সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রুপের মালিক, কর্মকর্তা এবং সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। অস্তিত্বহীন ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের নামে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় এ মামলা করে দুদক। রায়ে তানভীর ও জেসমিনকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ৪২০ ধারায় সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদের। গত ১৯ মার্চ’২৪ তারিখে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক মো. আবুল কাশেম আদালত কক্ষে আট আসামির উপস্থিতিতে এ রায় দেন। বিচারক আলোচিত এ মামলার রায়ে তানভীর, জেসমিন ছাড়া আরও নয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। পাশাপাশি আট আসামিকে দিয়েছেন বিভিন্ন মেয়াদের সাজা। এই মামলায় আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো—“অত্র মামলা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলা মনে করে, তাদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত মর্মে আদালত মনে করে।কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন। এমতাবস্থায় অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো”।হল-মার্ক কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের আর্থিক এবং ব্যাংকিং খাতে চাঞ্চল্যকর উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলেও একমাত্র নয় মোটেও।এ রায়ের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে দেশের ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম দুর্নীতি এবং কেলেঙ্কারির বিষয়ে আদালত কঠোর বার্তা দিয়েছেন।
একথা অনস্বীকার্য যে, দেশের ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা নৈরাজ্য অর্থ লোপাট আত্মসাৎ এবং অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে “বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩—এই ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট–বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া এ অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। অথচ এ অর্থে অনায়াসে বাজেট–ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো” { সূত্রঃ প্র/আলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ }।
দেশের মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ব্যাংক খাতের অনিয়মের এ তথ্য তুলে ধরেছে সিপিডি। গত ২৪ ডিসেম্বর’২৩ তারিখে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত “অর্থনীতির চলমান সংকট ও করণীয়” বিষয়ক ব্রিফিংয়ের ব্যাংকসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের চিত্র তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। “সিপিডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে ২০২২ সালে। ওই বছর ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। যার সঙ্গে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়। আর ২০০৮ সালের পর ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে বেসিক ব্যাংকে।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নানা অনিয়মের মাধ্যমে এ ব্যাংকটিতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)৬০টির মতো মামলা করেছে। বেসিক ব্যাংকের আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের পক্ষ থেকে ৫০টির বেশি মামলা করা হলেও বাচ্চুকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আলোচিত আরেক ঘটনা ছিল রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি। এতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়।
এ ছাড়া ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে জনতা ব্যাংকে ঘটে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা।ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপ এ ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিল।এর বাইরে ২০২১ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আর্থিক খাতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে আসে। এ ছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ৫০০ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে জনতা ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপের ৮১৬ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে শহিদুল আহসানের ৭০১ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে এবি ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে”{সূত্রঃ প্র/আলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩}।
ব্যাংকিং খাতের উপরোক্ত চিত্র দেশ ও জাতির জন্যে একটা বড় অশনি সঙ্কেত। ভয়ংকর ভয়াবহ এবং উদ্বেগের বিষয়ও বটে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাংকের উদাসীনতা গাফিলতি যথাযথ তদারকি ও নজরদারির অভাবে দেশের অর্থ লুঠ এবং বিদেশে পাচার হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের অনেক পরিচালক স্বনামে বেনামে নাম সর্বস্ব অস্তিত্ত্ববিহীন কোম্পানি্র নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে খুব দ্রুত ঋণ বিতরণের মাধ্যমে লোপাট করেছে যা অভাবনীয় অস্বাভাবিক এবং অকল্পনীয়ও বটে।পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকগুলোতে অযাচিত হস্তক্ষেপ, অনৈতিক চাপ প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে এবং কতিপয় অসাধু নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকর্তাদের যোগসজসে বড় বড় ঋণ জালিয়াতি এবং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছে।এভাবে দেশের প্রচুর অর্থ বিদেশেও পাচার হয়েছে।পাশাপাশি তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্যে ক্যাপিটাল মেশিনারি, কাঁচা মাল এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য আমদানী রপ্তানির মাধ্যমেও দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করছে অহরহ। এলসি’র মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে বিপরীতে দেশে আসছে খালি কনটেইনার, এক পণ্যের নামে আসছে অন্য পণ্য এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনাও ঘটছে। ছোট থেকে প্রথিতযশা এবং কর্পোরেট ব্যবসায়ীরাও এসব অনৈতিক দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, হল-মার্ক কেলেংকারীর হোতাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ কথা বলা উচিৎ হবে না যে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আপিল নিষ্পত্তি করে দোষীদের শাস্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদকের যথাযথ কার্যক্রম এবং উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে যেভাবে ব্যাংকগুলোতে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটে চলেছে তাতে দুই একটা ঘটনার বিচার সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে বা ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। এমতাবস্থায় সরকারকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং অঙ্গীকার নিয়ে অর্থ লোপাট আর পাচার বন্ধে প্রচলিত আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিবর্ধন পরিমার্জন এবং সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে হবে। পাশাপাশি দ্রুততার সঙ্গে সবগুলো মামলার রায় আপিল নিষ্পত্তির কার্যকরী পদক্ষেপ এবং উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্বৃত্ত্বায়ন বন্ধ করার জন্য সব অপরাধীকেই বিচারের আওতায় আনা একান্তই জরুরি। ফলশ্রুতিতে জনগণ এবং রাষ্ট্রের অর্থ সম্পদ নিরাপদ থাকবে।ফিরে আসবে সুশৃঙ্খল ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা বিশ্বাস।
লেখক প্রাবন্ধিক