মাণিক চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নায়ক। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মরণীয় ঘটনা তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মাণিক চৌধুরীকে ওই মামলায় ১২নং আসামী করা হয়। স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য মাণিক চৌধুরীর ওপর পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভের পর তাঁকে ও বিধান কৃষ্ণ সেনকে পটিয়া থানার পাঁচরিয়া দিঘির পাড়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সে সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতায় মাণিক চৌধুরী যখন তাঁর ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন মানুষ শিউড়ে উঠেছিলেন। সভায় উপস্থিত কোন কোন শ্রোতা-দর্শককে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁকে বরফের মধ্যে শুইয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয় এবং তাঁর পায়ুপথে সেদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলা মামলার গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু’র বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করার পর থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রাম চরম আকার ধারণ করে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেয়ার পর সরকার তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘ভারতের দলাল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও বাংলার মানুষ সরকারের কথায় বিশ্বাস করেনি। তারা এতদিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন করে আসছিলো, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হলো আর একটি দাবি, বন্দীমুক্তি ও আগরতলা মামলা বাতিলের দাবি। অতঃপর ৬ দফা বাস্তবায়ন ও আগরতলা মামলা বাতিলের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠলে পাকিস্তানের তথাকথিত লৌহমানব প্রেসিডেন্ট ফিন্ড মর্শাল আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বঙ্গবন্ধু, মাণিক চৌধুরীসহ সকল বন্দী মুক্তিলাভ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তন্মধ্যে সর্বশেষ বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা ছিলো পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈন্যদের দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সকল ক্যান্টনমেন্টে একযোগে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করা। কিন্তু এই পরিকল্পনা পরিণতি লাভ করার পূর্বেই ফাঁস হয়ে যায়। তখন পাকিস্তান সরকার সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ীসহ সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরক একে একে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে যে মামলাটি দায়েল করে, সেটিই ইতিহাসে আগরতলা মামলা নামে পরিচিতি লাভ করে।
বঙ্গবন্ধুর উক্ত স্বাধীনতা প্রচেষ্টার মুখ্য ব্যক্তি ছিলেন মাণিক চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু, পাকিস্তান নৌবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের পরই ছিলো মাণিক চৌধুরীর স্থান। প্রথমে মামলার নাম ছিলো ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’। বঙ্গবন্ধুকে ভারতের দালাল হিসেবে প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধি থেকে পরে পাকিস্তান সরকার মামলার শিরোনামে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা’র নাম জুড়ে দিয়ে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামকরণ করে।
ভারতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাণিক চৌধুরীর সুসম্পর্ক ছিলো। তাঁর মধ্যস্থতায় ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও ট্রেনিং প্রদান, প্রবাসী সরকার গঠন ও দাপ্তরিক কাজকর্ম পরিচালনা, সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন ও পরিচালনা এবং ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদান- এসব মাণিক চৌধুরীর কারণেই সম্ভব হয়েছিলো।
মাণিক চৌধুরীর প্রকৃত নাম ভূপতি ভূষণ চৌধুরী। তিনি পটিয়া উপজেলার গৌরব; শুধু পটিয়া নয়, চট্টগ্রাম জেলার গর্ব বললেও অত্যুক্তি হয় না।
১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর পটিয়া থানার হাবিলাসদ্বীপ গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম ধীরেন্দ্র লাল চৌধুরী ও মাতার নাম যশোদা বালা চৌধুরী।
বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস কখনো রচিত হলে মাণিক চৌধুরী তাতে নিঃসন্দেহে একজন জাতীয় বীর হিসেবেই চিহ্নিত হবেন। উন্মেষ থেকে ধাপে ধাপে রক্তাক্ত আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম বিকশিত ও পুষ্ট হয়েছে তার কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান-জাতির আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন চেতনায় ধারণ করে যিনি হয়ে ওঠেন জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, জাতিসত্তার প্রতীক “বঙ্গবন্ধু”, “জাতির জনক”। গ্যালাক্সির এই উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ককে ঘিরে ছোট বড় অনেক জ্যোতিষ্কের সমাবেশ ঘটেছিল। এই তারাম-লেরই এক প্রান্তে নীরবে নিভৃতে অবস্থান করেও যিনি স্বীয় প্রভায় সমুজ্জ্বল, আপন বিভূতির বিভায় জ্যোতির্ময় হয়ে আছেন, তিনি ঐ গ্যালাক্সিরই এক ‘মাণিক’, মাণিক চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের উত্থানপর্বে যাঁরা তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন মাণিক চৌধুরীকে দেখা গেছে তাদের অগ্রভাগে। বঙ্গবন্ধুর খুবই আস্থাভাজন ও প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।