আবছার একটা লম্বা ঘুম দিয়ে একদিন চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন। আফসার অর্থাৎ নুরুল আবছার চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা এবং আমাদের বন্ধু ছিলেন। আবছারের বাড়ি পটিয়া থানার খরনা গ্রামে। খরনার দু’জন মুক্তিযোদ্ধার নাম সবাই জানতো। একজন এ. কে. এম আবদুল মতিন চৌধুরী, আরেকজনের নাম নুরুল আবছার চৌধুরী।
আবছার একটি প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বংশের উত্তর পুরুষ ছিলেন। তাদের পাড়াটা ছিলেন ছাত্রলীগের আড্ডাখানা, ঘাঁটি ছিলো বললেও অত্যুক্তি হবে না। মতিন এবং আবছার দু’জনই পটিয়ার শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতা ছিলেন। মতিন ও আবছারের পথে এয়ার আলী চৌধুরী বাড়ি থেকে আরও একজন ছাত্রনেতা উদ্ভূত হন। তিনি হচ্ছেন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের জন্য বিশেষ খ্যাতি পাওয়া ৮০-র দশকের চট্টগ্রামের সম্মুখ সারির বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা এবং সরকারি হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি জামশেদুল আলম চৌধুরী। তিনি নুরুল আবছার চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র, তাঁর পিতা আবছারের জেঠাত ভাই।
নুরুল আবছার চৌধুরী ছিলেন ভিন্ন ঘরানার নেতা। অনেকের মধ্যে যেমন পদের লোভ, ক্ষমতার মোহ থাকে, নুরুল আবছার চৌধুরী তা থেকে আশ্চর্যরকম মুক্ত ছিলেন। তিনি ঘরোয়া আলাপ-আলোচনায় এবং সাংগঠনিক কাজকর্মে পটু ছিলেন। নিজেকে জাহির করার কোন ঝোঁক তার মধ্যে দেখা যেত না। অপরের প্রশংসা বা গুণকীর্তন করেই তিনি খুশি থাকতেন বেশি। হাসিখুশি সহজ সরল মানুষ, অকপটে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করতে পেরে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়তেন।
আবছারের তুলনায় মতিন সংগঠক তো ছিলেনই, ভালো বক্তাও ছিলেন। মতিন একজন চ্যাম্পিয়ন সংগঠক। তিনি জনসংযোগেও দক্ষ ছিলেন। তিনি খরনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তবে ইউপি চেয়ারম্যান নয়, মতিনের আসল কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়ার গৌরব করেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে আর দু’জন মুক্তিযোদ্ধা মতিনের পূর্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন ু চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক ভিপি জালাল উদ্দিন আহমদ এবং সাতকানিয়ার সাবেক এমপি ইব্রাহিম বিন খলিল।
আবছার পটিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি এবং তাঁর বন্ধু এম এ জাফর, মতিন পটিয়ার রাজপথে সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামে রশিদাবাদের, আবছার সামনের সারিতে থাকতেন। ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলা বাতিল আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে জাফর, মতিন, আবছার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। পটিয়া সদরের ছেলে না হয়েও রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁরা পটিয়াকে মাতিয়ে রাখতেন। ’৭০ এর নির্বাচনে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর পক্ষে তারা ব্যাপক প্রচার অভিযান চালান।
নুরুল আবছার চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থানার খরনা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি এয়ার আলী চৌধুরীর বাড়িতে। পিতা নুরুল আলম চৌধুরী এবং মাতা নুরুন্নাহার বেগম। ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। পটিয়ার বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম আবদুল মতিন চৌধুরী আবছারের জেঠাতো ভাই ।
নুরুল আবছার চৌধুরী এসএসসি পাস করেন ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে মুজাফফরাবাদ হাই স্কুল থেকে; এইচএসসি পাস করেন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে।
স্কুলে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ছাত্রলীগে যোগদান করেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইউসুফের মাধ্যমে। পটিয়ার ছাত্রলীগ রাজনীতির পিতৃপ্রতিম (ঋধঃযবৎষু ঋরমঁৎব) ব্যক্তিত্ব চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ মোজাফফরবাদ হাই স্কুলে গিয়ে ছাত্রলীগের শাখা গঠন করেন।
বৃহত্তর পটিয়া থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেন চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ, কবির সাহেব, শামসুদ্দীন আহমদ, মোজাম্মেল, ছৈয়দ বশর, এম এ জাফর, মাহবুবুর রহমান প্রমুখ। শাসকচক্রের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেন এবং ৬ দফার পক্ষে বৃহত্তর পটিয়ায় জনসমর্থন গড়ে তোলেন।
পটিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে আবছার কান্ডারী গ্রুপে যোগদান করেন এবং বৃহত্তর পটিয়া থানায় কান্ডারীর মাধ্যমে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেন।
আফজল, মোহাম্মদ আলী, সিদ্দিক আহমদ, বদিউর রহমান প্রমুখ সিনিয়র ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে আবছার ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে পটিয়ায় নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং ৭০-এর নির্বাচনে দক্ষিণ পটিয়ায় মুসলিম লীগ অধ্যুষিত এলাকায় নৌকার পক্ষে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে নুরুল আবছার চৌধুরী পটিয়া কলেজের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন, সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবু জাফর চৌধুরী।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করে ছাত্রলীগ একটি আন্দোলন শুরু করেছিলো, কলেজের অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ মজুমদার সে দাবি মানতে অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ, শামসুদ্দিন আহমদ, এমএ জাফর, এ কে এম আবদুল মতিন চৌধুরী, নুরুল আফসার চৌধুরী ও মনোজ হাজারী সহ ছয়জন ছাত্রনেতাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী সফরে পটিয়া এসেছিলেন। পটিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দানকালে তিনি পটিয়া থেকে ফিরে যাওয়ার পূর্বেই ছয় ছাত্রনেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। অধ্যক্ষ অবিলম্বে ছাত্রদের বহিষ্কারাদেশ তুলে নিয়েছিলেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং পাক বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশনে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
’৭১ এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে পটিয়ার ছাত্রলীগ নেতাদের খুব জোরালো ভূমিকা ছিলো। মেজর জিয়া সহ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের সংগঠকরা যখন ট্রান্সমিটার ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পটিয়া যায় তখন তারা ট্রান্সমিটারটি পটিয়া থেকে ভারতের পথে প্রেরণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
খরনায় আবছার আর মতিনের বাড়িটা ছিল চট্টগ্রাম ু কক্সবাজার সড়কের পাশে। পাঞ্জাবি সৈন্য বা রাজাকাররা যখন তখন তাঁদের বাড়িতে গিয়ে হানা দিত এবং তরুণ যুবকদের পেলে হয়রানি করত ও বাড়িঘর লুঠতরাজ ছাড়াও গরু, ছাগল নিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলতো। আবছার, মতিন এবং তাঁদের বন্ধু রশিদাবাদের এম.এ জাফর একদিন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে সবার অজান্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে যাত্রা ছিল রীতিমত এক ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চার। সেজন্য তাদের তারিফ করতেই হয়। তাঁরা দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে ডিমাগিরির পথে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে কেয়ারাছড়ি নামক স্থানে তাঁদের উপর মিজো বিদ্রোহীরা হামলা করে। সেখানে মিজোদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়, সংঘর্ষে তাদের দলের হারুন (তার বাড়ি এয়াকুবদণ্ডী) নামে একজন শহীদ হয়। অন্যরা ফিরে আসতে বাধ্য হন। এই যাত্রায় আবছারের সঙ্গী ছিলেন মুক্তিমান বড়ুয়া (পাঁচরিয়া, ছাত্র ইউনিয়নের সিনিয়র নেতা ও পরবর্তীকালে কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা), এম.এ জাফর (রশিদাবাদ, পরবর্তীকালে পটিয়া থানা ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা), আ. ক. ম শামসুজ্জামান (বড়লিয়া, পরবর্তীকালে পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), এস.এম ইউসুফ (পূর্ব পাঁচরিয়া, ব্যাংকার এবং অবসরের পর জাসদের বিশিষ্ট নেতা), মোহাম্মদ মহসিন ও আবু তাহের (চরকানাই) প্রমুখ।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর নুরুল আবছার চৌধুরী প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ছিন্নভিন্ন সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বিভিন্ন শাখার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ’৭৬ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর পটিয়া থানা ছাত্রলীগ আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পটিয়া থানার ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। আবছার ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে রেলওয়েতে চাকরিতে যোগদান করেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
নুরুল আবচার চৌধুরী মিরসরাইর বীর মুক্তিযোদ্ধা সমাজ সেবা কর্মকর্তা এম এ আউয়ালের ছোট বোনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে তাঁরা চার ছেলে ও দুই মেয়ে লাভ করেন। তাঁদের বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার।
রেলওয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর আবছার পবিত্র হজ্ব পালন করেন। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষটির জীবনের পথচলা থেমে যায়।








