স্বামী-সন্তান নিয়ে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় রাজধানীর বস্তিতে কাটিয়েছেন ইয়াসমিন। যেখানে তাদের নিত্যসঙ্গী ছিল আবর্জনা-দুর্গন্ধ। ছিল না বিদ্যুৎ। বৃষ্টির সময়ে হাঁটাচলা করাও কঠিন হয়ে পড়ত। কখনো কখনো তো ঘর থেকে বের হওয়াই সম্ভব হতো না। তবে ইয়াসমিনের সেই দুর্দিন ফুরিয়েছে। তিনি এখন বাস করেন বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনকল্পে শেখ হাসিনা সরকার নির্মিত আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বহুতল ভবনের একটি ফ্ল্যাটে।
সরকারি সংস্থা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ রাজধানী ঢাকার মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় ১৪ তলা বিশিষ্ট ৫টি ভবন নির্মাণ করেছে। সেখানে ইয়াসমিন এবং তার পরিবারের জন্য একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তার মতো আরও ৩০০ বস্তিবাসী পরিবারকেও সেখানে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
নিজের দিনবদলের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ইয়াসমিন বলেন, ‘আগে ৩০ জন লোকের জন্য মাত্র একটি গোসলখানা-টয়লেট বরাদ্দ ছিল। একটি মাত্র কামরায় কেউ চৌকির ওপর, কেউ বা মাটিতে শুয়ে ঘুমাত। কোনোভাবেই এটি বসবাসযোগ্য পরিবেশ ছিল না।’
এখন আলাদা একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন উল্লেখ করে ইয়াসমিন বলেন, ‘এখানে একটি আলাদা বাথরুম ও ব্যালকনি আছে। বিদ্যুৎ না থাকলে আছে জেনারেটর ব্যাকআপ। আছে লিফট। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, আমি এমন একটি বিল্ডিংয়ে থাকতে পারব।’
ইয়াসমিন আরও বলেন, ‘এখন আমি আমার সন্তানকে একটি ভালো পরিবেশে রাখতে পারব। বাবা-মায়ের কাছে এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কি হতে পারে? যদিও জীবনধারণের জন্য একটি ভালো পরিবেশ তৈরি করা কঠিন। তারপরও আমি চেষ্টা করছি কিছু আসবাবপত্র এনে ঘরটিকে ভালোভাবে সাজাতে। আমার কাছে এখনো সবকিছুকে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।’
কেবল ইয়াসমিন নয়, তার মা রেহানাকেও একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা হয়েছে ভবনটিতে। তিনি বলেন, ‘এমন পরিবেশে বাস করতে পারব তা কখনো কল্পনাও করিনি। সন্তানদের এমন সুন্দর পরিবেশে রাখতে পারা আমার স্বপ্ন ছিল। আমাদের মতো বস্তিবাসীদের এ সুযোগ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
তবে সরকার বস্তিবাসীদের জন্য নির্মিত এসব ফ্ল্যাট বিনামূল্যে বরাদ্দ দেয়নি। এর মধ্যে কয়েকটি বস্তির বাসিন্দারা মাসিক ভাড়া দেন। বস্তিবাসীদের জন্য ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাটের প্রকল্পটি ২০২১ সালের ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন। বস্তিবাসীদের জন্য ঢাকায় নির্মিত এই প্রকল্পের ভবনগুলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের এক অনন্য উদাহরণ।
বাংলাদেশ অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। সারা দেশে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকার পরও সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কাজ করছে যা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পক্ষে কথা বলে।
বাংলাদেশ গৃহহীনদের বাসস্থান এবং দরিদ্রদের খাওয়ানোর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যাতে কেউ পিছিয়ে না পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় বস্তিতে বসবাস করা নিম্নআয়ের ৩০০ পরিবারের মধ্যে সদ্য নির্মিত ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বস্তিবাসীদের উন্নত আবাসন দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ঢাকার মিরপুর-১১ নম্বরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। এমন আরও দুটি ভবনের কাজ চলমান। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ দেয়া হবে। ১৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এমন প্রায় ১০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে আরও ১০০১টি পরিবারের মধ্যে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হবে। বস্তিবাসীদের নতুন আবাসন পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং বস্তিবাসীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে।
সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ‘সবার জন্য ঘর’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, তার স্বপ্ন হলো দেশকে এমনভাবে গড়ে তোলা যেখানে কেউ গৃহহীন থাকবে না এবং সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হবে।
ঢাকা শহরে যেমন বস্তিবাসীদের জন্য উঁচু দালান তৈরি করা হচ্ছে তেমনি গ্রামেও গৃহহীনদের জন্য শুরু করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। এর মাধ্যমে সরকার গৃহহীনদের পাকা বাড়িতে থাকার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। প্রতিটি সুবিধাভোগী পরিবার দুই দশমিক দুই শতক জমি, দুই কক্ষের একটি আধা-পাকা বাড়ি, বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, একটি রান্নাঘর, একটি বাথরুম এবং একটি গোসলখানা। সাধারণত বাড়ি ও জমি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়। প্রকল্প এলাকায় ব্যাপক বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়েছে। পানিবাহিত রোগপ্রতিরোধে প্রতি দশটি পরিবারের জন্য একটি করে নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।
বিষয়টি এখানেই থেমে নেই। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কাছেই একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হবে। বিশ্বের মধ্যে গৃহহীনদের আশ্রয় দিয়ে তাদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে চালু করা এত বড় প্রকল্প এই প্রথম। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩টি বাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রকল্পের প্রথম দুই ধাপে। অধিকাংশ বাড়িই দেয়া হয়েছে ২০২১০২২ সালে মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। এর বাইরে আরও ৬৫ হাজার ৬৭৪টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলোও রয়েছে হস্তান্তরের অপেক্ষায়।
কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্পটি এখন তৃতীয় ধাপে রয়েছে এবং যথাসময়ের মধ্যেই এর যাবতীয় কাজ শেষ হয়ে যাবে এবং এরপর বাংলাদেশে আর কোনো গৃহহীন ব্যক্তি থাকবে না।