এস এম ইউসুফ একজন অসাধারণ প্রতিভাধর রাজনীতিবিদ ছিলেন। ছেচল্লিশে পটিয়ার একটি গ্রাম থেকে উদ্ভূত হয়ে তাঁর আলোকসামান্য প্রতিভা প্রথমে চট্টগ্রাম, তারপর বাংলাদেশকে আবিষ্ট করে ফেলেছিলো। তাঁর জীবন একটি অসমাপ্ত গল্পের উপমা, তিনি একটি ট্র্যাজেডির নায়ক। নীতিদীর্ঘ জীবনে কত ঘটনারই না জন্ম দিয়েছেন তিনি, বিস্তর আশা আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করেছেন জনমানসে। কিন্তু তা পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্বেই তাঁর দেহ ভূমায় মিলিয়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি যদি আরও পরমায়ু লাভ করতেন, তাহলে তিনি রাজনীতিতে আরও কি অবদান রাখতে পারতেন, তা জানতে না পেরে বেদনায় হাহাকার করে উঠে আমাদের আন্তর।
এস এম ইউসুফের রাজনীতির মধ্যে কোন মিনমিনে বা ম্যাড়মেড়ে ভাব ছিল না। তিনি একজন তেজস্বী রাজনীতিবিদ ছিলেন, বলিষ্ঠ নেতা ছিলেন। বক্তৃতায় তাঁর কোন জুড়ি ছিল না, এমন অননুকরণীয় ভঙ্গিতে তিনি শব্দ উচ্চারণ করতেন যে, স্পষ্ট উচ্চারণে তাঁর শব্দ প্রক্ষেপ হত যেন এক একটি আগুনে গোলা অথবা নিক্ষিপ্ত তীরের ন্যায়। ধ্রুপদী সঙ্গীতের দীপক রাগের মতো তাঁর অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা শ্রোতার দেহমনে আগুনে ধরিয়ে দিতো। প্রত্যেকটি বক্তৃতায় শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাস্টার দা সূর্য সেন প্রমুখ চট্টগ্রামের প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সাহিত্যিকদের নাম ধরে ধরে তিনি বক্তৃতা আরম্ভ করতেন, যার ফলে প্রথম থেকেই শ্রোতারা উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন যে এরপরে তিনি কি বলেন সেটা শোনার জন্য। এ ধরনের বক্তৃতা আর কেউ চট্টগ্রামে করতেন বলে মনে হয় না।
এস এম ইউসুফ আমার রাজনৈতিক গুরু, আমি তাঁর কাছ থেকে রাজনীতি শিখেছি। আমি যে মুক্তিযোদ্ধা হলাম সেটাও তাঁর কারণে। আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ’৭১-এর এপ্রিলের প্রথম দিকে আমার হুলাইনের বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে যাচ্ছিলাম, সঙ্গে ছিলেন আমার শিক্ষক অধ্যাপক বিপ্রদাশ বড়ুয়া। খাল, নদী সাঁতরে, পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে আমরা যখন রামগড়ে উপনীত হই, তখন সেখানে এস এম ইউসুফের দেখা পাই। তিনি আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ট্রেনিং-এ পাঠিয়ে দেন। আমি যে মুজিব বাহিনীর সদস্য হলাম সেটাও এস এম ইউসুফের কারণে। তাঁর ঋণ আমি কোনদিনই শোধ করতে পারব না।
স্বাধীনতার পর আমি তাঁর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। তখন ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে যায় ু এক ভাগে আওয়ামী লীগ সমর্থক যারা মুজিববাদী নামে পরিচিত তারা, আরেক ভাগে জাসদ সমর্থক ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন। এস এম ইউসুফ মুজিববাদী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং চট্টগ্রামের প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমি মুজিববাদী ছাত্রলীগের সাথে থাকি। আমি তাঁকে উপেক্ষা করে জাসদ সমর্থক ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এ কারণে এস এম ইউসুফ আমার প্রতি কখনো রাগ বা বিদ্বেষ বা অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। তিনি একবারও আমাকে বলেননি, তুমি কেন আমাদের বিরুদ্ধে রাজনীতি করছো। এইখানে আমি এস এম ইউসুফকে উদার হৃদয়ের একজন বড় মাপের নেতা হিসেবে পেলাম। যাঁর মনে কোন ক্ষুদ্রতা, নিচতা বা সংকীর্ণতা ছিল না।
এসএম ইউসুফের ন্যায় এমন বিচক্রণ, চতুর, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ খুব কমই দেখা যায়। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এম এ মান্নানের পর এস এম ইউসুফকেই শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বললে বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবে না। তিনি যাদের সঙ্গে রাজনীতি করছেন, তাদের চেয়ে তিনি বেশি জানতেন ও বেশি বুঝতেন। কিন্তু তাতে তাঁর লাভ হয়নি, তিনি ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়েছেন। সমসাময়িক বা সিনিয়র নেতারা তাঁর প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়েছেন, হীনম্মন্যতাবোধে আক্রান্ত হয়েছেন। যার ফল ভোগ করতে হয়েছে এস এম ইউসুফকে। তিনি যখন চট্টগ্রাম জয় করে ঢাকা গিয়ে জাতীয় রাজনীতি শুরু করেন, তখনও তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার কাছে অনেকেই পিছিয়ে পড়েন।
এসএম ইউসুফের জন্ম ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ এপ্রিল পটিয়া থানার মনসা গ্রামে। তাঁর পিতা মৌলভী আবদুস সালাম চৌধুরী, মাতা মোছাম্মৎ রাবেয়া খাতুন। তিনি মনসা প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে হাবিলাসদ্বীপ হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বপূর্ণ রেজাল্ট করে ম্যাট্রিক, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ’৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্টারমিডিয়েট ও ’৬৬ খ্রিস্টাব্দে ডিগ্রি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।
হাইস্কুল জীবন থেকেই তাঁর ছাত্র রাজনীতির সূচনা। তৎকালীন সামরিক শাসনামলে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন এবং স্কুল শাখার কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ’৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে বছরই শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে প্রথম কারাভোগের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। পরবর্তীকালে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হয়ে আবারো কারাবরণ করেন। ১৯৬৮-৬৯ মেয়াদে তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, মোখতার আহমদ সভাপতি ।
ছাত্রলীগ সম্পাদক হওয়ার পর এসএম ইউসুফ পুনরায় গ্রেফতার হয়ে কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ১ মাস পর মুক্তি লাভ করে দেশরক্ষা আইনে জেলগেটের সামনে থেকে আবারো গ্রেফতার হন। মুক্তি পান ’৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানকালে। জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদক হিসেবে সংগঠনের মুখপত্র সাময়িকী সম্পাদনা করেন। তিনি নূরে আলম সিদ্দিকী-শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত এই কমিটির স্থায়িত্ব ছিল।
বাগ্মিতায়, সাংগঠনিক দক্ষতায়, আলাপচারিতায়, প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে, বুদ্ধির দীপ্তিতে, জ্ঞানে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় এস.এম. ইউসুফের কোনো জুড়ি ছিলো না। নেতৃত্বের সহজাত গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। ঢাকা-চট্টগ্রামে যখন যেখানে তিনি রাজনীতি করেছেন, নেতৃত্বের আসন তাঁর জন্য পাকা ছিলো। ঘরোয়া আলাপচারিতায়, কথকতায় তিনি অকাট্য যুক্তি, তত্ত্ব, তথ্য পেশ করে শ্রোতৃমণ্ডলীকে মুগ্ধ, মোহাবিষ্ট ও অভিভূত করে ফেলতেন।
একটা সময় তিনি চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতির নিয়ন্তা হয়ে ওঠেন, খানিকটা চট্টগ্রামের সার্বিক রাজনীতিকেও প্রভাবিত করতে সমর্থ হন। ছাত্রনেতা হিসেবে এস এম ইউসুফের খ্যাতি ও প্রভাব কতদূর পৌঁছেছিল, তা বোঝানোর জন্য কবি ও কলামিস্ট ইদরিস আলমের ছাত্রলীগে যোগদানের ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। তিনি নিজেই একদিন আমাকে এ ঘটনার কথা বলেন—
“তাঁর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবিষ্ট, “আমার ছাত্র ইউনিয়নে যাওয়ার কথা ছিল। ছাত্র ইউনিয়ন ও তৎকালীন চট্টগ্রামের জাঁদরেল ছাত্রনেতা আবু তাহের মাসুদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে শুনে আমি ছাত্র ইউনিয়ন করবো ঠিক করে ফেলেছিলাম। মাসুদ আমার সমসাময়িক হলেও রাজনৈতিক চেতনায় আমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই সময় একদিন এস এম ইউসুফের বক্তৃতা শোনার সুযোগ পাই এবং এই একটি বক্তৃতাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এস এম ইউসুফের বক্তৃতার ওজস্বিতা, তেজ, যুক্তি, রেফারেন্স, উপমা, শব্দচয়ন, বাক্যসৃষ্টির কুশলতা ও ভাবপ্রকাশের অনায়াস দক্ষতা আমার ভাবজগৎ ওলটপালট করে দিলো, মনে হল এই বক্তৃতা শোনার জন্যই এ যাবৎ আমি উৎকর্ণ হয়েছিলাম। ইউসুফের বাকচাতুর্যের যাদু ছিল, মাসুদ ম্নান হয়ে গেলেন। আমি সিদ্ধান্ত পাল্টে ছাত্রলীগে যোগদান করলাম।”
ইদরিস আলমও একজন বাগ্মী, বিতার্কিক, বিখ্যাত ছাত্রনেতা ছিলেন। পরে তিনি কলামিস্ট হিসেবেও সুখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি কবি ছিলেন। তিনি পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম শহর আওয়াী লীগের দপ্তর সম্পাদক, স্বাধীনতার পরে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এহেন রাজনীতিবিদ, বাগ্মীপ্রবর, ষাটের দশকে প্রথম সারির ছাত্রনেতা, লেখক ইদরিস আলম যদি এস এম ইউসুফের বক্তৃতা শুনে ছাত্রলীগে যোগদান করে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এসএম ইউসুফ তাঁর চেয়েও বড় নেতা ছিলেন। তখন চট্টগ্রামে আশরাখ খান, ইদরিস আলমের চেয়ে বড় ছাত্রনেতা ছিলো না।
মুক্তিযুদ্ধে এসএম ইউসুফের অবদান চট্টগ্রামের অন্য যেকোন নেতার চেয়ে বেশি। তিনি ৭১-এর পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দেয়ার পর থেকে ঘর ছেড়ে সেই যে রাজপথে নেমে এসেছিলেন, আর ঘরে ফিরে যান নি। সারাদিন মিটিং-মিছিল করে শুধু রাতে চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন।
’৭১ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ ডাকসুর ভিপি আ.স.ম আবদুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। আর এদিনই চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় এস এম ইউসুফ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগ সভাপতি শেখ মোহাম্মদ আইয়ুব বাঙালি উক্ত জনসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। এস এম ইউসুফ ছিলেন জনসভার শেষ বক্তা।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর তিনি চট্টগ্রামের বিপুল সংখ্যক ছাত্র-যুবককে নিয়ে প্রথমে পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ক্যাম্প করে থাকেন। কালুরঘাট প্রতিরক্ষা ঘাঁটির পতনের পর রামগড়ে যান। এপ্রিলে তিনি রামগড় ও ফটিকছড়ির হেঁয়াকোতে পাক আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে হরিণা ক্যাম্পে অবস্থান নেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মুজিব বাহিনীর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক অধিনায়ক নিযুক্ত হয়ে বাহিনী গঠন ও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পালনকালে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। ফটিকছড়ির খিরাম পাহাড়ে ছিল তাঁর সদর দপ্তর। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁর ডেপুটি ছিলেন যথাক্রমে স্বপন চৌধুরী ও রণবিক্রম ত্রিপুরা। মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়কদের মধ্যে একমাত্র তিনিই দেশের অভ্যন্তরে এসে বাহিনীর কার্যক্রম তদারকি করেছেন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে পর্যায়ক্রমে তিনি জাতীয় শ্রমিকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা- কেন্দ্রীয় সদস্য, উত্তর-দক্ষিণ জেলা যুবলীগ যৌথ কমিটির যৌথ আহ্বায়ক, কৃষকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, বাকশাল যুব ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল ওসমানীর নির্বাচনী কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা আহ্বায়ক; একই বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক, ’৮১ খ্রিস্টাব্দে একই সংগঠনের শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর কথায় হ্যামিলনের সেই বংশীবাদকের তুলনা এসে যাচ্ছে। এসএম ইউসুফ তেমন এক বাঁশিঅলা ছিলেন, যাঁর বাঁশির মোহন সুরে মজে ঘরছাড়া হয়েছিলাম আমরা- চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মুকুল বোস, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, খ ম জাহাঙ্গীর ও ফজলুর রহমান, বিচারপতি এনায়েত, গোলাম মহিউদ্দিন, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, শহীদ আবদুর রব, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, সালাহউদ্দিন মাহমুদ, শহীদ স্বপন চৌধুরী, ইন্দুনন্দন দত্ত, আবদুল্লাহ হারুন, জালালউদ্দিন আহমদ, ওসমান গণি খান, আনোয়ারুল আজিম, রণবিক্রম ত্রিপুরা (গৌতম দেওয়ান ও মণিস্বপনও কী?), রবিউল হোসেন কচি, এডভোকেট জসিম উদ্দিন খান, চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক জিএস বোরহান উদ্দিন আহমদ, চাকসু’র সাবেক জিএস জমির চৌধুরী, প্রফেসর শওকত হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, জাতীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারমান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম, জাতীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, জামশেদুল আলম চৌধুরী, সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান ও স্বদেশ রায়, সাবেক কাউন্সিলর তারেক সোলায়মান সেলিম, সাবেক কমিশনার জালাল উদ্দিন ইকবাল, মশিউর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারমান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, অধ্যাপক মোহাম্মদ মইনুদ্দিন, পটিয়ার শামসুদ্দিন আহমদ, মরহুম বদিউর রহমান, আফজল ভাই, মোহাম্মদ আলী ভাই, আবু সিদ্দিক ভাই, নুর মোহাম্মদ সিদ্দিকী, অধ্যাপক আবু জাফর চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, শামসুল আলম, তসলিম মাহবুব, মাহফুজুর রহমান খান, এম এ জাফর, কাজী আবু তৈয়ব, এম এন ইসলাম, এমএন ইসলাম, আ ক ম শামসুজ্জামান, হাফেজ আহমদুল হক, এ কে এম আবদুল মতিন চৌধুরী, নুরুল আফসার চৌধুরী, নুরুল ইসলাম, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, রফিক আহমদ, মোহাম্মদ রফিক, আমেরিকা প্রবাসী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী, আবু তাহের বাঙালি, স্বপন চৌধুরী, মোহাম্মদ ইউসুফ, হামিদুল হক, আবুল হাশেম, মাহবুবুল আলম, চৌধুরী মাহবুবুর রহমান, বোয়ালখালীর আ হ ম নাসিরউদ্দিন, আবুল হোসেন, আহমদ হোসেন, সেলিম, আবুল মনসুর চৌধুরী, নুরুল আলম, আবদুল মান্নান —মধ্যষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত তাঁর হাতে দীক্ষিত হয়েছেন অগণন মানুষ, কতজনের নাম বলবো, সবার নাম আমার জানাও নেই। সেজন্য তাদের কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
এসএম ইউসুফ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁর জয়ের সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু নানা কারণে তাঁর জয় হাতছাড়া হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের জন্য এস.এম. ইউসুফের অবদান অপরিমেয়। সে তুলনায় দলে তাঁর মূল্যায়ন হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন এটাই তাঁর মরণোত্তর স্বীকৃতি।
কিন্তু জীবিতকালে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। এক সময় তিনি অভিমানাহত হয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। সেই অভিমান নিয়েই কী তিনি চলে গেলেন চিরতরে?
এস.এম. ইউসুফ বিভিন্ন সমাজকল্যাণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির ও পটিয়া সমিতির উপদেষ্টা কমিটির সদস্য, মনসা হাইস্কুল ও কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য, হাবিলাসদ্বীপ হাই স্কুলের আজীবন সদস্য। তিনি একাধিক সম্মাননা, সম্বর্ধনা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর সখ ছিলো বই পড়া ও গান শোনা।
এসএম ইউসুফের জীবনে একটি আধ্যাত্মিক পর্ব আছে। তিনি জীবনের শেষদিকে কুতুবদিয়ার আধ্যাত্মিক সাধক মালেক শাহ’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং মালেক শাহ’র মৃত্যুর পর সবান্ধবে কুতুবদিয়ায় তাঁর কবর জেয়ারতে যাতায়াত, মাঝিরঘাটে মালেক শাহ’র আস্তানায় জিকির, ওয়াজ-মাহফিলে নিয়োজিত থাকতেন।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পুনর্বার তিনি গ্রেফতার হয়ে কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ১ মাস পর মুক্তি লাভ করে দেশরক্ষা আইনে জেলগেটের সামনে থেকে আবারো গ্রেফতার হন। মুক্তি পান ’৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানকালে।
তিনিই প্রথম মুজিববাদের বুকলেট প্রণয়ন করেন, বুক প্রমোশন থেকে যার ১ লাখ কপি ছেপে দেশের সব জেলায় বিলি করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্মারকগ্রন্থেরও তিনি সম্পাদনা করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আমির হোসেনের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক পদক্ষেপ নামে একটি পত্রিকার প্রকাশক মুদ্রক ছিলেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের পট পরিবর্তনকালে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ সময় ‘শামীম ভাই’ ছদ্মনামে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের র্যাঙ্ক এন্ড ফাইলে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য যে সাংগঠনিক তৎপরতা চালান, তার কোন তুলনা হয় না। চট্টগ্রামে মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে তিনি একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে ভারতে পাঠিয়ে ট্রেনিং দিয়ে তাদেরকে নিয়ে চট্টগ্রামে এসে বিভিন্ন অপারেশন করেন। ভারতে রাজনৈতিক পদ পরিবর্তন হওয়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধ মাঝ পথে বদ্ধ হয়ে যায়। এরপর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠন করার জন্য তিনি সারাদেশে চারণের ন্যায় ঘুরে বেড়ান। তখন দলের হাল ধরার জন্য তিনি ছাড়া আর কোন সিনিয়র নেতা ছিলেন না। এর পরই দল পুনরুজ্জীবিত হলে এস এম ইউসুফকে বিভাগীয় সম্পাদক পদে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এস এম ইউসুফ স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ করলেও তিনি সব সময় ছাত্র ও যুব সমাজের নয়ন মণি ছিলেন।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি পটিয়া থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বুলগেরিয়া সফর করেন। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউএই, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।
জনাব এস.এম. ইউসুফ বিভিন্ন সমাজকল্যাণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির ও পটিয়া সমিতির উপদেষ্টা কমিটির সদস্য, মনসা হাইস্কুল ও কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য, হাবিলাসদ্বীপ হাইস্কুলের আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি বহু সম্মাননা, সম্বর্ধনা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর সখ ছিলো বই পড়া ও গান শোনা।
১৫ নভেম্বর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে এস এম ইউসুফের অসামান্য গৌরবময় জীবনের উপর যবনিকাপাত ঘটে।








