দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সূতিকাগার বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। এই চট্টগ্রামের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় দেশের সিংহভাগ আমদানি-রফতানি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তাই বলা হয়, চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন; চট্টগ্রাম আগালেই এগিয়ে যায় দেশ। সেই বাস্তবতায় বর্তমান সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নে বহু মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তার মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।
এ টানেল দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশের প্রথম টানেল। যার নির্মাণ ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এই বঙ্গবন্ধু টানেল গোটা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে, ঘটবে প্রবৃদ্ধির উর্ধ্বগতি আর বাংলাদেশের উন্নত বিশ্বে উত্তরণে রাখবে অনবদ্য ভূমিকা। আর এই বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ যুক্ত হতে যাচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে। মিয়ানমার হয়ে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তিসহ ৭টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু টানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মিয়ানমার, চীন, হংকং ও থাইল্যান্ডের সংযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যাত্রা শুরু হবে পূর্বমুখী।
‘এক নগর, দুই শহর’ এই উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সামনে রেখে টানেলটি নির্মিত হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে কর্ণফুলীর দুই পাড়ের এলাকার আশে-পাশে শিল্পোন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার বদৌলতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। এর প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের অর্থনীতির আকার এবং জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। টানেলটি জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ অবদান রাখবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ফিন্যান্সিয়াল এবং ইকোনোমিক আইআরআর এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তাছাড়া, ফিন্যান্সিয়াল এবং ইকোনোমিক Benefit Cost Ratio (BCR)-এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১ দশমিক ০৫ শতাংশ এবং ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল তৈরির প্রতিবেদনে- প্রতি বছর এই টানেলটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ মূল্য তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা বা চার লাখ ৪০ হাজার ডলার সংযোজন করবে বলে ধারণা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী চালুর প্রথম বছরে টানেল দিয়ে ৬৩ লাখ যানবাহন চলাচল করবে। টানেলটি চালুর তিন বছর পর এই সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩৯ লাখ; ২০৫০ সালে তা হবে তিন কোটি ৩৯ লাখ এবং ২০৬২ সালে ৫ কোটি ৫ লাখ। যদিও টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে করা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সুড়ঙ্গপথ অর্থাৎ কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বাংলাদেশের জন্য অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলছে। এতে শিল্প উদ্যোক্তারা নতুন নতুন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। টানেলের কারণে যে সহজ যোগাযোগব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন বেশি। গতি বাড়বে আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায়। ফলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্পাঞ্চল। এর মধ্যে কক্সবাজারে চারটি ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে টানেলকে কেন্দ্র করে পোষাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্য, ফিশারিজ, টেক্সটাইল খাতের বেশ কিছু শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে।
তথ্যমতে, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড়ে আনোয়ারায় গড়ে উঠেছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড)। শিল্পায়নের ফলে এ অঞ্চলের লাখো মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। ৭৮৩ একর জমি নিয়ে আনোয়ারায় চায়না ইকোনোমিক জোন স্থাপিত হচ্ছে। উক্ত এলাকায় চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। এখানে রপ্তানিমুখি জাহাজ শিল্প, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফার্নেশ ও সিমেন্ট শিল্প সহ ৩১টি শিল্প কারখানা স্থাপিত হবে। তাছাড়া, বিভিন্ন ধরনের ২৩টি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ৩টি বড় কোম্পানী- গায়া প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানী ও ডেইগু প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানী তাদের ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু করেছে।
আশা করা যায় রপ্তানিমুখি জুতা, তৈরী পোশাক শিল্প, টেক্সটাইল সহ নানা উৎপাদনমুখি শিল্প প্রতিষ্ঠান উক্ত এলাকায় স্থাপিত হবে। তাতে অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। বেকার যুবক মহিলাসহ দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীদের প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজিকরণ, আধুনিকায়ন, শিল্পকারখানার বিকাশসাধন এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের ফলে বেকারত্ব দূরীকরণসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এ টানেলের মধ্যদিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে উত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের অপরাপর প্রান্তের অনিন্দ্য সেতুবন্ধন রচিত হবে।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর করা হচ্ছে। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর থেকে শিল্পের কাঁচামাল ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে। মিরসরাই থেকে বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ হলে অনেক বিস্তৃত উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হবে। মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে বাস্তবায়নাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল ও মিরসরাইয়ের প্রস্তাবিত বন্দর যুক্ত হয়ে সহজ যোগাযোগ গড়ে উঠবে।
তাছাড়া এই টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত হওয়ার ফলে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে অবস্থিত কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইপিজেড, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল, বাঁশখালীর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র সমুহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। বাড়বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ।
বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে এবং দেশের পূর্বপ্রান্তের সাথে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সুদৃঢ় সংযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এককথায়, শিল্পায়ন ও পর্যটনশিল্পের বিকাশের অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। অনেক উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু টানেল সংশ্লিষ্ট এলাকায় কারখানা গড়ে তোলার চিন্তা থেকে আগাম জমি কিনে রাখছেন। যদিও এক দশক আগেও কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে তেমন কোনো শিল্পকারখানা ছিল না।
বঙ্গবন্ধু টানেলের ফলে ওই এলাকার প্রায় ২৭ শতাংশ জমি শিল্প উন্নয়নে ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে আশপাশের জমির দাম বেড়েছে দশগুণের বেশি। সরকার দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার লক্ষ্যে আর্থিক ঋণ সহায়তার আওতায় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ৩২ হাজার ৪৬২ মিলিয়ন জাপানি ইয়েন ব্যয়ে মহেশখালী, চকরিয়া ও টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র টানেল বঙ্গবন্ধু টানেলটির মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ের সাথে যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করে উন্নত বিশ্বে উত্তরণে একধাপ এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশ।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।