চার বড় কোম্পানি দাম কমানোর পর ঢাকার বড় বাজারগুলো ব্রয়লার মুরগির দাম নেমে এসেছে কেজি ২০০ টাকায়। রোজার মধ্যে তাতে স্বস্তি ফিরেছে ক্রেতাদের মধ্যে। তবে বেশি দামে মুরগির বাচ্চা ও খাবার কিনে এখন লোকসান গোনার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছোট খামারিরা।
ডিম ও মুরগির বাজারের নিয়ন্ত্রণ বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো নিয়ে নিয়েছে, এমন কথা কিছুদিন ধরেই বলে আসছেন ছোট খামারিরা। এখন আবার লোকসানের ধাক্কায় ছোট খামারিরা আবার ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’র নামে বড় কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে বলে শঙ্কা করছেন তারা।
ডিম-মুরগির বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে পোল্ট্রি বোর্ড গঠন করা এখন জরুরি হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার।
সম্প্রতি হঠাৎ করেই ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে যায়। দেড়শ থেকে পৌনে দুইশ টাকার মধ্যে এই দর ঘোরাঘুরি করলেও তা এক লাফে আড়াইশ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
ক্রেতাদের অসন্তোষের মুখে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তখন তৎপর হয়। গত বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠকে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৪০ টাকা কমানোর ঘোষণা দেয় চার কোম্পানি কাজী ফার্মস, আফতাব, প্যারাগন ও সিপি।
সেই বৈঠকে পাইকারিতে কেজি ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দিলেও কোম্পানিগুলো এখন ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি করছে বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান।
দাম ঘোষণার চেয়ে বেশি কমেছে
ঢাকার কাপ্তান বাজারের মুরগির আড়ত শাহিনুর হেন্স হাউজের মালিক ওমর ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা সোমবার ১৭০-১৮০ টাকা কেজিতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেছেন। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তারা মুরগি পাচ্ছেন ১৫৫-১৬০ টাকায়।
তিনি বলেন, “কোম্পানি যে বলে দাম কমিয়ে দেবে, তাতে তো তাদের লস নাই। বাজার খারাপ, মাল তো চলে না। মাল না চললে এগুলা বলে। কিছুদিন আগে দাম বাড়তি ছিল, মানুষ নিত না। খুব লস গেছে, এখন মানুষ একটু তাকায় ব্রয়লারের দিকে। কোম্পানির হাতেই সব।”
একই দিন কারওয়ান বাজার, মিরপুরের কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ায় ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজিতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করতে দেখা গেছে।
কারওয়ান বাজারের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, চার-পাঁচ দিন আগেও তারা ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায় মুরগি বিক্রি করেছিলেনন।
কাজীপাড়া বাজারের উল্টোদিকের প্রোটিন এন্টারপ্রাইজে ব্রয়লারের বিক্রেতা জানান, তিনি ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। রাস্তার অন্যপাশে কাজীপাড়া বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা দরে।
দোকানি রিয়াদুল বলেন, “মালের আমদানি যেমন হয়েছে, সে অনুযায়ী বিক্রি হচ্ছে।”
শেওড়াপাড়ার দোকানি ফজলুল হক বলেন, “আইজ ২০০ ট্যাকা কেজি, কাইল ২২০ টাকায় বেচছি। … আগের দিন ১৯০ এর উপরে কি না আছিল, আইজ রেইট গেছে ১৭৫।”
খামারিরা নাখোশ
মুরগির দাম কমে যাওয়ায় ভাঁজ ফেলেছে ঢাকার সাভারের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার খামারী গোপাল চন্দ্র মণ্ডলের কপালে। কারণ তিনি মুরগির বাচ্চা বেশি দামে কিনে সবে খামারে তুলেছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাশের খামার থেকে বিক্রি করল ১৫৫ টাকায়। এখন যারা বিক্রি করছে তাদের বাচ্চা কেনা আছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। এরা যদি ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে মুরগি বিক্রি করে, তাহলে এরা কোনোরকম ক্যাশ পাবে, লাভ যদিও হবে না।
“কিন্তু প্রতিদিন তো ১০ থেকে ১৫ টাকা কমতেছে, ১০ থেকে ১৫ দিন পর কী হবে, তা তো বুঝতে পারতেছি না।”
গোপালের মুরগির বাচ্চা কেনা পড়েছে ৮০-৯০ টাকায়। তিনি বলেন, “অনেক ভাই-ব্রাদার খামারে বাচ্চা উঠাচ্ছে ৮০-৯০ টাকায়। এই দামে বাচ্চা কিনলে ওয়েট আসার পর ১৭০-৭৫ খরচ পড়বে, সেটা ১৯০ টাকার কমে বিক্রি করলে আমরা লাভ পাব না। এখন যে পরিস্থিতি, তারা (কোম্পানি) কমানোর ঘোষণা দিলেও লসে আমরা।”
মুরগির দাম বাড়তি দেখে অনেক খামারি খামারে (শেডে) বাচ্চা তুলেছেন জানিয়ে গোপাল বলেন, “কেউ দুই হাজারের শেডে বেশি রেটে হাজার খানেক, কেউ কেউ তিন হাজারের শেডে দেড় হাজার বাচ্চা তুলেছে। এখন যেভাবে দাম কমা শুরু করছে, খামারিরা আবার ঋণগ্রস্ত হবে। এই সুযোগে সব কোম্পানিদের হাতে যাবে। লোকজন কন্ট্রাক্টে যাবে।”
কেজিপ্রতি ৪০ টাকা দাম কমানোর ঘোষণা দিয়ে ৭০ টাকার বেশি কমিয়ে দেওয়ায় বড় কোম্পানির উপর ক্ষুব্ধ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুরগির দাম কমার কারণে যারা খামার বন্ধ রেখেছিল, তারা দাম বেশি দেখে বাচ্চা উঠাইছে। কোম্পানি ফিড-বাচ্চার দাম উঠিয়ে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে খামারিদের কাছে বাচ্চা বিক্রি করেছে। এখন তারা দাম কমিয়ে প্রান্তিক খামারিদের লসে ফেলে দিয়েছে।
“করপোরেট কোম্পানির টার্গেট, প্রান্তিক খামারিদের নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করবে। আমাদের কাছে যখন মুরগি থাকে না, তখন তারা দাম বাড়ায়, আমাদের কাছে থাকলে তারা দাম কমিয়ে দেয়।”
“সরকারের উচিৎ, পোল্ট্রি বোর্ড গঠন করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা এবং করপোরেটে মুরগি-ডিম উৎপাদন বন্ধ করা। তা না হলে প্রান্তিক খামারি হারিয়ে যাবে, সবাই করপোরেটে জিম্মি হবে,” বলেন খামারিদের এই নেতা।
মুরগির খামারিরা বড় কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ার যে অভিযোগ করছেন, তার সমর্থন এসেছে কৃষি অর্থনীতিবিদদের মধ্য থেকেও।
বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে খামারিদের কিছু চুক্তিপত্রে কোম্পানির পরিচালন ব্যয়ও খামারির কাঁধে চাপাতে দেখা গেছে।
তবে খামারিদের জিম্মি করার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা।
অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় কিছু দিন আগে কাজী ফার্মসের বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবু কাওসার মো. সালেহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, উভয় পক্ষের লাভালাভের হিসাব কষেই চুক্তি হয়ে থাকে।
“লাভ না থাকলে কেন তারা (খামারি) বাচ্চা নেবে? আমরা তো কাউকে জোর করি না। লাভ হয় বলেই খামারিরা বাচ্চা নিচ্ছে, ফিড নিচ্ছে।”
ভোক্তা অধিদপ্তর ‘দেখছে’
মুরগির দাম বেশি কমে যাওয়ায় প্রান্তিক খামারিরা যে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তা স্বীকার করছেন ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও।
সোমবার মুরগির পাইকারি আড়ত কাপ্তান বাজারে অভিযানে গিয়ে অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ‘অল্প লাভ’ করে ব্রয়লার মুরগি ১৮৫ টাকা দরে বিক্রির আহ্বান জানান।
এর পরপরই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “তারা (ব্যবসায়ীরা) ঘোষণা দিল ১৯০-১৯৫ টাকা, আজ কেন তারা ১৬০ টাকায় বিক্রি করছে?
“আমাদের প্রান্তিক চাষিদের কিন্তু তাহলে লস দিয়ে বিক্রি করতে হবে, যেহেতু ফিডের দাম বেশি। আমাদের ক্ষুদ্র খামারিরা বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবে। আমরা এই বিষয়টি দেখছি। আমি ইতোমধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছি।”
শফিকুজ্জামান বলেন, “আমার প্রশ্ন এখানে, যে মুরগি ফার্ম থেকে চার দিন আগে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তারা ঘোষণা দিল ১৯০-১৯৫ টাকা, সেটি আজ তারা ১৬০ টাকায় বিক্রি কীভাবে করে? তাহলে এই ৭০-৮০ টাকার যে গ্যাপ, এটি কি তারা জনগণের পকেট থেকে তুলে নিয়ে গেছে?”
প্রতিশ্রুত দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করার বিষয়ে জানতে সোমবার কয়েকটি কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তাকে কল করা হলেও তাদের কেউ ফোন ধরেননি, কেউবা এবিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
কোম্পানিগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশন কী করছে- জানতে চাইলে কমিশনের চেয়ারপারসন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুরগি এবং ডিম নিয়ে আমাদের কমিশনে কয়েকটি মামলা আছে, এগুলো চলমান আছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেগুলো প্রতিযোগিতা কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে করেছে। এর কিছু তদন্তের পর্যায়ে আছে, কিছু মামলার প্রতিবেদন জমাও পড়েছে।
“কমিশনের পাঁচ সদস্যের মধ্যে তিনটি পদ খালি অনস্থায় আছে, এখানে কোরামের সংকট তো আছেই। আমাদের জনবল সংকট আছে, সরকারকে জানিয়েছি, সহসাই আশা করি লোক পাব। জনবল পেলে আপনারা যে জায়গাটি বলছেন, সেখানে আমরা কাজ করব, আমাদের আগ্রহও আছে।” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম