শেখ মোজাফফর আহমদ একজন অনন্য পুরুষ। নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি। তাঁর জীবন এক বিরল প্রতিভাধর মানুষের উপমা। নানাদিকে বিকশিত হয়েছে তাঁর প্রতিভা; যখন যেদিকে আকৃষ্ট হয়েছে তাঁর প্রতিভা সেইদিকে সৃষ্টির ঝর্ণাধারা নেমেছে। ফোটা ফুলের অপরূপ মেলা বসে গেছে।
রাজনীতিক ছিলেন শেখ মোজাফফর আহমদ। এটাই হয়তো তাঁর আদি ও অকৃত্রিম পরিচয়। কিন্তু রাজনীতি করে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন এমন রাজনৈতিক নেতা ক’জন খুঁজে পাওয়া যাবে। চট্টগ্রামে অনেক খুঁজে আমি সাতটি নাম উদ্ধার করতে পেরেছি। তাঁরা হচ্ছেনÑ কমরেড মুজফফর আহমদ, স্বনামধন্য নূর মোহাম্মদ চেয়ারম্যান, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা আলী আহমদ ওলী ইসলামাবাদী, লোকমান আহমদ শেরওয়ানী, পূর্ণেন্দু দস্তিদার ও অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ। স›দ্বীপ নিবাসী মুসলিম লীগের মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ (অলি গান্ধী) ও কংগ্রেসের অধ্যপক রাজকুমার চক্রবর্তীর কথাও এ প্রসঙ্গে বলতে হয়। তবে অলি গান্ধী যত না রাজনীতিক তার চেয়ে বেশি ছিলেন সাংবাদিক এবং অবশ্যই সাহিত্যিক। রাজকুমার চক্রবর্তী মূলত শিক্ষাবিদ ও স্বদেশব্রতী।
কী মুসলিম লীগ, কী আওয়ামী লীগ, কিংবা ন্যাপ বা কমিউনিস্ট পার্টিÑচট্টগ্রামের তাবৎ রাজনীতিকের মধ্যে শেখ মোজাফফর আহমদের মহিমা এখানেই যে, রাজনীতিতে যেমন তার প্রতিষ্ঠা, সাহিত্যেও তেমনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন তিনি। এই ঘটনা আমাদের বিস্ময়াবিষ্ট করে, বিমোহিত করে।
আরো এক কারণে শেখ মোজাফফর আহমদ বিশিষ্টতার দাবিদার। সেটা হচ্ছে তাঁর সমর প্রতিভা। এখানে তিনি নিঃসঙ্গ শেরপা। রাজনীতিক ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে, কিন্তু সামরিক জ্ঞান আছে এমন রাজনীতিক কী আমরা দেখেছি? আমি অন্তত দেখিনি। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, নেতাজী সুভাষ বসু, মাস্টারদা সূর্যসেন, অনন্ত সিং, লোকনাথ বলেরও সামরিক জ্ঞান ছিলো, কিন্তু তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী রাজনীতিবিদ।
শেখ মোজাফফর আহমদ ফোর্ট উইলিয়ামে হায়দ্রাবাদ রেজিমেন্টের সৈনিক ছিলেন। তিনি আর্মড গার্ডেও যোগদান করেছিলেন। সামরিক জ্ঞানের জন্যেই তাঁকে ন্যাশনাল গার্ডের কমান্ডার করা হয়েছিলো। আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যও তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ও কুচকাওয়াজে সালাম নিয়েছিলেন।
শেখ মোজাফফর আহমদ পাকিস্তান আন্দোলনে চট্টগ্রাম জেলার ন্যাশনাল গার্ডের কমান্ডার ছিলেন। সেজন্যে তাঁর নামের সঙ্গে ‘সালারে জিলা’ এমনভাবে অভেদাত্মক হয়ে যায় যে, তাঁকে ঠিক সালারে জিলা না বললে চেনা যায় না। পাকিস্তান আন্দোলনও আর হবে না। ন্যাশনাল গার্ডও আর হবে না। সুতরাং সালারে জিলাও আর কেউ হবে না। শেখ মোজাফফর আহমদই এক এবং অদ্বিতীয় ‘সালারে জিলা’।
১৯৫৫-৫৮ মেয়াদের পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য শেখ মোজাফফর আহমদ। চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র তিনিই আওয়ামী লীগের টিকিটে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেবার গণপরিষদে আওয়ামী লীগের মাত্র ১৩জন সদস্য ছিলেন। যাদের সমর্থন নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
শেখ মোজাফফর আহমদ বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী পুরুষ। বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য যেমন তিনি রাজপথে লড়াই করেছেন, তেমনি সংসদেও বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে মাতৃভাষার সম্মান উর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। তখন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যরা ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেন। শেখ মোজাফফর আহমদই সর্বপ্রথম বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
শেখ মোজাফফর আহমদ সুফি সাধক ছিলেন। এও তাঁর এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। রাজনীতির কোলাহল সাঙ্গ হলে তিনি নিভৃতে অধ্যাত্ম সাধনায় মগ্ন হয়ে যেতেন। আউলিয়া-দরবেশের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধা। সময় ও সুযোগ পেলে তাঁদের মাজার জেয়ারত করতে যেতেন। সর্বধর্মের মিলনতীর্থ, অসা¤প্রদায়িক ঐতিহ্যের প্রতীক, মহামানবের সাগরতীর মাইজভাÐার দরবারে প্রায়ই যেয়ে তাঁর মোর্শেদের সন্নিধ্যে কিছু সময় কাটিয়ে আসতেন।
বঙ্গভঙ্গের কালে চট্টগ্রাম যখন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের একটি জেলা, এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের আগুনে চট্টগ্রাম জ্বলছিলো, তখনই শহরের পাঠানটুলীর কাপুড়িয়া পাড়ায় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রæয়ারি এক ব্যবসায়ী পরিবারে তাঁর জন্ম। চট্টগ্রামের বাতাসে তখন বারুদ জমা হচ্ছিলো; ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে যে বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল ছিন্ন করে চট্টগ্রামকে চারদিনের জন্য স্বাধীন করেছিলো, সকলের অলক্ষে পুলিশ-গোয়েন্দার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেই বিপ্লবের বহ্নি ধূমায়িত হয়ে উঠছিলোÑ এমনি এক ভীষণ সময়ে কাপুড়িয়া পাড়ার নজু মিয়া সওদাগরের ঘর আলোকিত করে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হলো, সে উত্তরকালে ‘বাঙলার পতন’ নাটক লিখে দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেবে; ‘ন্যাশনাল গার্ডের’ কমান্ডার হবে; পাকিস্তান কায়েমের জন্য লড়াই করবে এবং অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্যও সংগ্রাম করে জীবন দেবেন। যে পাকিস্তানের জন্য তিনি লড়াই করেছেন, সেই কথিত মুসলিম রাষ্ট্রকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের বৈরী রাষ্ট্রে পরিণত হতে দেখে তাকে বধ করার জন্য চট্টগ্রামের মাটিতে আওয়ামী লীগের বীজ বপন করে স্বাধীনতার ফুল ফুটিয়েছিলেন, আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রস্তুত করে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ লালদিঘি ময়দানে তাদের কুচকাওয়াজের আয়োজন করে সালাম গ্রহণ করেছিলেন। শেখ মোজাফফর আহমদের তিন বছর বয়সে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। তারপর খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ধর্মঘট, বিওসি ধর্মঘট, দ্বিতীয় মহাসমর, পঞ্চাশের মন্বন্তর, ৪৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাÑএসব ঘটনা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা শেখ মোজাফফরের মানস সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনায় শাণিত হয়ে ওঠে।
অতি অল্প বয়সে শেখ মোজাফফর আহমদ পিতৃহারা হন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। পিতার আকস্মিক তিরোধানে পরিবারের সমস্ত ভার এসে পড়ে তাঁর ওপর। লেখাপড়া ছেড়ে তাঁকে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের জেটিতে চাকরি নেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ বছর। আগেই বলেছি একই সময়ে তিনি নাটক লেখা আরম্ভ করেন। শেখ মোজাফফর আহমদ ছিলেন স্বাধীনতাচেতা। জাতির পরাধীনতা যেমন তাঁর নিদারুণ মর্ম-বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তেমনি ব্যক্তি জীবনও বাঁধাধরা চাকরির অনুকূল ছিলো না। দু’বছর যেতে না যেতেই জেটির চাকরিতে তিনি হাঁফিয়ে উঠলেন। অবশেষে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ছেড়েই দিলেন সে চাকরি। একই বছর তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের টেরিটোরিয়াল ফোর্সের হায়দ্রাবাদ রেজিমেন্টের অধীনে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। সামরিক বাহিনীতে কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলার গভর্ণরের পক্ষ থেকে পদক লাভ করেন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। সামরিক বাহিনীতে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তাঁকে ইবংঃ অধিৎফ খেতাব দেয়া হয়।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে শেখ মোজাফফর আহমদ আর্মড গার্ডে যোগ দেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার বন্দরের জেটিতে চাকরি নেন। এ সময় তাঁকে সিভিল গার্ডের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সিভিল গার্ড সংগঠিত করেন।
এ সময় পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। শেখ মোজাফফর আহমদ মুসলিম লীগে যোগ দেন। মুসলিম লীগ ‘ন্যাশনাল গার্ড’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করলে সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ শেখ মোজাফফর আহমদকে তার ‘সালারে জিলা’ বা জেলা কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রাম জেলায় পঞ্চাশ হাজার সদস্যের ‘ন্যাশনাল গার্ডের’ এক বিশাল সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত শেখ মোজাফফর আহমদ অত্যন্ত কর্মব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। গণপরিষদের সদস্য থাকাকালে এক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি চিন সফর করেন। এই প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর ইস্কান্দর মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। গণপরিষদ বিলুপ্ত করা হয়। ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দর মির্জাকে হটিয়ে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন।
সামরিক শাসন আমলে সমস্ত রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ফলে রাজনীতিকদের ব্যস্ত জীবনযাত্রায় হঠাৎ অখÐ অবসর জুটে যায়। শেখ মোজাফফর আহমদও এবার নিজের পরিবারের দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পেলেন। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে ব্রতী হলেন। প্রথমে আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে নিজের জায়গায় একটি বিস্কুট তৈরির বেকারি খুললেন। তাঁর চার সন্তান জাহাঙ্গীর, আলমগীর, খুরশিদ ও শহীদÑএদের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে বেকারির নাম রাখলেন ‘জ্যাকস’। অচিরে জ্যাকস শহরের একটি রুচিশীল অভিজাত বেকারি হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা ও ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে গেল। ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি এই বেকারিটি হয়ে গেল চট্টগ্রামের রাজনীতির একটি তীর্থক্ষেত্র। আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর নিত্য উপস্থিতি ছাড়াও দলের অন্যান্য নেতা-কর্মীদেরও আনাগোনায় জ্যাকস যেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যালয়ে পরিণত হলো।
জ্যাকস প্রতিষ্ঠা করে আর্থিক প্রতিষ্ঠা লাভের পর তিনি সীতাকুÐে একটি ইটভাটা স্থাপন করেন। ইট তৈরির ব্যবসায়ও তিনি প্রভূত সাফল্য লাভ করেন।
পাঠানটুলী খুব বড়ো জায়গা নয়। কিন্তু এর মধ্যেই নানান বৃত্তি ও পেশার মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ বসবাস। যেমন শেখ মোজাফফর আহমদ যে পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছেন তার নাম কাপুড়িয়া পাড়া। নামেই বুঝা যায় সেখানে কাপড় তৈরি হতো এবং কাপড়ের কারিগররা সপরিবারে বসবাস করার কারণে স্থানটির নাম হয়ে গেছে কাপুড়িয়া পাড়া।
চট্টগ্রাম শহরের ডবলমুরিং থানাধীন ঐ অঞ্চলে কখনো পাঠান সেপাইরা উপনিবেশ স্থাপন করে বসতির পত্তন করেছিলো বলে পাঠানটুলী নামের উৎপত্তি। এরকম মোগলদেরও একটি টুলি আছে পাঠানটুলির অদূরে।
তা’ পাঠানটুলি সেপাইদের বাসস্থান এবং তার মধ্যে তারাই হয়তো নানা বৃত্তির মানুষ এনে বসিয়েছিলো তাদের প্রয়োজন মেটাতে। কিন্তু এলাকাটি কখনোই সাহিত্যরস সৃষ্টির অনুকূল ছিলো না। আর এই নীরস, রু², পাথুরে প্রান্তরে কী করে সাহিত্যের রস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন লোকমান খান শেরওয়ানি, অলি আহমদ ওলী ইসলামাবাদী, শেখ মোজাফফর আহমদ ও ফেরদাউস খানÑএটা পরম বিস্ময়ের ব্যাপার। এ চার সাহিত্যিকই পাঠানটুলি থেকে উদ্ভূত হয়ে সাহিত্যাকাশে তারকার দীপ্তি নিয়ে জ্বলে উঠেছিলেন।
শেখ মোজাফফর আহমদ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গজল, হামদ, নাত ও নাটক লিখেছেন। ‘ছিন্নবাণী’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন, তবে সেটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। তাঁর সাহিত্য প্রতিভার সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশ ঘটে নাটকে। জীবনে একটিই নাটক তিনি লিখেছেন এবং সেই নাটকটি তাঁকে সাহিত্যের আসরে পাকাপোক্ত আসনে বসিয়ে দেয়। নাটকের নাম ‘বাঙলার পতন’Ñ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দরের আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে জেটিতে চাকরিরত অবস্থায় তিনি নাটকটি লিখতে আরম্ভ করেন। এবং তিন বছর ধরে যে নাটকটি তিনি রচনা করলেন, সেটি মঞ্চায়নের অনুমতি পেলো না। কারণ ইংরেজ বিদ্বেষ এবং নবাব সিরাজদৌলার প্রতি লেখকের পক্ষপাত কর্তৃপক্ষের মনঃপুত হয়নি।
নাটকের মধ্য দিয়ে নাট্যকারের স্বাদেশিকতা এবং স্বদেশ চেতনা ফুটে উঠেছে। নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ি, সাহিত্যিক-গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ভারতবর্ষ সম্পাদক রায় বাহাদুর জলধর সেন, সাংবাদিক-সাহিত্যিক আলী আহমদ ওলি ইসলামাবাদী নাটকটি পাঠ করে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী খান সাহেব আবদুল হাকিম মিঞা ও খান বাহাদুর খলিলুর রহমানের বদান্যতায় কলকাতার করিম ব্রাদার্স নাটকটি প্রকাশ করে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে । প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নাটকটি ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। নাট্যকারের মূল লক্ষ যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করা, তা’ অনুধাবন করতে পেরে সাম্রাজ্যবাদী সরকার যে বছর প্রকাশিত হয়, সে বছরই নাটকটি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাটকের ওপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। সে বছর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলে বিষয়টি তাঁর গোচরীভূত হয় এবং তিনি নাটকটির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অধুনালুপ্ত নূরজাহার লাইব্রেরির স্বত্ত¡াধিকারী আবদুর রহিম চৌধুরীর চেষ্টায় এবং নুরুল আমিন চৌধুরী ও জিন্নাত আলী মুন্সির উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও আর্থিক সাহায্যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বাঙলার পতন’Ñএর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
শেখ মোজাফফর আহমদের চরিত্রের নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম। এর মধ্যে একটি গুঢ় কথা রয়ে গেছে, সেটাই এবার বলার চেষ্টা করবো।
শেখ মোজাফফর আহমদের জীবনের মূলমন্ত্র ছিলো স্বদেশপ্রেম, স্বদেশচেতনা। তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠার স্থানকালের আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি, চট্টগ্রাম স্বদেশব্রতের সাধনা ও বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হবার এক ভীষণ অস্থির, অশান্ত ও বিক্ষুব্ধ সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বেড়ে উঠেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, এ বি রেলওয়ে ও বিওসি ধর্মঘট প্রভৃতি ঘটনা থেকে শেখ মোজাফফর আহমদ বিদ্রোহ ও বিপ্লবের পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁর অন্তরে স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা এবং বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের বীজ রোপিত হয়েছিলো। দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবল তাড়না অনুভব করছিলেন তিনি। কিন্তু প্রকাশ্য রাজনীতি বা গোপন বৈপ্লবিক কার্যক্রম-কোনটাতেই অংশগ্রহণের সুযোগ তাঁর ছিলো না। কারণ অল্প বয়সে পিতৃহারা হয়ে তাঁকে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়তে হয়েছিলো। তাহলে কী নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবেন? না, শেখ মোজাফফর আহমদ দমে যাবার পাত্র নন। দেশবাসীর স্বাধীনতার বিপুল কর্মযজ্ঞে কোনোভাবে নিজেকে যুক্ত করার চিন্তা থেকে তিনি নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন।
চল্লিশের দশকে সরাসরি রাজনীতির মঞ্চে অবতীর্ণ হন শেখ মোজাফফর আহমদ। ন্যাশনাল গার্ডের চট্টগ্রাম জেলার অধিনায়কত্ব গ্রহণ করে তিনি প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তান বিরোধী বাংলাদেশ সংগ্রামের সূচনা থেকেই তাঁকে অগ্রভাগে দেখা যায়। পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ), যে দল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার চেতনায় জাগিয়ে তুলবে এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে, শেখ মোজাফফর আহমদ সেই দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি যে অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন, সেটা ঐ স্বাধীনতার চেতনা থেকেই। তিনি দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালি ব্রিটেশের কবল থেকে মুক্ত হলেও স্বাধীন হতে পারেনি, নতুন করে ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের পিঞ্জরে আবদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তানের শোষণ ও কারাগার থেকে মুক্তির জন্য তাকে নতুন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে হবে। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপ ভাষা আন্দোলন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ মোজাফফর আহমদ। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। ২১ ফেব্রæয়ারি ৫২ ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি বর্ষণের সংবাদ চট্টগ্রামে এসে পৌঁছার পর বিকেলে লালদিঘি ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মোজাফফর আহমদ। সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেয়া পর্যন্ত আপসহীন সংগ্রামের সংকল্প গ্রহণ করা হয়। জনসভায় ৪০ সহস্রাধিক মানুষ সমবেত হয়। ২১ ফেব্রæয়ারি দিবাগত রাতেই আন্দোলনকারীরা লালদিঘি ময়দানের পশ্চিম পাশে ভিক্টোরিয়া গার্ডেনে (পরবর্তীকালে ওখানে সিরাজুল হক পেট্রোল পাম্প স্থাপিত হয় এবং এখনো সে পাম্প আছে।) শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এটিই চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার। শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যিক আবদুল ফজল, শেখ মোজাফফর আহমদ, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, ডা. সৈয়দুর রহমান চৌধুরী, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, গোপাল বিশ্বাস, ডা. আনোয়ার হোসেন, কৃষ্ণ গোপাল সেন, রুহুল আমিন নিজামী, ননী ধর, আহমদ ছগীর, ডা. কামাল এ খান প্রমুখ। ২৪ ফেব্রæয়ারি লালদিঘি ময়দানে অপর এক জনসভায় অনুষ্ঠিত হয় শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে। লক্ষাধিক জনতার এ সভায় বক্তার তালিকায় শেখ মোজাফফর আহমদের নাম পাওয়া যায়। আরো বক্তব্য রাখেন এ কে খান, এম এ আজিজ, চৌধুরী হারুনুর রশিদ, আজিজুর রহমান প্রমুখ।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ মোজাফফর আহমদের খুব নিকট সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে তাঁকে খুব সম্মান ও সমীহ করে কথা বলতেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী চট্টগ্রাম আসলে স্টেশন রোডে বর্তমান বিআরটিসি বাস টার্মিনালের পূর্ব পাশে ‘ওয়ালেস’ (বর্তমানে নেই) নামে একটি হোটেলে উঠতেন। চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে প্রথমেই তিনি শেখ মোজাফফর আহমদকে ডেকে নিতেন এবং তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। শেখ মোজাফফর আহমদ সোহরাওয়ার্দীর এতই অনুরক্ত হয়ে পড়েন যে, সোহওয়ার্দীর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে তিনি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাজনীতিই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে অন্তরে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগরুক ছিলো। সক্রিয় রাজনীতি না করলেও পরিস্থিতির অগ্রগতির প্রতি তিনি তী² দৃষ্টি রাখতেন। যখন দেখলেন একাত্তর সালে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য রাজপথে নেমে এসেছে, তখন শেখ মোজাফফর আহমদ আর দূরে থাকতে পারলেন না। তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। ২৫ মার্চ লালদিঘি ময়দানে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কুচকাওয়াজের আয়োজন করে জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে সালাম গ্রহণ করেন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে শেখ মোজাফফর আহমদ যুদ্ধ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন এবং ৩০ মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে শহরের পতন ঘটলে তার দ্বিতীয় পুত্র আলমগীরকে নিয়ে তিনি রাউজানের এয়াছিন নগর গ্রামে তার শ্বশুর বাড়িতে আত্মগোপন করেন। এটা ছিলো তাঁর কৌশলগত পশ্চাদপসরণ। তিনি সেখানে বসে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও সামরিক শক্তি সঞ্চয় করে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ রচনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এর মধ্যে এয়াছিন নগরে তাঁর অবস্থানের কথা ফাঁস হয়ে যায়। ফলে তাঁর পক্ষে সেখানে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৭ এপ্রিল পুত্রকে নিয়ে শহরে ফিরে আসার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর দালালরা তাঁর পিছু নেয়। তাঁদের বাস হাটহাজারী পৌঁছার পর সেখানে আগে থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকা জনৈক চিহ্নিত দালাল বাস থামিয়ে পিতাপুত্রকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। পাক বাহিনী তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। এরপর আর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। পরে জানা যায় ১৮ এপ্রিল তাঁদেরকে ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়। শেখ মোজাফফর আহমদ তাঁর জীবন উৎসর্গ করে সে মূল্য পরিশোধ করেছেন। সম্ভবত সারাদেশে তাঁর স্তরের কোনো নেতা মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেননি। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোনো জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিকে জীবন দিতে হয়নি। শেখ মোজাফফর আহমদ যার সভাপতি ছিলেন, সেই অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ পরবর্তীকালে ভেঙে ভেঙে শহর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা-তিনটি শাখায় রূপান্তরিত হয়েছে।