বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫, ৯ মাঘ, ১৪৩১, ২২ রজব, ১৪৪৬

‘আমাকে কোলে নিয়ে পালাতে গিয়ে মা গুলি খায়’ নেলিতে মুসলিম নিধনের সেই ভয়াল স্মৃতি

বিবিসি বাংলা

আসামের নির্বাচন কভার করতে ২০১৪ সালে গিয়েছিলাম আসামের নেলি অঞ্চলে। জোহরা খাতুনের মুখের সামনে মাইক ধরেছিলাম তার সাক্ষাৎকার নেবার জন্য। কথা বলার সময় ছলছল করছিল তার চোখ। জোহরা খাতুনকে কোলে নিয়ে পালাতে গিয়ে যেদিন তার মা গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিলেন, সেটা ছিল আজ থেকে ঠিক ৪০ বছর আগের ঘটনা। তিনি তখন ছয় মাসের শিশু।

‘পরিকল্পিত গণহত্যা’
আসামের তৎকালীন নগাঁও জেলার (বর্তমানে মরিগাঁও) নেলি অঞ্চলে ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ সালে ঘটে গিয়েছিল এক ‘পরিকল্পিত গণহত্যা’ । একবেলার মধ্যে গুলি করে, কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল তিন হাজারেরও বেশি বাংলাভাষী মুসলমানকে।

বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা অবশ্য ১০ হাজারেরও বেশি। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল শয়ে শয়ে ঘরবাড়ি।
সেই সময়ে নেলিই ছিল স্বাধীন ভারতের জঘন্যতম নর সংহারের ঘটনা। প্রয়াত সাংবাদিক হেমেন্দ্র নারায়ণ সেই নারকীয় হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
“একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম আমরা। আওয়াজটা খুব স্পষ্ট, কিন্তু বাচ্চাটিকে আমরা দেখতে পাই নি,” তার বইয়ে লিখেছিলেন মি. নারায়ণ। হয়ত ভয়ার্ত ছোট্ট জোহরা খাতুন বা তার মতই কোন শিশুর কান্নার আওয়াজই সেই ভয়াল সকালে শুনতে পেয়েছিলেন তিনি।

ওই কান্নার আওয়াজ পাওয়ার আগেই আরেকটি বাচ্চা ছেলেকে জবাই হওয়ার হাত থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যেতে দেখেছিলেন হেমেন্দ্র নারায়ণ।

‘বাচ্চা ছেলেটি হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিল’
ঘটনার ২৫ বছর পরেও সেই বাচ্চা ছেলেটির কথা স্পষ্ট মনে ছিল তার। হেমেন্দ্র নারায়ণ একটা বই লেখেন, ‘টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স অন.. নেলি স্টিল হন্টস’ নামে।

ওই বইতে মি. নারায়ণ লিখেছেন, “যেন একটা খরগোশ যাচ্ছে, সেভাবেই বাচ্চা ছেলেটি এগোচ্ছিল। ছয় কি সাত বছর বয়স হবে তার। তাকে দেখে আমাদের পা এগোয়নি আর, বড়জোর ৩০ থেকে ৪০ মিটার দূরে ছিলাম আমরা। আমাদের মাঝে দেমাল বিল।

”সে কেন ওইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিল, সেটা কয়েক মুহূর্ত পরে বুঝেছিলাম। বিপদ এগিয়ে আসছিল তার দিকে। ধুতি পরা একজন দা হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছিল।”

যে লোকটি ওই শিশুটির দিকে এগোচ্ছিল সে ওই হত্যাকারী দলেরই সদস্য ছিল, লিখেছেন হেমেন্দ্র নারায়ণ।

“তাদের শিকারদের তাড়া করে পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল সে। অন্যদিকে বাচ্চা ছেলেটি তার পরিজনদের থেকে আলাদা হয়ে পড়েছিল।

“দুজনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছিল। ছেলেটি প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ফসল কাটা হয়েছে সদ্য, তাই লুকনোর সুযোগ বিশেষ ছিল না,” হেমেন্দ্র নারায়ণ লিখেছিলেন।

লোকটির হাতের নাগালে যখন চলে এল বাচ্চা ছেলেটি, তখন মি. নারায়ণরা দেখলেন সে তার দা-টা ডান হাত থেকে বাঁহাতে নিল আর তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ছেলেটিকে একটা চড় মারল। একটা চাপা আর্তনাদ, তারপরেই বাচ্চা ছেলেটি মাটিতে পড়ে যায়।

হেমেন্দ্র নারায়ণ বুঝতে পারেননি কেন ওই একাকী বাচ্চা ছেলেটিকে দা হাতে থাকা লোকটি না কুপিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল।

হেমেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন ওই গণহত্যার তিন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের একজন। তিনি তখন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের আসামের সংবাদদাতা ছিলেন। আর সেদিন অন্য যে দুজন সাংবাদিক প্রত্যক্ষ করেছিলেন ওই গণহত্যা, তারা হলেন আসাম ট্রিবিউনের সাংবাদিক বেদব্রত লহকার আর অ্যামেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা এবিসির চিত্রগ্রাহক মি. শর্মা।

সকাল সাতটায় বাড়ি জ্বালানো শুরু হয়
ঘটনাচক্রে ওই গণহত্যার সময়ে তারা তিনজন নেলিতে পৌঁছেছিলেন কোনও আগাম পূর্বাভাস ছাড়াই। “আমরা তিনজন একটা গাড়ি নিয়ে গুয়াহাটি থেকে নগাঁওয়ের দিকে রওনা হয়েছিলাম সেদিন সকালে। কোনও নির্দিষ্ট খবর জোগাড় করার কথা আমাদের মাথায় ছিল না। সেই উত্তাল সময়ে আসামে ‘এক্সক্লুসিভ’ খবর পাওয়া খুব কঠিন ছিল না,” স্মৃতিচারণ করেছেন হেমেন্দ্র নারায়ণ।

তার কথায়, “জাগি রোডের কয়েক কিলোমিটার পরে হঠাৎই দেখলাম একদল আদিবাসী হাতে নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে একটা ছোট টিলা থেকে নেমে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। আমার মন বলছিল একটা কোনও ঝামেলা হতে পারে, আমাদের থামা দরকার। শেষমেশ যখন তিনজনে থামার সিদ্ধান্ত নিলাম, সেটা ধর্মাতুল সেতুর কাছাকাছি। নেলি থেকে একটু দূরে। আমরা কোনাকুনি পায়ে হেঁটে এগোতে লাগলাম।“

তিনি লিখেছেন, কয়েকশো আদিবাসী সেখানে জড়ো হয়েছিল, তাদের হাতে নানা ধরনের অস্ত্র। “কয়েকজনের হাতে বাঁশের মাথায় কাপড় জড়ানো। তারা ‘জয় আঈ অহম’ স্লোগান দিচ্ছিল,” তার বইতে লিখেছেন হেমেন্দ্র নারায়ণ।

মি. নারায়ণ ও অন্য দুই সাংবাদিক ওই আদিবাসীদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, ততক্ষণে জোহরা খাতুনদের গ্রাম বসুন্ধারির মুহম্মদ আব্দুল হকের বাড়ির পিছনে চাষের জমিতে জড়ো হয়ে গেছেন গ্রামের নারী পুরুষ আর শিশুরা। সেই ঘটনার কথা মনে আছে মি. হকের।

আমাকে ২০১৪ সালে মি. হক বলেছিলেন, “সকাল সাতটা নাগাদ বাড়ি-ঘর জ্বালানো শুরু হয়েছিল। গ্রামের দুই প্রান্ত থেকেই ঘর জ্বালাতে জ্বালাতে এগোচ্ছিল ওরা। সব মানুষ আমার বাড়ির ঠিক পিছনের ক্ষেতে জমা হয়েছিল। হঠাৎ দেখলাম অনেকগুলো গাড়ি থেকে অস্ত্র হাতে লোকজন নামছে, মুখে গামছা বাঁধা। তারপরেই শুরু হয়েছিল গুলি আর তীর ছোঁড়া।”

আব্দুল হক নিজেও স্ত্রী, পুত্র আর কন্যাকে হারিয়েছেন ওই গণহত্যায়।

পাশের গ্রাম বুকডোবা হাবির বাসিন্দা মুসলিমুদ্দিদেরও পাঁচ বছরের মেয়ে, স্ত্রী সহ প্রায় পুরো পরিবারই সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

পাশাপাশি দুটো গ্রামেই মারা গিয়েছিলেন দু হাজার ছশোরও বেশি মানুষ।

আবার বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ের কোলে চা বাগান ঘেঁষা গ্রাম বরবরিতেও একই সময়ে চলেছিল হামলা। মেরে ফেলা হয়েছিল সাড়ে পাঁচশো নারী-পুরুষ-শিশুকে।

প্রাণে বাঁচার জন্য দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবাই দৌড়িয়েছিলেন সেদিন।

‘সেই সবুজ শাড়ি পরা নারী’
এরকমই এক মাকে দেখতে পেয়েছিলেন হেমেন্দ্র নারায়ণ আর তার দুই সাংবাদিক বন্ধু।

তার ‘টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স অন.. নেলি স্টিল হন্টস’ বইতে একটি পরিচ্ছেদের নামই দিয়েছেন তিনি ‘ওম্যান ইন গ্রিন শাড়ি’, অর্থাৎ ‘সেই সবুজ শাড়ি পরা নারী’।

“আমরা যখন তাকে দেখি, তিনি একটা শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে আরেকটি সন্তানের হাত ধরে টানতে টানতে দৌড়াচ্ছিলেন। পিছনে দৌড়াচ্ছিল তার আরেক সন্তান। সবুজ শাড়ি পরা ওই নারীর গলা দিয়ে একটানা অদ্ভুত একটা আওয়াজ বেরচ্ছিল। এবিসি-র ক্যামেরাম্যান মি. শর্মা যখন ছবি তোলার জন্য ওই নারীর দিকে তার টিভি ক্যামেরাটা ঘোরালেন, তখন ওই নারীর আর্তনাদ আরও বেড়ে গেল,” লিখেছেন হেমেন্দ্র নারায়ণ।

ওই নারী আর তার সন্তানরা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু দেমাল বিলে ভাসতে থাকা আরেক নারীর সেই সৌভাগ্য হয় নি। তাকে হত্যাকারীরা বল্লম দিয়ে চিরে দিয়েছিল।

বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে ওই হত্যা লীলা দেখার পর হেমেন্দ্র নারায়ণরা যখন ফেরার পথ ধরছেন, তখন তারা দেখা পেয়েছিলেন একদল কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ সদস্যের, কিন্তু তারা বেশ ধীরে সুস্থে হাঁটছিলেন, হত্যাকারীদের ধরার জন্য কোনও তাগিদ তাদের ছিল না বলেই মনে হয়েছিল সাংবাদিকদের ওই দলটির।

‘দলাপাকানো কিছু মৃতদেহের ওপরে আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম’
ঘটনার তিনদিন পরে গ্রামে ফিরতে পেরেছিলেন বসুন্ধারির বাসিন্দা আব্দুল সোবহান। তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের কবরস্থানে।

“দিন তিনেক পরে যখন গ্রামে আসতে পারলাম, দেখি যাকে যেভাবে পেরেছে কবর দিয়েছে। কারও হাত বেরিয়ে আছে, কারও পা। রাত্রিবেলা নিরাপত্তা বাহিনীই কবর দিয়েছে। পরে আমরা সেগুলোর ব্যবস্থা করে মৃতদের শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করি,” আমাকে তিনি বলেন।

ঘটনার একদিন পর, ১৯৮৩-র ১৯শে ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসেরই আরেক সাংবাদিক শেখর গুপ্তা গিয়েছিলেন নেলিতে।

সেদিনের কথা তিনি লিখেছিলেন পরের বছর তার প্রকাশিত বই ‘আসাম: আ ভ্যালি ডিভাইডেড’এ। বইটির কিছু বাছাই করা অংশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্যা প্রিন্ট’ সংবাদ পোর্টালে।

“দলাপাকানো কিছু মৃতদেহের ওপরে আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু যতই চেষ্টা করি লাফিয়ে ডিঙ্গিয়ে যেতে, পচা বাধাকপির মতো ছড়িয়ে থাকা দেহ বা দেহাংশগুলিতে পা পড়ে যাচ্ছিলই,” লিখেছিলেন মি. গুপ্তা।

তার মিনোলটা ক্যামেরা দিয়ে ছবিও তুলছিলেন মি. গুপ্তা। সঙ্গে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর ১০ নম্বর ব্যাটালিয়নের সাব ইন্সপেক্টর তাড়া দিচ্ছিলেন মি. গুপ্তাকে, “আপনি এক জায়গায় এত সময় নষ্ট করলে চলবে? ওদিকে আরও শয়ে শয়ে মৃতদেহ পড়ে আছে যে!”

শেখর গুপ্তা এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ২৫৬টি মৃতদেহ গুনতে পেরেছিলেন।

“আরেকটি গ্রাম মুলাদারি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তাটা জুড়েই যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। একজন নারীর নিম্নাংশটা একটা চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল। চীৎকার করছিলেন ওই নারী। তার বুক থেকে রক্ত বেরচ্ছিল। গ্রামের যে কজন বেঁচে ছিলেন, আব্দুল হান্নান তাদের অন্যতম। তিনি বলেছিলেন, ওই নারী ছমাসের গর্ভবতী ছিলেন। তার যোনিতে বল্লমের হাতল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তার গর্ভপাত হয়ে গেছে। হত্যাকারীরা যাওয়ার আগে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে,” লিখেছেন শেখর গুপ্তা।

আঙুল তুলে তিনি মি. গুপ্তাকে পাশের দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, “ওই নারীর প্রথম সন্তান, দুবছর বয়স। তাকে দুভাগে চিরে দিয়েছে।“

আব্দুল হান্নানকে উদ্ধৃত করে শেখর গুপ্তা লিখেছিলেন, “ওর দুটো হাত দুদিক থেকে দুজন করে ধরে মাঝামাঝি চিরে দিয়েছে।“

কারা ঘটিয়েছিল ওই হত্যা লীলা?
আবারও ফিরে যেতে হবে হেমেন্দ্র নারায়ণের লেখায়। তাদের তিনজনের সঙ্গে যখন হত্যাকারীদের প্রথমবার দেখা হয়েছিল, তারা মি. নারায়ণদের বলেছিল যে অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী, যাদের বিদেশী বলে তার আগেই দাগিয়ে দিয়েছিল অসমীয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু), তাদের কারণে আসামের বাসিন্দা ওই আদিবাসীরা নিজভূমেই পরবাসী হয়ে গেছে।

আসুর স্লোগান ‘জয় আঈ অহম’ও তিনি শুনতে পেয়েছিলেন হামলাকারীদের গলায়, যে স্লোগানের অর্থ ‘আসাম মাতার জয়’।

যেসময়ে নেলির গণহত্যা ঘটে, সেটা ছিল আসামে নির্বাচনের সময়। ঘটনার কয়েকবছর আগে থেকেই আসাম আন্দোলনের ফলে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজ্য। তার মধ্যেই নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। আসু সহ অসমীয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো বয়কট করেছিল নির্বাচন।

সেই সময়ে আসামে যারা সাংবাদিকতা করতেন, তাদের কাছে শোনা যায় নিয়মিতই ‘জনতা কার্ফু’, ‘জনতা হরতাল’ ইত্যাদি ডাকত আসু। দেওয়ালে যেসব স্লোগান লেখা হত, তার মধ্যে এরকম স্লোগানও থাকত যে যারা ভোট দেবে, তারা বিশ্বাসঘাতক। তাদের রক্তে রাস্তা রাঙিয়ে দেওয়া হবে।

‘বিদেশী’ ইস্যুতে আসু পাশে পেয়ে গিয়েছিল আসামের আদিবাসীদের একাংশকে।

ভোট যত এগিয়ে আসতে লাগল, প্রশাসন ততই বুঝতে পারছিল যে স্থানীয় সরকারী কর্মচারীরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন না। তাই অন্যান্য রাজ্য থেকে সরকারি কর্মচারী, অন্য রাজ্যের পুলিশ নিয়ে আসা হয়েছিল।

৪০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী আর সেনাবাহিনীর ১১টা ব্রিগেড নামানো হয়েছিল সেই নির্বাচনে।

সেই সময়ে আসাম পুলিশের আইজি আইনশৃঙ্খলা ছিলেন কেপিএস গিল। নেলি গণহত্যার অনেক পরে এক অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে ৬৩টি বিধানসভা আসনে ভোট নির্বিঘ্নে করানো সম্ভব ছিল, আর ২৩টা এমন আসন ছিল যেখানে ভোট করানো অসম্ভব ছিল। নেলি এলাকা দ্বিতীয় আসনগুলির মধ্যে পড়ত।

কিন্তু নেলিতে ভোট নেওয়া হয়েছিল ১৯৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওই অঞ্চলটির মুসলমানরা ঠিক করেছিলেন যে তারা ভোট বয়কটের ডাকে সাড়া দেবেন না।

তাই ভোটের আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল হুমকি।

কোথায় ছিল পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনী?
গণহত্যার ঠিক আগের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন জাপানী গবেষক মাকিকো কিমুরা। দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি খুঁজে বার করেছেন সেই সময়ে নেলি ও আসামের পরিস্থিতি নিয়ে বহু প্রায় অজানা তথ্য। সেগুলো সবই তিনি লিখেছেন তার বই ‘দ্যা নেলি ম্যাসাকার অফ ১৯৮৩ – এজেন্সি অফ রায়োটার্স’-এ।

ওই বই থেকেই জানা যায় যে ভোটের পরের দিন, ১৫ ফেব্রুয়ারি নগাঁও থানার ওসি একটা বেতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। সেখানে বলা হয়েছিল যে আগের রাতে খবর পাওয়া গেছে যে নেলি আর তার আশপাশের গ্রামগুলির প্রায় হাজার খানেক অসমীয়া মানুষ মারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জড়ো হয়েছে। মুসলমানরা ভয় পাচ্ছেন, যে কোনও সময়ে আক্রমণ হতে পারে। শান্তি বজায় রাখার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

নেলির গ্রামবাসীরা আমাকে ২০১৪ সালে জানিয়েছিলেন যে ঘটনার দুদিন আগে গ্রামে পুলিশ গিয়েছিল। দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠক করে শান্তি কমিটিও তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল তারা।

আর ১৭ই ফেব্রুয়ারি রটে যায় যে স্থানীয় লালুং আদিবাসী সম্প্রদায়ের কয়েকটি শিশুকে অপহরণ করা হয়েছে। পরের দিন সকাল থেকে শুরু হয় হত্যা লীলা।

পুলিশ বা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তখন ধারেকাছে দেখা যায়নি।

বসুন্ধারি গ্রামের বাসিন্দা মুহম্মদ আব্দুল হক বলেছিলেন, “কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী গণ্ডগোল আঁচ করতে পেরেছিল, গুলির শব্দও হয়তো শুনেছিল। কিন্তু স্থানীয় পুলিশ বাহিনীকে গ্রামে না নিয়ে এসে অন্যান্য দিকে টহল দেওয়াচ্ছিল। পরে কয়েকজন নারী কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়িগুলির পথ আটকালে তারা বুঝতে পারে যে কী ঘটছে ভেতরের গ্রামগুলোতে। দুষ্কৃতিরা তখনই পালাতে শুরু করে।“

গণহত্যা আটকানো সম্ভব ছিল?
গণহত্যার পরে সরকার একটা তদন্ত কমিশন গড়েছিল প্রশাসনিক অফিসার টিপি তিওয়ারির নেতৃত্বে। তিওয়ারি কমিশন।

পরের বছর কমিশন সরকারের কাছে তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। পরের বছর ৫৪৭ পাতার রিপোর্ট জমা পড়ে সরকারের কাছে। কিন্তু সেই সময়কার কংগ্রেস দলীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে ওই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে না। তারপরে অসম গণপরিষদও একই সিদ্ধান্ত বজায় রাখে। এমনকি বিধানসভাতেও ওই রিপোর্ট পেশ করা হয় নি।

বহু বছর ধরে ওই তদন্ত রিপোর্টের মাত্র তিনটি কপি সরকারের কাছে রাখা ছিল, যদিও অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে তার ফটোকপি বলে কিছু কাগজ ঘুরত।

কয়েক বছর আগে সেন্টার ফর ইক্যুয়িটি স্টাডিজ তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় একটি আবেদন করে, যার ফলে ওই তদন্ত রিপোর্ট সামনে আসে।

তিওয়ারি কমিশন তিনজন পুলিশ কর্মকর্তার ওপরে সব দোষ চাপিয়ে দিয়েছিল। ওই যে ওয়্যারলেস বার্তাটি ১৫ই ফেব্রুয়ারি পাঠিয়েছিলেন নগাঁও থানার ওসি, সে কারণেই নাকি মূল গণ্ডগোলটা হয়েছিল, বাকি সরকারির কাঠামো ঠিকঠাকই কাজ করেছে, এমনটাই মন্তব্য করে তিওয়ারি কমিশন।

তাদের রিপোর্টে লেখা হয় বার্তাটি তিনি যাদের পাঠিয়েছিলেন, তারা সেগুলি পড়েই দেখেননি।

এদের দুজনকে পরে সাসপেন্ড করা হয় কিছুদিনের জন্য, একজনেরও কোনও শাস্তিই হয়নি।

শাস্তি হয়নি হত্যাকারীদের কারও। যদিও ৬৮৮টি এফআইআর করা হয়েছিল, ২৯৯ টির ক্ষেত্রে চার্জশিটও জমা পড়েছিল। কিন্তু সাজা হয়নি কারও।

স্বজনহারা পরিবারগুলোকে প্রত্যেক মৃতদেহের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা করে, আর কিছু ঢেউ টিন।

আসামের মানবাধিকার কর্মী আমন ওয়াদুদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “কয়েক হাজার পরিবার চার দশক ধরে অপেক্ষা করে আছে ন্যায়বিচারের আশায়। হয়তো এখনও সময় আছে, বিচার প্রক্রিয়াটা শুরু তো হোক অন্তত।”

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আলবিদা ২০২৪

২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া লাইফ ইন এ মেট্রো ছবির আলবিদা শিরোনামের গানের লাইন এটি। (উল্লেখ্য বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী জেমসের গাওয়া)। সত্যিই তো আর মাত্র

বিস্তারিত »

‘দিনের পর দিন অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ চলতে পারে না’

সংস্কারের কারণে দিনের পর দিন অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ চলতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) জাতীয়

বিস্তারিত »

সচিবালয়ে প্রবেশ: সাময়িক অসুবিধায় দুঃখ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চায় সরকার

সচিবালয়ে প্রবেশ ইস্যুতে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চেয়েছে সরকার। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভয়াবহ

বিস্তারিত »

স্বামীর ছোড়া অকটেনের আগুনে দগ্ধ গৃহবধূ নাজমা আর নেই

চন্দনাইশে স্বামীর ছোড়া অকটেনের আগুনে দগ্ধ গৃহবধূ নাজমা মারা গেছে। শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাজমা মারা যায়

বিস্তারিত »

হাসিনা ও রেহানার ব্যাংক হিসাব তলব

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানার ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সেই সঙ্গে

বিস্তারিত »

জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগানের রায় স্থগিত

২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল হাই কোর্ট। ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত

বিস্তারিত »

সাংবাদিক মাহবুব উল আলমের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, বাম রাজনীতির নীরব সমর্থক ও সংগঠক, মাইজভাণ্ডারী দর্শন ও মওলানা ভাসানীর একনিষ্ঠ অনুসারী এবং সাহিত্যিক মোহাম্মদ মাহবুব উল আলম হাটহাজারী

বিস্তারিত »

‘কেয়ামতের ফজরেও আ.লীগ রাজনীতি করতে পারবে না’

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের আমির ও সাবেক এমপি শাহাজাহান চৌধুরী বলেছেন, নবী মুহাম্মদ (স.) যেমন মসজিদের ঈমাম, যুদ্ধের ময়দানেও সেরকম সেনাপতি।

বিস্তারিত »

আন্দরকিল্লায় দুটি সড়কে ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য

ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্যে নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকার দুইটি সড়কে যানবাহন তো দূরের কথা পথচারীর চলাচলও কঠিন হয়ে উঠে। ভয়াবহ রকমের বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকা ব্যাটারি রিকশাগুলো পথচারীদের

বিস্তারিত »