রাজধানীর গুলশানে একটি বহুতল আবাসিক ভবনে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে একজনের মৃত্যু হয়েছে; আহত হয়েছেন আরও অন্তত দশজন, যাদের মধ্যে তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।
রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টায় গুলশান-২–এর ১৩ তলা ওই ভবনে আগুন লাগার পর চার ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একটি শিশুসহ মোট ২২ জনকে তারা সেখান থেকে জীবিত উদ্ধার করেন।
ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরে তাদের সাথে যোগ দেয় বিমান বাহিনীর দুটি ইউনিট। রাতে উদ্ধার কাজে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার কথা জানানো হয় আইএসপিআরের তরফ থেকে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন রাত ১২টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগুন রাত ১১টার দিকে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পরে পুরো ভবন তল্লাশি করে আর কাউকে পাওয়া যায়নি। লিফটের শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি আমরা।”
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার খালেদা ইয়াসমীন জানান, সন্ধ্যা ৭টায় মানারাত স্কুলের পাশে ওই ভবনের সপ্তম তলার দিকে আগুন লাগার খবর পান তারা। কয়েক ধাপে তাদের ১৯টি ইউনিটের ১১৪ জন কর্মী সেখানে উদ্ধার কাজে যোগ দেন।
আবাসিক ওই ভবনের নিচ তলা বাদে উপরের ১২ তলায় ছয়টি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে কয়েকটি পরিবারের বসবাস। আগুন ছড়িয়ে পড়লে ভবনের বিভিন্ন তলায় অনেকে আটকা পড়েন। আগুন থেকে বাঁচতে ব্যালকনি থেকে কয়েকজনকে লাফিয়ে নিচে নামতে দেখা যায়।
ভবন থেকে বের হওয়া শিরিন নামের একজন নারী জানান, তিনি নবম তলার ‘হোসেন সাহেবের’ ফ্ল্যাটে কাজ করেন। আগুন লাগার সময় তিনি এবং গৃহকর্ত্রী বাসায় ছিলেন।
“ম্যাডাম বয়স্ক, অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন উনাকে নামাল, আমি ম্যাডামকে আগলে ধরেছিলাম। কিন্তু নিচে নামার পর আর ম্যাডামকে খুঁজে পাইনি।”
ভবনের উপরের দুটি ফ্লোরে একমি গ্রুপের পরিচালক ফাহিম সিনহার বাসা। ওই বাসার গৃহকর্মী রিনা ও আলোসহ সাতজন আগুন লাগার পরপরই নেমে পড়েন।
রিনা বলেন, “আমার পরেও ম্যাডাম শামা রহমানসহ তিনজন বাসায় ছিলেন। পরে ম্যাডাম উপর থেকে লাফ দেন।”
ওই বাড়ির কয়েকটি ভবন পর শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আহতদের উদ্ধার করে প্রাথমিকভাবে সেখানেই নেওয়া হয়।
হাসপাতালের চিফ মেডিকেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সুব্রত কুমার সাহা বলেন, “হাসপাতালে মোট ১৩ জন এসেছিলেন, তাদের মধ্যে আটজনকে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রাজিব নামের একজন পেশায় বাবুর্চি, তাকে আই সি ইউ তে নেওয়া হয়েছে। শামা রহমান নামের আরেকজনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।”
শামা রহমান একমি গ্রুপের অন্যতম মালিক এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ফাহিম সিনহার স্ত্রী বলে হাসপাতালের সামনে থাকা কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা জানান, আগুন লাগার পর শামা ১২ তলা থেকে দোতালার সুইমিংপুলের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার শরীরে ‘বার্ন ইনজুরিও’ রয়েছে বলে চিকিৎসক সুব্রত সাহা জানান।
শিকদার মেডিকেলে ভর্তি অন্য ছয় জন হলো আব্দুল নূর, কহিনুর, হৃদি, রিয়া, রাহেলা হোসেন ও সেলিনা আক্তার। তাদের মধ্যে চার বছরের শিশু হৃদির পোড়া জখম রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, রাত ১০টার দিকে ৩০ বছর বয়সী একজন পুরুষের মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন।
শামা রহমানসহ মোট তিনজনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানিয়েছেন।
খবর পাওয়ার ১১ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানোর পরও কীভাবে ওই ভবনে আগুন এতটা ছড়িয়ে পড়ল, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তবে লিফট থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ায় এবং বিলসবহুল বাসাগুলোর অন্দর সজ্জায় প্রচুর কাঠ ব্যবহার হওয়ায় আগুন ব্যাপক মাত্রা পায় বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ধারণা। আর তারা ভবনের কাছে থেকে পানি মারতে পারছিলেন না বলেও জানিয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিসের গণমাধ্যম বিভাগের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, “ভবনটির পেছনদিকে ও মাঝখানে আগুন দেখা যাচ্ছিল। তবে ভবনটির অবস্থান এমন জায়গায় যে আমাদের উঁচু মইগুলো নাগাল পাচ্ছিল না। আরো এক ভবন পরে থেকে ফায়ার সার্ভিসের উঁচু মই দিয়ে উপরের তলাগুলোতে পানি দিতে হয়েছে।”
রাতে আগুন নেভার আগেই সেখানে উপস্থিত হন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনিও আগুন নেভাতে সমস্যা হওয়ার কথা বলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ঘটনাস্থলে এসে রাত ১১টার দিকে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, “সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী সহায়তা করেছে ফায়ার সার্ভিসকে। তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই।”
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন বলেন, ভবনের ফায়ার এক্সিট ও অগ্নি নির্বাপন সরঞ্জাম ছিল কিনা সে বিষয়গুলো তারা এখনও জানতে পারেননি।
“আমরা এই মূহুর্তে আসলে জানাতে পারব না, তদন্ত শেষে আমরা বলতে পারব। আমরা এখন মানুষের জীবনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।”
তবে উৎসুক জনতার কারণে অগ্নিনার্বাপন কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ক্রাউড কন্ট্রোলে আমাদের খুবই বেগ পেতে হয়েছে।”