মঞ্জু ভাইয়ের (অধ্যাপক নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু) পরবর্তী ছোট ভাই বাবুল ভাইয়ের (সালাহউদ্দিন আহমদ) অসুস্থ স্ত্রী সাহেদা ইউনুছকে দেখার জন্য দেওয়ানবাজরস্থ এম এ আজিজের বাসায় গিয়েছিলেন মাহফুজ ভাই; দেখে এসে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সোলায়মান খান, মশিউর রহমান খান, সুজাউদ্দৌলা বাবুলও গিয়েছিলেন। মাহফুজ ভাই এখন এই কাজটি রুটিন ধরে করেন; স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ ও জাসদ নেতাদের কেউ অসুস্থ হয়ে বাসায় শয্যা গ্রহণ করলে কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ পেলে তাঁদেরকে দেখতে যেতে মাহফুজ ভাই’র কখনো ভুল হয় না। তিনি এটাকে একটি কর্তব্যকর্ম হিসেবে নির্ধারণ করে নিয়ম করে ফেলেছেন। জাসদের জন্য মঞ্জু ভাই এবং তাঁর পরিবারের অবদানের কোন তুলনা হয় না।
চট্টগ্রামে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের একটি অস্থির গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের ভাঙন এবং জাসদের গঠনকালে মঞ্জু ভাই একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। মঞ্জু ভাই না হলে চট্টগ্রামে জাসদ প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে যেত। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, সেটা ছেড়ে জাসদ গঠন প্রক্রিয়য় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডবলমুরিং আসনে জাসদের প্রার্থী হয়ে লড়েছিলেন। দেশ এবং ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর যে অবস্থান, চট্টগ্রামে এম এ আজিজেরও তেমনই অবস্থান। এম আজিজ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং স্বাধীনতা-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগকে এনডিএফ থেকে বের করে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা এম এ আজিজের সহযোগিতা ছাড়া সফল হওয়া দুঃসাধ্য ছিল। এম আজিজ ৬ দফা সমর্থন করে ৬৬ খ্রিস্টাব্দর ১৩ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান না করলে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা জন্মেই অপমৃত্যু বরণের আশঙ্কা ছিল। বঙ্গবন্ধুই এম এ আজিজকে বলেছিলেন, তোমরা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ থেকে একটা বিবৃতি দাও, নইলে আইয়ুব খাঁ ৬ দফা নিষিদ্ধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করে বিচার শুরু করতে পারে। তিনি তাঁর বন্ধু ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেনকেও বলে দিয়েছিলেন, তাঁর চট্টগ্রাম অফিসের প্রধান মঈনুল আলমকে বলার জন্য, তিনি যেন এম এ আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবৃতি সংগ্রহ করে নিউজ করে ঢাকায় পাঠান। এম এ আজিজ নিজে এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুন, এ কে এম আবদুল মন্নান এবং চট্টগ্রাম কপ তথা সম্মিলিত বিরোধী দলের আহ্বায়ক আবুল কাশেম সাবজজের স্বাক্ষর নিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ’৬৬ ইত্তেফাকে ঐ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। এম এ আজিজ প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকের বিরোধিতা এবং যোগদান প্রতিহত করেছিলেন। এ ব্যাপারে বেগম মুজিবও তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন। এম এ আজিজই প্রথম এক দফার কথা বলে প্রকারান্তরে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন।
সুতরাং চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ মহলে এম এ আজিজের ব্যাপক প্রভাবের কথা চিন্তা করেই চট্টগ্রামে জাসদের উদ্যোক্তারা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে মঞ্জু ভাইকে জাসদে নিয়ে এসেছিলেন। মঞ্জু ভাই বয়সে আমাদের বেশ বড়, যে কারণে তাঁর কাছে দেখাসাক্ষাতের জন্য তাদের বাসায় যেতে যেতে তাঁর ছোট ভাই বাবুলের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। মঞ্জু ভাই বাসায় থাকলে বা না থাকলে বাবুলই আমাদের টেক কেয়ার করতো। এ কারণে তাঁদের পরিবারের যে কোন সদস্যের বিপদ আপদ, রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার খবরে আমরা চট্টগ্রামের জাসদ নেতা-কর্মীরা উদ্বিগ্ন হই, শঙ্কিত হই।
মাহফুজ ভাই সে কারণেই বাবুলের অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে গেছেন। তিনি আরোগ্যের পথে শুনে স্বস্তি বোধ করছি এবং পরম করুণাময়ের কাছে আশু নিরাময়ের জন্য প্রার্থনা করছি।
প্রসঙ্গক্রমে আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে নিবিড় অন্তরঙ্গতায় অঙ্গীভূত যেসব তথ্য আহরণের চেষ্টা করলাম, তা সম্ভবত বঙ্গবন্ধু’র প্রচলিত জীবনীগ্রন্থে পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর জীবনী গবেষক ও লেখকরা হয় এসব তথ্যের সন্ধান পাননি, পেলেও হয়তো গুরুত্ব দেননি। অথবা চট্টগ্রামের ঘটনাকে এত গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই মনে করে পাশে সরিয়ে রেখেছেন। তাতে যেটা ক্ষতি হয়েছে সেটা হলো তাঁদের বইয়ের পাঠকরা খণ্ডিত ইতিহাস পেলেন, পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানতে পারলেন না।
এম এ আজিজ প্রসঙ্গে যে তিনটি ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করলাম, সেগুলি তো আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; ৬ দফা সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান, বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে যেতে বাধা প্রদান এবং এক দফার বক্তব্য। আরো একটি ঘটনা আছে, যে ঘটনায় এম এ আজিজের সাহসী ভূমিকা আওয়ামী লীগ ও ৬ দফাকে রক্ষা করেছিল। সেটি হলো ৬ দফাকে বানচাল করার জন্য সরকারের সাথে যোগসাজশে আওয়ামী লীগের আপসকামী সুবিধাবাদী অংশ পিডিএম গঠন করে ৮ দফা দিয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এম এ আজিজ চট্টগ্রাম থেকে কয়েকশ’ কর্মী এবং ঢাকা থেকে শ্রমিক নিয়ে কাউন্সিল ঘেরাও করে পিডিএম-ওর ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।