তাঁর পিতা ওছমান আলী মাস্টার ছিলেন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের বন্ধু; সেই সূত্রেই হয়তো মাস্টার পুত্র সন্তান লাভের পর তার নামকরণ করতে গিয়ে বন্ধু শের-ই-বাংলার কথা মনে রেখেই নাম রেখেছিলেন এ কে ফজলুল হক। হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁর পুত্রও একদিন এ কে ফজলুল হকের নামের গৌরব অক্ষুণœ রাখবে।
কালে রাউজানের ফজলুল হক চাখারের এ কে ফজলুল হকের ন্যায় বাংলার বাঘ হতে না পারলেও রাউজানের বাঘ তো হয়েছিলেন। শের-ই-বাংলার কিছু গুণের অধিকারী তিনি হয়েছিলেন। যেমন শের-ই-বাংলা রাজনীতি করতেন, রাউজানের ফজলুল হকও রাজনীতি করতেন, বাংলায় না হলেও চট্টগ্রামে করতেন। শের-ই-বাংলা স্বদেশপ্রেমিক ছিলেন, ফজলুল হকও দেশপ্রেমিক এবং ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। শের-ই-বাংলার সঙ্গে তাঁর তুলনা হতে পারে না। শুধু সাদৃশ্য দেখানোর জন্য এই উল্লেখ।
চট্টগ্রামের অনেক ভাষা সংগ্রামী ছিলেনÑমাহবুব উল আলম চৌধুরী, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, সালারে জিলা শহীদ শেখ মোজাফফর আহমদ, ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান, আজিজুর রহমান (গোরা আজিজ), চৌধুরী হারুনুর রশিদ, কৃষ্ণগোপাল সেন, ডা. আনোয়ার হোসেন, ফরমানউল্লাহ খান, এজহারুল হক, অ্যাডভোকেট এ কে এম এমদাদুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আল হারুন, ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী, মওলানা আহমদুর রহমান আজমী, এমএ ওহাব, সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, আবদুল হাই, জওশন আরা রহমান, প্রতিভা মুৎসুদ্দী, ডি পি বড়–য়া, বিনোদ দাশগুপ্ত, গোলাম আকবর চৌধুরী, অধ্যক্ষ শামসুদ্দীন মোহাম্মদ ইসহাকÑ এমনি আরো অনেকে ছিলেন, যাঁদের নাম আমি মনে করতে পারছি না। ফজলুল হকও ভাষা সংগ্রামী ছিলেন, তবে ওপরে যাঁদের নাম আমি উল্লেখ করলাম, তাঁরা সবাই চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন করেছেন। তাঁদের সঙ্গে ফজলুল হকের পার্থক্য হলো ভাষা আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ঢাকার রমনায় পুলিশের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা যে মিছিল বের করেছিলেন, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফজলুল হকও সেই মিছিলে যোগ দিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন। পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম, শফিউর শহীদ হন, ফজলুল হকও শহীদ হতে পারতেন। হননি, হয়তো তাঁর বুজুর্গ পিতা ওছমান আলী মাস্টারÑ যাঁর বিদ্যাবত্তা, কোরআন হাদিসে অপার পাÐিত্যের জন্য উত্তর চট্টগ্রামের মানুষ যাঁকে ‘বড় মাস্টার’ সম্বোধনে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতেন, তাঁর দোয়ায় ফজলুল হকের শরীরে পুলিশের গুলি লাগেনি। চট্টগ্রামের অন্য কোন ভাষা সংগ্রামী ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে অংশগ্রহণ করেননি। একজন ছিলেন, তিনি হচ্ছেন ফৌজদারহাটসহ দেশের বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
ফজলুল হক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। চোখ বুজে নির্ভর করা যায়, এমন বিশ্বস্ত, সৎ অনুসারীদের মধ্য থেকে বেছে বেঁছে ক’জন মানুষকে তিনি তৃণমূলের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে জানানোর জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সরকারের এসবি, ডিআইবি, এনএসআই-এর ন্যায় এরাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর গোয়েন্দা বাহিনী। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে পরিহাস করে বলতেন ‘আমার গুপ্তচর’।
যাঁরা সারাদেশে তাঁর এমনি গুপ্তচর আরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন এবং কে কোথায় বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা বা সমালোচনা করছে, আওয়ামী লীগের প্রতি জনমত কখন কিভাবে ওঠানামা করছে, সেগুলি শুনে বঙ্গবন্ধুর কাছে রিপোর্ট করাই ছিলো তাঁদের কাজ। তাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জনমত মাপার ব্যারোমিটার। চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, সমাজহিতৈষী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, শাহ বদিউল আলম, মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও উপপ্রধান শাহ বদিউল আলম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ‘গুপ্তচর’।
চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার উত্তর গুজরা গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই জন্ম এ.কে ফজলুল হক চেয়ারম্যানের। তাঁর পিতা আলহাজ ওছমান আলী মাস্টার রাউজানবাসীর নিকট নিরব আধ্যাত্মিক সাধক ‘বড় মাস্টার’ নামে পরিচিত ছিলেন। ৪ ভাই ৫ বোনের মধ্যে ফজলুল হক ছিলেন প্রথম। মেজ এনামুল হক মুন্সি, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। সেজ আনোয়ারুল হক মানিক প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার, ৪র্থ মুজিবুল হক এর নিজস্ব ওয়ার্কশপ এবং ছোট এমদাদুল হক নিজের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত আলমাচ হজ কাফেলার চেয়ারম্যান।
বোনদের মধ্যে সবার বড় আনোয়ারা বেগম, তাঁর পুত্রদের মধ্যে দেশের কীর্তিমান ব্যাংক ব্যক্তিত্ব এসএম খোরশেদ আলম ও হাটহাজারী থানার সাবেক চেয়ারম্যান যুবনেতা এসএম রাশেদুল আলম এ পরিবারের অন্যতম রতœ। মেজ মেয়ে মরহুমা মোহছেনা বেগম, সেজ সুলতানা বেগম, ছোট সাজেদা বেগম।
বাল্যকাল থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত ও ডানপিটে। পারিবারিক কঠোর শাসনও দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁর দস্যিপনা।
শৈশব-কৈশোরের দুঃসাহসই উত্তর কালে ফজলুল হককে রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনের অনেক জড়-ঝঞ্ঝা, সংকট মোকাবেলায় দুঃসাহসী করে তুলেছিলো। গুজরা, নোয়াপাড়া কোয়েপাড়া, বাগোয়ানÑএই গ্রামগুলি ছিলো ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের দুর্গ, মাস্টারদা গুপ্ত বিপ্লবী কর্মকাÐের অভয়ারণ্য, সাম্যবাদী রাজনীতির উর্বর প্রজননক্ষেত্র। বাংলা সাহিত্যে স্বাদেশিকতার উদগাতা মহাকবি নবীন চন্দ্র সেন, মহাবিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অমর সেন, কমরেড আবদুস সাত্তার প্রমুখ বিপ্লবী নায়করা এই অঞ্চলেরই ভ‚মিপুত্র। এ কে ফজলুল হক যুব বিদ্রোহের দু’বছর পরে গুজরা থেকে উদ্ভূত হলেও তখনো মাস্টারদা জীবিত এবং তাঁর নির্দেশে কুমিল্লা, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, কলকাতা, মেদিনীপুর, চন্দননগর পর্যন্ত বিপ্লবের অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিলো। বাংলা তখন বিপ্লবের অগ্নিঋষিদের হোমানলে জ্বলছে; সেই আগুনের আঁচে বর্ধিত হয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হওয়া নবীন বিপ্লবী যুবক ফজলুল হক পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বিপ্লবে আত্মাহূতি দিয়েছিলেন।
পূর্বাপর অনেক শতাব্দীর মধ্যে বিংশ শতাব্দী ছিলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ, মর্মান্তিক, হিংসা, রিরংসা, অশ্রæ, আর্তনাদ, আহাজারি, মৃত্যু, ধ্বংস, সভ্যতার পচন, মানবতার অপমান ও বিনষ্টির এক নিকৃষ্ট সময়। ফজলুল হকের বেড়ে ওঠার কাল ত্রিশ ও চল্লিশের দশকেই ছিলো এসব ঘটনা সংঘঠনের কাল। অগ্নিযুগ শেষ হয়েছিলো তেতাল্লিশে, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, বম্বের নৌ বিদ্রোহ, রশিদ আলী দিবস, ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো বাংলা। যাবতীয় ধ্বংস, মৃত্যু, বিপ্লবের ঘনঘটায় ক্ষুব্ধ ফজলুল হকের মানস ও চেতনার জগত তখনই দ্রোহের উপাদানে ভরে উঠেছিলো। ফজলুল হকের মধ্যে যখন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটছিলো, তখন পাকিস্তান আন্দোলনের ঢেউ এসে তাদের চিন্তার জগতকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো। শেখ-ই-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবদুল হক দোভাষ, শাহ বদিউল আলম, আ¯্রাফউদ্দিন, জালাল আহমদ জগলুলের ন্যায় সমানজনক মুষ্ঠিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলনে ভেসে গিয়েছিলো। এ কে ফজলুল হকও তার ব্যতিক্রম নন। ৪৭-এ র্যাডক্লিফের ছুরিতে বাংলা ভাগের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলো কলকাতা ও নোয়াখালী। সেই বছরই ম্যাট্রিকুশেন পাসের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য ফজলুল হক যখন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কলেজ ভর্তি হন, তখন তাঁর সামনে বৃহত্তর জগত খুলে যায়। এই সময় কতগুলি ঘটনায় ফজলুল হকের চেতনার জগতে পরিবর্তন আসতে থাকে। যেমন দেশভাগের প্রাক্কালে মিত্রবাহিনীর হাতে কাঁহারপাড়ায় একজন যুবতীর শ্লীলতাহানি, হাটহাজারীর মাদার্শায় হালদার টেক কাটা আন্দোলনে কৃষকদের ওপর পুলিশের গুলিতে ডা. আবুল খায়ের, জব্বার বলিসহ কয়েকজনের প্রাণহানি, টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে বিরোধী দলীয় প্রার্থীর কাছে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী জমিদার খুররম খান পন্নীয় পরাজয়- এসব ঘটনা ফজলুল হকের চেতনার জগতে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। ৪৭-এর আরেকটি ঘটনা ফজলুল হক-মানসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলো। সেটা হলো কলকাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয়; সে সময় তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তাঁর জীবনের এই পরিচয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে দীর্ঘ দেহের অধিকারী এমন রূপবান বাঙালি তিনি আর দর্শন করেননি এবং চার চোখের মিলন হতেই ফজলুল হক বঙ্গবন্ধু কাছে তাঁর আত্মাকে সমর্পন করে দেন। এরপর ফজলুল হকের জীবন বঙ্গবন্ধুকে ঘিরেই অবর্তিত হয়। চট্টগ্রাম, ঢাকা, কলকাতার মধ্যে যখন তাঁর জীবন শাটল করছিলো, তখন ফজলুল হক একজন নতুন মানুষ, একজন পরিবর্তিত মানুষ হয়ে উঠেন। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তাঁর চিন্তায় জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত¡, মুসলিম জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতার যে প্রভাব পড়েছিলো, তা ক্রমশ দূরীভ‚ত হয়ে যেতে থাকে এবং তিনি ইহজাগতিকতা, উদার মানবিকতা, মাতৃভাষা বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন। ৪৮ থেকে ৫৪ পর্যন্ত পর পর ঘটে যাওয়া অনেকগুলি ঘটনায় পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃশপটে এক নতুন মধ্যবিত্ত বাঙালির গঠন ও বিকাশ হচ্ছিলো; এই নবার্বিভূত বাঙালিই পরবর্তীকালে ষাটের দশকে জাতিসত্তার রূপ পরিগ্রহ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে লিপ্ত হবে। রাউজানের গুজরানিবাসী ফজলুল হক যিনি তখন পড়াশোনার জন্য ঢাকায় অবস্থান করছিলেন, তিনিও এই নব্য শিক্ষিত বাঙালির অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। ৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান, তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ উত্তরকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষীরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা অথবা অধ্যয়নে রত ছিলেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহের হোসেন, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মোহাম্মদ আবদুল হাই, প্রমুখ বরেণ্য শিক্ষক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, গাজীউল হক, আবদুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, মুনীর চৌধুরী, মোহাম্মদ সুলতান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজুর রহমান, মুস্তাফা নুরুল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, কে জি মুস্তফা, ওসমান জামালÑকী সব গা ছম ছম করা নাম। ৫০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আলোকিত করা এই বিদ্বজ্জনমÐলীর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়ে ফজলুল হকের মনের বয়স রাতারাতি অনেক বেড়ে গিয়েছিলো।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আণবিক বোমা নিষিদ্ধকরণের দাবিতে গঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের চট্টগ্রাম শাখার স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী, খান বাহাদুর আবদুল হক দোভাষ ও মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সঙ্গে ফজলুল হকও ছিলেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরের হরিখোলা মাঠে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সংস্কৃতি সম্মেলনের তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সংস্কৃতি সম্মেলনে মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনিও যোগ দেন।
গণঅভ্যুত্থান ও ৭০ এর নির্বাচনে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ-এর ছায়াসঙ্গী ছিলেন।’
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে পাকিস্তানের বড়লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে ছাত্ররা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে, সূচনা হয় ভাষা আন্দোলনের। ছাত্রলীগ গঠন এবং ভাষা আন্দোলনকালে ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তৎপর ছিলেন। রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক এম এ ওয়াদুদ তখনকার পরিস্থিতি বর্ণনা করে লিখেছেন, ‘১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে (১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠার পরে সেটাই ছিলো সংগঠনের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হয়ে ইত্তেফাকে কাজ করছি পুরোদমে। একদিন শিল্পী মুর্তজা বশীরসহ চট্টগ্রামের এ.কে ফজলুল হক এলো অফিসে। দীর্ঘসময় স্মৃতিচারণ চললো। অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সে বললো, ‘ওয়াদুদ ভাই, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক তৎপরতায় এবং ইত্তেফাকের প্রকাশনা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে আপনি জীবনের যে মূল্যবান সময় ব্যয় করেছিলেন আপনার সেই আত্মত্যাগ এবং কর্মনিষ্ঠার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। যাঁদের করার কথা ছিলো তাঁরা তা করেননি। আমি অশ্রæসজল চোখে তার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলাম, মূল্যায়নের অভিপ্রায়ে আমি যেমন কিছু করিনি, তুমিও তো তাই।’
প্রবাদপ্রতিম শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক গবেষক প্রফেসর আনিসুজ্জামান ভাষা আন্দোলনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় সংগঠক ছিলেন। সে সময় ফজলুল হকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। বহু পরে লেখা তাঁর এক নিবন্ধে ফজলুল হকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি লেখেন, ‘১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত চট্টগ্রামে অবস্থানকালে ফজলুল হক সাহেবের সাথে আমার নিবিড় বন্ধুতা চলমান ছিলো। এর মধ্যে যুদ্ধকালীন তথা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ আমরা কুÐেশ্বরী ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করি। সে সময়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি পশ্চিম গুজরায় বেশ ক’বার যাওয়া-আসা করেছি নানাভাবেই। আমাদের অনেকেই তাঁর সাথে গভীর যোগাযোগ রাখতেন। তিনি পরম বন্ধুবৎসল এবং আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন। যুদ্ধকালীন রাউজানে তাঁদের বাড়ি ‘ওছমান আলী মাস্টার বাড়িতে ছিলো স্বীয় ইউনিয়নের প্রধানতম সেল্টার হাউস। তিনি সেল্টার মাস্টার হিসেবে রাউজানে স্ব-নামে খ্যাত ছিলেন। নিজেদের বাড়ি ছাড়াও হাটহাজারী-রাউজানের অসংখ্য সেল্টার হাউস তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়।
জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলহাজ্ব ওছমান আলী মাস্টারের সুযোগ্যপুত্র এ.কে ফজলুল হক ড. শহীদুল্লাহর পুত্র শিল্পী মুর্তজা বশীরেরও ছোটবেলার বন্ধু ছিলেন। কালজয়ী চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর এ.কে ফজলুল হক সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সে ছিলো আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমার বাবার সাথে মাস্টার সাহেবের (ওছমান আলী মাস্টার) ঘনিষ্ঠ বন্ধুতা আমাদের মাঝেও বহমান ছিলো।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ফজলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। একসাথে থাকি-খাই-আড্ডায় সময় কাটে। সে সময় হাজং বিদ্রোহ চলাকালে আমারই আঁকা পোস্টার ছিড়ে যাওয়ায় জোড়া লাগাতে গিয়ে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হলাম। চরম নির্যাতন ভোগ করি। আমার বন্ধুও গ্রেফতার। বিনাদোষে সে কারাভোগ করলো আমার সাথে। এটি এখনো আমাকে কষ্ট দেয়। দু’বন্ধু ভাষা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রæয়ারি গুলিবিদ্ধ বরকতসহ অন্য সহযোদ্ধাদের সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের অনেক বন্ধুর মধ্যে ফজলুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে।
আমার তুই-তোকারী বন্ধু ফজলুল হক গুছিয়ে কথা বলতো। সভা সমিতিতে গেলেও ফিতা কাটতে পছন্দ করতো না, বক্তৃতায় অনীহা ছিলো কিন্তু সে অনলবর্ষী বক্তা ছিলো। তার চমৎকার ভাষাশৈলী ও অসাধারণ উপস্থাপনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো শ্রোতারা। সে ছিলো অনন্য ব্যক্তিত্বের আধার।’
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হলে ফজলুল হক গোড়া থেকে তার সঙ্গে জড়িত হন। ভাষা সংগ্রামী ও রাউজান থানা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাকেরিয়া চৌধুরী রাউজানে ছাত্রলীগের শাখা গঠনে ফজলুল হকের অবদান নির্ণয় করতে গিয়ে বলেন, ‘১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা হলে সংগঠনের (রাউজান থানায়-লেখক) সহ-সভাপতি করা হলো এ.কে ফজলুল হককে। আমি সেক্রেটারি। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ গঠন হলে আমরা থানা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। রাউজান থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, জয়েন্ট সেক্রেটারি ফজলুল হক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আমি। স্বাধীনতার পর আমি রাউজান থানা আওয়ামী লীগের ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হলেও ফজলুল হক মূল রাজনীতিতে কোন পদ-পদবীতে আগ্রহী ছিলো না, তবে কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দের সাথে এবং উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ ছিলো তার; সে জেলা আওয়ামী লীগ এবং রাউজান থানা আওয়ামী লীগ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের দাবানলে আমি রাউজান থানা সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক।
৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮ খ্রিস্টাব্দে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ফজলুল হক নিঃস্বার্থভাবে জীবনবাজী সংগ্রামে ভ‚মিকা পালন করেন। বিশেষ করে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭০ এর নির্বাচনে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ-এর ছায়াসঙ্গী ছিলেন।’
এ.কে ফজলুল হক খুবই সাহসী ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ষাটের দশকের ছাত্রনেতা শওকত হাফিজ খান রুশ্নি একটি ঘটনার উল্লেখ করে এ.কে ফজলুল হকের সাহস ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘৭০-এর নির্বাচনের পূর্বের একটি ঘটনা রাউজান থানা ফজলুল হককে আওয়ামী লীগের অন্যতম বীর সেনানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। খালেদ সাহেবের নির্বাচনী প্রচারণার শেষের দিকে একটি গণমিছিলের আয়োজন করা হয়। মিছিলের কর্মসূচি ছিল রাউজান সদর থেকে মিছিল শুরু হয়ে হাফেজ বজলুর রহমান সড়ক হয়ে পাহাড়তলী অতিক্রম করে গশ্চি নয়াহাট, নোয়াপাড়া, বদুমুন্সিপাড়া, রামচন্দ্র বাজার, মগদাই বাজার ও কাগতিয়া বাজার হয়ে পুনরায় রাউজান সদরে গিয়ে শেষ হবে। নির্ধারিত কর্মসূচি মোতাবেক রাউজান সদরে প্রত্যেক ইউনিয়ন থেকে নেতা-কর্মীরা এসে জমায়েত হয়। সেখান থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল জলিলনগর বাস স্ট্যান্ড হয়ে হাফেজ বজলুর রহমান সড়ক বেয়ে পাহাড়তলীর দিকে এগিয়ে যায়। পথিমধ্য সোমবারের হাট, ইয়াছিন ভট্টের হাট, পরীর দীঘির পাড়ে পথসভায় বক্তব্য রাখেন খালেদ সাহেব। পাহাড়তলী চৌমুহনীতেও পথসভা করে গশ্চি নয়াহাট হয়ে নোয়াপাড়া পথের হাটে মিছিলটি এসে এক সংক্ষিপ্ত জনসভা হয়। তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। জনসভা শেষে মিছিলটি রাউজান- নোয়াপাড়া সড়ক দিয়ে বদুমুন্সিপাড়া ও রাম বাজার অতিক্রম করে যখন মগদাই ব্রীজ পার হচ্ছিল তখন রাতের ঘন কালো আঁধারে চারিদিক ঢেকে গেছে। মিছিলের অগ্রভাগটা শ্যামাচরণ উচ্চ বিদ্যালয় ছেড়ে গেছে। পশ্চাতভাগের কিছু ব্রীজের উপর আর কিছু অংশ ব্রীজের দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে। হঠাৎ করে মিছিলের পশ্চাতভাগে হট্টগোলের আওয়াজ শুনা গেল। খবর নিয়ে জানা গেল ফজলুল কাদের চৌধুরীর কিছু উচ্ছৃংখল কর্মী সমর্থক অতর্কিত হামলা চালিয়ে মিছিলকারীদের এলোপাতারি পিঠাতে থাকে। এতে অনেকে আহত হয়, তখন খবর পেয়ে হক সাহেব মিছিলের অগ্রভাগ থেকে বিদ্যুৎবেগে মগদাই বাজারে পৌঁছে যখন হুংকার দিয়ে উঠলেন তখন সন্ত্রাসীরা হক সাহেবের ভয়ে পালিয়ে যায়। কারণ তারা হক সাহেবকে কমান্ডার হিসাবে জানত। এরপর তিনি আহতদের সবাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলে প্রত্যেককে যার যার বাড়িতে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। এরকম নানা কারণে হক সাহেব অধ্যাপক খালেদ-এর নিকট ছিলেন অত্যন্ত আস্থাভাজন। সেদিন রাত ১২টার পর থেকে নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হক সাহেবের কর্মতৎপরতা বেড়ে গেলো । তিনি একদিকে খালেদ সাহেবের সাথে থেকে কেন্দ্রভিত্তিক তালিকা তৈরি করে এজেন্ট নিয়োগের ফরম ভাগ করছেন অন্যদিকে নিজে ও অন্যান্য নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে সেই এজেন্ট ফরমগুলি প্রতিটি কেন্দ্রের এজেন্টদের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। ৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে হক সাহেব আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে নিয়ে কেন্দ্র পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন। ৭ ডিসেম্বর অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হল। নির্বাচনে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সাহেব বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
এরপর থেকে তিনি রাউজানে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সংগঠিত করতে লাগলেন। রাউজানের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ ছিলেন শহিদ নাজিম উদ্দীন। নাজিম ভাই শহীদ হলে রাউজানের কমান্ডার ইন চীফের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। তখন আমাকে বলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ এলাকায় নিয়ে যান তিনি। এখানে উল্লেখ্য যে, নক্সালপন্থি গেরিলাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে-মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এরকম এক সংঘর্ষে কদলপুর এলাকায় হক সাহেব কাঁটাযুক্ত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে গিয়ে তাঁর সারা শরীর কাঁটার আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে গেছিল। এরপর থেকে নক্সালীদের তৎপরতা স্থিমিত হয়ে পড়ে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই মামার তত্ত¡াবধানে বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পিতভাবে অপারেশন শুরু করলেন।
তারপর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করে নিরাপদে রাখার জন্য ও খাওয়া- দাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করার কাজে লেগে গেলেন তিনি। তখন মামা চিন্তা করলেন হয়ত মুসলিম লীগ করার কারণে এলাকার কিছু নামি- দামি মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়তে পারে। তাই এদেরকে লঘুপাপে গুরুদÐ দেয়া থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি কৌশলে সেইসব লোকদের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তন্মধ্যে মোহাম্মদ আলী কন্ট্রাক্টর, নুরুল হক মাস্টার উল্লেখযোগ্য।’
ফজলুল হক স্পষ্টভাষী, সৎ, উদার, মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত চিন্তার মানুষ ছিলেন। দুর্দান্ত সাহস ছিলো তাঁর, যা’ বিশ্বাস করতেন এবং সত্য বলে মানতেন, তা’ প্রকাশ করতে কখনো পরান্মুখ হতেন না, অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। সারা জীবন একই আদর্শ অনুসরণ করেছেন, দুঃসময়ে, দুর্দিনেও দল ত্যাগ করেননি, আদর্শের সাথে বেঈমানি করেননি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং নেতা কর্মীরা কারাবরণ অথবা ফেরার, তখন ফজলুল হক নেতা-কর্মীদের মনোবল অটুট রাখতে এবং দলের শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সাহসী ভ‚মিকা পালন করেছিলেন, এ সময় কারাবরণ করেছিলেন । স্বাধীনতার পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ইউনিয়নের আইন-শৃঙ্খলা অক্ষুণœ রাখা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করা এবং নয় মাসের যুদ্ধকালে যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিলো, তাদেরকে পুনর্বাসন করা এবং রিলিফ সামগ্রীর সুষ্ঠু বিলি বন্টন নিশ্চিত করার জন্য গুজরা ইউনিয়নের মানুষ তাঁকে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করেন। তিনি দীর্ঘদিন অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ১১ নম্বর পশ্চিম গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং রাউজান চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গহিরা শান্তির দ্বীপ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিরও দীর্ঘ সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। নিজ এলাকায় শিক্ষা বিস্তারেও রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পরলোকগমন করেন।
ফজলুল হকের সহধর্মিণী আলহাজ বেগম লায়লা হক একজন ‘রতœগর্ভা মা’ সম্মাননায় ভ‚ষিত ও সংবর্ধিত হয়েছেন। ফজলুল হক ও বেগম লায়লা হক হীরের টুকরো ৪ পুত্র ও ৫ কন্যা সন্তানের গর্বিত জনক-জননী। জ্যেষ্ঠ পুত্র সিভিল প্রকৌশলী শওকত ওসমান কুয়েত মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্সে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে কর্মরত প্রথম বাংলাদেশী। ২য় পুত্র সফটওয়্যার প্রোগ্রামার শওকত হোছাইন কুয়েত-অ্যামেরিকান যৌথ কোম্পানী ৮০০’র কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ৩য় পুত্র লেখক-সাংবাদিক শওকত বাঙালি যুদ্ধাপরাধ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। কনিষ্ঠ পুত্র আলহাজ শওকত আল আমিন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদ। জ্যেষ্ঠ কন্যা শিরিন হক রাউজান কন্ঠ সম্পাদক, ২য় কন্যা শাহীন আকতার শিল্পোদ্যোক্তা ‘খানাদানা’ ফুড ব্র্যান্ডের স্বত্ত¡াধিকারী, ৩য় কন্যা স্কুল শিক্ষিকা তোহিন আকতার বর্তমানে অনলাইন পোষাক বিক্রয় প্রতিষ্ঠান নতুনত্ব’র স্বত্ত¡াধিকারী, ৪র্থ কন্যা শামীন আকতার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বক্ষব্যাধীর লেডি হোম ভিজিটর এবং কনিষ্ঠ কন্যা শারমিন আকতার কচি আবুল খায়ের গ্রæপে এইচআর’এ অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। যে ছিলো সবার ছোট, সে চলে গেল সবার আগে।
বড় পুত্রবধূ শায়লা ওসমান কুয়েতে শিক্ষকতা পেশায়, মেজ আকলিমা আকতার স্বপ্নপুরী ফ্যাশনের স্বত্ত¡াধিকারী, সেজ শাহীন আকতার তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব নিয়ামক দপ্তরে এবং ছোটজন নূরী জান্নাত রুম্পা গৃহিণী।