চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার আওয়ামী লীগের তিন বড় নেতার তিন কন্যা তাঁদের গুণী পিতৃদেবের উত্তরাধিকার বহন করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় তাদের স্কন্ধোপরি তুলে নিয়েছেন। জৈবিক উত্তরাধিকার নয়, সে তো তাঁদের অন্তর্গত শোণিতে প্রবহমান। আমি বলছি রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের কথা। তিন নেতা ও কন্যাত্রয় হচ্ছেন রাউজানের আবদুল্লাহ আল হারুন ও তদীয় কন্যা শামীমা হারুন লুবনা, আনোয়ারার আতাউর রহমান কায়সার ও তৎকন্যা ওয়াশিকা আয়শা খান এমপি, রামুর ওসমান সরওয়ার আলম ও তদীয় কন্যা কাবেরী সরওয়ার নাজনীন। ফটিকছড়ির সাবেক সাংসদ রফিকুল আনোয়ারের আত্মজা খাদিজাতুল আনোয়ার সনি এমপির কথাও বলতে হয়। কিন্তু রফিক ভাই ভালো মানুষ হলেও তিনি তো আর হারুন ভাই, কায়সার ভাই’র সমপর্যায়ের নেতা ছিলেন না।
লুবনা নারী উদ্যোক্তা এবং নারী নেত্রী। উইমেন চেম্বারের নেত্রী। পিতা যতদিন জীবিত ছিলেন, তিনি রাজনীতিতে আসেন নি। কিন্তু পিতার রাজনীতি খুব কাছে থেকে দেখেছেন তিনি। ঈশ্বর নন্দী লেনের পৈতৃক বাসভবনে বড় হতে হতে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁদের বাসায় দেশী-বিদেশী রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের আনোগোনা। চট্টগ্রামের রাজনীতির এক তীর্থই তো ছিলো তাঁদের বাসভবন। পিতার অকস্মাৎ অকাল প্রয়াণ অন্তঃপুরের অবগুণ্ঠন তুলে রাজনীতিক মাঠে এসে দাঁড়াতে হয়েছিলো এই সংগ্রামী নারীকে। তখন তিনি গৃহবধূ। অতঃপর চট্টগ্রাম প্রত্যক্ষ করলো এক সাহসী নারীর বু্দ্ধিদীপ্ত পথচলা। সংগ্রাম ও জ্ঞান, সাহস ও প্রজ্ঞার অপূর্ব সমন্বিত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লুবনা। পিতার মতোই বুদ্ধি ও জ্ঞান দিয়ে রাজনীতি করছেন তিনি। আর সাহস-সে তো উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছেন চট্টগ্রামের এক অগ্রগণ্য রাজনৈতিক পরিবারের এই সন্তান। লুবনা বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের ক্লিন অ্যান্ড ইন্টেলেকচুয়াল লিডার আতাউর রহমান খান কায়সারের কন্যা ওয়াশিকা আয়েশা খান এমপি পেশায় ব্যাংকার। অপুত্রক কায়সার ভাই’র তিন কন্যাও ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাঁদেরকে যে কখনো রাজনীতির মাঠে অবতীর্ণ হতে হবে সেটা তাঁরা যেমন ভাবেন নি, তেমনি আলোকপ্রাপ্ত কায়সার দম্পতিরও হয়তো কখনো তেমন ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু কায়সার ভাই ও নিলুফার ভাবিও হারুন ভাইয়ের মতো অকালে দেহত্যাগ করলে ওয়াসিকা পাদপ্রদীপের আলোয় এসে দাঁড়ালেন। অসাধারণ বিদূষী নারী ছিলেন নিলুফার ভাবি। মেয়েদের মধ্যে যে সংস্কার তিনি প্রোথিত করে দিয়েছিলেন, তাতে ওয়াশিকার মতো একজন বিদগ্ধ, বুদ্ধিমতী নারী নেতৃত্বের অভিষেক ঘটলো চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। ওয়াশিকা উপর্যুপরি ক’বার সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, বর্তমানেও তাই।
কঙবাজার জেলার রাজনীতিতে এ মুহূর্তে চারজন নারীর বিচরণ লক্ষ্যগোচর হলেও চট্টগ্রামের তুলনায় কঙবাজারের রাজনীতিতে নারীরা আসেন অনেক দেরিতে। বর্তমানে যাঁদেরকে আমরা দেখছি, তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন তাঁদের স্বামীদের কারণে রাজনীতির মাঠে দৃশ্যমান। এই ত্রয়ী নারীর একজন কঙবাজার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোশতাক ভাই’র পত্নী কানিজ ফাতেমা মোশতাক, আরেকজন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের পত্নী হাসিনা আহমদ এবং তৃতীয়জন টেকনাফের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির স্ত্রী শাহীন আখতার চৌধুরী। চতুর্থ নারী কঙবাজারের সব্যসাচী রাজনীতিক রাষ্ট্রদূত অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর কন্যা কাবেরী সরওয়ার নাজনীন।
বহুমুখী প্রতিভাধর অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী রামুতে একটি রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকার সৃষ্টি করে পরলোকগমন করেছেন। তাঁর পুত্র কাজল রাজনীতিক ও উপজেলা চেয়ারম্যান, কমল রাজনীতিক ও এমপি এবং কাবেরী রাজনীতিক, নারী নেত্রী এবং ব্যবসায়ী। কাবেরী ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতি করছেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রী এবং শিবির খেদাও আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। কাবেরী কঙবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আফছার কামাল চৌধুরীর পুত্রবধূ। পিতৃকূল, শ্বশুরকূল-দু’দিকে থেকে কাবেরী রাজনীতির আশির্বাদপুষ্ট। তিনি বর্তমানে কঙবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
রফিক ভাইর কন্যা খাদিজাতুল আনোয়ার সনি বয়সে নবীন। তাঁর রাজনীতিতে আসার কোনো প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা হয়তো ছিলো না। পড়াশোনার জগতেই মগ্ন ছিলেন। তারপর হঠাৎ বজ্রাঘাত, পিতা চলে গেলেন। কন্যার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেলেন তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনের দায়। কিন্তু তাঁর পিতা ফটিকছড়ির ক্লেদাক্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিচ্ছন্ন রাজনীতির যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে যাচ্ছিলেন তাঁর অবর্তমানে সেই ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন হওয়ার আশংকা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে পড়তে এখন তো সনি ফটিকছড়ির অপরিহার্য আলোচিত নেত্রী।
সংসদ সদস্য হিসেবে ওয়াশিকা ও সনি যে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন, লুবনা ও কাবেরী সেখানে একটু পিছিয়ে আছেন। তবে তাঁরা পিতার প্রভাব, গ্ল্যামার এবং নিজেদের সামাজিক অবস্থান এবং অবশ্যই নিজেদেও যোগ্যতা দিয়ে তা’ কাটিয়ে উঠতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে চারজন সম্পর্কে যে প্রশ্নটি আমার মনে বারবার উদিত হচ্ছে, তা’ হলো শেষ পর্যন্ত তাঁরা রাজনীতিতে থাকবেন তো? একজন রাজনীতিকের জীবনে জোয়ার ভাটা কিংবা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা থাকতে পারে, কিন্তু বড় কথা হচ্ছে তাঁরা ধারাবাহিকতা বজায় রাখছেন কিনা? শুধু সংরক্ষিত মহিলা আসনই যদি তাঁদের রাজনীতির গন্তব্য হয়, তাহলে এ আলোচনা প্রলম্বিত করার কোনো মানে হয় না। রাজনীতির বড় আসরে পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে তাঁরা যদি সাফল্যের বরমাল্য কণ্ঠে তুলে নিতে পারেন, সেদিন তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আর কোথাও সংশয় থাকবে না। আমরা অবশ্যই চাই যে, নারীরাও রাজনীতির বড় আসরে অবতীর্ণ হয়ে পুরুষের একাধিপত্যের অবসান ঘটাক। সেদিনই দেশে সত্যিকার অর্থে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ঘটবে।
প্রাতঃস্মরণীয় মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অবরোধবাসিনী নারীকে অন্তঃপুর থেকে বহির্জগতে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানানোর পর তাঁর প্রজ্বলিত প্রদীপের আলোয় একে একে বহির্গত হন শামসুন নাহার মাহমুদ, বেগম সুফিয়া কামাল, সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দিন সাহেব ও তদীয় কন্যা বেগম সম্পাদক নুরজাহান এবং সর্বশেষ আমাদের চট্টগ্রামের ওয়াশিকা, লুবনা এবং কাবেরী; মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবের আগুনে জ্বলে ওঠা তিন কন্যা-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত (যোশী), বীণা দাশ (ভৌমিক) শুধু নারী নন, বাংলার পুরুষেরও সমান আরাধ্য দেবী।
মধ্যবর্তী সময়ে চকমকির ন্যায় জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠেন পোস্তার পাড়ের আছমা খাতুন, সাতবাড়িয়ার স্বনামধন্য নাজির কৃষ্ণ চন্দ্র চৌধুরীর পৌত্রী জ্যোতির্মালা দেবী, চুনতির জওশন আরা রহমান, হারবাঙ-এর খান বাহাদুর জালালউদ্দিন আহমদের কুলতিলক মাহফিল আরা, চান্দগাঁও মৌলভী বাড়ির প্রফেসর চেমন আরা বেগম, প্রতিভা মুৎসুদ্দী, আন্তর্জাতিক খ্যাত ভাস্কর বাঁশখালীর নভেরা আহমদ, তোহফাতুন্নেছা আজিম, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এমপি, খালেদা খানম, রাশেদা খানম, জাহানারা আঙুর। ওয়াশিকা, লুবনা, কাবেরী, সনি উপরে উল্লেখিত স্বনামধন্য পূর্বসূরীদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে তাদের গন্তব্য খুঁজে নেবেন এমন প্রত্যাশা করা নিশ্চয় অসঙ্গত হবে না।