জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা- সমালোচনার মধ্যেই পঞ্চমবারের মতো দেশজুড়ে বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) পালিত হয়েছে জাতীয় ভোটার দিবস।
গণতন্ত্র, নির্বাচন ও ভোটাধিকার বিষয়ে ভোটারদের সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে আয়োজন করা দিবসটিকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন কোন কোন বিশ্লেষক।
তবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমান সময়ে ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনীহার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে তাতে পুরো বিষয়টিকে অর্থহীন হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।
ভোট নিয়ে অসন্তোষ ভোটারদের
সদ্য পড়াশোনা শেষ করা ফারজানা রহমান ভোটাধিকার লাভ করলেও কখনো কোন ভোট দেননি। আর এর কারণ হিসেবে তিনি নির্বাচনের প্রতি আস্থাহীনতার দিকটির কথাই বলছেন। “ভোটচুরি বা ভোটকাটা যাওয়ার ব্যাপারটা আমরা সবাই জানি। যে জায়গায় নির্বাচনের পরিবেশই সুষ্ঠু না, সে জায়গায় আবার ভোট দিয়ে কী হবে?”
“আমি ভোট না দিলেও আমার নামে ভোট হয়ে যাবে কারো না কারো মাধ্যমে”। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নিলেও ভবিষ্যতে ভোট দেয়ার ইচ্ছা আছে ফারজানা রহমানের। “কোনোদিন যদি মনে হয় এই নির্বাচন টা সুষ্ঠু হতে যাচ্ছে তবে নিশ্চয়ই ভোট দিবো”।
২০১৮ সালে ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফয়সাল নূরকে।
ভোট দিতে যাবার সময় কোন সমস্যা না হলেও ফিরবার সময় তাকে অবরুদ্ধ করে কয়েকজন। কোন দলকে ভোট দিয়েছেন, কেন ভোট দিয়েছেন- এমন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে।
মিস্টার ফয়সাল বলছেন, ছোটবেলায় নির্বাচন মানেই যেমন ভোটারদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত একটি বিষয় দেখা যেত, সেটা আর এখন দেখা যায় না। আস্থাহীনতার কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
আগের বছরের তুলনায় এবছর কী পরিমাণে ভোটার বেড়েছে তা জানানো এবং ভোটারদের নাগরিক অধিকার- ভোটাধিকার সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে দিবসটি পালন করার কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মোঃ আনিছুর রহমান।
লক্ষ্যপূরণে ভোটারদের জন্য ব্যানার, ফেস্টুন, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজনের কথাও জানান তিনি। নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে যে সংশয় তৈরি হয়েছে তাতে দিবসটি পালনের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান কমিশন আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সাম্প্রতিক নির্বাচন ও উপনির্বাচনে ‘৬০ শতাংশের বেশি’ ভোটার উপস্থিতির কথাও উল্লেখ করেন তিনি। মিস্টার রহমান বলেন, কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিতের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের না, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের।
কী মনে করছেন বিশ্লেষকরা?
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন ভোটার দিবস পালন করা গুরুত্বপূর্ণ, তবে আরও জরুরি ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। “ভোটার মানে দেশের মালিক। আর ভোট দেয়া অর্থ মালিকানার প্রতিফলন।
ভোটার দিবস পালনের মাধ্যমে ভোটাররা তাদের মালিকানা প্রদর্শনের আবহ সৃষ্টি হয় তবে সেটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক”। তবে বর্তমান ভোটারদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোর কারণে ভোট দেয়ার প্রতি যে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে তাতে আশাবাদী হওয়া দূরুহ বলে মনে করছেন এই বিশ্লেষক।
অনেকটা একই মত নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আবদুল আলীমের। তিনি বলছেন, যেকোনো দিবসের তাৎপর্য হচ্ছে এর বার্তা অংশীজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে নির্বাচন কমিশন সঙ্গে নিতে না পারে তবে এটির অর্থবহ হবার কোন সুযোগ নেই। বর্তমান নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যে যে দুর্বলতাগুলো আছে তা চিহ্নিত করে হ্রাস করার লক্ষ্যে যদি কিছু করা যায় তবে দিবসটি তাৎপর্যপূর্ণ হবে বলে মন্তব্য করেন মিস্টার আলীম।
ভোটার দিবস
২০১৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে জাতীয় ভোটার দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। গণতন্ত্র, নির্বাচন ও ভোটাধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতিবছর পহেলা মার্চকে জাতীয় ভোটার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পরে ২০২০ সালে নতুন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দোসরা মার্চ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
দিনটিতে দেশজুড়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে বিভাগীয় নির্বাচন কমিশন। একইসঙ্গে আগের বছরের ভোটার তালিকা হালনাগাদের চূড়ান্ত ভোটার সংখ্যা প্রকাশ করা হয় দিবসটিতে। এবছর ‘ভোটার হব নিয়ম মেনে, ভোট দিব যোগ্যজনে’ প্রতিপাদ্যে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৯০ লাখ ৬১ হাজার ১৫৮ জনে।মৃত্যুজনিত কারণে বর্তমান ভোটার তালিকা হতে ২২ লাখ ৯ হাজার ১২৯ জনের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। এবার নতুন ভোটার হয়েছে ৫৭ লাখ ৭৪ হাজার ১৪৮ জন, আর ভোটার বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ১০ শতাংশ।