চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পৌর মেয়র জহুরুল ইসলাম জহুর বলেছেন, চারিদিকে এখন নবান্নের পিঠা উৎসবে মেতে উঠেছে বাঙালি। এ পিঠা উৎসব বাঙালি সাংস্কৃতি ঐতিহ্যকে ধরে রাখে।
বুধবার (৭ জানুয়ারি) আইএফআইসি ব্যাংকের বোয়ালখালী শাখার পিঠা উৎসবের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
এসময় ব্যাংকের ব্যবস্হাপক, সৌরভ চৌধুরী, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, ডা. প্রতীক সেন,পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খসরু পারভেজ, বোয়ালখালী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মঞ্জুর মাস্টার, সাংবাদিক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রভাস চক্রবর্ত্তী, প্রলয় চৌধুরী মুক্তি, শিক্ষিকা আরাফা,এসএম ওমর ফারুক, মোর্শেদুল আলম, প্রিয়ঞ্জিত চক্রবর্ত্তী, শিক্ষিকা ফাতেমা বেগমসহ ব্যাংকের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
এসময় ব্যাংকে আগত গ্রাহকদের উৎসব মুখর পরিবেশ পিঠা পরিবেশন করা হয়। বিভিন্ন জাতের পিঠা মধ্যে ভাবা পিঠা ও পাটিসাপটা পিঠা উল্লেখযোগ্য।
দেশে পিঠা খাওয়ার প্রচলন অনেক প্রাচীন। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান ওঠার পর সেগুলো গোলাবন্দি করতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। এই কর্মব্যস্ত সময়ে গ্রামীণ মানুষের ‘শখ’ করার সময়টুকু থাকে না। নবান্নের পর জাঁকিয়ে শীত পড়লে পৌষসংক্রান্তিতে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। তারপর বসন্তের আগমন পর্যন্ত চলে হরেকরকম পিঠা খাওয়ার মহোৎসব।
মূলত মাঘ-ফাল্গুন এ দুমাসই জমিয়ে পিঠা খাওয়া হয়। এরপর আর পিঠার স্বাদ ঠিকমতো পাওয়া যায় না। বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকায় কাজল রেখা গল্পকথনের সূত্র ধরে আনুমানিক ৫০০ বছর আগেও বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
যেহেতু প্রাচীন বইপুস্তকে পিঠার উল্লেখ আছে, কাজেই ধরে নেওয়া যায় পিঠা খাওয়ার প্রচলন বাঙালি সমাজে অনেক প্রাচীন। বিশাল উপমহাদেশে বসবাস করা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পিঠা যে জনপ্রিয় খাবার, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসাবে পিঠার জনপ্রিয়তাই সম্ভবত বেশি ছিল। বাঙালির লোকজ ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠা-পুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সেসময় থেকেই। পিঠা-পায়েস সাধারণত শীতকালের রসনাজাতীয় খাবার হিসাবে অত্যন্ত পরিচিত এবং মুখরোচক খাদ্য হিসাবে বাঙালি সমাজে আদরণীয়। আত্মীয়স্বজন ও পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনকে আরও দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে পিঠা-পুলির উৎসব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস তৈরির ধুম শীতকালেই বেশি পড়ে।
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে ব্যস্ত সময় কাটায় পিঠা তৈরিতে। অতিথি বিশেষ করে জামাইদের এ সময় দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হয়। এ সময় খেজুরের রস থেকে গুড়, পায়েস এবং নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়। খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে তৈরি পিঠা-পায়েস আরও বেশি মধুময় হয়ে ওঠে। সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে ভাপা পিঠা।
এছাড়াও আছে চিতই পিঠা, দুধচিতই, ছিট পিঠা, দুধপুলি, ক্ষীরকুলি, তিলকুলি, পাটিসাপটা, ফুলঝুড়ি, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, মালাই পিঠা, মালপোয়া, পাকন পিঠা, ঝাল পিঠা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে শতাধিক ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে। কালের গভীরে কিছু হারিয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। শীতকালে শুধু গ্রামবাংলায়ই নয়, শহর এলাকায়ও পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ইদানীং শহরেও পাওয়া যায় শীতের পিঠার স্বাদ। হিন্দু সমাজে যেমন নতুন ধানের নতুন চালে জমে ওঠে পৌষ-পার্বণ, মুসলমান সমাজেও তেমনই ফুটে ওঠে পিঠা-পায়েসের আনন্দ।
একসময় এ দেশে যেমন শত শত নামের ধান ছিল, তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। কত কী বিচিত্র নামের পিঠা পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার মেয়েদের ঐতিহ্য। পিঠা-পায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এখনো অসংখ্য গান, কবিতা ও ছড়া প্রচলিত আছে। পিঠাকে ঘিরে ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’ পিঠা-পুলি আমাদের লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই প্রকাশ।