শহীদ অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী ও আমার বন্ধু দীপেশ চৌধুরীর ছোট ভাই শিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক শ্রী দীপেন চৌধুরী আমার উদ্দেশে একটি প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিয়ে জানতে চেয়েছেনÑমুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখন বাস্তবায়িত হবে?
দীপেন চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তরে আমার বক্তব্য নিবেদন করছিÑ
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একদিনে বা এক বছরে বা এক যুগেও বাস্তবায়িত হয় না। এমনকি শতাব্দিতেও হওয়ার কথা নয়। কারণ দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি জাতির অন্তরে নিহিত থাকে। চোখের মণির মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আগলে রাখতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধ কিছু বিষয় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলো। সেগুলি অলঙ্ঘনীয়, অপরিবর্তনীয়। এসব বিষয়ের সবতো এখানে বলা সম্ভব নয়। কিছু বলছি। যেমন দেশের নাম, চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, জাতীয় সঙ্গীত, ‘বাংলাদেশ বেতার’, ইত্যাদি। এখন একজন বা একাধিক সেনা অফিসার যদি উচ্চাভিলাষী হয়ে কখনো বন্দুকের নল উঁচিয়ে রক্তাক্ত কিংবা রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান সংঘটিত করে ক্ষমতা দখল করে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের অর্জিত মূল্যবোধ, মূলনীতি, স্লোগান, শব্দ ইত্যাদি পরিত্যাগ করার চেষ্টা করে, সেদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাহত বা বিকৃত হবে। যেমন ৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে খোন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তন, সংবিধান পরিবর্তন, বাংলাদেশ বেতারকে ‘রেডিও বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’ পাল্টে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদে’র অনুকরণে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ করে। আরো পরে জিয়া, এরশাদ অশিক্ষিত অর্ধশতক সাধারণ মানুষের কোমল অনভূতিতে সুড়সুড়ি দেয়ার অসদুদ্দেশ্যে সংবিধানকে ইসলামীকরণের চেষ্টা করে। তারা সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করে এবং সংবিধানের মুখবন্ধে ইসলামের কথা অন্তর্ভুক্ত করে। এভাবে মুশতাক, জিয়া, এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুষ্ঠিত করে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এসব বুঝেও ইসলাম, বিসমিল্লাহর ব্যাপারে নিশ্চুপ রয়েছেন।
কোন দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যখন জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করে, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। জামায়াতের সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে যদি জামায়াত নেতাদেরকে কেবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের গাড়িতে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে রক্তে রঞ্জিত লাল-সবুজ পতাকা ওড়ে, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেঁদে ওঠে। জিয়া যখন রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাসকে দেশের প্রেসিডেন্ট করে, রাজাকার আবদুল মতিন চৌধুরীকে মন্ত্রী বানায় এবং তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া আলবদর নেতা ঘাতক নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী নিয়োগ করে, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে যায়।
যদি আওয়ামী লীগের কোন মন্ত্রী জামায়াত শিবির কর্মীকে কোর্টে এপিপি, এজিপি করেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের ঐ মন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিসর্জন দেন। যদি বারও শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্যানেলে রাজাকার, আলবদরকে মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচিত করে আনা হয়, তাহলে শিক্ষক সমিতি ও বারের ঐ আওয়ামী লীগ নেতারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করেন। যদি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের মনোনয়ন দান করেন, তাহলে ঐ ভিসি নিজেকে আর মুক্তিযুদ্ধের কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বলে দাবি করতে পারেন না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়ানো না হয়, তাহলে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরাজ করছে একথা আর বলা যায় না। মোট কথা জীবনের সর্র্বক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনের সর্বাবস্থায় যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে পদক্ষেপ দেয়া না হয়, তাহলে আমাদের দেশ, সমাজ এবং জীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত একথা জোর দিয়ে বলতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুহূর্তের জন্যও ভুলে গেলে চলবে না।
দীপেন বাবু যদি আমার মুক্তি৭১ কখন চালু করবো, সেটা জানতে চান, তাহলে বলবো-মুক্তিযুদ্ধ যখন আমাদের জীবনে চলছে, তখন মু্িক্ত৭১-ও চলমান।
অপেক্ষা করুন আর চোখ রাখুন আপনার ফেসবুকে, মুক্তি৭১ ক্রমশ প্রকাশ্য।