বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫, ৪ আষাঢ়, ১৪৩২, ২১ জিলহজ, ১৪৪৬

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

সংখ্যালঘুদের কি অপরাধ

সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু ভেদাভেদ কেন বাংলাদেশে? এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না এদেশে। পাকিস্তানে ছিলো। যে দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো হিন্দু ও মুসলমান দুই জাতি তত্তে¡র ওপর ভিত্তি করে, সে দেশে হিন্দু, মুসলিম ভেদাভেদ অস্বাভাবিক ছিলো না। যদিও দ্বি-জাতি তত্তে¡র প্রবক্তা ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমরা একটি পোকায় খাওয়া দেশ পেয়েছি। আজ থেকে আমরা কেউ আর হিন্দু নই, মুসলমান নই, আমরা সবাই পাকিস্তাকি। আমরা সবাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক’। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দ্বি-জাতি তত্তে¡র ফেরি করে তিনি যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, সেটি তখন বড় হয়ে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে গেছে। জিন্নাহ সাহেবেরও সাধ্য ছিলো না তাকে উপড়ে ফেলার।
৪৬-এ কলকাতা-নোয়াখালী ও ৪৭-এ পাঞ্জাব লক্ষ লক্ষ নরনারী শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার রক্তে ভেসে যাবার পর শান্তির ললিতবাণী তখন পরিহাসের মতই শোনাচ্ছিলো। নোয়াখালীর দাঙ্গা থামাতে গান্ধীজী নোয়াখালী এসেছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও চট্টগ্রামের বিপ্লবী বীণা দাসও তখন নোয়াখালী এসেছিলেন। অতএব, ৪৭-এ দেশভাগের সময় দেশত্যাগের সুযোগ থাকা সত্তে¡ও যেসব হিন্দু জন্মভ‚মির মায়া কাটাতে না পেরে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ঘৃণা ও বিদ্বেষের পাত্র হয়ে থেকে গিয়েছিলো, ৭১-এ পাকিস্তানের কবর রচনা করে পূর্ববঙ্গ বাংলাদেশ না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে সংখ্যাগুরু মুসলিম বাঙালির নিগ্রহ ও করুণার ওপর ভিত্তি করেই বেঁচে থাকতে হয়েছিলো। এই পরিস্থিতির ততক্ষণ অবসান হয়নি, যতক্ষণ না ফরিদুপর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গীপাড়া গ্রামের শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমান নামক এক বঙ্গসন্তান ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত পূর্ববঙ্গবাসীকে বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বাঙালি হিসেবে সংগঠিত করে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তীরের সুজলা, সুফলা, শষ্য-শ্যামলা ভ‚মিকে বাংলাদেশে রূপান্তরের জন্য রক্তাক্ত সংগ্রাম আরম্ভ করেননি।
বঙ্গবন্ধু জিন্নাহর হিন্দু-মুসলিম দুই জাতিতত্তে¡র বিপরীতে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-এক জাতি অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তার তত্ত¡ উপস্থাপন করলেন। তিনি বললেন, ধর্ম কখনো জাতীয়তার ভিত্তি হতে পারে না। অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যই জাতীয়তার সূত্র।
হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পরিচয়ে এই ভ‚মিতে বসবাসকারী বাংলা মায়ের সন্তানদের কাছে তাদের জাতীয় পরিচয় উন্মোচন করে মুজিব তাঁদের মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার চেতনা সঞ্চারিত করেছিলেন। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে সেই কর্মসূচির ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। পূর্ববঙ্গের (পূর্ব পাকিস্তান) স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রাজপথে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। দ্বিজাতিতত্তে¡র সা¤প্রদায়িক রাজনীতির পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তার অসা¤প্রদায়িক রাজনীতি জনচেতনায় দৃঢ়মূল হতে থাকে।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সরকারের ভেদনীতিতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে বঙ্গবন্ধু কিভাবে এক মোহনায় মিলিত করে বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণ করেছিলেন? ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মুসলিম লীগের পাল্টা সংগঠন হিসেবেই আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিলো। সংবাদপত্রে নতুন দল গঠনের নিউজ বের হয়েছিলো ‘কাউন্টার মুসলিম লীগ ফরম্ড্’ শিরোনামে।
প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থার কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৩ সালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৫৫ সালে পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক হয়ে প্রথমেই দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জন করে আওয়ামী লীগ গঠন করেন এবং আওয়ামী লীগ সর্বধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু আর একটা কাজ করেছিলেন, সেটার ফল হয়েছিলো সুদূরপ্রসারী এবং বাঙালি জাতিসত্তা গঠনের পরিপূরক। সেটা হলো পাকিস্তান আমলে দোয়া দরূদ পড়ে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ বলে মুসলিম লীগ রাজনৈতিক সভা সমাবেশ আরম্ভ করতো। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান, গীতা, ত্রিপিঠক ও বাইবেল থেকে পাঠ করার রেওয়াজ প্রবর্তন করেন। এতে চার ধর্মের মানুষের এক মোহনায় মিলিত হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছিলো। তারপর পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যের অবসানের জন্য বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা ঘোষণা করেন; তখন সেই কর্মসূচির ভিত্তিতে সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবোধ থেকে জাগ্রত বাঙালি জাতিসত্তার আত্মবিকাশের প্রয়োজনীয়তা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা মূর্ত করে তোলে। সুতরাং ৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য বাঙালি যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো, তার পরিণতিতে ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আবিভর্‚ত বাংলাদেশ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। সেখানে লেশমাত্রও সা¤প্রদায়িকতার উপাদান ছিলো না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সব ধর্মাবলম্বী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। ধর্মগত কোন ভেদাভেদ তখন ছিলো নাÑবাঙালি জাতিচেতনা সমগ্র জাতিকে এক অবিচ্ছেদ্য, অবিচ্ছিন্ন, অবিভাজ্য সত্তায় রূপান্তরিত করেছিলো।
এই বাঙালি জাতিসত্তা আবার স্বাধীন বাংলাদেশে কিভাবে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি জমানার ন্যায় হিন্দু, মুসলমান দুই জাতি হয়ে গেলো ? বাংলাদেশের রাজনীতির এ এক হেঁঁয়ালি, বিরাট প্রহেলিকা। অভিন্ন নৃতাত্তি¡ক দৈহিক গঠন ও গড়ন নিয়েও বাঙালি জাতির দুই বিরাট উপাদান হিন্দু ও মুসলমান ধর্মীয় পরিচয়ে দ্বিধাবিভক্ত কিভাবে হয়ে গেলো আমি বুঝতে পারি না।
শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতিসত্তার দুই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিন্দু ও মুসলমান ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৫০, ১৯৭১-এর দাঙ্গাকালীন সময়ের ন্যায় পরস্পরকে শত্রæ জ্ঞানে হিংসা করতে থাকলো। এই হিংসার পথ ধরে সৃষ্টি হলো সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু চেতনা। বাঙালিকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে বিচার বা গণনা করলে কেউ হয় সংখ্যাগুরু, কেউ সংখ্যালঘু। যেহেতু এদেশে মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি, সেজন্য তারা সংখ্যাগুরু, আর হিন্দুরা সংখ্যায় কম, সেজন্য তারা সংখ্যালঘু। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে অখÐ জাতিসত্তাকে খÐ বিখÐ করলেই না সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু হয়। কিন্তু তাই বা কেন করা হবে? মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে অসহযোগ আন্দোলনের সময়, নির্বাচনের সময়, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় অখÐ-জাতিসত্তাই তো ছিলো। তখন তো হিন্দু, মুসলমান ভেদ ছিলো না। বাঙালি এক জাতিসত্তায় রূপান্তরিত হয়ে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলো। জাতিসত্তা পরে ভেঙে ধর্মের পরিচয়ে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান হয়ে গেলো কেন? এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে শেষ হয়ে যাওয়ায় সময়ের অগ্নি পরীক্ষার কষ্টি পাথরে আমাদের দেশপ্রেমের চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হতো, পাঁচ-দশ বছর প্রলম্বিত হতো, তাহলে আমরা সবাই ধৈর্য্য ধরে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারতাম কিনা তা তো যাচাই করার সুযোগ পাওয়া গেল না। আমাদের ব্যক্তিগত ও পরিবারিক জীবন চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতো, সে পরিস্থিতিতে কেউ কেউ ভেঙে পড়তো কি না সেটাও তো দেখা হলো না। যুদ্ধের ময়দানে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে পাশাপাশি অবস্থান করে লড়াই করতে করতে সা¤প্রদায়িক চেতনার হয়তো অবলুপ্তি ঘটতে পারতো। নয় মাসের মধ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ায় আমাদের মনের, চেতনার পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা বাহ্যত বাঙালি হয়েছিলাম, কিন্তু অন্তরে হিন্দু বা মুসলমানই থেকে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে হয়তো যুদ্ধের আগুনে পুড়ে আমরা খাঁটি বাঙালি হতে পারতাম।
এই পরিস্থিতির কথা ভেবেই বোধ করি চিনে ১৯৪৯ সালে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার এক দশক পর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধ্বনি উঠেছিলো।
জাতিসত্তার মুক্তির প্রশ্ন যখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিলো, তখন হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম সম্প্রদায়গত বিভেদ গৌণ হয়ে হয়েছিলো। অভিন্ন জাতীয় শত্রæর মোকাবেলায় একে অপরের প্রতি যুগসঞ্চিত সন্দেহ, অবিশ্বাস, হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছিলো উভয় সম্প্রদায়। কিন্তু মনের গহীন কোণে, অবচেতনে তা’ চাপা পড়ে ছিলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অভিন্ন জাতীয় শত্রæ যখন সামনে থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেল, অবচেতন মনে সুপ্ত অবস্থায় চাপা পড়ে থাকা পুরোনো বিরোধগুলি আবার মাথাচাড়া গিয়ে উঠতে থাকলো। স্বাধীনতার পর যদি গণচিনের মতো একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করা হতো, তাহলে হয়তো হিন্দু-মুসলিম বৈরিতার চির অবসান ঘটতে পারতো। সাংস্কৃতিক বিপ্লব মানে সংস্কৃতি চর্চা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করা। এখনো যদি পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণ উৎসব, আমের আঁটি বাঁধার কালে কচি আম ভর্তা করে বা এমনি খাওয়ার উৎসব, গ্রামে গ্রামে ঐতিহ্যবাহী বলীখেলা ও মেলার নবায়ন, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উদযাপন, জ্যৈষ্ঠ মাস মধু মাসে পাকা ফলের মধুর রসে মুখ রঙিন করার উৎসব, বর্ষাকালে বর্ষামঙ্গল উৎসব, শরৎকালে প্রভৃতির শান্ত শ্রী রূপের আরাধনায় শারদোৎসব আয়োজন, পৌষ মাসে গোলায় নতুন ধান উঠলে নতুন ধানের গন্ধে মৌ মৌ করে কৃষকের দাওয়া, উঠোনে শুকানো ধান ঝাড়াই-মাড়াই, ঢেঁকিতে ধান ছাটা, চালের গুঁড়ি আর গুড় বা চিনি দিয়ে পায়েস, পাটিসাপটা, ভাপা পিঠা, পাক্কন, পাঁইচ পিঠা, গুড়া পিঠা ইত্যাদি পিঠা, পুলির উৎসবে মেতে উঠে যখন গ্রাম বাংলা-শহরে নাগরিক জীবনে পিঠা উৎসব বা নবান্ন উৎসবের আয়োজন, মাঘে প্রচÐ হাড় কাঁপানো শীতে যখন বাঘ ডাকে, বাড়ির পাশে গাদাগাদি করে রাখা খড়ের কুঁড়েতে গা ডুবিয়ে শীতের মিষ্টি নরম রোদে ওম নিতে নিতে কৃষকের অলস সকাল আনন্দে ভরে থাকে, তখন শহুরে জীবনেও কোন উন্মুক্ত প্রান্তরে কিংবা তরুলতার সান্নিধ্যে আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতায় মাখামাখি হতে হতে শৈশব-কৈশোরের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতির জাবর কাটতে কাটতে মাঘ্যেৎসবের আয়োজন, ফাল্গুনে বসন্তোৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি চেতনা সঞ্চারিত করে ক্ষুদ্রতা, নীচতা, সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিভেদের অবসান ঘটানো যেতে পারে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রবারণা পূর্ণিমায় একটা সাংস্কৃতিক উৎসবের গন্ধ পাই আমি। রাতের আকাশে যখন বৌদ্ধ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা ফানুস উড়িয়ে দেয়, তখন জ্বলন্ত ফানুসের অগ্নিশিখা রাতের আকাশকে বর্নিল আলোকছটায় উদ্ভাসিত করে তোলে। মুসলমানদের এই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে কোন বাধা দেখি না।
কক্সবাজার, মহেশখালীর রাখাইন এবং বান্দরবানের মারমারা নববর্ষের উৎসবকে রঙিন করে তোলে পানি খেলার আয়োজনে করে। সুন্দর, ঝলমলে পোষাক পরিহিত পরীর ন্যায় রাখাইন তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের দিকে পানি ছুঁড়ে যখন জলকেলি করে তখণ স্বর্গ যেন মর্ত্যে নেমে আসে। হিন্দু-মুসলিম সবাই এই উৎসবের রঙে নিজেদেরকে রাঙিয়ে তুলতে পারে।
পাহাড়তলী মহামুনি মন্দিরে নববর্ষে উপলক্ষে বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবের যেটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সেটা হলো, প্রাচীনকালের পারস্য দেশের (ইরান) স্বয়ম্ভর সভার মতো এখানে বিয়ের উপযুক্ত তরুণ-তরুণীরা মন্দিরকে মাঝখানে রেখে চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। ঘোরার মধ্যেই পাত্র-পাত্রী পছন্দ হয়ে যায় এবং তরুণ-তরুণী বা যুবক-যুবতীরা নিজ নিজ মনোনীত পাত্র বা পাত্রীর গলায় মালা দিয়ে বাগদানের কাজ সেরে ফেলে। এখানে একটি শতবর্ষী বুড়ি গাছও আছে, মানস করে অনেকেই গাছে রেশম সূতা বেঁধে দেয়। এ উপলক্ষে একটি মেলাও হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হলেও এর একটি সার্বজনীন দিকও আছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ মহামুনির মন্দিরের এই উৎসব ও মেলায় ভিড় করে।
হিন্দুদের নিয়েই যেহেতু সাম্প্রদায়িক সংকট সৃষ্টি হয়, তাই ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সফর বিনিময় কর্মসূচি গ্রহণ করলে দু’দেশের মানুষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটতে পারে। শুধু ভারত নয়, নেপাল, মায়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডের সঙ্গেও সাংস্কৃতিক সফর বিনিময় করা যেতে পারে।
আমাদের একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের মিলিত ঐতিহ্য। কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারকÑ যাঁরা আমাদের সমাজ, সভ্যতা ও রাষ্ট্র নির্মাণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান রয়েছেন, তাঁদের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি জোরদার হবে। উদাহরণ স্বরূপ আমি এখানে কিছু নাম উল্লেখ করছিÑকলকাতার রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ার, চট্টগ্রামের ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর, শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, যাত্রামোহন সেন, মহিমচন্দ্র দাশ, শরচ্চন্দ্র দাশ, ড. বেনীমাধব বড়–য়া, মহাকবি নবীন চন্দ্র সেন, শাহ বদিউল আলম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নীহাররঞ্জন রায়, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, জসিমউদ্দিন-আশুতোষ চৌধুরী, আচার্য যদুনাথ সরকার, আর সি মজুমদার-রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-তপন রায় চৌধুরী-সুখময় মুখোপাধ্যয়, ড. আহমদ শরীফ, ড. এ বিএম হাবিবুল্লাহ-ড. এ আর মল্লিক-ড. সালাহউদ্দিন আহমদ-ড. আবদুল করিম; মোহিতলাল মজুমদার-শশাঙ্কমোহন সেন-শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-ক্ষিতিমোহন সেন-শশিভ‚ষণ দাশগুপ্ত-আবদুল হাই-কাজী আবদুল ওদুদ-আবুল ফজল-মুনীর চৌধুরী-আনিসুজ্জামান-সৈয়দ আলী আহসান, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু-এ কে ফজলুল হক-শহীদ সোহরাওয়ার্দী-মওলানা ভাসানী-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড মণি সিং, রাসবিহারী বসু-বাঘা যতীন-ভগত সিং-মাস্টারদা সূর্য সেন-ক্ষুদিরাম-মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী-বিনয়-বাদল-দীনেশ-কানাই- অনন্ত সিং-গণেশ ঘোষ-লোকনাথ বল-প্রীতিলতা-কল্পনা দত্ত; উদয়শঙ্কর-বুলবুল চৌধুরী-রুনু বিশ^াস; সোমনাথ হোর-নভেরা আহমদ-সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ; ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, সুরকার হিমাংশু দত্ত, শচীন দেববর্মণ, ঠাকুদা-খ্যাত সুরেন্দ্র লাল দাশ, কমল দাশগুপ্ত, পÐিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, আব্বাসউদ্দিন, নির্মলেন্দু চৌধুরী, লালন শাহ, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, মান্না-হেমন্ত-সন্ধ্যা-লতা মঙ্গেশকর, সত্য সাহা-আবদুল জব্বার-আঞ্জুমান আরা-নীলুফার ইয়াসমিন-রুনা-সাবিনা; সত্যজিৎ রায়-মৃণাল সেন-সুভাষ দত্ত-জহির রায়হান-আলমগীর কবির-আমজাদ হোসেন-খান আতাউর রহমান; শরৎচন্দ্র, তিন বাড়–য্যে-বিভ‚তি-মানিক-তারাশঙ্কর, সমরেশ বসু-বিমল মিত্র, মাহবুব উল আলম-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক-হুমায়ুন আহমেদ-মাহমুদুল হক-সৈয়দ শামসুল হক, ড. হুমায়ুন আজাদ এবং আরো অনেকে।
দেশে কিছু হলেই সংখ্যালঘুদের নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া শুরু হয়ে যায়। দেশে যখনই কোথাও কোন গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, তখন হিন্দুরাই সর্বপ্রথম আক্রমণের শিকার হয়, এই ঘটনাই আমাদের দেশে বহুদিন ধরে ঘটে আসছে। সংখ্যালঘুদের কোন ভ‚মিকা না থাকলেও, সংখ্যালঘুরা কোন পক্ষ-বিপক্ষ না হলেও তাদের ওপর হামলা হয়। তাদেরকে মারধর এমনকি হত্যা, বাড়িঘর ও মঠ-মন্দিরে হামলা চালিয়ে সবকিছু ভাংচুর, তছনছ করে জ¦ালিয়ে দেয়ার ঘটনাও দুর্লক্ষ্য নয়।
তা অপরাধটা কি সংখ্যালঘুদের ? সংখ্যালঘু হওয়াটাই কি অপরাধ? কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছায় তো মানুষ সংখ্যালঘু হয় না। এটি একটি ঐতিহাসিক পরিস্থিতি। কোন দেশের কোন বিশেষ সময়ে সেদেশের অধিবাসীদের কোন একটা অংশ যদি জনগণনায় সংখ্যালঘু হয়, সেটা তাদের কোন দোষ নয়। ইতিহাসের বিশেষ একটা সময়ের জনসংখ্যানুপাতের বিশেষ অবস্থা মাত্র। সংখ্যালঘু ধর্ম স¤প্রদায় ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীও হতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা কেন সংখ্যালঘু তার পেছনে দীর্ঘ ইতিহাসের কারসাজি আছে। সাদা চোখে আমরা যা দেখতে পাই, তা’ হলো দেশভাগের ঠিক আগের বছর ১৯৪৬ সালে কলকাতা ও নোয়াখালীতে ভয়াবহ সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বহু হিন্দু চৌদ্দ পুরুষের ভিটে মাটি ফেলে এক কাপড়ে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে (তখনো পশ্চিমবঙ্গ হয়নি) চলে যায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ও অনেকে বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিলো।
১৯৫০ সালে আরেকটি মারাত্মক দাঙ্গা হয়, সে সময় ব্যাপক সংখ্যয় দেশ ত্যাগ করেছিলো হিন্দু স¤প্রদায়ের মানুষ। ৪৬, ৪৭-এর যারা যায়নি, তাদেরও অনেকেই ৫০-এ চলে যায়। খেটে খাওয়া গরীব মানুষ, প্রান্তিক চাষী, বর্গাচাষী, দিন মজুর, ক্ষেতমজুর, মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষ যারা যেত পারেননি, তারাই পরবর্তীকালে বারবার দাঙ্গার শিকার হয়েছেন। ধনী ব্যবসায়ী, জমিদার, জোতদার, অবস্থাপন্ন মানুষরা চলে গিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর আইয়ুব খান তো হিন্দুদের শত্রæই ঘোষণা করলেন, হিন্দুর সম্পত্তিকে শত্রæ সম্পত্তি আখ্যায়িত করা হলো। সেবারও অনেকেই ভারতে চলে যান।
১৯৭১ সালে ১ কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। তারা প্রায় সবাই হিন্দু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেই শরণার্থীদের বেশিরভাগ দেশে ফিরে আসলেও সবাই আসেননি। স্বাধীন বাংলাদেশেও কয়েক বার হিন্দুরা সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়েছে। বাবরি মসজিদের ঘটনার সময় যে দাঙ্গা হয়, সেটি ছিলো সবচাইতে ভয়াবহ। তখনো দেশ ত্যাগের হিড়িক পড়েছিলো, এভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে মাইগ্রেট করতে করতে বর্তমানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

শহীদ অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকাণ্ড

সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হওয়ার পর এটা নিশ্চত হয়ে যায় যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি এবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, যে কোন মূল্যেই তারা

বিস্তারিত »

৭১-এ চেরাগী পাহাড়ে ইউসিসে বোমা মেরেছিলেন দু’জন বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা

ওসমান গণি চৌধুরী ষাট ও সত্তরের দশকের চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাউজান থানার গহিরা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা আলহাজ্ব জহুরুল হক চৌধুরী ও

বিস্তারিত »

ওসিকে ‘মারধর’: চট্টগ্রামের ৩ আনসার, এক পুলিশ কর্মকর্তাকে সরানো হল

চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনার পর তিন আনসার ও এক পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গত সোমবার নগরীর ফয়’স লেক এলাকায় ৩১ আনসার

বিস্তারিত »

রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি পদে অধ্যাপক ড. মো. আহসানুল হক সম্ভাবনাময় প্রার্থী

রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি পদে অধ্যাপক ড. মো. আহসানুল হক সম্ভাবনাময় প্রার্থী। তিনি অন্যান্যদের চেয়ে অধিকতর যোগ্য বলে বিভিন্নসূত্রে জানা যায়। তিনি বর্তমানে

বিস্তারিত »

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা আসছে

শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত প্রক্রিয়ার নানা ঘটনাবলি নিয়ে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা দেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) রাতে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র

বিস্তারিত »

স্বামীর ছোড়া অকটেনের আগুনে দগ্ধ গৃহবধূ নাজমা আর নেই

চন্দনাইশে স্বামীর ছোড়া অকটেনের আগুনে দগ্ধ গৃহবধূ নাজমা মারা গেছে। শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাজমা মারা যায়

বিস্তারিত »

জয় বাংলা

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত গতকাল এক রায়ে বলেছে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান নয়। ইতিপূর্বে হাইকোর্ট ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান বলে রায় দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ সেই

বিস্তারিত »

দিল্লির কাছে আত্মসমর্পণ করতে স্বাধীনতা অর্জন করিনি: রিজভী রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা পিন্ডির কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছি দিল্লির কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য নয় বলে মন্তব্য

বিস্তারিত »

জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগানের রায় স্থগিত

২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল হাই কোর্ট। ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত

বিস্তারিত »