ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলায় সিআইডির দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন নাকচ করে পিবিআইকে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
দিয়াজের মা, মামলার বাদী জাহেদা আমিন চৌধুরীর করা নারাজি আবেদনের শুনানি শেষে চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আওলাদ হোসাইন জুনায়েদ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন।
বাদী পক্ষের আইনজীবী শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, “সিআইডির দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করেন বাদী। শুনানি শেষে আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা দিয়ে মামলাটি আবার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।”
দিয়াজের বোন আইনজীবী জুবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা বলেন, “ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এটা হত্যা। সেটাকে ডিনাই করে কীভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়? এছাড়া অনেক সাক্ষীকে হাইড করা হয়েছে সেই প্রতিবেদনে।
“পাশাপাশি যাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সে চার জন বলেছে, ঘটনার রাতে তারা সেখানে ছিল। তাহলে তারা ঘটনার পর পুরো দিন সে বিষয়ে কাউকে কিছু বলেনি কেন? তাহলে তারা তো আসামি হওয়ার কথা, তারা সাক্ষী হলেন কীভাবে? ঘটনার পাঁচ বছর পর কেন তারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিল?”
এসব বিষয় আদালতে উপস্থাপন করে সিআইডি’র দেওয়া প্রতিবেদন খারিজের আবেদন করা হয় বলে জানান জুবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী নিপা।
প্রায় ছয় বছর তদন্ত শেষে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলায় ‘চূড়ান্ত প্রতিবেদন’ দেয়। তাতে বলা হয়েছিল, দিয়াজ ‘আত্মহত্যা’ করেছিলেন।
সেদিন সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “হত্যা মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তে আমরা পেয়েছি দিয়াজ আত্মহত্যা করেছে। তাই ‘তথ্যগত ভুল’ উল্লেখ করে আমরা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্তে যা পেয়েছি সে অনুযায়ীই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।”
সেদিনই পরিবারের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়। তখন জুবাঈদা বলেছিলেন, “চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগে অমার মা, যিনি মামলার বাদী, উনাকে সিআইডির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।
“আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছি আসামি আলমগীর টিপুর ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখে। তারা জানে, কিন্তু আমরা কিছুই জানি না।”
মামলার বাদী দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি ‘প্রভাবিত হয়ে’ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।
২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে নিজের বাসা থেকে উদ্ধার হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত মরদেহ।
দিয়াজের মৃত্যুর তিন দিন পর ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করা হয়। তার ভিত্তিতে হাটহাজারী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করে পুলিশ।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্মাণ কাজের দরপত্র নিয়ে কোন্দলের জেরে এ ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ বলে শুরু থেকেই দিয়াজের পরিবার ও তার অনুসারী ছাত্রলীগের কর্মীরা দাবি করে আসছিল।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ওই বছরের ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে আদালতে হত্যা মামলা করেন।
তাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি আলমগীর টিপু, সেসময়ের সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, তাদের অনুসারী রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরাব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমানকে আসামি করা হয়।
আসামিদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন এবং মোহাম্মদ আরমান জামিনে আছেন। বৃহস্পতিবার আদালতে তাদের আইনজীবী দুজনের জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করলে, তা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
আসামিরা সবাই চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। দিয়াজও ছিলেন নাছিরেরই অনুসারী।
প্রথম ময়নাতদন্তের পর দিয়াজের মায়ের আপত্তিতে আদালত সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়।
এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হয়। এজন্য তখন তারা চট্টগ্রামে দিয়াজের লাশ উদ্ধারের স্থানেও যান।
২০১৭ সালের ৩০ জুলাই দেওয়া দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজের শরীরে হত্যার আলামত রয়েছে। ওই প্রতিবেদনের পর দিয়াজের মায়ের করা এজাহার হত্যা মামলা হিসেবে নিতে হাটহাজারী থানার ওসিকে নির্দেশ দেয় আদালত।