তিক হয়, তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ ভারতের সাহায্য ও সমর্থন পাবে। এই বিষয়গুলোই তো মুজিবের স্বপ্নের বিষয়। কাজেই মুজিব তাতে সানন্দে সম্মতিসূচক প্রতিশ্র“তি দেন। তার বিনিময়ে তিনি ভারতের কাছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সর্বাঙ্গীণ সহায়তা ও সাহায্যের নিশ্চয়তা চান।’
নির্বাচনের পর বিভিন্ন প্রস্তুতি
৭০-এর নির্বাচনের পরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন বাঙালি। কাজেই তৎকলীন পাকিস্তানি সামরিক চক্র বাঙালির হাতে ক্ষমতা না দেয়ার জন্য বন্ধপরিকর হলেন। বঙ্গবন্ধু এটা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই ৩১ ডিসেম্বর ’৭০ তিনি জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত সব আওয়ামী লীগ সদস্যকে ডেকে ঐ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তাঁদের শপথ নিয়েছিলেন।
১৫ ফেব্র“য়ারি ’৭১ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন ডাকার জন্য অধিকাংশ নির্বাচিত সদস্যের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের মাধ্যমে যথাযথভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, যদি ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার ঐ তারিখে মধ্যে সংসদ অধিবেশন না ডাকে, অথবা ঐ তারিখে সংসদ অধিবেশনের পরিবর্তিত সুর্নিদিষ্ট তারিখ ঘোষণা করে না তবে যে কোনও পরিস্থিতির দায়দায়িত্ব তাঁদের ওপরই বর্তাবে। সে অনুযায়ী ঘোষনা করা হয়েছিলো যে, ৩ মার্চ ’৭১ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন বসবে।
অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার জের হিসেবে বঙ্গবন্ধু পূর্বাণী হোটেলে আহূত সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন, ‘সংসদ অধিবেশন যতদিন না বসবে, ততদিন কেন্দ্রীয় সরকারের কোন নির্দেশ পালন হবে না। অতঃপর বঙ্গবন্ধু’র নির্দেশ অনুযায়ী পয়লা মার্চ ’৭১ থেকেই সারা দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এটা ছিলো নতুন প্রকৃতির অসহযোগ আন্দোলন। সরকার চলছে, স্টেট ব্যাংক চলছে, রেলগাড়ি চলছে। কেবল অসহযোগ কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ বলেছিলেন, গান্ধীজী পর্যন্ত ভাবতে পারেন নি যে অসহযোগ আন্দোলন এত শক্তিশালী হতে পারে। সবকিছু অচল করে দিয়েছে, অথচ সব চলছে।
স্বাধীনতার গোপন প্রচেষ্টায় কোনো অগ্রগতি না হলেও নিয়মতান্ত্রিক ধারায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয় এবং ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। যদিও তা সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিলো না; তথাপি মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রামে দুই বাংলার সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের নিয়ে সংস্কৃতি সম্মেলন, টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘট, ৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারির রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে হক-ভাসানীÑসোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের কাছে সরকারী দল মুসলিম লীগের ভরাডুরি ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের জনগণের একদিকে যেমন বিচ্ছিন্নতা তৈরি হতে থাকে, তেমনি তাদের ক্ষোভ এবং আস্থাহীনতারও প্রকাশ ঘটতে থাকে। ঐতিহাসিক সালাহউদ্দীন আহমদের ভাষায় “……পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে বাঙালি মুসলমাদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তারা সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করল, বিশেষ করে যখন তারা উপলব্ধি করল যে, পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, যারা ছিল অধিকাংশই অবাঙালি, তারা ধর্মের জিগির তুলে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ বাংলাদেশেকে তাদের অবাধ শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত করেছেন। বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতিকে উপেক্ষ করে বাঙালিদর ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্তকে বাঙালি মুসলমানরা সুনজরে দেখতে পারে নি। তখন থেকেই শুরু হল বাঙালি মুসলমানদের মোহমুক্তির আলা, বরুদ্দীন উমরের ভাষায় ‘বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।’ যে বাঙালি মুসলমান নিজের মাতৃভূমিকে উপেক্ষা করে আরব, ইরান ও তুরস্কের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল, পরিবর্ততে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নতুন জাগরণ দেখা দিল এবং তারা স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের বাঙালিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হতে শুরু করল”।৭ টীকা ও তথ্যনির্দেশ : ১. আফসান চৌধুরী : বাংলাদেশ ১৯৭১ প্রথম খণ্ড, ভূমিকা; (ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৭)
২. আফসান চৌধুরী : প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৪।৩. আফসান চৌধুরী : প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫।৪. আফসান চৌধুরী : প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫।৫. মুহাম্মদ শামসুল হক : স্বাধীনতার সশস্ত্র প্রস্তুতি আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দি; (চট্টগ্রাম : বলাকা ২০০৯) পৃ. ৬৭।
৬. মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর-কথোপকথন, ; (ঢাকা : প্রথমা, ২০১১) পৃ. ১৩২।
৭. সালাহউদ্দিন আহমদ : বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিয্দ্ধু (ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশন ১৯১২) পৃ. ১১১।