বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির দায়িত্বশীল হিসেবে এ কথা না বললে নয় যে, ১৯৯০ দশকে আমরা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দুটি টানেল চেয়েছিলাম। যার একটি কালুরঘাটে অর্থাৎ বোয়ালখালী এলাকায় আরেকটি ১৫ নম্বর ঘাটে। এটার একটা উদ্দেশ্য ছিল। কর্ণফুলী নদীতে এর আগে একটি কাঠের তৈরি সেতু ছিল। এটি তৈরি করা হয়েছিল এরশাদ সরকারের আমলে।
সেতুটি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার পর আমরা সরকারের কাছে একটি নতুন সেতু কামনা করেছিলাম চট্টগ্রামবাসীর জন্য। আমরা কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে নদীর তলদেশে সরকারের কাছে টানেল চেয়েছিলাম। যাতে নদী ভরাট হয়ে না যায় কারণ এই চট্টগ্রাম বন্দর হচ্ছে বাংলাদেশের হৃদপিণ্ড। এই চট্টগ্রাম বন্দর গড গিফটেড। তাই এটি যাতে রক্ষা হয় সেজন্য আর কোন সেতু না হয়ে নদীর তলদেশে আমরা সরকারের কাছে টানেল চেয়েছিলাম। তো কালের বিবর্তনে সে সময় টানেল হয়নি। পাশাপাশি আমরা চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীও চেয়েছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে চট্টগ্রাম আর বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে ওঠেনি। এটি নিয়ে অনেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করেছে কিন্তু যেটা করার কথা ছিল সেটা আর হয়নি।
এর অনেকদিন পর বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ২০০৮ সালে লালদীঘি ময়দানে ঘোষণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন যেটা এখন দৃশ্যমান। যেগুলো আমাদের বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের দাবি ছিল, তার প্রেক্ষিতে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। এটা চট্টগ্রামবাসীর জন্য সুখবর, আনন্দের খবর। ওয়ান সিটি টু ডাউন করার ক্ষেত্রে এটা কার্যকর হবে। তবে এই টানেলে কখনো বিদ্যুৎ বিপর্যয় না ঘটে সেদিকে কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে হবে।
আমাদের দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতি এবং লোডশেডিং হয়ে থাকে এ ধরনের কোন কিছু ঘটলে টানেলটি মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। পাশাপাশি এই টানেলের সুফল পেতে হলে যা করণীয় সেই অবকাঠামো দুই পাড়ে এখনো গড়ে ওঠেনি। এ টানেল থেকে বের হয়ে যে গাড়িগুলো ছুটবে তার রাস্তা এখনো তৈরি হয়নি। যেমন টানেলের শহর অংশে যে লিংক রোড তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে তার অনেকগুলোর র্যাম এখনো তৈরি হয়নি।
অন্যদিকে আনোয়ারার দিকের কথা যদি বলি, টানেল থেকে বের হয়ে গাড়িগুলো যাওয়ার এখনো কোন রাস্তা তৈরি করা হয়নি। এটা কক্সবাজার মহেশখালীর মাতারবাড়িতে যে গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে তার সঙ্গে সংযুক্ত হবে, সেই রাস্তাগুলো এখনো তৈরি হয়নি। এখানে হলুদ ফিতার দৌড়াদৌড়ি দেখতে পাচ্ছি একটা। এখান থেকে একটা রোড চন্দনাইশ হয়ে কক্সবাজারে চলে যাবে। সেটা হোক, এটার বিরুদ্ধে আমরা নই তবে বাঁশখালী দিয়ে যদি ছয় লাইনে আরেকটি একটি রাস্তা করে দেওয়া না হয় তাহলে মাতারবাড়ি বন্দরে যাওয়ার জন্য এই টানেলের সফলতা আসবে না।
পাশাপাশি টানেলের সংযোগ আনোয়ারা কালাবিবি দিঘির আগে যে গ্রাম দিয়ে উঠেছে সেখানে দুটি সংযোগ আছে, যার একটি হচ্ছে শাহ মোহছেন আউলিয়া রোড এবং অন্যটি আনোয়ারা সেন্টার রোড, দুটি সংযোগ সড়ক এসে যোগ হয়েছে টানেলে। এতে গাড়ি চলাচলে রাস্তা তৈরি হলো ঠিকই কিন্তু সাধারণ মানুষের হাঁটার কোন রাস্তা রাখা হয়নি এখানে। টানেলের বাইরে যে রাস্তাটা করা হয়েছে তাতে অবশ্যই পাবলিক চলাচলের জন্য ফুটপাত তৈরি করতে হবে, এটা যদি করা না হয় তাহলে যেকোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
কর্ণফলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটা মাইলফলক উন্নয়ন। এ জন্য আমি বৃহত্তম চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি একইভাবে চট্টগ্রামের দাবিগুলো আরো দ্রুতগতিতে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। একই সঙ্গে জরাজীর্ণ মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুর পাশে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি। আমরা দাবি দিয়েছি সেখানে নতুন ব্রিজ তৈরি করার জন্য, তবে পুরাতন সেতুটিও থাক। একটা নতুন ব্রিজ হোক, রেল কাম সড়ক। সেতু হবে সরকারের ঘোষণা ছিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা দিয়েছিলেন কালুরঘাট সেতু হবে। একনেকে পাস হয়েছে এবং এটার একটা নকশাও পত্র-পত্রিকায় দেখেছি আমরা। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেতুটা হলো না।
চট্টগ্রামবাসীর দুঃখ এই সরকারের আমলে এত উন্নয়নের ভীড়ে কালুরঘাট সেতুটি হল না। বর্তমান সরকার আগামীতে আসবে কি আসবে না সেটা পাবলিক দেখবে। সাধারণ জনগণ চাইলে আসবে, না হয় আসবে না কিন্তু এই সরকারের আমলে সেতুটা না হওয়ায় চট্টগ্রামবাসী বিস্মিত হয়েছে। আমরা হতাশ হয়েছি, আমাদের প্রাণের দাবি কালুরঘাটে নতুন সেতু হোক। বাংলাদেশের সকল নদীসহ কর্ণফুলী-হালদা রক্ষায় নিয়মিত ড্রেজিং করা হোক। সকল নদী রক্ষা পাক আমরা এটাই চাই।
এটা অস্বীকার করার উপায় নাই যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের প্রতি আন্তরিক। আমরা দেখেছি চট্টগ্রামে যে পরিমাণ উন্নয়ন দৃশ্যমান। মেগা প্রকল্পগুলো একমাত্র বর্তমান সরকারের আমলে হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর পাড়ে কালুরঘাট থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত নেভাল রোডটি আমরা চেয়েছিলাম। যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিরসরাই পর্যন্ত নিয়ে যাবেন বলেছেন। এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়, একইভাবে আরেকটি রাস্তা কর্ণফুলী টানেল থেকে কক্সবাজার টেকনাফ পর্যন্ত করার ঘোষণা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। ভবিষ্যতে এটার বাস্তবায়ন দেখব আমরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত প্রশংসনীয় এই ভূমিকার পাশাপাশি বৃহত্তর চট্টগ্রামের পর্যটন নগর- তিন পার্বত্য অঞ্চল ও কক্সবাজারের দিকে নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। যদিও কক্সবাজার উন্নয়নের কিছু মেগা প্রকল্প মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাতে নিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম সাগরের মধ্যে থেকে মাটি ভরাট করে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ। পাশাপাশি সেন্ট মার্টিনেরও কিছু উন্নয়নের কাজ হাতে নিয়েছেন তিনি। তবে সে তুলনায় তিন পার্বত্য অঞ্চল রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে তেমন কিছুই হয়নি। এখানকার উন্নয়নের খুব প্রয়োজন। কাপ্তাই হ্রদগুলোর পরিচর্যা করে নতুনভাবে সাজালে সেখানে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবে।
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে চট্টগ্রামবাসী কল্পনাতীত সাফল্য পাবে। এই টানেল চট্টগ্রাম তথা পুরো বাংলাদেশের জন্য একটা মাইলফলক। এই টানেলের মাধ্যমে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। পাশাপাশি ভারতের যে সেভেন সিস্টার দেশ রয়েছে তাদেরকে আমাদের বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার মাধ্যমে এবং আমরা তাদের বন্দর ব্যবহার করব এই ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে যদি বন্দরকে ব্যবহার করা যায় তাহলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও লাভবান হবে বলে আমি মনে করি।
এই টানেল নির্মাণের ফলে কর্ণফুলীর দুই পাড়ে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রীকে আবেদন জানাচ্ছি আনোয়ারা পটিয়া এবং চন্দনাইশ নিয়ে যাতে একটা নতুন পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলার জন্য।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করায় অবশ্যই শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আগেও জানিয়েছে এবং আশা করব আরো যেগুলো কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে সেগুলো যাতে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করা যায় যে সমস্ত মেগা প্রকল্প সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। যাতে সেগুলো সঠিক সময়ে শেষ করে এবং কালুরঘাট সেতু থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করা যায় সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।
মুজিবুল হক শুক্কুর : সভাপতি বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদ