বাংলাদেশে গৃহকর্মীরা হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও মানসিক নির্যাতনের নিত্য শিকার৷ একই সঙ্গে তারা শ্রমশোষণের শিকারও৷ সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে৷ গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় দেশে কোনো আলাদা আইনও নাই৷ আইনের কথা অনেক দিন ধরে বলা হলেও শুধুমাত্র একটি নীতিমালা৷ তবে সেটিও কার্যকর নয়৷
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক জরিপের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের শতকরা ৬৭ ভাগ মানসিক নির্যাতনের শিকার৷ এছাড়া গৃহকর্মীদের প্রতি সহিংসতা ও লিঙ্গভিত্তিক সহিসংতা বাড়ছে৷
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পাঁচ জন গৃহকর্মী সহিংসতার শিকার হয়েছেন৷ এই সময়ে সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন একজন৷ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন একজন৷
গত বছর ২০২২ সালে মোট ২৬ জন সহিংসতার শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতনে নিহত হয়েছেন একজন৷ তাছাড়া আরো ১১ জন মারা গেলেও তাদের মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি৷ একজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ আসকের এই হিসাব পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা৷ তবে তারা বলছে, অনেক ঘটনাই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না৷ স্থানীয় পর্যায়ে সমঝোতা করা হয়৷
বিলসের গবেষণা বলছে, কম মজুরি, নিয়োগপত্র না থাকা, বাসস্থান, গৃহকর্তার আচরণ গৃহকর্মীদের বিপর্যস্ত করে তুলছে৷প্রতিকার সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং কোনো শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত না থাকার কারণে এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো পথও খুঁজে পায় না তারা৷
‘সিকিউরিং রাইটস অব উইমেন ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণা করা হয়৷ গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় গবেষণাটি পরিচালনা করে বিলস৷
মজুরি ও বাসস্থান
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দারিদ্র্য, পেশার সহজলভ্যতা এবং বিবাহ বিচ্ছেদসহ বিভিন্ন কারণে নারীরা গৃহকর্মীর কাজ বেছে নেন৷ কিন্তু এই পেশায় এসে ৪২ শতাংশ আবাসিক গৃহকর্মী বসার ঘর অথবা রান্নাঘরের মতো খোলা জায়গায় ঘুমান৷ ৭৫ শতাংশ অনাবাসিক অথবা খণ্ডকালীন গৃহকর্মী বস্তিতে বাস করেন৷
আবাসিক গৃহকর্মীরা দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন৷ অনাবাসিক বা খন্ডকালীন গৃহকর্মীদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পান না৷
মানসিক নির্যাতন
বাসাবাড়িতে কাজ করতে গিয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ৬৭ শতাংশ গৃহকর্মী৷ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিষয়ে সাহায্য চাওয়ার যেসব উপায় রয়েছে, যেমন হটলাইন, হেল্পলাইন সম্পর্কে সচেতন নয় ৯১ শতাংশ গৃহকর্মী৷
করোনা মহামারির সময়ে গৃহকর্মীদের ওপর লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়৷
করোনার সময়ে দুই শতাংশ গৃহকর্মী চাকরি হারিয়েছেন এবং দুই শতাংশ গৃহকর্মী আয়ের উৎস হারিয়ে স্বামী বা পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷
বেতন ও নিয়োগপত্র
শতভাগ গৃহকর্মীই কাজ করেন মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে৷ গৃহকর্মীদের গড় মাসিক আয় পাঁচ হাজার ৩১১ টাকা৷ কিন্তু তাদের মাসিক গড় ব্যয় ১০ হাজার ৮০১ টাকা৷
৯৬ শতাংশ গৃহকর্মী বলছেন, বর্তমান মজুরি তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়৷
কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি বা বিলম্বের কারণে মজুরি কর্তনের শিকার হন ২৬ শতাংশ গৃহকর্মী৷ মাত্র চার শতাংশ গৃহকর্মী কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকেন৷
কেন এই পরিস্থিতি?
বিলসের সহ-সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘‘গৃহকর্মীরা এখনো শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি৷ তাদের কোনো নিয়োগপত্রও নেই৷ এই দুইটি কারণেই তারা এতটা নিগৃহীত৷’’
তার কথা, ‘‘এর ফলে যা হয়, তারা মজুরি নিয়ে কথা বলতে পারেন না৷ কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন৷ তারা হয়তো ফৌজদারি অপরাধের প্রতিকার দেশের প্রচলিত আইনে চাইতে পারেন; কিন্তু তাদের বেতন কম দিলে , বেতন না দিলে, অতিরিক্ত কাজ করালে, মানসিক নির্যাতন চালালে তারা কোনো প্রতিকার পান না৷ শ্রম আইনে শ্রমিকদের যে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে, গৃহশ্রমিকদের সেই সুবিধা নেই৷ তারা শ্রম আদালতেও যেতে পরেন না৷ ফলে তারা সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করতে বাধ্য হন৷’’
তিনি জানান, ‘‘দেশে কোনো জরিপ না হলেও কম বেশি এক কোটির মতো গৃহশ্রমিক আছেন৷ অনেক দিন ধরে তাদের জন্য একটি সুরক্ষা আইনের কথা বলা হলেও নীতিমালা করে ফেলে রাখা হয়েছে , আইন করা হয়নি৷ তারা কোনো ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না, ফলে তাদের কথা বলার কোনো ফোরামও নাই৷’’
গৃহকর্মীরা এখনো ‘গৃহদাস’
আসকের সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকদের এখনো গৃহভৃত্য হিসেবে দেখা হয়৷ তাদের প্রতি দাসসুলভ একটি মনোভাব এখনো গৃহকর্তাদের অধিকাংশের মধ্যে কাজ করে৷ এই সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের কারণে তাদের প্রতি যেমন খুশি তেমন আচরণ করা হয়৷’’
তার কথা, ‘‘তাই বেতন কম দেয়া, মানসিক নির্যাতন ছাড়াও তারা সহিংসতা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন৷ তেমন কোনো প্রতিকারও নেই৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় দুই-একটি ছাড়া বিচারও হয় না৷ এর কারণ হলো তাদের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে খুবই দুর্বল৷ তাই অর্থের লোভ দেখিয়ে থানায় যাওয়ার আগেই অনেক ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়৷ আর মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত চাপ ও অর্থ দিয়ে ওই মামলা অকার্যকর করে ফেলা হয়৷ এর সঙ্গে পুলিশও জড়িত থাকে৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘যদি কমপক্ষে গৃহকর্মীদের নিবন্ধনব্যবস্থা চালু এবং তাদের জন্য ৯৯৯ এর মতো একটি আলাদা হটলাইন চালু করা যেত তাহলেও তারা কিছুটা প্রতিকার পেত৷ আর কর্মঘণ্টাও সর্বনিম্ন বেতন বেধে দিলে শ্রমশোষণ বন্ধ হওয়ার পথ হতো৷
এদিকে বিলস তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করেছে৷ সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম- গৃহশ্রমিকের নিবন্ধন, থানাগুলোতে গৃহশ্রমিকদের জন্য পৃথক কোন অভিযোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ তৈরি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে গৃহশ্রমিকের অধিকার ও তা লঙ্ঘনের প্রতিকার বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তনে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ৷