ভ্রাতৃপ্রেমের চিরায়ত দৃষ্টান্ত হিসেবে ক্রেতা যুগে ভারতে রচিত মহাকাব্য ‘রামায়ন’-এর নাম চরিত্র ভগবান রাম এবং তদনুজ লক্ষণ-দুই ভাইয়ের কাহিনী উল্লেখিত হয়। রামকে যখন ১৪ বছর বনবাসে যেতে হয়, তখন অনুজ লক্ষণও অগ্রের অনুগমন করে পঞ্চবটি বনে যান। ১৪ বছর বনবাসকালে লক্ষণ রাম ও সীতার সেবা করেন। তিনি রামের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে গিয়ে দুর্বাসা ঋষির সামনে নিজেকে উৎসর্গ করেন এবং সরযূ নদীতে দেহত্যাগ করে রামের প্রতি তাঁর চূড়ান্ত আনুগত্য প্রকাশ করেন।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত শিল্প জিপিএইচ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং তাঁর সহোদর মোহাম্মদ আলমাস শিমুলের কথা শুনে আমার রাম ও লক্ষণের ভ্রাতৃপ্রেমের কিংবদন্তীর কথাই মনে পড়ে গেল। জিপিএইচ-এর ফিন্ড মার্শাল যদি হন জাহাঙ্গীর সাহেব, তাহলে তাঁর ডেপুটি বা সেকেন্ড-ইন-কমান্ড শিমুল সাহেব। অগ্রজের প্রতি অনুজের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রামের প্রতি লক্ষণের আনুগত্যই স্মরণীয় ।
জাহাঙ্গীর সাহেব একজন শিল্প-চিন্তাবিদ, যিনি শুধু পয়সা দিয়ে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার কারণে শিল্পপতি আখ্যায়িত হতে চান না, তিনি বহুদূর অবধি ভবিষ্যৎ কল্পনার চোখে প্রত্যক্ষ করার দূরদৃশী মানুষ, একজন কবি ও বিজ্ঞানী বললেই যার যথার্থ অভিধা হতে পারে।
জিপিএইচ-এর উৎপত্তি কিভাবে হলো জানতে গিয়ে যা জানতে পারলাম তাতে জাহাঙ্গীর সাহেবের প্রতি আমি আরো শ্রদ্ধালু হয়ে পড়ি। জিপিএইচ কোন মামুলি নাম নয়, ইংরেজি ৬টি শব্দ দিয়ে গঠিত তিনজোড়া সেট থেকে উৎপন্ন হয়েছে— এচঐ – এ দিয়ে “এড়ফ ভবধৎরহম”, চ দিয়ে “চষধরহ ষরারহম” এবং ঐ দিয়ে নিষ্পন্ন হয় “ঐরময ঞযরহশরহম”- তার মধ্যে নির্হিত রয়েছে একটি দার্শনিকতা, সুগভীর জীবনবোধ। গ্রিক দার্শনিক মহামতি এরিস্টটলের নামে-চষধরহ ষরারহম এবং ঐরময ঞযরহশরহম-এমনি দার্শনিক প্রত্যয় প্রচারিত আছে। এরিস্টটল থেকে উক্ত জীবন দর্শণ আহরণ করে জাহাঙ্গীর সাহেব তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিল্পের নীতি ঘোষণা করেছেন। শুধু তার শিল্পের নয়, এটি যে তাঁর জীবন দর্শনও, তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। এরিস্টটলের উক্তির সঙ্গে গডফিয়ারিং শব্দবন্ধ যুক্ত করে তিনি যে খোদাভীরু তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামকরণে এমনি আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিকতার প্রমাণ দেন পিএইচপি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আলহাজ সুফি মিজানুর রহমান।
ইস্পাত বিপ্লবের দৌড়ে একটু দেরিতেই সামিল হয় জিপিএইচ ইস্পাত। কিন্তু রেসের মাঠের সেই টগবগে তেজী ঘোড়ার মত, অনেক পেছনে থেকেও একের পর এক সকলকে ছাড়িয়ে সে ঘোড়া ফটো ফিনিশংয়ে পৌঁছে যায়। জিপিএইচও ইস্পাত তৈরিতে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবাইকে ছাড়িয়ে ১নং অবস্থানে উন্নীত হয়ে মার্কেট লিডার হয়ে যায়।
জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, যাঁকে প্রতিষ্ঠানটির প্রাণপুরুষই বলতে হয়, তাঁর বক্তব্য হলো—‘আমরা কত উৎপাদন সক্ষমতার নতুন কারখানা করব, সেটি এখনো চূড়ান্ত করিনি। অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ার পরই বিস্তারিত পরিকল্পনায় যাব।’
জিপিএইচ কোয়ান্টামের উচ্চশক্তির রড নিয়ে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উচ্চশক্তির রড ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে পরিমাণগতভাবে রডের ব্যবহার কমানো সম্ভব। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা হবে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতি হবে আরও মজবুত।
এটা হচ্ছে রাম-রূপ জাহাঙ্গীর সাহেবের কথা, আর লক্ষণ-রূপী আলমাস শিমুল সাহেব বলছেন, -‘জিপিএইচ ইস্পাত শিল্পে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে চায়’।
দেশে একের পর এক অনেক বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। বিএসআরএম, একেএইচ, জিপিএইচ ইস্পাত—একে একে এমনি এক একটি বিপ্লবের নাম; বলতে হয় আরো একটি নাম— কেআরএসআরএম। সবার ওপরে খোদ বাংলাদেশ, একাত্তরের নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশই তো ছিলো সবচেয়ে বড় বিপ্লব। সেই দেশের ভৌত অবকাঠামো গড়ে তুলবার জন্য যখন প্রয়োজন পড়লো নির্মাণ বিপ্লবের, তখন হাত ধরাধরি করে ভিড় করে আসে উপর্যুক্ত চারটি নাম। চোখ ঢেকে যায় তাদের বিজ্ঞাপনে— তাদের আগ্রাসী ক্ষুধা খেয়ে ফেলে পত্রিকার প্রথম পাতা, টিভি পর্দা কেঁপে যায় বাহারি বিজ্ঞাপনে।
আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধায় বাস্তুশিল্পীদের কল্পনায় পাখা মেলে গড়ে ওঠে আকাশ ছোঁয়া দশ বিশ, ত্রিশ তলা, অফিস, কনডোমিনিয়ামের একের পর এক স্কাইস্ক্যাপার। লোহা ও ইস্পাতই তার মেরুদণ্ড। রাজপথ, ব্রিজ, ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড হাইওয়ে, মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, বিমান বন্দর, সুপার শপ, ফিউচার পার্ক, রাজপ্রাসাদ, আলিশন রিসর্ট, পাঁচতারা, সাততারা হোটেল, সবই তো নির্মাণ শিল্পের অন্তর্গত আর নির্মাণ মানেই তো লোহা, ইস্পাত, ইট, বালি, সিমেন্টের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য।
মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে লোহার অবদান অপরিসীম। যেমন পাথরের ঘর্ষণে অগ্নি উৎপন্ন হত দেখে মানুষ যেদিন আগুন ব্যবহার করতে শিখলো, সেদিন মানব সভ্যতার ইতিহাসে সত্যিকার বিপ্লব সাধিত হয়েছিলো। আগুন হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা, শীত নিবারণে সহায়ক হয়েছিল। তখনো পাথর এবং কাঠ ছিল মানুষের শিকারের হাতিয়ার। সেটা ছিল শিকারের যুগ। তখনো বৃক্ষোপরি ছিলো মানুষের বসবাস।
যেদিন লোহার আবিষ্কার হলো, সেদিনই মানুষের জীবনে আরেক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। মানব সভ্যতা সমুখপানে বড় এক ধাপ এগিয়ে গেল (অ মৎবধঃ ষবধঢ় ভড়ৎধিৎফ)। লোহা থেকে হাতিয়ার তৈরি হলো, মানুষ বৃক্ষশাখা থেকে মাটিতে নামলো। তারপর গুহা হলো মানুষের আবাসস্থল। লোহার ব্যবহার করতে করতে মানুষ নদীতীরে উপনীত হলো এবং নদীতীরেই গড়ে উঠলো সব প্রাচীন সভ্যতা। নদীর পানি থেকে মানুষ চাষাবাদ করতে শিখলো, এলো কৃষির যুগ। অনেকদিন স্থায়ী হলো কৃষি সভ্যতা। তারপর নগর সভ্যতা এবং আরো অনেক ধাপ অতিক্রম করে ইউরোপে সৃষ্টি হলো ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র এবং ঘটল শিল্প বিপ্লব। ইতিমধ্যে মানুষ আরো অনেক কিছু আবিষ্কার করলো।
বাংলাদেশে লোহার ব্যবহার কখন থেকে শুরু হয়েছে, সেটা সন তারিখ নির্ণয় করে বলা মুস্কিল। তবে ব্যাপকভাবে লোহার ব্যবহার আরম্ভ হলো নির্মাণ শিল্পের বিকাশের কারণে। পাকিস্তান আমলে আজকের বাংলাদেশ ছিলো পূর্ব পাকিস্তান- পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। পাকিস্তানের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ছিল পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নবাব, রাজা, জমিদারদের হাতে কেন্দ্রীভূত; তারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনি বানিয়ে রেখেছিলো। যেভাবে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ তো বটেই, গোটা ভারত ছিল সাহেবদের কলোনি। পূর্ব পাকিস্তানে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট অর্থাৎ ভৌত অবকাঠামো তেমন কিছুই তারা তৈরি করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, পাটনির্ভর অর্থনীতি বললেও ভুল বলা হবে না। পাটের ওপর নির্ভর করে পাকিস্তানের কথিত ২২ পরিবার যে শিল্প-কারখানা করেছিল পূর্ব পাকিস্তানে, তার লাভ নিয়ে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে; উন্নয়ন করতো সেখানে। সেজন্যই তো হলো কত আন্দোলন, সংগ্রাম; তাতেও যখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের টনক নড়লো না, তখন বঙ্গবন্ধুর আহবানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি এবং ৩০ লাখ বাঙালি এক সাগর বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে আলাদা হয়ে গেল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
স্বাধীনতার পূর্বে চট্টগ্রামে লোহা তৈরি করতো আজকের বিএসআরএম-এর পূর্বসূরী এইচ আকবর আলী। তারা লোহা বুঝতো, কারণ লোহা ছিল তাদের খানদানি জিনিস। স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছর বঙ্গবন্ধুর হিমালয়তুল্য ব্যক্তিত্ব এবং অলৌকিক জাদুকরী হাতের ছোঁয়ায় সারিয়ে তোলা দেশ যখন উন্নয়নের জন্য দৌড় শুরু করেছিলো রানওয়েতে, তখনই বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবার পরিজনসহ দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছিলো নরপশুরা। তারপর মুশতাকের ক্ষণকালের শাসনের পর জিয়াউর রহমান একাধিক ক্যু ও পাল্টা ক্যুর মধ্য দিয়ে অনেক হত্যাকাণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডের পর দেশে যখন স্থিতিশীলতা এনেছিলেন এবং পর্যায়ক্রমে ঝানু আমলা শফিউল আজম, অভিজ্ঞ চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট জামাল উদ্দিন ও সাইফুর রহমানরা অর্থনীতির রশি হাতে পেলেন, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছু কিছু শিল্প-কারখানা গজাতে দেখা গেল। অবশ্য তার আগেই বুদ্ধিমান আখতারুজ্জামান বাবু যে জাবেদ স্টিল ও আসিফ স্টিল নামে দুটি স্টিল মিল ও একটি রঙের কারখানা করে ফেলেছিলেন সেকথাও বলতে হয়। এই পটভূমিতে একদিকে গার্মেন্টস, অন্যদিকে রড শিল্পের পত্তন হয়েছিলো বাংলাদেশে। ‘হিজবুল বাহার’ নামে যে পানির জাহাজে চড়ে মানুষ হজে যেত, সেটি অকেজো হয়ে গেলে একজন শিল্পপতি সেটি কিনে এনে কাটা শুরু করলে তার পাইপ, লোহার পাত দিয়ে শুরু হয় রি-রোলিং মিলুরড শিল্পের যাত্রা। আখতারুজ্জামান বাবুর শ্বশুর আনোয়ারা জুট মিলের মালিক লালু কন্ট্রাক্টর বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হয়তো জাহাজ ভাঙা শিল্পের পাইওনিয়ার। তিনি নাসিরাবাদে একটি মিলও করেছিলেন। আমাকে বাংলাদেশের খড়হমবংঃ ঝবৎারহম ইধহশবৎ দিলীপ বাবু (দাশগুপ্ত) জানালেন, ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন সাবেক বিসিসিআই ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার সেকেন্ড অফিসার, তখন হেগী এন্ড কোম্পানির এমডি এম এ জিন্নাহ (পরে বিএনপি নেতা এবং দু’বার মিরসরাই থেকে বিএনপির টিকিটে নির্বাচিত এমপি; জিয়াউর রহমানের স্বনির্ভর উপদেষ্টা এবং পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী মাহফুজুল হকের পুত্র) তাঁর কাছে জাহাজ ভাঙার জন্য লোন চাইতে গিয়েছিলেন। তাঁর কথা মানলে জিন্নাহ সাহেবই শিপ-ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রির অগ্রদূত বলতে হয়।
যাই হোক, জিয়ার আমলে দেশে অনেকের হাতে টাকা-পয়সা আসতে থাকলে তারা অফিস, ঘরবাড়ি তৈরি শুরু করেছিলেন, ফলে লোহার চাহিদা এবং বাজার সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ সস্তায় জমি কিনে প্রথম দিকে প্লট বিক্রি এবং পরে বিল্ডিংও তৈরি করেছিলেন। ঢাকায় প্রথম দিকের এমনি একজন ডেভেলপার হচ্ছেন ইস্ট-ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট বা বসুন্ধরার মালিক আহমদ আকবর সোবহান ওর্ফে শাহ আলম।
তারপর জাতীয় বাজেটের আকারও বড় হতে থাকে। সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়। লোহার মার্কেট বুম করে। গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক রি-রোলিং মিল, স্টীল মিল। প্রথমে লোহা-তারপর ইস্পাত এবং ইস্পাতেরও যে কত রকমকের সেটা বুঝতে আমাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। ৫০০, ৬০০ গ্রেড, টিএমটি। বিএসআরএম ৬০০ গ্রেডের রড উৎপাদন করে বাংলাদেশে ইস্পাত তৈরিতে বিপ্লব করলো সত্যি, কিন্তু আবুল খায়ের তো আরেক কাঠি সরেস; তারা ইলেক্ট্রিক আর্ক ফানেল ব্যবহার করে আরো শক্তিশালী রড তৈরির দাবি জানালে পিছন থেকে মুচকি মুচকি হাসছিলেন জিপিএইচ-এর প্রাণপুরুষ জাহাঙ্গীর সাহেব। তিনি আরো এক ধাপ এগিয়ে বললেন, তারা বিশ্বের সর্বাধুনিক কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তিতে রড তৈরি করছেন।
জিপিএইচ প্রথমবারের মতো বুয়েট দ্বারা পরীক্ষিত জিপিএইচ কোয়ান্টাম বি-৬০০-সি-আর স্টিল রি-বার উৎপাদন শুরু করেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান আবাসিক ও অবকাঠামোগত নির্মাণের চাহিদা পূরণের জন্য জিপিএইচ এটি উৎপাদন করেছে। এই স্টিল রি-বার বাজারের যে কোন রডের চেয়ে শক্তিশালী এবং নির্মাণে রডের ব্যবহার ১৬%-৩০% কম হবে। পাশাপাশি শ্রমিক সহ অন্যান্য নির্মাণ খরচও কমে আসবে এবং ফ্লোর স্পেস বৃদ্ধি সহ নির্মাণের গুণগত মান উন্নত করবে এবং বিল্ডিংয়ের ডেডলোড কমিয়ে দেবে।
২০২০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় এশিয়ার মধ্যে প্রথম ও বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় হিসেবে বাংলাদেশে এমন প্রযুক্তি নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এই প্রযুক্তিতে উৎপাদিত ৬০০ গ্রেডের উচ্চশক্তির রড জিপিএইচ কোয়ান্টাম ব্র্যান্ডে বাজারজাত করছে তারা। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ বিভিন্ন প্রকল্পে জিপিএইচ ইস্পাতের রড ব্যবহৃত হয়েছে।
বাংলাদেশে জিপিএইচ ইস্পাত প্রথম উচ্চশক্তির ৬০০ গ্রেড রড উৎপাদন ও বাজারজাত করছে—জানালেন জিপিএইচ-এর হেডঅব কোয়ালিটি কন্ট্রোল প্রকৌশলী মশিউর রহমান ভূঁইয়া। জিপিএস কোয়ান্টামের ৬০০ গ্রেডের রডের লোডিং সক্ষমতা বেশি। এতে ৬০০ গ্রেডের রড ব্যবহার করলে ৫০০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ এবং ৪২০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ রড সাশ্রয় হয়। আর যখন রডের ব্যবহার কমে, তখন কলামের সেকশন সাইজ কমিয়ে ভবনের নকশা করলে বেশি জায়গা পাওয়া যায়। ফলে সার্বিকভাবে নির্মাণ খরচ কমে।
সীতাকুণ্ডে ১৫০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা কারখানায় জিপিএইচ ইস্পাতের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানে ১০ লাখ টন। জিপিএইচের কারখানায় উৎপাদিত ইস্পাত চীনেও রপ্তানি হয়েছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, দেশে ইস্পাত খাতে স্বয়ংক্রিয় কারখানা প্রায় ৪০টি। তার মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪-৫টি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে ১ কোটি টনের বেশি রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। দেশে রডের বার্ষিক ব্যবহার ৬৫-৭৫ লাখ টন।
যে ইলেক্ট্রিক আর্ক ফার্নেসে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সকল প্রকার স্ক্র্যাপ, অ্যালয় ও অ্যাডিটিভস এর পরিমিত পরিমাণ ব্যবহার নিশ্চিত করে স্ক্র্যাপ প্রি-হিটিং এর মাধ্যমে ফ্লাট বাথ অপারেশনের দ্বারা সম্পূর্ণ মেল্টিং ও রিফাইনিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর সাইফোনিক বটম ট্যাপিং এর মাধ্যমে ১০০% স্ল্যাগ ফ্রি গলিত ইস্পাত উৎপাদন করা হয় তাকেই বলা হয় কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রিক আর্ক ফার্নেস।
স্টেট অফ আর্ট টেকনলজি : বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্টিলের গুনগত মান নিশ্চত করেই তৈরি হচ্ছে জিপিএইচ ইস্পাত প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে মানুষের কল্যাণ এবং টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়। একইসাথে অবিচল লক্ষ্যে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং দেশীয় ইস্পাত শিল্পকে উত্তরোত্তর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে নিতে দেশে জিপিএইচ ইস্পাত-ই সর্বপ্রথম নিয়ে এসেছে খবাবষ ২.৫ অটোমেশন ও সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড ইন্টিগ্রেটেড ডিজিটাল শিল্প প্রযুক্তি যা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ নামেও বহুল পরিচিত। এই ধরনের এডভান্স স্টিল মেকিং ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রয়োগ প্রচলিত ইন্ডাকশন ফার্নেস টেকনোলজিতে একেবারেই অসম্ভব। এই সমস্ত টেকনিক্যাল কাজ সম্পাদনের জন্য জিপিএইচ ইস্পাতে রয়েছে স্টিল তৈরির বিশেষায়িত প্রকৌশল শাখা যেমন, মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন শাখার অনেক অভিজ্ঞ প্রকৌশলী। এইসব প্রকৌশলীদের বিশেষায়িত কারিগরি দক্ষতা ও বিশ্বসেরা প্রযুক্তির সংমিশ্রনে জি পি এইচ কোয়ান্টাম রড আজ বিশ্বসেরা। পিপলস, প্যান্ট এবং পারফরম্যান্স এই তিনটি টেকসই স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে তাদের ইস্পাত উৎপাদন। পরিবেশের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে জিপিএইচ এমন এক টেকনলজিতে রড উৎপাদন করে যা কিনা বিশ্বব্যাংক সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল পরিবেশ মানদণ্ডের ভিত্তিতে উত্তীর্ণ। আর সে কারণেই বর্তমানে এটি একটি ওঝঙ ৯০০১: ২০১৫ (ছঁধষরঃু গধহধমবসবহঃ), ১৪০০১: ২০১৫ (ঊহারৎড়হসবহঃ গধহধমবসবহঃ) ্ ৪৫০০১: ২০১৮ (ঙপপঁঢ়ধঃরড়হধষ ঐবধষঃয ্ ঝধভবঃু গধহধমবসবহঃ) স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান।
সেখানে ১৫ লাখ ঘনমিটার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়ার পর নির্গত পানি পরিশোধন করে আবারও ব্যবহার করা হয়। এতে ৯০ শতাংশ পানিই আবার ব্যবহার করা হচ্ছে।
জিপিএইচ ইস্পাত ১৮ নভেম্বর ২০২০ থেকে ইস্পাত পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশ চীনে বিলেট রপ্তানি শুরু করেছে। ওইদিন বিকেলে ওয়েবিনারে শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম চেম্বার এর প্রেসিডেন্ট ও আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এ রপ্তানি কার্যক্রমের উদ্বোধন হয় । যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ চালান । বাংলাদেশ থেকে একসঙ্গে এত বড় চালান এর আগে কখনো রপ্তানি হয়নি । এরই ধারাবাহিকতায় ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম চালান রপ্তানি হয়েছে চীনে ।
বাংলাদেশের ভারি শিল্প পণ্যের রপ্তানি শুরু ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে শিপ বিল্ডিং সেক্টরের মাধ্যমে, যদিও ১৩ বছরে উক্ত সেক্টর মাত্র ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে ইস্পাত শিল্পে রপ্তানি দেশের রপ্তানি খাতের নতুন সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ যাবৎ জিপিএইচ ইস্পাত কর্তৃক রপ্তানিকৃত বিলেটের সারসংক্ষেপ নিম্নে দেয়া হলোঃ
জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ‘বিশ্বের প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সবচেয়ে উন্নত দেশ চীনে জিপিএইচ ইস্পাত বিলেট রপ্তানি করছে; যা একমাত্র সম্ভব হয়েছে উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানের কারণে। আর গুণগত মান নিশ্চিত হওয়ায় আমাদের প্রতিষ্ঠান বিশ্বমান অর্জন করেছে। উল্লেখ্য যে, দেশের পুঁজিবাজারের জিপিএইচ ইস্পাত ২০১২ খ্রিস্টাব্দে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মানসম্মত ইস্পাত উৎপাদন প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বড় ধরনের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে কাজ শুরু করেছিল জিপিএইচ ইস্পাত। বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতাসহ এমএস বিলেটের মোট বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১০ লাখ ০৮ হাজার মেট্রিক টন এবং এমএস রড ও মিডিয়াম সেকশন প্রোডাক্টের মোট বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ০৭ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন।’
বিলেটের চাহিদা পাঁচ বছর আগেও ছিল বছরে ৪০ লাখ টনের কাছাকাছি। তখন আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮ লাখ টন । বাকী প্রায় ২১-২২ লাখ টনের চাহিদা মেটানো হতো দেশে তৈরি বিলেট ও জাহাজ ভাঙা শিল্পের লোহার পেট থেকে। কিন্তু, পাঁচ বছরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে সেই চিত্র পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
ইস্পাত উৎপাদনে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে চীন। বাংলাদেশেও বিলেট আমদানির সিংহভাগ আসত চীন থেকে। আর সে দেশেই বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিলেট রপ্তানির কৃতিত্ব দেখিয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত। বিলেট রপ্তানি বিবেচনায় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী জিপিএইচ ইস্পাত। জিপিএইচ ইস্পাত ইতিমধ্যে চীনে রপ্তানি করেছে এক লাখ টন। দুবাইতেও বিলেট রপ্তানির ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছে।
জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘রপ্তানিকে একটি ভালো জায়গায় নেয়ার একটি বড় পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছি আমরা । নতুন প্রযুক্তিতে অক্সিজেন ব্যবহারের মাধ্যমে স্ল্যাগ ফেলে দিয়ে নিখাদ স্টিল তৈরি করছি যা বায়ুদূষণ কমাতে খুবই কার্যকর। এছাড়া সাধারণ কারখানায় এক টন ইস্পাতপণ্য তৈরিতে যে বিদ্যুৎ খরচ হয় কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস পদ্ধতির কারখানায় একই পরিমাণ ইস্পাত বা ইস্পাতপণ্য তৈরিতে খরচ হবে তার অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ। একইভাবে প্রচলিত প্রযুক্তির বিভিন্ন কারখানার তুলনায় জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় প্রাকৃতিক গ্যাসের সাশ্রয় হবে। জ্বালানির অপচয় রোধ হলে ব্যবসার ব্যয় কমবে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে । আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত, গ্যাসও কম। তাই সবকিছুই বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে । আমদের পদক্ষেপগুলো এমন হওয়া উচিত যেন ২০৪১-এর আগে আমরা উন্নত দেশে রূপান্তর হতে পারি ।
মেল্টিং সেকশনে সর্বাধুনিক কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেসে সর্বোচ্চ বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে বিলেট উৎপাদনের পাশাপাশি বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার, সৌরবিদ্যুৎ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে উৎপাদনে ব্যবহার, পানি ও বায়ু পরিশোধনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থার মাধ্যমে কারখানাটিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।
জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, যাঁকে প্রতিষ্ঠানটির প্রাণপুরুষই বলতে হয়, তাঁর বক্তব্য হলো—‘আমরা কত উৎপাদন সক্ষমতার নতুন কারখানা করব, সেটি এখনো চূড়ান্ত করিনি। অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ার পরই বিস্তারিত পরিকল্পনায় যাব।’
জিপিএইচ কোয়ান্টামের উচ্চশক্তির রড নিয়ে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উচ্চশক্তির রড ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে পরিমাণগতভাবে রডের ব্যবহার কমানো সম্ভব। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা হবে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতি হবে আরও মজবুত।
পরিবেশবান্ধব উৎপাদনব্যবস্থা : জিপিএইচ-এর কারখানায় মেল্টিং সেকশনে কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেসে উৎপাদন চলছে। দৈত্যকার সেই চুল্লির বেশ কয়েক ফুট দূর দিয়ে যাওয়ার সময় আগুনের উত্তাপ গায়ে লাগে। তারপর ল্যাডেল রিফাইনিং ফার্নেস পেরিয়ে কনটিনিয়াস কাস্টিং মেশিনে বিলেট উৎপাদনের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
উৎপাদিত বিলেট সরাসরি রোলিং মিলে পাঠানো হয়। বিলেট উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় কিছু তাপমাত্রা হারায়। তখন রি হিটিং ফার্নেস বা ইন্ডাকশন হিটারে উত্তপ্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোলিং মেশিনে রোলিং করা শুরু হয়। একের পর এক মেশিনের ভেতরে রোল হয়ে শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট আকৃতির রড আকারে বের হয়। সেই রড কুলিং বেডে শীতল করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঁধাই করা হয়। তারপর চুম্বকযুক্ত বিশাল ক্রেন দিয়ে ট্রাকে তোলা হয়। কারখানাটিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে কার্বন নিঃসরণ খুবই কম।
রড উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। আর সীতাকুণ্ডে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খুবই নিচে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পাশের পাহাড়ি এলাকায় বিশাল আধার বা ড্যাম গড়ে তুলেছে জিপিএইচ ইস্পাত।
২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ১৭ মে জিপিএইচ ইস্পাত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে কার্যক্রম শুরু করে। এটি ২০১২ খ্রিস্টাব্দে একটি পাবলিক লিমিটেড সংস্থা হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে তার সম্প্রসারণ প্রকল্প শুরু করে। সংস্থাটি ৮ লক্ষ মেট্রিক টন বার্ষিক ক্ষমতার ইস্পাত কারখানার জন্য প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। জিপিএইচ তার সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সংগ্রহ করেছে।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানিটি প্রাইমট্যালস টেকনোলজিস, সিমেন্স ভিএআই এবং মিৎসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড পার্টনারদের যৌথ উদ্যোগের সহযোগিতায় সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রামে তার সম্প্রসারণ প্রকল্প শুরু করে। কোম্পানিটি ০.৮ গঞচণ ইস্পাত উৎপাদন সুবিধার জন্য প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। নতুন মিলটি একটি কোয়ান্টাম বৈদ্যুতিক আর্ক ফার্নেস, একটি ল্যাডেল ফার্নেস, একটি থ্রি-স্ট্র্যান্ড, উচ্চ-গতির অবিচ্ছিন্ন বিলেট কাস্টার এবং একটি বার এবং সেকশন মিল ব্যবহার করে। এটি বিশ্বে প্রথমবারের মতো রোলিং মিলের জন্য ডরহখরহশ ঋষবী প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কোম্পানি ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পুঁজিবাজার এবং সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য কোম্পানির রক্ষিত আয়ের মাধ্যমে মোট টঝ$১৫৪ মিলিয়ন সংগ্রহ করেছে। এটি তার পুরনো ইস্পাত কারখানার পাশে নতুন কারখানার জন্য ৮.৮৫ একর জমি কিনেছে।
এটি জার্মানির ঙউউঙ ইঐঋ ব্যাংক থেকে $৯৫ মিলিয়ন এবং বিশ্বব্যাংক থেকে $৪৪.২ মিলিয়ন মেয়াদী ঋণ সংগ্রহ করেছে, যা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছিল।
এটি সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে স্থানীয় এবং বিদেশী বাজারে তার নতুন প্ল্যান্টের পণ্য বিক্রি শুরু করছে। ২০২৩ এবং ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানিটি অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (ধ২র) এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত দায়িত্বশীল উৎপাদন ও ব্যবহার বিভাগে ” ঝউএ ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার” অর্জন করে। ২০২৪ সালের আগস্টে, কোম্পানিটি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ২৪২ কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য রাইট শেয়ার ইস্যু করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে ।
জিপিএইচ ইস্পাতে ঘণ্টায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এর বড় অংশ জাতীয় গ্রিড থেকে নেওয়া হলেও কারখানার মধ্যে গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১২ মেগাওয়াট উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া ৬ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে জিপিএইচ রিনিউবল পাওয়ার প্ল্যান্ট। সেটি কিনে নেয় জিপিএইচ ইস্পাত। এ ছাড়া কার্বন ক্রেডিটের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান সেই বিদ্যুতের দাম দিচ্ছে মাসে ২০ লাখ ডলার। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জিপিএইচের চুক্তি চার বছরের।
রডের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত। রডের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে ১৮ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার লাগবে। এর মধ্যে ১৫ কোটি ডলার হংকং স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বাকি অথের্র যোগান আসবে কোম্পানির পুঞ্জীভূত মুনাফা বা রিটেইনড আর্নিংস থেকে।
দেশ ও জনগণের সেবায় জিপিএইচ
জিপিএইচ শুধু ইস্পাত তৈরি করে না, দেশ গঠন এবং সমাজ উন্নয়নেও অবদান রাখার মাধ্যমে ইতিমধ্যে সুধীজনের প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। জিপিএইচের উৎপাদিত রড, বিলেট ইত্যাদি দেশের অবকাঠোমো উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ গঠনে অবদান রাখছে, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। সিএসআর অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তার, প্রতিভা অন্বেষণ, ক্রীড়া, বিনোদন এবং দুঃস্থ ও আর্তমানবতার সেবায় তার সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছে। করোনার অতিমারীর ন্যায় বৈশ্বিক ও দৈশিক সংকটে অক্সিজেন সরবরাহ করে মানবতার ত্রাণে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে জিপিএইচ।
করোনা মহামারীর ক্রান্তিলগ্নে যখন বাংলাদেশে হাহাকার চলছিল, জীবন সঞ্জীবনী অক্সিজেনের জন্য এমন সংকটকালীন সময়ে বিনামূল্যে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, মা ও শিশু হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, ফিল্ড হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, মুন্সীগঞ্জ জেলা এবং উপজেলায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিতরণ করেছে জিপিএইচ ইস্পাত। করোনাকালীন সময়ে জিপিএইচ সারা বাংলাদেশের প্রায় ৮০,০০০ অক্সিজেন সিলিন্ডার বিনামূল্যে রিফিলসেবাসহ বিতরণ করেছে।
দেশের সাংবাদিকতার একজন কিংবদন্তী, জ্যেষ্ঠতম সম্পাদক, চট্টগ্রামের প্রাচীনতম দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক ‘একুশে পদক’ লাভ করায় ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল রেডিসন ব্লুু হোটেলে জিপিএইচ পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৮ মার্চ ২০২২ খ্রিস্টাব্দে জিপিএইচ ইস্পাত তাদের কর্মকর্তাদের সন্তানদের জন্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডস্থ কুমিরা অফিসে ‘ভবিষ্যত বাংলাদেশ” শীর্ষক এক চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের সীতাকুণ্ডের কুমিরাস্থ প্ল্যান্ট ও তার পার্শ্ববতী এলাকার মহিলাদের জন্য দিনব্যাপী চিকিৎসা ক্যাম্প করে। এতে আশাপাশের গ্রামের কয়েক’শ দরিদ্র মহিলাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ প্রদান করা হয়।
এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করে জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জিপিএইচ প্রথমবারে মত মহিলাদের জন্য ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পের আয়োজন করেছে।
অনুষ্ঠানে জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল বলেন, মানুষের সেবায় সব সময়ই জিপিএইচ কাজ করে চলেছে।
২০২২ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে চট্টগ্রাম রেডিসন ব্লু হোটেলে জিপিএইচ ইস্পাত মিট দ্যা ডেভেলপমেন্ট মাস্টারমাইন্ডস ২০২২ অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ১৭৪ জন প্রকৌশলী অংশ নেন।








