প্রায় ৭ ঘণ্টার চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজের আগুন। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিটসহ অন্যান্য বাহিনীর অক্লান্ত চেষ্টায় রাত ৯টা ১৮ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে এই ভয়াবহ আগুন।
তবে রাত ২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করা যায়নি।
গত শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিটের দিকে বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় আকস্মিকভাবে আগুন লাগে। খবর পেয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে একে একে ঘটনাস্থলে আসে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট। পাশাপাশি বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণে নামে। তাদের সহযোগিতায় আসে পুলিশ, র্যা ব, আনসার ও সেনাবাহিনী।
প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে পুড়ে গেছে বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো শাখায় থাকা হাজার হাজার কোটি টাকার মালামাল। বিমানবন্দরের এই শাখায় রাখা ছিল বিদেশ থেকে আমদানি করা পোশাক, ইলেকট্রনিকস পণ্য ও রাসায়নিকসহ বিভিন্ন পণ্য।
বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের পাশেই ছিল এই আমদানি কার্গো শাখা। ঠিক কোথায় থেকে আগুনের সূত্রপাত তা এখনো জানা না গেলেও সেখানে কুরিয়ার সার্ভিসের গোডাউন, ফার্মাসিউটিক্যাল ও ভ্যারাইটিজ পণ্যের গোডাউন, কুল রুম, ডেঞ্জারাস গুডসের (বিস্ফোরক দ্রব্য) গোডাউন, আমদানি করা মোবাইলের গোডাউন ও বিজিএমইর গোডাউন ছিল।
আগুনে আমদানি করা সব পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর। তামিম এক্সপ্রেস লিমিটেড নামের একটি কুরিয়ার কোম্পানির পরিচালক সুলতান আহমেদ বলেন, সকালেই তার কোম্পানির আড়াই টন মালামাল নেমেছে কার্গো শাখায়। শনিবার অর্ধদিবস কার্যক্রম চলায় কোনো মালামালই তিনি বের করতে পারেননি। সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।
দাহ্য পদার্থ থাকায় ভয়াল হয়ে ওঠে আগুন
আমদানি কার্গো শাখার একটি গোডাউনে বিভিন্ন ধরনের আমদানি করা রাসায়নিক রাখা হয়। সেখানে বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে বলে জানিয়েছেন ওই শাখায় কর্মরতরা। তারা জানান, রাসায়নিক থাকায় পানি দিয়ে সহজে আগুন নেভানো যায়নি। বরং দাউদাউ করতে জ্বলতে থাকে।
বিমানবন্দরের ভেতরে বিদেশগামীদের ভোগান্তি, বাইরে স্বজনদের অপেক্ষা
অগ্নিকাণ্ডের কারণে বিমানবন্দরে প্রায় ৭ ঘণ্টা বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে ভোগান্তিতে পড়েন বিভিন্ন দেশে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা। ফ্লাইট বন্ধ থাকায় দীর্ঘ সময় ধরে তাদের বিমানবন্দরের টার্মিনালের ভেতরে ও বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। অনেকে কী করবেন, তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন। চাকরি হারানোর শঙ্কায়ও পড়েন কেউ কেউ।
সিঙ্গাপুর যেতে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন মিয়া পারভেজ। তিনি সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানিতে কাজ করেন। রাত ১১টা ৫০ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তার সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা ছিল। আগামী সোমবার (২০ অক্টোবর) তার কাজে যোগ দেওয়ার কথা।
রাত ৮টার দিকে মিয়া পারভেজ বাংলানিউজকে বলেন, ছুটিতে দেশে এসেছিলাম। এখন ফেরত যাচ্ছি। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিমানবন্দরে এসে দেখি আগুনের কারণে ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। পরিবারের যারা সঙ্গে এসেছিলেন তারা আমাকে বিমানবন্দরে দিয়ে চলে গেছেন। এখন কী করব বুঝতে পারছি না। কখন আবার ফ্লাইট দেবে সেটাও বুঝতে পারছি না। সোমবার আমার কাজে যোগ দেওয়ার কথা। যদি সময়মতো যেতে না পারি কোম্পানি তাড়িয়ে দিতে পারে, পারমিট ক্যানসেল করতে পারে।
এদিকে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের নিতে বিমানবন্দরের বাইরে স্বজনদেরও অপেক্ষায় উৎকণ্ঠাময় সময় কাটাতে হয়েছে। কখন স্বজন দেশে ফিরবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে প্রায় সবাই।
১৫ বছর বয়সী রাফিয়া মা ও ভাইয়ের সঙ্গে বিমানবন্দরে এসেছেন দীর্ঘ বছর পর দুবাই থেকে দেশে ফেরত আসা বাবা জালাল হাওলাদারকে নিতে। সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে তার বাবাকে বহনকারী ফ্লাইট বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা ছিল। এখন তারা আর জালাল হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
বিমানবন্দরের সামনে রাফিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমরা মাদারিপুর থেকে এসেছি। সন্ধ্যা ৬টা থেকে বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছি। এতদিন পর বাবা আসছে, সেই খুশিতে ছিলাম। কিন্তু এখন বিরক্ত লাগছে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে জানি না। কেউ কিছু বলতেও পারছে না।
চালু হয়েছে বিমান চলাচল
আগুন নিয়ন্ত্রণের পর পুনরায় চালু হয়েছে বিমান চলাচল কার্যক্রম। রাত ৯টা ৬ মিনিটে ফ্লাই দুবাইয়ের একটি ফ্লাইট নিরাপদে অবতরণ করেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) কাউছার মাহমুদ জানান, রাত ৯টা থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম চালু হয়েছে। রাত ৯টা ৬ মিনিটে ফ্লাই দুবাইয়ের একটি ফ্লাইট নিরাপদে বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
বাতাসের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়
আগুন নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বাতাস সবচেয়ে বড় বাধা ছিল বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। রাত ১০টায় বিমানবন্দরের আট নম্বর গেটের সামনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ জানান।
ডিজি বলেন, আসলে আগুন নেভাতে এসে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বাতাস। যেহেতু এটা খোলা জায়গা, প্রচুর বাতাস ছিল। ফলে অক্সিজেনের প্রাপ্তি সবসময় ছিল, যেটা আগুন জ্বালাতে সহায়তা করে। যে কারণে আপনারা অনেক ওপর পর্যন্ত ধোঁয়া দেখতে পেয়েছেন।
আহত ২৫ আনসার সদস্য
বিমানবন্দরের আগুন নেভাতে গিয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ২৫ সদস্য আহত হয়েছেন। তবে তারা শঙ্কামুক্ত রয়েছেন।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা উত্তর জোন কমান্ডার (উপ-পরিচালক) গোলাম মাওলা তুহিন জানিয়েছেন, আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর বিমানবন্দরে দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। ফায়ার সার্ভিস আসার পরও আমাদের প্রায় ছয়শ আনসার সদস্য আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। এ সময় ২৫ জন আনসার সদস্য আহত হন। তাদের মধ্যে ১০ জনকে সিএমএইচ হাসপাতালে, ৮ জনকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ব্যারাকে পাঠানো হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে দুই কমিটি
কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে এই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এই কমিটিকে দ্রুততম সময়ে অগ্নিকাণ্ডের সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ড ঘিরে ‘ষড়যন্ত্রের’ ধোঁয়া
কার্গো নিরাপত্তা মূল্যায়নে শতভাগ নম্বর অর্জনের সপ্তাহ না পেরোতেই পুড়ে ছাই হয়ে গেল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ। এতে এই অগ্নিকাণ্ড ঘিরে ‘ষড়যন্ত্রের ধোঁয়া তৈরি হয়েছে।
এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতেই ফ্যাসিস্টদের দোসররা জোরালোভাবে নানাধরণের সহিংস কর্মকাণ্ড শুরু করেছে।
দেশে একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, সম্প্রতি দেশে কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং আজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে আগুন লাগার ঘটনাও একইসূত্রে গাঁথা। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত বলে জনগণ বিশ্বাস করে।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতার প্রমাণ পেলে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা গভীরভাবে অবগত। আমরা সব নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই— নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।
এতে আরও বলা হয়, নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।