ভারত একটি জুজু, কিছুদিন পর পর এই জুজুর ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। আগের দিনে যেমন পাড়া গাঁয়ের মা-বোনেরা বর্গীর ভয় দেখিয়ে দুষ্টু ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়াতেন।
যদিও ভারতের সাহায্য না পেলে আমরা স্বাধীন হতে পারতাম না, তবুও স্বাধীনতার পর থেকে সেই দুর্দিনের বন্ধু রাষ্ট্র এবং তার জনগণকে আমরা কিভাবে শত্রু ভেবে গালি দিতে শুরু করলাম, আমি ভেবে কুলকিনারা করতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের কথা স্বীকার করলে যদি ভারতের দালাল হতে হয়, তাহলে আমি একশবার ভারতের দালাল হতে রাজি। শুধু ভারত সরকার নয়, ভারতের মানুষ যাঁদেরকে আমরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হিন্দু বলে ঘৃণা বা হিংসা করি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানও অপরিসীম। জনগণের সমর্থন না থাকলে ভারত সরকার কখনই বাংলাদেশের শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করতে পারত না। বহু স্থানে যেখানে শরণার্থীরা গেছেন, তাদেরকে ভারতের মানুষ নিজেদের বাসাবাড়িতে ঠাঁই দিয়ে নিজেরা কষ্ট করে ঘুমিয়েছেন। এমন সব বাসা, যেখানে ছোট একটি পরিবার ঠাসাঠাসি করে বসবাস করে, সেসব বাসায়ও শরণার্থীরা আশ্রয় পেয়েছেন। গৃহস্বামী কিংবা তার সন্তানেরা ঠাঁয় বসে বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন, এমন দৃষ্টান্তও দুর্লভ নয়।
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার, তাদের কর্মকর্তা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিভিন্ন সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার, সেক্টর প্রশাসনের কর্মকর্তারা এবং মুজিব নগর সরকারের প্রশাসনের কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আশ্রয় দিয়ে তাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির খুলে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করায় ভারত সরকারকে আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আমেরিকা, চীন ও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড বিরোধিতা তো ছিলই। এমন অবস্থা হয়েছিল যে, ভারত কূটনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবুও ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে সাহায্যের হাত উঠিয়ে নেয়নি।
শুধু আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ নয়, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আবদুল্লাহ-আল-হারুন প্রভৃতি আওয়ামী লীগ নেতারাই নন, মওলানা ভাসানী, কমরেড মণি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমদ প্রভৃতি ন্যাপ ও কমিউনিস্ট নেতারাও মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মোজাফফর ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের জন্য আগরতলায় ক্রাফটস হোস্টেলে শেল্টার এবং তেজপুরে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ভারত সরকার। জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল খালেদ মোশাররফ, জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, কর্নেল আবু তাহের, জেনারেল আবুল মনজুর, মেজর রফিকুল ইসলাম, কর্নেল জাফর ইমাম বীর বিক্রম, মেজর হাফিজ উদ্দিন, ব্যারিস্টার শাহজাহান উমর এবং মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তাগণ প্রত্যেকেই তো ভারতে ছিলেন। বিপদের সময় ভারত ভালো, বিপদ থেকে উদ্ধার হলে ভারত খারাপ-এই মানসিকতা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য। ভারত আশ্রয় না দিলে ১ কোটি শরাণার্থী, মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান আর্মির হাতে কচুকাটা হয়ে যেতেন। এই কথাটা মানে রাখলে ভারতকে আর খারাপ মনে হবে না।
কিন্তু তাদেরকে কেউ ভারতের দালাল বলে না, শুধু আওয়ামী লীগের নামেই ভারতের দালালির যত অভিযোগ। সব সরকারই ভারতের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে দেশ পরিচালনা করেছে। জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা কেউই ভারতকে চটিয়ে দেশ শাসন করেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী কাদের সিদ্দিকী, মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, এস এম ইউসুফ প্রমুখ যুবনেতা যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যুদ্ধ করার জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের ইনসারজেন্সি বন্ধ করার জন্য জিয়াউর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে যুদ্ধ বন্ধ করে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন। শুধু মৌলভী সৈয়দ দেশে ফিরে এসেও মা-বাবার কোলে ফিরে যেতে পারেননি। তাঁকে সীমান্ত থেকে আটক করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।
আমি এমন কথাও শুনেছি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে মুখ্য ভূমিকা পালন করায় ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ-রাজ্যসভা ও লোকসভার যৌথ অধিবেশনে কর্নেল অলির জন্য ধন্যবাদ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। তাঁর জন্মদিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিনন্দন জানিয়েছেন। আর এটা তো জানা কথাই যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয়তা পার্টি ও জামায়াত নেতারা তাদের ছেলেমেয়েদের ভারতের ভাল ভাল স্কুলে পড়ান এবং চিকিৎসার জন্য ভারতের হসপিটালে ভিড় জমান। সেটা তখন ভারতের দালালি হয় না।
পৃথিবীতে এক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্যদেশের সাহায্য করার দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ের পর সাহায্য প্রদানকারী দেশের সৈন্যবাহিনী সহজে ফিরে আসার দৃষ্টান্ত খুব নেই। ভারতই একমাত্র দেশ, যে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের পূর্বেই বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে ভারতে ফেরত নিয়ে গিয়েছিলেন। এই কথাটাও বাংলাদেশের মানুষ ভুলে গিয়েছিল। ভারতের নিঃস্বার্থ সাহায্যের জন্য যেখানে ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকাই উচিত ছিল, আমরা সেখানে কৃতঘ্ন হয়ে ভারতকে গালাগালি দিতে শুরু করলাম। হিন্দুদের জাত তুলে শাপান্ত করতে থাকলাম।
শেখ হাসিনা দেশান্তরী হওয়ার পর বাংলাদেশে আবার সেই পুরোনো কায়দায় ভারত বিরোধিতার জিগির শুনতে হল। তিস্তার পানি, সীমান্ত সংঘর্ষ, ট্রানজিট, ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ভারত বিরোধী এক নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টির কম চেষ্টা হয়নি। ভারতের শত্রু পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে সখ্যতার হাবভাব দেখিয়ে ভারতকে বিরক্ত করার চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে দহরম মহরম তো আছেই।
চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম বন্দর এমন একটি কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থানে অবস্থিত যার প্রতি বৃহৎ শক্তি এবং আঞ্চলিক পরাশক্তির লালায়িত জিহ্বা থেকে লোভে লালা ঝরে ঝরে পড়ছে। বর্তমান বিশ্বের মোড়ল আমেরিকার শ্যেন দৃষ্টি বহুদিন থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরের প্রতি নিবদ্ধ। সেই সত্তরের দশকেই আমেরিকা বঙ্গবন্ধুর কাছে নিঝুম চট্টগ্রামের ইজারা চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু রাজি হননি, সেজন্য বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হয়েছে। তাতেই কমেনি আমেরিকার গোস্বা; আরো অর্ধশতাধিক বছর পরে এসে তাঁর কন্যাকেও তার মাশুল গুণতে হয়েছে।
অবশ্য ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্টিভিডোর সার্ভিসেস অব আমেরিকা (এসএসএ) প্রস্তাব দেয় চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি বন্দর নির্মাণ করার জন্য। বাংলাদেশ সরকার ও এসএসএ-এর মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের জন্য আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই চুক্তিকে দেশের স্বার্থপরিপন্থী এবং অসম উল্লেখ করে চট্টগ্রামের মেয়র ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত ২২টি সংগঠন তুমুল আন্দোলনে নামে। তারা হাইকোর্টে একটি মামলাও দায়ের করেন, সেই মামলার প্রধান কৌশুলী ড. কামাল হোসেন বিদেশ থেকে কাগজপত্র এনে প্রমাণ করে দেখান যে, নেদারল্যান্ডে রেজিস্ট্রিকৃত এসএসএ একটি ভুয়া সংগঠন। ড. কামাল হোসেন আদালতের রায় পান। অন্যদিকে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত এই চুক্তিটি বাতিল করা হয়।
আমেরিকা শেখ হাসিনার কাছেও সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইজারা চেয়েছিল। তিনি তো বাপের বেটি, তিনিও আমেরিকার মুখের ওপর না করে দিলেন। ফল হলো তাঁকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে আমেরিকার পছন্দের মানুষ ড. ইউনূসকে একটি পুতুল সরকার করে দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আমেরিকাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র অভ্যুত্থানের মদদ জুগিয়েছিল এবং অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর ইউনূস সরকারের কাছ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইজারা চুক্তিতে নাকি সই করিয়ে নিয়েছে।