চট্টগ্রামের সুসন্তান ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন এখন লন্ডনে ব্যস্ত আইনজীবী। তাঁকে বর্তমানে চট্টগ্রামের ক’জন মানুষ চেনেন আমি জানি না। কিন্তু একদা তাঁকে না চিনে চট্টগ্রামের মানুষের কোনো উপায় ছিলো না। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্বে যখন অবসাদগ্রস্ততা নেমে এসেছিলো, চাক্তাই খালের পানিতে চট্টগ্রাম হাবুডুবু খাচ্ছিলো, রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে করুণ অবস্থা বিরাজ করছিলো; এমনি সংকটময় সময়ে চট্টগ্রামের সামাজিক জীবনে নতুন নেতৃত্বের উদ্ভবের প্রত্যাশায় যখন রাত্রির তপস্যা দীর্ঘতর হচ্ছিলো, তখনই চট্টগ্রামের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃশ্যপটে মনোয়ারের আবির্ভাব। স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও সংগঠক মনোয়ার হোসেন ততদিনে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গণে বিশিষ্ট ছাত্রনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। কাজেম আলী মাস্টারের প্রপৌত্র শিল্পী ছাত্রনেতা শাহরিয়ার খালেদ তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত তরুণতর সহকর্মী।
এমন সময় মনোয়ারকে পেলেন জামাল ভাই (বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও শ্রমিক নেতা, মুক্তিযোদ্ধা এসএম জামালউদ্দিন) অথবা জামাল ভাইকে মুরুব্বি হিসেবে পেলেন মনোয়ার। দু’জনের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিলো আমরা জানি না। তবে, অতঃপর জামাল-মনোয়ার জুটি চট্টগ্রামে অভিনব এক সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করলেন, অতীতে যা আর কখনো দেখা যায় নি। এল কে সিদ্দিকী ও মঈনুল আলম সাহেবরা ‘শত নাগরিক কমিটি’ নাম দিয়ে একটি নাগরিক আন্দোলনের প্রয়াস পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু হোয়াইট-কার্লাড অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকায় সেটি সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করতে পারে নি। ২২ মহল্লা সর্দার কমিটিও সিরাজ মিয়া ও আবুল খায়ের মেম্বারের নেতৃত্বে কবরস্থান নিয়ে একটি জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো।
জামাল ভাই ও মনোয়ার প্রথমে চাক্তাই খান খনন আন্দোলন ও পরে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন গণসংগ্রাম কমিটি নাম দিয়ে সন্দ্বীপ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এক প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। রাজনৈতিক দলের ন্যায় হরতাল, অবরোধে অচল করে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামকে। বড় বড় মঞ্চ তৈরি করে অবস্থান, অনশন চালিয়ে যেতে থাকলেন। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনের লিফলেট ও পোস্টারের ভাষা এবং বক্তব্য ও স্লোগানের মধ্যে তাদের দুঃখ, অভাব-অভিযোগ প্রতিধ্বনিতে হতে দেখে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান এবং চট্টগ্রামের উন্নয়নের দাবিতে একটি ব্যাপক জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে উঠলো। তো মনোয়ার সেই আন্দোলনের পাইওনিয়রিং রোল প্লে করে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তারপর হঠাৎ করে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পাড়ি জমান এবং যথাসময়ে বার-এট-ল ডিগ্রি নিয়ে সেখানেই আইন পেশায় যোগ দেন। তবে মনোয়ার ঢাকা ও চট্টগ্রামেও নিয়াজোঁ অফিস করেছেন এবং ইদানিং ঘনঘন চট্টগ্রাম আসা যাওয়া শুরু করেছেন। দেশে এসে যখন তিনি তাঁর নিজের শহরে কোন সমস্যা দেখেন তখন তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন এবং ফেসবুকে সচিত্র পোস্ট দেন। আজও তাঁর একটি পোস্ট দেখলাম, তাতে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা তিনি তুলে ধরেছেন। মনোয়ারের কথার খেই ধরে আমি কিছু বলার চেষ্টা করছি।
জলাবদ্ধতা সমস্যা চট্টগ্রাম শহরের প্রধানতম ও অতি পুরাতন সমস্যা। নিকট অতীতে চট্টগ্রামের অনেক পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয় নি। জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ নগর পরিচালনা কর্পোরেশনেরই কাজ এবং নগরের উন্নয়ন তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়ের কাজও কর্পোরেশনই করে থাকে। এতকাল আমরা তাই দেখে এসেছি। মানুষও মনে করে শহরের মা বাপ সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু সরকার কর্পোরেশনকে সে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে সিডিএ’র হাতে কেন অর্পণ করেছে আমরা জানি না। তবে এটুকু বুঝি নাছিরের কাছে থাকলেই ভালো ছিলো। তাহলে বৃষ্টিতে এখন যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য চসিক মেয়রকে জবাবদিহি করতে হতো। কিন্তু এখন তিনি সুযোগ পেয়েছেন দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার। জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি বলেছেন জলাবদ্ধতা কেন হচ্ছে আমি কেন তার জবাব দেব। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন তাঁর তো এখন সে দায়িত্ব নেই।
কর্পোরেশন থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব নিয়ে ফেলার কারণ কি? কর্পোরেশন কি অপারগতা প্রকাশ করেছিলো ? কিন্তুনাছির সাহেব তো সেটা বলেন নি। চসিক যদি অপারগতা প্রকাশ না করে, তাহলে সিডিএ-কে দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলার মানে বুঝতে পারলাম না। সরকারের দু’টি সংস্থার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে মানুষ কেন দুর্ভোগ পোহাবে? নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিজেরা মিটিয়ে ফেলা দরকার।